somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাজী নাফিসের সেই চিঠি..............আমি ভুল করেছি।

১২ ই আগস্ট, ২০১৩ রাত ১২:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সন্ত্রাসী হামলার চেস্টায় জড়িত থাকায় ৩০ বছরের কারাদন্ড

জুলাই ৩১, ২০১৩

সম্মানিত ক্যারল বাগলি অ্যামন

চিফ ইউনাইটেড স্টেটস ডিস্ট্রিক্ট জাজ

ইস্টার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব নিউইয়র্ক

সম্মানিত বিচারক অ্যামন,

আমি কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল নাফিস। আমি যা করতে চেয়েছিলাম সত্যিই তা ভয়াবহ ছিল। এজন্য আমি খুব দুঃখিত। এখন আমার একমাত্র স্বস্তির বিষয় হলো, আমার এই নির্বুদ্ধিতায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।

আমি ইসলামি মৌলবাদে আর বিশ্বাস করি না। আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে একে ঘৃণা করি। এটি পুরোপুরি খারাপ ও অমানবিক। এটি মোটেও ইসলাম নয়। এই কাজটিকে সমর্থন করায় আমি সব সময় অনুশোচনা করে যাব, যে কাজ আংশিকভাবে আমাকে খেপাটে এক কাজে নিয়ে গিয়েছিল। এ কাজের জন্য আমৃত্যু আমার অনুশোচনা থেকে যাবে।

আমি যা বলতে যাচ্ছি, দয়া করে তা গ্রহণ করুন। কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনার কথা বলে আমার অনুভূতির ব্যাপারে যে স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিচ্ছি, কেবল এজন্য নয়, পরিষ্কারভাবে অপরাধের দায় গ্রহণ ও শাস্তি পাওয়ার মতো অপরাধের বিষয়টি উপলব্ধির জন্য আমার এ আবেদন গ্রহণ করুন। একই সঙ্গে আমি আপনার কাছে দয়া ও ক্ষমা প্রত্যাশা করছি।

আমার কৃতকর্ম অমার্জনীয় ও কাপুরুষোচিত। এ বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করার পর আমার কর্মকাণ্ডের প্রতি ঘৃণা জন্মেছে। আমি জানি, ভবিষ্যতে আমি আর কখনো কোনো ধরনের কাজ করতে পারব না, কেননা এটি শুধু অনৈসলামিক নয়, এটি আমার পরিবার ও আমার জীবনকে ধ্বংস করেছে, সর্বোপরি জীবনের এ দুর্বিপাকের জন্য আমার মাথা হেঁট হয়ে গেছে।

খুব ছোটবেলা থেকে আমার বেশ তোতলামির সমস্যা ছিল এবং তা কয়েক বছর ধরে চলে। আমার সত্যিকারের কোনো বন্ধু ছিল না। মা-বাবার সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল না। নিঃসঙ্গভাবে বেড়ে উঠি। একটা কিছু হতে আমি জীবনভর চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু হতে পারিনি। এটি আমার ও পরিবারের জন্য পুরোপুরি হতাশার। বাবা-মায়ের কাছে আমি ‘লোকসানি প্রকল্প’ বৈ কিছু ছিলাম না। আমার জন্য তাদের সব চেষ্টা বিফলে গেছে। কোনো সাফল্য না পাওয়ায় আমার জীবনটা পুরোপুরি বরবাদ হয়ে গিয়েছিল।

সাদাসিধে মানুষ হিসেবে আমি লোকজনের কথায় সহজেই ভজে যেতাম। বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার প্রকৃত কোনো বন্ধু ছিল না। কাজেই প্রভাবশালী ও নামডাকওয়ালা মৌলবাদী বন্ধুরা যখন কাছে এল, খুব সহজে তাদের সঙ্গে তাদের কথায় পটে গেলাম। তাদের সঙ্গে মিশে এবং কথা শুনে ধার্মিক হয়ে উঠতে লাগলাম, কিন্তু কখনো মনে হয়নি যে ধীরে ধীরে ভুল পথে এগোচ্ছি। তবে তা নিশ্চিতভাবে ছিল ইসলামের নামে ভুল শিক্ষা।

ভাগ্যান্ব্বেষণে নিজের পায়ে দাঁড়াতে আমি একসময় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমাই। পরিবারের বোঝা হয়ে আর থাকতে চাইনি। আশা ছিল, আয়-রোজগার করে নিজের জীবনযাপন আর পড়ার খরচ চালিয়ে নেব। কিন্তু কোনোটিই হয়ে ওঠেনি, বরং আমার পেছনে মা-বাবার খরচের বোঝা বাড়িয়েছি। খরচ বাঁচাতে আমি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া শিক্ষাগত যোগ্যতার কাগজপত্র মিসৌরি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পাঠাই। কিন্তু শিক্ষাগত যোগ্যতার মান ছিল খুব খারাপ। এতে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। পরে নিউইয়র্কের আলবেনিতে চাচার কাছে চলে আসি। একটা চাকরি খুঁজে বেড়াই। কিন্তু সফল হইনি। চাচির অমত থাকায় চাচার ওখানে বেশি দিন থাকা হয়নি।

এরপর জ্যামাইকার কুইন্সে দূর সম্পর্কের আত্মীয় সোনিয়ার কাছে চলে যাই। সেখানে আমি কিছু কাজ পেলেও কোনোটি চালিয়ে যেতে পারিনি। সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে নিজেকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিফল মনে হতে লাগল। ধাবমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে আমি ঠিক কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। গভীর বিষণ্নতায় ডুবে যেতে লাগলাম।

একদিন সোনিয়ার বাবার সঙ্গে আমার উত্তপ্ত বাগবিতণ্ডা হলো। সামান্য ভুলের জন্য তিনি আমাকে জঘন্য ভাষায় অপদস্থ করলেন। এ ঘটনার পর সোনিয়ার ওখানে থাকা আমার জন্য অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগল। বাংলাদেশি আরেকটি মেয়ের কদর করতাম, যার সঙ্গে আমি আমার ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলাম। একপর্যায়ে টের পেলাম সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করছে। সেটা জানার পর আমার মন থেকে শেষ সান্ত্বনাটুকুও মুছে গেল। গোটা আকাশ যেন আমার মাথার ওপর ভেঙে পড়েছে। মনে হলো, এই পৃথিবীতে আমার আর কোনো স্থান নেই। বেঁচে থাকারও কোনো মানে নেই।

কিন্তু ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ থাকায় আমি আত্মহত্যাও করতে পারিনি। সোজাসুজি চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললাম, হয়ে গেলাম খেপাটে। এভাবেই জিহাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ভাবনা আসে। কিছুদিন পর জিহাদি কর্মকাণ্ডের বার্তাবাহক ও ছদ্মবেশী চরদের সঙ্গে দেখা করি। আমার ইচ্ছার কথা জানাই তাদের। এই খেপাটে চিন্তাভাবনা নিয়ে পড়ে থাকি আমি। জিহাদি কাণ্ড ঘটানোর আগে একবার বাংলাদেশে যাওয়ার কথা ভাবি। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার ব্যাপারে আমার পরিবারের কাছ থেকে কোনো আশা যদি পাওয়া যায়, এ আশায় সিদ্ধান্তটা নিই। চর আমাকে জানায়, এ কাজ করলে তারা আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। এ কথায় আমি সত্যিই আহত হই এবং মনে মেনে বলি, বাংলাদেশে যদি কোনো আশাই থাকত, তাহলে তো আর যুক্তরাষ্ট্রে আসতাম না। তাই আমি যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাই এবং যত দ্রুত সম্ভব পৃথিবী ত্যাগে যা খুশি করতে থাকি।

গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইসলাম বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য আমি প্রচুর সময় পেয়েছি। আমি পুরো কোরআন পড়েছি, কারাগারে আসার আগে কখনো এই সুযোগ হয়নি। যতই পড়েছি, আমি ততই বুঝতে পেরেছি আমি কোনো কিছু না বুঝেই অন্ধভাবে মৌলবাদীদের অনুসরণ করেছি। আমার পরিকল্পিত এই কর্মকাণ্ডের সমর্থনে আমি কোরআনের কোথাও একটি আয়াতও পাইনি। একেকটি দিন যাচ্ছিল, আর আমি আল্লাহকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। কেননা, কোনো দিনও সত্যিকারের কোনো মানুষের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। এই চররা যদি আমাকে না পেত, তাহলে আমি জানি না কী হতো। আমাকে এ ধরনের চূড়ান্ত আত্মঘাতী অপকর্মের হাত থেকে রক্ষা করায় আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞ।

যেদিন আমি গ্রেপ্তার হই, ওই দিনই আমি চরদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেছিলাম। শুরু থেকে তারা আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করে, যা আমার কাছে প্রায় অবিশ্বাস্য ছিল। আমি তাদের সঙ্গে মজা করতাম। মনে আছে, আমি তাদের বলেছিলাম আমার প্রিয় চলচ্চিত্র ‘আমেরিকান পাই’। বৈঠকে তারা আমার সঙ্গে ছোট ভাইয়ের মতো আচরণ করত। একবার আমার খুব ঠান্ডা লাগার কারণে একজন এজেন্ট তার জ্যাকেটটা আমাকে দিয়ে দিয়েছিল। আমি দুপুরে কী খেতে চাই, তারা তা জানতে চেয়েছিল।

খাবার আনার পর আমরা সবাই একটি পরিবারের মতো খেয়েছিলাম। আমি বারবার ভাবছিলাম, মৌলবাদীদের কাছ থেকে শুনেছি মার্কিনরা মুসলিমদের ঘৃণা করে, অথচ আমি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক উড়িয়ে দিতে চাই জানার পরও এই চরেরা আমার সঙ্গে কতটা ভালো ব্যবহার করছে।

আরেক দিনের কথা আমার মনে পড়ছে। আমি তাদের বললাম, আমি হালাল মুরগি খেতে চাই। এর কিছুক্ষণ পর একজন চর আমাকে জানাল, আজ হালাল মুরগি নেই। একই সঙ্গে জানতে চাইলেন, আমি ভেড়ার হালাল মাংস খাব কি না? তারা আমার প্রতি যে সততা ও সম্মান দেখাল, তাতে আমি বিস্মিত হলাম। আমি বুঝতে পারলাম, যুক্তরাষ্ট্রে মুসলিম দেশগুলোর চেয়েও ইসলামের নিয়ম-কানুন বেশি মানা হয়।

এমডিসিতে আমার অভিজ্ঞতা আমেরিকা সম্পর্কে আমার ধারণা অনেকখানি বদলে দিতে সহায়তা করেছে। এসএইচইউতে আমার জীবনের নিকৃষ্টতম কিছু দিন কেটেছে। কিন্তু সেই কঠিন সময়েও আমি এসএইচইউয়ের লেফটেন্যান্টের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা পেয়েছি। তিনি আমার প্রতি খুব দয়ালু এবং আন্তরিক পরামর্শক ছিলেন।

শুরুর দিকে এখানকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা একটু কঠিন ছিল। তবে ধীরে ধীরে যখন মিশতে শুরু করলাম, তারা আমার প্রকৃত আচরণ সম্পর্কে জানতে পারল, তখন তারা আমার প্রতি বন্ধুসুলভ হলো। এমডিসির যে জিনিসটি আমার ভালো লেগেছে তা হলো, এখানে সবাইকে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সমভাবে দেখা হয়। বড়দিনের সময় এমডিসি যে ‘হলিডে প্যাকেজ’ দিয়েছিল, তার কথা মনে পড়ছে। এই প্যাকেজ পেয়ে আমি খুশি ও বিস্মিত হয়েছি। আর ভেবেছি, আমি কিনা আমেরিকার বিরুদ্ধে গিয়েছি, সেও এই প্যাকেজ পেলাম; প্যাকেজ দেওয়ার সময় তারা আমাদের ‘হ্যাপি হলিডে’ জানায়। প্যাকেজ নিয়ে কারাকক্ষে যাওয়ার পর আমি আমার কৃতকর্মের জন্য সত্যিই খুব দুঃখবোধ করলাম। আমি আমার নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, যে আমেরিকা সমান অধিকার ও ন্যায়বিচারে বিশ্বাস করে, আমি কেন তার বিপক্ষে গেলাম? :) :)

এমডিসিতে আমরা মুসলমানেরা নামাজ আদায় করতে পারি। কাউন্সিলর, সিও, ইউনিট ব্যবস্থাপকসহ সবাই ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। রোজার মাসে সিওরা রাত সাড়ে তিনটার দিকে ঘুম থেকে ওঠেন। এমডিসি সেহরি ও ইফতারে আমাদের ভালো খাবার দেয়। টার্কি, বিফ স্টু, পিচ ফলের মতো সুস্বাদু খাবার আমি আগে কখনো খাইনি।

যুক্তরাষ্ট্র আমার জন্য বিনা খরচে হেইডি সি সিজার নামে একজন ভালো আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে। আবারও বুঝতে পারি, মার্কিন জনগণকে নিরপেক্ষ ও সমভাবে দেখে। আমার আইনজীবী হেইডি শুধু ভালো আইনজীবীই নন, ভালো মানুষও। এসএইচইউতে থাকার সময় তিনি প্রায়ই আমাকে দেখতে আসতেন। আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাঁরাই একমাত্র মাধ্যম ছিলেন। তিনি আমাকে বোঝার অনেক চেষ্টা করতেন। তিনি আমার সঙ্গে খালা বা ফুপুর মতো নিকটাত্মীয়দের ব্যবহার করতেন।

এমডিসিই প্রথম জায়গা যেখানে আমি ইসলামি মৌলবাদ নিয়ে মৌলবাদী নয়, এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করতে পেরেছি। কোরআন পাঠ করার পর এবং কয়েকজন জ্ঞানী মুসলমানের সঙ্গে কথা বলার পর আমি বুঝতে পারি, আমি কত ভুল জানতাম।

ইসলামে মৌলবাদের স্থান নেই। দুর্ভাগ্যের শিকার না হলে আমি কখনো এ ধরনের জিহাদি কাজ করতাম না। কারণ, আমি কখনোই মন থেকে ইসলামী মৌলবাদে বিশ্বাসী ছিলাম না। এখন আমি বুঝতে পারছি, ইসলামের নামে কীভাবে মৌলবাদের বিকৃত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়। আমেরিকা ইসলামের শত্রু না, ইসলাম ও মুসলমানদের শত্রু মৌলবাদীরা।

আমি বন্দী। যুক্তরাষ্ট্রের সেই সুন্দর দিনগুলোর কথা পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলাম। বেঁচে থাকার সব আশা ছেড়ে মৌলবাদে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। মিসৌরির কেপ গিয়ারডিউয়ের জীবনের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। কেপ গিয়ারডিউ জায়গাটা দারুণ। আমার কাছে মনে হয়েছে, সেখানকার লোকজন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও সবচেয়ে বন্ধুসুলভ। একটি দিনের কথা মনে পড়ছে। আমি আর এক বাংলাদেশি যুবক একটা ‘এটিটি স্টোর’ খুঁজছিলাম। পথে একজন বৃদ্ধ দম্পতির দেখা পাই আমরা। তাঁরা আমাদের জানালেন, আমরা ভুল পথে যাচ্ছি। বুঝতে পারলাম, গন্তব্যস্থল থেকে অনেক দূরে আমরা। ওই বৃদ্ধ দম্পতি আমাদের পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব করলেন। তাঁরা শুধু আমাদের ওই দোকানে পৌঁছেই দেননি, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমাদের কাজ শেষ হলো, তাঁরা অপেক্ষা করলেন এবং বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। আচরণে মনে হচ্ছিল, আমরা যেন তাঁদেরই নাতি।

আমরা যেখানে থাকতাম, সেখানে রাস্তার পাশে একটি পশুপাখির দোকানে এক নারী কাজ করতেন। তিনি আমার প্রতি খুব দয়াশীল ও আমার ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আমাকে একটা চাকরি খুঁজতে সহায়তা করবেন বলে জানিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া পদার্থবিদ্যার ক্লাসে এক প্রবীণ সহপাঠীর কথা মনে পড়ছে। ক্লাস শেষ হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন তিনি আমাকে তাঁর গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দিতেন। আমার ক্যালকুলেটর ছিল না। সেটা জানতে পেরে তিনি আমাকে ১০০ ডলার দিয়ে একটা ক্যালকুলেটর কিনে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আমার বন্ধুর মতো।

হায়! এখন সেই দিনগুলোর জন্য খুব আফসোস হচ্ছে। আমি সত্যি দুর্ভাগা! নিজের কৃতকর্মের জন্য আমি কতটা অনুতপ্ত, তা পশুপাখির দোকানের নারী বা ক্লাসের ওই প্রবীণ সহপাঠীকে ব্যাখ্যা করার ভাষা আমার কাছে নেই। নিজেকে ঋণী মনে হচ্ছে। তাঁদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা কখনো ফিরিয়ে দিতে পারব না।

সত্যি বলতে কি, কারারুদ্ধ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি মনোভাব বদলে গেছে আমার। মাননীয় বিচারক, আমি মার্কিনদের ভালোবাসি। আমার আরও ধৈর্য ধরা উচিত ছিল। অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে মার্কিন নাগরিকদের মূল্যায়ন করা উচিত ছিল। এখন যখনই পেছনে ফিরে তাকাই, নিজের প্রতি ঘৃণা হয়। আমি কল্পনাও করতে পারি না, কী করতে যাচ্ছিলাম। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি ভাগ্যবান যে চররা আমাকে ধরতে পেরেছিল। তারা আমাকে আত্মঘাতী হামলা করা থেকে রক্ষা করেছে। আমি এখন জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেয়েছি।

কারাগারে ধর্মচর্চা করার পুরো সুযোগ আমার রয়েছে। এখানে আসার পর আমি আরও ধার্মিক হয়েছি। পবিত্র কোরআনের আয়াত মুখস্থ করছি। নামাজ আদায় করে, বই পড়ে, টিভি দেখে, অন্যদের সঙ্গে গল্পগুজব করে এখানে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি।

মাননীয় বিচারক, আমি আমার মা-বাবার একমাত্র ছেলে। আমার বড় বোন বিবাহিত। বাবার বয়স ৬৩ বছর, মায়ের ৫২। পরিবারের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ আছে আমার। মা-বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসেন। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বুঝতে পারিনি, আমি তাঁদের কতটা ভালোবাসি বা তাঁরা আমাকে কতটা ভালোবাসেন। মা-বাবার ভালোবাসায় আমি আবারও পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আশা দেখছি। জঘন্য অপরাধ করে তাঁদের হূদয় ভেঙে দিয়েছি আমি। ভালোবাসা ও শান্তি দিয়ে গড়া এক নতুন জীবন আমাকে এনে দিয়েছেন তাঁরা। মনে হচ্ছে, মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছি। কারণ ভেতরে ভেতরে আমি পুরোপুরি মরে গিয়েছিলাম। সব সময় নিজের মৃত্যু কামনা করতাম। কিন্তু আমি আবারও হূদয়ের ভেতরে স্পন্দন টের পাচ্ছি। আমি সবকিছুর জন্য পৃথিবীতে বাঁচতে চাই, বিশেষ করে মা-বাবার জন্য। কারণ, তাঁরাই আমার জীবনের সব। তাঁরা ছাড়া আমি কিছুই নই।’

মা-বাবাকে কতটা দুর্দশায় ফেলেছি, ধারণাও করতে পারি না। অথচ এখনো তাঁরা আমাকে ভালোবাসেন। আমার কারণে বাবা চাকরি হারিয়েছেন। সঞ্চয়ের অর্থ থেকে তাঁরা জীবনধারণ করছেন, সেখান থেকেই আমার জন্য টাকা পাঠাচ্ছেন। একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহই জানেন, এভাবে তাঁরা কত দিন চলতে পারবেন। আমার বয়স্ক মা-বাবাকে দেখার কেউ নেই।

মাননীয় বিচারক, যত দ্রুত সম্ভব আমি তাঁদের কাছে যেতে চাই। আমাকে দেওয়া আল্লাহর শ্রেষ্ঠ উপহার তাঁরা। এই আশায় বেঁচে আছি যে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার আগে একদিন তাঁদের কাছে যেতে পারব। দয়া করে আমার বেঁচে থাকার আশাটা হারিয়ে যেতে দেবেন না। আমাকে ক্ষমা করার অনুরোধ করছি। আপনার কাছে আরেকটা সুযোগ প্রার্থনা করছি।

মাননীয় বিচারক, আমি গুরুতর ভুল করেছি। দয়া করে আমাকে করুণা করুন। আমাকে শাস্তি দেওয়ার আগে আমার জীবনের পরিস্থিতিটা বিবেচনা করুন। একেবারে সাধারণ, শান্ত এই আমি মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে সহিংস অপরাধ করতে যাচ্ছিলাম। গুরুতর অপরাধের জন্য আমাকে ক্ষমা করতে আপনাকে বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি। আপনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সব নাগরিক, বিশেষ করে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের কাছে ক্ষমা চাই। মাননীয় বিচারক, দয়া করে আমাকে বেঁচে থাকার আশা দিন। আপনার করুণা প্রার্থনা করছি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করুন।

আপনার একান্ত অনুগত



২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কমলার জয়ের ক্ষীণ ১টা আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:১৮



এই সপ্তাহের শুরুর দিকের জরীপে ৭টি স্যুইংষ্টেইটের ৫টাই ট্রাম্পের দিকে চলে গেছে; এখনো ট্রাম্পের দিকেই আছে; হিসেব মতো ট্রাম্প জয়ী হওয়ার কথা ছিলো। আজকে একটু পরিবর্তণ দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিড়াল নিয়ে হাদিস কি বলে?

লিখেছেন রাজীব নুর, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:২৪



সব কিছু নিয়ে হাদিস আছে।
অবশ্যই হাদিস গুলো বানোয়াট। হ্যা বানোয়াট। এক মুখ থেকে আরেক মুখে কথা গেলেই কিছুটা বদলে যায়। নবীজি মৃত্যুর ২/৩ শ বছর পর হাদিস লিখা শুরু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বকেয়া না মেটালে ৭ নভেম্বরের পর বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না আদানি গোষ্ঠী

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:৪১





বকেয়া বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে কোটি কোটি টাকা। ৭ নভেম্বরের মধ্যে তা না মেটালে বাংলাদেশকে আর বিদ্যুৎ দেবে না গৌতম আদানির গোষ্ঠী। ‘দ্য টাইম্স অফ ইন্ডিয়া’-র একটি প্রতিবেদনে এমনটাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×