মেলানকোলিয়া, এর অন্য নাম বিষাদ রোগ বা গভীর ডিপ্রেশন। উপন্যাসের নাম মন্মথের মেলানকোলিয়া- এই নাম বলে দেয় গভীর বিষাদাক্রান্ত কোন মানুষের দেখা পাওয়া যাবে এই উপন্যাসে। পাওয়া গেল, প্রথম অধ্যায়ের প্রথম পৃষ্ঠাতেই; মানুষটির নাম কাজলী। এই কাজলীর মন খারাপ, অথবা কাজলীর মন খারাপ নয়। কাজলীর ভালো লাগে অথবা ভালো লাগে না। এইভাবে কাজলির সাথে পাঠকের প্রথম পরিচয় ঘটে- তাকে কিছু বোঝা যায় কিছু বোঝা যায়না।
গল্প এগোনোর সাথে সাথে কাজলীর সম্পর্কে আরো কিছু জানা যায়। ব্যভিচারী মা চলে গেছে পরপুরুষের সঙ্গে। এই শোকেই- বাবা হার্টফেল করে মারা যায়। বড় বোন বিজলী কোথায় হারিয়ে গেল কাজলী জানেনা।
কাজলী অন্তর্জালের জগতে বিজলীকে খুঁজে বেড়ায়,আর ব্যর্থ হয় খুঁজে পেতে। এই ব্যর্থতা, বাবাকে হারানোর দুঃখ, মায়ের প্রতি তীব্র ঘৃণা কাজলীকে ঘিরে রাখে প্রতিক্ষণ। কাজলী ক্লান্ত, দিনযাপনের বিষম অবসাদ তাকে ঘিরে রাখে। এমন ক্লান্তিময় দিনে অফিস ফেরত কাজলী কে এক কাপ চা বানিয়ে দেবার জন্য কখনো বুয়াকে পাওয়া যায় কখনো পাওয়া যায় না। তার চায়ের কাপে বিষাদ আর বিস্বাদ মিলেমিশে একাকার হয়ে ঐকতান বুনে চলে ডেভিড লিঞ্চের নীলচে মখমলের কুহক গানের মত । কাজলীর একাকী সংসারে এই বুয়াই তার একমাত্র সঙ্গী। কাজলী চাকরি করছে দুই বছর যাবত্ কিন্তু অফিসে তার কোন বন্ধু আছে বলে জানা যায় না। পুরো গল্প জুড়ে কাজলী নিঃসঙ্গ, কেবল অফিস আর বাসায় মধ্যেই তার সমস্ত সময় কাটে। তার কোন প্রেমিক নেই। অতীতে ছিল তেমনটাও জানা যায়নি, ভবিষ্যতে হবে তেমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ। ভার্চুয়াল দুনিয়ায় পরিচয় হওয়া এক ফ্লা্র্টবাজ লেখক প্রায়শই হানা দেয় কাজলীর মেসেঞ্জারে, কাজলী তাকে তেমন পাত্তা দেয় না।
আর দশজনের মতোই কাজলী অফিসে কাজে ব্যস্ত থাকে। কিন্তু দেখা যায় কখনো অফিসের এসি রুমে বসে কাজলী হঠাৎ ঘামতে থাকে, তার চোখের মনি স্ফিত হয়ে আসে, বুক ধড়ফড় করে, ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ে। একই অভিজ্ঞতা তার মাঝে মাঝে হয় একাকী ঘরে। তখন প্রচণ্ড আতঙ্কের দমকায় উড়ে যেতে চাইছে হৃদপিণ্ড। এটা প্যানিক অ্যাটাক। প্যানিক অ্যাটাক; the worst thing a human being can experience. এই প্যানিক অ্যাটাক কি কাজলীর সমস্ত ডিপ্রেশনের উৎস? জানা নাই। শুধু দেখতে পাই কাজলী জিওনীল টেবলেট খায়, কখনো খায় নেশা ধরানোর জন্য কফ সিরাপ। কাজলী নানাভাবে চেষ্টা করে এই অবস্থা থেকে উত্তরণের; সেজন্য কাজলী লেখালেখিতে ব্যস্ত হতে চায়, আকুল হয়ে খোঁজে এমন কাউকে যে তাকে একটু বুস্ট দিতে পারে। সে অফিস থেকে ক্রমাগত ছুটি নিতে থাকে; এক সময় অফিসের প্রাপ্য নানা ধরনের ছুটির প্রায় সব তার নেয়া হয়ে যায়। গল্পের শেষে এসে দেখি সে পত্রিকায় একটি পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দিয়েছে এরকম;
আমার বয়স ২৯, বেসরকারি কোম্পানিতে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ পদে কর্মরত আছি।
হবু পাত্রকে কাজলীর একটা চাহিদা পূরন করতে হবে বলে বিজ্ঞাপনে জানানো হলো। চাহিদাটা বড় অদ্ভুত!
এই বিজ্ঞাপন দেবার ফল যা হল তা চমক জাগানিয়া!!
কাজলীর গল্পের সাথে সাথেই সমান্তরাল ভাবে এগিয়েছে বিট্টুর গল্প। বিট্টু রাস্তার কুকুর- তাকে ভালোবাসে যে খেলুড়ে ছেলেটি তার নাম মিরু। বইয়ের পাতায় পাতায় বিট্টুর নানা আচরণ, বৈশিষ্ট্য ও কাহিনী বলা হয়েছে। একটি বৈশিষ্ট্য এমন,বিট্টুর ভোকাবোলারি হাজার শব্দের। আরো নানা বৈশিষ্ট্য আছে যা মিরুর চোখে ধরা পড়ে।
রাস্তার কুকুর আমার পছন্দ নয় তাই বিট্টুর আচরণের বর্ণনা আর দিলাম না।
বিট্টুর জানার কথা নয়, মাঝে মাঝে দুই জীবনের অসঙ্গত বিন্দুগুলি কিভাবে কেন মিলে যায়, অথবা যায় না।
কার জীবনের সাথে কার জীবন মিলে যাবার কথা বলা হয়েছে তা জানতে হলে মন্মথের মেলানকোলিয়া শেষ অবধি পড়তে হবে।
এবার বলি আমার কেমন লাগলো মন্মথের মেলানকোলিয়া। গল্প বলার ভাষা ও ভঙ্গিমা চমৎকার। আমি এমন পাঠক যে গল্পে চেনাজানা মানুষের ছায়া দেখতে পেলে সেই গল্প তরতর করে পড়ে ফেলতে পারি। কিন্তু এই গল্প পড়তে আমার দীর্ঘ সময় লেগেছে; প্রথমত কাজলীকে বুঝতে গিয়ে- কাজলী আমার চেনাজানা চরিত্রের মধ্যে পড়ে নাই। দ্বিতীয়তঃ অনেক কিছুই পড়তে ভালো লাগেনি, তাই। যেমন কাজলী বসে মানুষের গলা কাটা ভিডিও দেখছে! অবশ্য গলাকাটার কোন রগরগে বর্ণনা গল্পে দেয়া হয়নি। বেশ কয়েকদিন লাগিয়ে বইটা শেষ করার পর মনে হল- না পড়লে জানতেই পারতাম না একজন মানুষ কতটা কষ্টের ভিতর ডুবে যেতে যেতে প্রাণপণ চেষ্টা করে ভেসে উঠতে!! মনে পড়ে গেল কয়েক বছর আগে পত্রিকায় আসা রীতা মিতার কাহিনী। আমাদের আশেপাশে মনের অসুখে ভোগা এমন অনেক মানুষ আছেন তাদের আমরা জানতে পারিনা। এই গল্প পড়লে সেই জানার কাজটি সহজ হয়ে যায়।
বোল্ড করা লাইনগুলো মন্মথের মেলানকোলিয়া থেকে কপি পেস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১২:৫২