ছোটবেলা থেকেই জোরকরে গেলানো জিনিসে আমার খুব ভয়, অভিজ্ঞতায় জেনেছিলাম জোর করে গছানো বা গেলানো জিনিস কখনও ভাল হয় না। ফেব্রুয়ারি মাস এলেই এই ভয়টা বেড়ে যায়, কারণ এটি বই গছানোর মাস। জানিনা কেন, ফেব্রুয়ারি মাস এলেই কিছু পুরোনো পরিচিতের সাথে নতুন করে পরিচিত হই- বেশিরভাগেরই নতুন পরিচিতি কবি বলে, কারণ বইমেলায় তাদের কবিতার বই বের হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ আত্মজীবনী বা ইতিহাসও লিখে থাকেন। এই মাসে এহেন লেখকদের সাথে দেখা হলে অনিবার্য এক ঘটনা ঘটে- তিনি তার ঝোলা থেকে অথবা মস্ত বড় ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে নিজের লেখা বইটি বের করে বইয়ে স্বাক্ষর দিয়ে হাসিমুখে বইটি বাড়িয়ে দেন।
--এই যে, এটা আপনার জন্য।
একটা বই উপহার পেলেও আরও অন্তত একটি বই নিতে হয় মূল্য চুকিয়ে, সৌজন্য বলে তো একটা ব্যাপার আছে! এভাবে জোড়া জোড়া গছানো বইয়ে প্রায় একবস্তা ভরে গেছে, ঠিক করেছি কোনদিন ঘরে গ্যাস না থাকলে এগুলো দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে খাব।
গছানোর আরো তরিকা আছে। একদিন বিয়ে বিয়ে বাড়িতে গেছি, স্বামীর বন্ধু- পত্নীর সাথে দেখা।
-- কি খবর? কেমন আছেন?
-- আছি ভালোই, কিন্তু খুবই ব্যস্ত । প্রতিদিন বইমেলায় যাওয়া লাগছে, আমার আবার এবার দুটো বই বের হলো কিনা।
ভয়ে ভয়ে হাতের দিকে তাকালাম, নাহ্, হাতে শুধু বিয়ে বাড়ির উপযোগী একটা ছোট ব্যাগ, এর ভিতর কোন কবিতার বই রাখা সম্ভব নয়। অতএব কবিতার বইয়ের প্রসঙ্গ ভুলে গিয়ে নিশ্চিন্তে অনেক রকম গল্প করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি স্বামীকে ডেকে বললেন,
--এই, গাড়ি থেকে ভাবীর জন্য ক'টা বই নিয়ে এসো না, প্লিজ।
বই!!! আবার একটা না, ক'টা!! ফেব্রুয়ারি মাসে বিয়ে বাড়িতে আসাও দেখছি বিপদজনক। ক্ষীণ স্বরে বললাম,
-- ও আপনার কবিতার বই? তাতো পড়তেই হবে। এক কাজ করি, যাবার সময় নিয়ে নেব।
--না না, পরে আবার ভুলে যেতে পারি। এইতো সেদিন একজন বই নেবেন বলে হঠাৎ করে কার সাথে কথা বলতে বলতে হারিয়ে গেলেন, পরদিন আমাকে তার বাসায় বইগুলো পৌঁছাতে হলো।
আজ্ঞাবহ স্বামী গিয়ে দুহাতে যতগুলো বই ধরে নিয়ে এলেন, দুই বইয়ের অনেকগুলো করে কপি। আরেকজন, বন্ধুপত্নীর কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বললেন,
--সেকি! আপনি এত বই লিখেছেন! ঠিক আছে আমি বেশ কয়েকটা নেব। আপনার এমন প্রতিভা, আমাদের তো উৎসাহ দেওয়া উচিত।
আমাকে এবার কথা বলতেই হল,
--এই বিয়েবাড়িতে কিন্তু আমি বই হাতে করে ঘুরতে পারবো না, বই তোমাকে বইতে হবে।
এবার তার উৎসাহে একটু ভাটা পড়ল। বিয়ে বাড়িতে একগাদা কবিতার বই হাতে নিয়ে থাকাটা খুব উৎসাহ ব্যঞ্জক মনে হলো না হয়তো। তাই বললেন,
--ঠিক আছে, আপাতত দুটো বই নেই।
ভাবির অনেক আপত্তি সত্বেও বইয়ের দাম ৪০০ টাকা জোর করে দিয়ে দিলেন। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম- হায়! আমার কাব্য প্রতিভা যদি আমাকে ছেড়ে না যেত!! মনে পড়ল, এক সময় আমিও কবিতা লিখতে পারতাম, তখন খুব কবিতা লিখতাম। এক দুঃখজনক ঘটনা আমার কাব্যপ্রতিভার সমাপ্তি টেনে দেয়। প্রায় ৩০-৩৫ বছর আগে আগের ঘটনা, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। হঠাৎ করে জানলাম আমাদের দুই সেমিস্টার পরীক্ষা একবারে দেওয়া লাগবে। এর আগে প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষার আগে ছাত্ররা পরীক্ষা পিছানোর আন্দোলন করেছিল। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সেবার প্রথম সেমিস্টার পরীক্ষা বাতিল করে দেয়। পরে দেখা গেল বাতিল করেনি, বরং পরীক্ষা পিছিয়ে দ্বিতীয় সেমিস্টার পরীক্ষার সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এক সেমিস্টার পরীক্ষা দিতেই নাভিশ্বাস, দুই সেমিস্টার একসাথে দিতে হবে শুনে মাথাটা কেমন হালকা হয়ে গেল। পড়াশুনা বাদ দিয়ে আমি দিনরাত কবিতা লিখতে লাগলাম। বেশিরভাগই গণিত বিষয়ক কবিতা যেমন,
ল্যাপলেস ফোরইয়ার
দুইয়ে দুইয়ে হয় চার।
আমাদের ছাত্রীবাসে একটা নোটিশ বোর্ড ছিল। সেটা ভরে গেল আমার লেখা কবিতায়। একদিন খেয়াল করলাম অন্য মেয়েরা আমার দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে। কারণ জানতে চাইলে বনি আপা বলল,
--দুই সেমিস্টার এর দুঃখে অনেক ছেলেই পাগল হয়ে গেছে, মেয়েদের মধ্যে তুমিই একমাত্র।
কথাটা শুনে মাথায় প্রচন্ড ঝাকি লাগলো। আমি কবিতা লেখা বন্ধ করলাম, আবার পড়াশোনা শুরু হল। কিন্তু খাতায় লেখা শেষ কবিতাটা খাতাতেই রইল, ছিড়েও ফেললাম না বা নোটিশ বোর্ডেও দিলাম না। জীবনের সেই শেষ কবিতাটি এতবার পড়েছি যে একেবারে মুখস্থ হয়ে গেছে। এই সেই কবিতা:
কেন দুটি হাত,
দিলে নাথ?
এ যেন বৃক্ষ শাখা,
তাইতো প্রশ্ন রাখা,
তোমার কাছে
পার্থক্য কি আছে
মানুষে ও গাছে?
যারা এ পর্যন্ত সাথে আছেন, ইতিমধ্যেই তারা আমার লেখা শেষ কবিতাখানা গিলে ফেলেছেন!
ধন্যবাদ সামু ব্লগ কে, আমার কবিতা প্রকাশের সুযোগ করে দেবার জন্য।
যাহোক, ফিরে আসি সেই বই গছানোর গল্পে। এবছর ফেব্রুয়ারিতে ভাই এসেছে বিদেশ থেকে, বইমেলায় গিয়ে ফিরল এক গাদা বই নিয়ে।
-- এত বই কিনেছিস কেন?
-- অনুরোধে। মেলায় এত চেনা মানুষের সাথে দেখা হল, তারা যখন তাদের লেখা বই কিনতে অনুরোধ করলো তখন না করি কি করে বল? এত বই তো আমি নিয়ে যেতে পারবো না, তুই কিছু নিয়ে নে।
-- তুইও আমাকে বই গছাবি?
ভাই বই উপহারও পেয়েছে। বন্ধুর বাড়ি গেছে দাওয়াত খেতে, খাবার পরে বন্ধুর বউ নাম স্বাক্ষর করে ভাইকে একটা বই দিলেন- তার নিজের লেখা কবিতার বই। ভাই বইয়ের দুয়েক পাতা উল্টে কিছু প্রশংসা করতেই তার বন্ধুপত্নী জানালেন বইমেলা উপলক্ষে তার মা একখানা আত্মজীবনী লিখেছেন, আর তার বোন একখানা ভ্রমন কাহিনী লিখেছেন। সেই দুখানা বইও পেল ভাই- বিনি পয়সায়।
যে হাতে পুলিশ রাবার বুলেট ছোড়ে সেই হাতে আবার কবিতাও লিখে- এই তথ্যটা জানা হল সেই বই গছানোর সূত্রেই। ভাগ্নের একটি পুলিশ ক্লিয়ারেন্স দরকার, তার বাবার সাথে সে গেল পুলিশের দপ্তরে। ক্লিয়ারেন্স দেবার আগে পুলিশ সাহেব বইমেলায় প্রকাশিত নিজের একটা বই দিলেন, দু'শ টাকা দিয়ে বইটা কিনতে হল। এরপর তিনি সেই বইয়ের আরেক কপি বের করে ভাগ্নেকে বললেন,
--শুধু কি পড়ার বই পড়বে? মাঝে মাঝে অন্য বই ও পড়া দরকার। আমার এই বইটা পড়লে চিন্তার অনেক খোরাক পাবে। ওই বই তো তোমার আব্বু পড়বে- এটা তোমার জন্য।
আরো দু'শ টাকা গেল। উপায় নেই, ক্লিয়ারেন্সের কাগজ তো পেতে হবে!
বই গছানোজনিত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবার কোন পথ তো আপাতত দেখতে পাচ্ছিনা। কি করা যায় ভেবেই চলেছি।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১০:৩৮