আদুরী শরৎ, রবীন্দ্র, বঙ্কিম, কিংবা মানিকের সৃষ্ট কোনো চরিত্র নয়, আদুরী বাবাকে হারানোর পর অন্যের বাসায় কাজ করতে যাওয়া রক্ত মাংশের এক জলজান্ত কিশোরী, ২০১৩ সালে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতিতা এ মেয়েটিকে ঢাকার কোনো এক ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা হয়।
মরিয়মের বয়স মাত্র ১১ বছর, সে ধানমন্ডির একটি বাসায় কাজ করে দু'বছর থেকে, অভাবের সংসারে ঠিকমতো খাবার না পেয়ে তার বাবাই তাকে তার মামার সঙ্গে পাঠিয়ে দেয় ঢাকায়৷ মামা মরিয়মকে পাঠান বাসার কাজ করতে৷
বাসায় মরিয়মকে কাপড়-চোপড় ধোয়া, ঘর পরিষ্কার করা, থালা-বাসন ধোয়া, এমনকি রান্না-বান্নার কাজও করতে হয়৷ এছাড়া ঘরের সবাই যখন বাইরে যান, তখন মরিয়মকে থাকতে হয় তালাবদ্ধ৷ দু'বছরে মরিয়ম একবারও গ্রামের বাড়ি যেতে পারেনি৷ তারা বাবা দু'বার এসে তাকে দেখে গেছেন৷ বাবাকে কষ্টের বলে মরিয়ম৷ কিন্তু জবাবে বাবা দু'বেলা খাবারের নিস্চয়তাকেই মেনে নিতে বলেন, বাড়িতে যে সে নিস্চয়তাটুকু ও নেই
হাসিনা ময়মনসিংহের মেয়ে, টানাটানির সংসারে একটু সচ্ছলতার আশায় হাসিনার মা সালমা বেগম চার মাস আগে তাকে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থেকে নিয়ে এসে ঢাকার একটি বাড়িতে কাজে দেন। এই চার মাসে মেয়ের কোনো ধরনের খবর পাননি সালমা বেগম। চার মাস পর তার খোঁজ পেলেন, কিন্তু সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। শরীরে আঘাতের চিহ্ন। গত শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়
আদুরী, মরিয়ম, হাসিনার গল্প গুলো এ দেশে বিরল কিছু নয়, বরং অদুরিদের গল্পের ভিন্নতা খুব বিরল। একটি কাপ ভাঙার অপরাধে রংপুরের রহিমার পিঠে গরম ইস্তিরির ছেঁকা দেন গৃহকর্ত্রী। কাচের প্লেট ভাঙার অপরাধে পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার ১০ বছর বয়সী রোমেলাকে বেদম নির্যাতন করেন পুলিশের এক এসআইয়ের স্ত্রী। রোমেলার সারা শরীরে গরম খুন্তির ছেঁকা দেওয়া হয়। এ রকম বিস্তর উদাহরণ গত একবছরের পত্রিকা ঘাটলেই পাওয়া যাবে,
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ’ (বিলস) পরিচালিত এরকমই একটি নিউজ পেপার সার্ভে মতে ২০১৩ সালে নির্যাতনের শিকার ৫৬ জন গৃহকর্মীর মধ্যে মারা যায় ৩২ জন ও আহত হয় ২৪ জন, ২০১৪ সালে নির্যাতনের শিকার হয় ৫৫ জন, মারা যায় ২৭ জন ও আহত হয় ২৮ জন, ২০১৫ সালে নির্যাতনের শিকার হয় ৭৮ জন, তাদের মধ্যে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়, আহত হয় আরও ৩৯ জন
অনেক দেরিতে হলেও সরকার গত বছরের ডিসেম্বরে গৃহকর্মকে শ্রমের মর্যাদা দিয়ে “গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫” (Domestic Workers Protection and Welfare Policy, 2015) প্রকাশ করে, যেখানে গৃহকর্মীদের মজুরি নির্ধারণ, মজুরি পরিশোধ, নিয়োগের চুক্তি, গৃহকর্মীর বয়স, কর্মঘন্টা, ছুটি, বিশ্রাম ও বিনোদন, প্রসুতি কালীন সুবিধা, চিকিত্সা, ধর্ম পালনের সুযোগ, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, সুরক্ষা ও কল্যাণ কার্যক্রম সহ চাকরির অবসান জনিত প্রাপ্প উল্লেখ আছে......
যাদের জন্য এ আইন শিক্ষা অধিকার বঞ্চিত এ মানুষগুলোর সুরক্ষা ও অধিকারের এ আইনের হয়ত সামান্যটুকুও জানার সুযোগ তাদের নাই, কিন্তু এ আইন জেনে তার বাস্তবায়নে বিবেকের কাছে কি নিযোগকর্তা আমরা দায়বদ্ধ নই?