শ্রাবণ মেঘের দিন
মুক্তির সাল: ১৯৯৯
কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ ও পরিচালনা : হুমায়ূন আহমেদ
প্রযোজনা ও পরিবেশনা :নূহাশ চলচ্চিত্র
গীতিকার: উকিল মুন্সি, রশীদ উদ্দীন ও হুমায়ূন আহমেদ
সঙ্গীত পরিচালক: মকসুদ জামিল মিন্টু
চিত্রগ্রহণ: মাহফুজুর রহমান খান
সম্পাদনা: আতিকুর রহান মল্লিক
অভিনয়ে: জাহিদ হাসান, শাওন, মাহফুজ আহমেদ, আনোয়ারা, মুক্তি, গোলাম মোস্তফা,সালেহ আহমেদ. ডাঃ এজাজুল ইসলাম. শামীমা নাজনীন প্রমুখ
শ্রাবণ মেঘের দিন হুমায়ূন আহমেদের পরম যত্নে বানানো এক অমর সৃষ্টি। হুমায়ূন আহমেদ এ ছবির আগে ও পরে বহু নাটক-সিনেমা-টিভি ধারাবাহিক বানিয়েছেন। কোন কোনটা জনপ্রিয়তা পেয়েছে, বোদ্ধামহলে প্রশংসিত হয়েছে। আবার কোনটার জন্য তিনি সমালোচিতও হয়েছেন। খেয়ালি এই শিল্পী যেমন ইচ্ছে তেমন করেই কাটিয়েছেন সারাটা জীবন । পরোয়া করেননি কোন কিছুর। কিন্তু শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিটি নির্মাণে হুমায়ূন তাঁর স্বভাবজাত স্টাইলে অনড় থাকলেও খেয়ালিপনায় না গিয়ে অনেক বেশি সতর্ক থাকার চেষ্টা করেছেন। ছবির প্রতিটি দৃশ্য নির্মাণ, চরিত্র সৃষ্টি এমনকি ছোট-খাটো ডিটেইলগুলোতে তাঁর কড়া নজরদারি ছিলো। এর আগে এমনটি শুধু একবারই দেখা গিয়েছিলো, তাঁর সবচেয়ে আলোচিত দর্শকনন্দিত সৃষ্টি আগুনের পরশমণি-তে। শ্রাবণ মেঘের দিনের পরে আর কখনও এতটা প্রবলভাবে হুমায়ূনকে সেলুলয়েডে পাওয়া যায়নি।
বাংলার মাটির মানুষ, ভাটির মানুষ, গানের মানুষ, সাদাসিধে মানুষের ইতিবৃত্ত শ্রাবণ মেঘের দিন। ভাটি অঞ্চলের একটি গ্রামে গাতক মতির বসবাস। গানই জীবন, গানের সঙ্গেই তার সহবাস। তাকে ভালোবাসে সেই গ্রামেরই গানপাগল এক খেয়ালি মেয়ে কুসুম। কুসুমের মনের ভাবনা অজানা নয় মতির। কিন্তু গাতক মতি বিশ্বাস করে সংসারী মানুষের গলায় গান বসেনা। তাই সে সঙ্গীতের জন্য পরিত্যাগ করে সংসারকে । ছবিটি মূলত এই দুই মানব-মানবীর ভালোবাসার ট্র্যাজিক উপাখ্যান। গল্পের শুরুটা হয় সেই গ্রামের এক কালের জমিদারের দুই নাতনী শাহানা আর নিতুর আগমনের মধ্য দিয়ে। পুত্রের সঙ্গে দীর্ঘ দুই যুগ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় শহর থেকে আসা দুই নাতনীকে পেয়ে আনন্দে মেতে উঠে জমিদার সাহেব। জমিদারের নাতনীদের সঙ্গে যাত্রাপথেই দেখা হয় গাতক মতির। গান শুনেই মতির ভক্ত হয়ে উঠে শাহানা। জমিদার নাতনীদের আগমনী বার্তায় জেগে উঠে গ্রাম, উঠে খুশির রব। সত্যিকার রাজকন্যাদের দেখা পেয়ে সবাই শিহরিত হয়! পেশায় চিকিৎসক শাহানা সেই গ্রামের হিন্দু এক রমণীর বাচ্চা প্রসবে সহায়তা করে সবার মধ্যমনি হয়ে উঠে। জমিদার বাড়ির প্রতি গ্রামের মানুষের ঘৃণা শাহানার কারনে রূপান্তরিত হয় ভালোবাসায়। অপরদিকে জমিদারের ছোট নাতনী নিতুর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে কুসুমের ছোট বোন পুষ্পের। মতির সঙ্গেও জমিদারের নাতনীদের ভাব জমে উঠে, বিশেষ করে শাহানার সঙ্গে। আর সেটাই কুসুমের হৃদয়ে তোলে ঝড়। ভালোবাসার আগুনে জ্বলে পুড়ে মরে একাকার হয় কুসুম। এরই মাঝে দীর্ঘদিন নিরুদ্দেশ থাকা কুসুম-পুষ্পের পিতা বাড়িতে ফিরে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে উজানের এক যুবক সুরুজকে। মেয়ে কুসুমের সঙ্গে ছেলেটিকে বিয়ে দেয়ার নিমিত্তে।
কুসুম-মতির সহজ-সরল সম্পর্কের জটিলতা ছবিটিতে অসাধারনভাবে ফুটে উঠেছে। মতি জানে কুসুম তাকে ভালোবাসে। মতির হৃদয়েও কী কুসুমের প্রতি ভালোবাসা জাগেনি? কুসুম যখন মতিকে তার বিয়ের কথা জানাতে যায় মতির বুক কী কেঁপে উঠেনি! কসুম যখন মতিকে বিয়ে করে গানের দল করার কথা বলে তখন মতির কী একবারও ইচ্ছে হয়নি এ মেয়েটির হাত ধরে আজানার পথে পাড়ি জমাতে! মতির শিল্পী হৃদয়ের কাছে প্রেমিক হৃদয় ছিলো পরাজিত। নিজের শিল্পসত্তাকে হারোনোর ভয়ে মতি নিজেই তার এই সত্তাকে গলা টিপে হত্যা করেছিলো। তাই হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ গল্প-উপন্যাস-চলচ্চিত্রের মতই এ ছবির নায়ক-নায়িকারা ট্র্যাজিক পরিণতি বরণ করে নেয়। তবে অস্বীকার করলে চলবেনা এই পরিণতিই সার্থক করেছে চলচ্চিত্রটিকে।
এই গল্পে আরেকজন পরাজিত মানুষ আছেন। তিনি ভালোবাসার কাছে হেরেছেন, আটকে গেছেন মায়া নামক আফিমের জালে। তাই হেরে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তিনিই জয়ী । বলছি জমিদারের কথা। ছবিটিতে মতি-কসুমের সম্পর্কের বিষয়টি ছাড়াও জমিদারের অংশটুকুও গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে এসেছে। উঠে এসেছে নাতনীদের সঙ্গে জমিদারের সম্পর্ক, সেই সঙ্গে তার অতীত জীবনের কালো অধ্যায়। হুমায়ূন মুক্তিযুদ্ধকেও এনেছেন গল্পের দাবিতে।
শ্রাবণ মেঘের দিন ছবির কিছু কিছু দৃশ্য এত আবেগঘন যে দর্শকের বুকের ভেতরে হাহাকার সৃষ্টি করে। একজন পরিচালক তখনই সফল যখন দর্শক ছবির চরিত্রগুলোর সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারে। এ দিক থেকে হুমায়ূন শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে উৎরে গেছেন। জমিদার বাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়ে মতি রাতে খেতে গেলে জমিদার তাকে ঘরের সিঁড়ি গোড়ায় বসিয়ে আপ্যায়ন করে, তার নাতনীদের সঙ্গে দেখা করতে দেয়না। অপমানের বোঝা আর এক বুক কষ্ট নিয়ে মতি পরাণের বাড়ি ফিরে আসে। পরাণ মন ভালো করার জন্য তাকে বাদ্য-বাজনার কথা বলে। অশ্রুসিক্ত কন্ঠে মতি গান ধরে ‘আমার গায়ে যত দু:খ সয়’…. মতির কষ্ট আকাশও বুঝি সইতে পারেনা। প্রবল ধারায় সে ঝরতে থাকে। ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে কুসুম লুকিয়ে লূকিয়ে তার ভালোবাসার মানুষটিকে প্রাণভরে দেখে। পুরো দৃশ্যটিতে অদ্ভূত এক ব্যঞ্জনার সৃষ্টি হয়।
পরিচালক তাঁর চিত্রগ্রাহককে দিয়ে সর্বোচ্চ কাজ আদায় করে নেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন। পুরো গ্রাম বাংলাকে ধারণ করার চেষ্টা ছিলো প্রশংসনীয়। সূর্যাস্তের সময় পরাণ ও তার ছেলের সাঁকো দিয়ে হেঁটে যাওয়া, একটা ছিলো সোনার কন্যা গানের চিত্রায়ন, শেষ দৃশ্যে মাঝ নদীতে নৌকার দৃশ্য সবই ছিলো চোখে লেগে থাকার মত।
এ ছবির উল্লেখযোগ্য দিক অবশ্যই অভিনয়। ছবিটির প্রতিটি চরিত্রেই প্রতিষ্ঠিত অভিনয়শিল্পীরা কাজ করেছেন। কাজেই পুরো ছবিটাই অভিনয়ের কারনে অনেক বেশি বাস্তবসম্মত ও হৃদয়গ্রাহী লেগেছে। মতি চরিত্রে জাহিদ হাসান, কুসুম চরিত্রে শাওন, শাহানা চরিত্রে মুক্তি, সুরুজ চরিত্রে মাহফুজ আহমেদ, কুসুমের মায়ের চরিত্রে আনোয়ারা সবাই ছিলেন অনবদ্য। তবে এ ছবির সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্রটি ছিলো জমিদারের। আর এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিংবদন্তী অভিনেতা গোলাম মোস্তফা। চরিত্রটিতে একই সঙ্গে ভালো-খারাপ উভয় সত্তার টানাপোড়েন ছিলো। কী অসাধারন দক্ষতায়েই না গোলাম মোস্তফা চরিত্রটি চিত্রণ করলেন! হুমায়ূন আহমেদকেও স্যালুট এমন একটি চরিত্র সৃষ্টির জন্য এবং সেই চরিত্রটিকে পর্দায় রূপ দিতে সবচেয়ে যোগ্য একজন মানুষেকে নির্বাচনের জন্য। হুমায়ূন আহমেদ চরিত্র সৃষ্টিতে সবসময়ই মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন। ভালো-খারাপের বৃত্ত ছাপিয়ে সবসময়ই তিনি চেষ্টা করেছেন মানুষ সত্তার মানচিত্র আঁকতে। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর বক্তব্যই শেষ কথা- ‘আমি সব সময় বিশ্বাস করি, একজন মহান শিল্পীর হাতে সবচেয়ে খারাপ চরিত্রটিও পরম নিরাপদ বোধ করে। শিল্পী যখন খারাপ মানুষকেও আঁকবেন, তখন একটা ‘মানুষ’ই আঁকবেন, সিনেমার ভিলেন নয়। হুমায়ূন আহমেদের মতো এত আশ্চর্য সংবেদনশীলতায় খারাপ মানুষকে বা ভালো মানুষের খারাপিকে আর কে আঁকতে পেরেছে? এখানে পাঠককে অনুরোধ করব, তাঁরা যেন না ভাবেন, হুমায়ূন আহমেদ কেবল খারাপ মানুষই ভালোভাবে এঁকেছেন। খারাপ মানুষের উদাহরণ দিলাম। কারণ, খারাপ মানুষ ভালোভাবে আঁকা সবচেয়ে কঠিন কাজ। ‘খারাপ মানুষ’ আর ‘ভালো মানুষ’—এই কথাগুলো প্রচলিত সামাজিক অর্থে ব্যবহার করলাম।’
এ ছবিটিকে বাংলাদেশের মানুষ আরেকটি যে কারণে অনেকদিন মনে রাখবে তা হলো ছবিটির সঙ্গীত। শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিটিকে সঙ্গীতের শৈল্পিক অভিযাত্রা হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। ফোকধর্মী মিউজিকের এমন অসামান্য ব্যবহার বাংলা চলচ্চিত্রে খুব কমই দেখা গেছে। উকিল মুন্সীর হারিয়ে যাওয়া গানুগলো হুমায়ূন এ ছবিতে তুলে নিয়ে আসেন পরম মমতায়। লোকে জানতে পারে বাংলা গানের অমূল্য এক ভান্ডারের কথা। পুবালী বাতাসে, আমার গায়ে যত দু:খ সয়, শুয়া চান পাখি আমি ডাকিতাছি তুমি ঘুমাইছো নাকি উকিল মুন্সীর কালজয়ী এ গানগুলো দরদ ভরা কন্ঠে মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেন বারী সিদ্দিকী। এর আগে টুকটাক গান লিখেলেও মূলত এ ছবিতেই গীতিকার হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। হুমায়ূন আহমেদের লেখা ‘একটা ছিলো সোনার কন্যা’ গানটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গানের স্বীকৃতি পেয়েছে। সুবীর নন্দী গানটি গেয়ে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতে নেন। এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদ ছবিটির জন্য আরো তিনটি গান লিখেন- ওগো ভাবীজান নাও বাওয়া মর্দ লোকের কাম, আমার ভাঙ্গা ঘরের ভাঙ্গা চালা এবং কাইল আমরার কুসুম রানীর বিবাহ হইবো। সবকটি গানই তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ছবির আরেকটি গান ‘মানুষ ধর মানুষ ভজ’-র জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকারের জাতীয় পুরষ্কার পান রশীদ উদ্দিন।
শ্রাবণ মেঘের দিন চলচ্চিত্রটি মোট ছয়টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার জিতে নেয়
শ্রেষ্ঠ অভিনেতা: জাহিদ হাসান
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক: মকসুদ জামিল মিন্টু
শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেতা: গোলাম মুস্তাফা
শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পী: সুবীর নন্দী (একটা ছিল সোনার কন্যা)
শ্রেষ্ঠ গীতিকার: রশীদ উদ্দিন (মানুষ ধর মানুষ ভজ)
শ্রেষ্ঠ শব্দগ্রাহক: মফিজুল হক
বাংলা ছবির অশ্লীলতার যুগে শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিটি জাগিয়েছিলো গ্রীষ্মের রৌদ্রতপ্ত দিনে শ্রাবণধারার শীতল পরশের মত অনুভূতি । মুখ ফিরিয়ে নেয়া দর্শকদের করেছিলো হলমুখী। দেশের চলচ্চিত্রপ্রেমী মানুষদের কাছে বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলো আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প ফুরিয়ে যায়নি। আজ বাংলা ছবি হতাশা কাটিয়ে কিছুটা আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন বাংলাদেশি চলচ্চিত্র ফিরে পাবে অতীতের ফেলে আসা হারানো গৌরব। বাংলা চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরে আসায় যে মানুষটির নাম বারবার উচ্চারিত হবে তিনি আমাদের সবার প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ।
বাংলা চলচ্চিত্রে বার বার ফিরে আসুক শ্রাবণ মেঘের দিন-এর মত চলচ্চিত্র।
___________________________________________________
দেশের প্রথম অনলাইন সিনে ম্যাগাজিন মুখ ও মুখোশ-এ প্রকাশিত
গত ২০ই জুলাই মুখ ও মুখোশ অনলাইন সিনে ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে হুমায়ূন আহমেদ বিশেষ সংখ্যা । মুখ ও মুখোশ-এর এবারের সংখ্যায় আমরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেছি এই মহান শিল্পীকে। রয়েছে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত আটটি চলচ্চিত্র নিয়ে পূর্ণাঙ্গ রিভিউ। মুখ ও মুখোশ স্পেশালে থাকছে হুমায়ূন আহমেদের শিষ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা মাসুদ আখন্দের জবানীতে তাঁর গুরুকে নিয়ে স্মৃতিকথা। আরো রয়েছে হুমায়ূনের গান ও তাঁর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র নিয়ে সালতামামি।
দেশের প্রথম অনলাইন সিনে ম্যাগাজিন মুখ ও মুখোশের সঙ্গেই থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জুলাই, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৩৬