বাবা মাকে নিয়ে আমার খুব একটা লেখা হয়নি। কেনো জানি হয়ে উঠেনি। একদিনের মা দিবস একদিনের বাবা দিবস একদিনের ভালোবাসা দিবস আমার ব্যাক্তিগতভাবে পছন্দ না। তবুও আজ ইচ্ছে হলো কিছু লিখার। একচুয়ালি অনেক কিছু লিখার।
আমার ফুপুদের চুল যেমন ঘন তেমনি সিল্কি আর লম্বা। একেবারে কেশবতী বলতে যা বোঝায় আর কি। উত্তরাধিকার সূত্রে ফুপাতো- চাচাতো বোনরাও পেয়েছে ঘন কালো ঝলমলে কেশ।
চাচার ছোট মেয়েটার চুল এতোই ঘনো যে একবার শুনলাম পার্লারে গিয়ে চুল কমিয়ে এসেছে।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম ক্যানো!? জবাবে যা বললো তার শানে নুজুল হলো চুল দুই দিনেও শুকায় না। ফলে ঠান্ডা লেগে যায়। কথা সেটা না। কথা বলতে চাচ্ছি আমার ফ্যামিলি নিয়ে। আমার বাবার চুল ও খুবই সফট আর সিল্কি। চুল নিয়ে উনি বেশ সচেতন ও।
কিন্তু কাহিনী হলো আম্মুর চুল নিয়ে। ম্যাগি নুডলস না হলেও খুব কম যে কোকড়া তাও কিন্তু না। তবে অতীব সুন্দরী হওয়াতে কেউ চুলের দিকে তেমন তাকায় ও না। যাইহোক আম্মুর জন্য আমরা পেয়েছি মিক্সড হেয়ার। আই মিন ভদ্র ভাষায় বললে যাকে বলে হালকার উপর ঝাপসা ওয়েভ। কিন্তু পোড়া কপাল আমার ছোট ভাইয়ের। সবে মাত্র কলেজে পড়ে। চোখে রঙিন চশমা। চেহারা ভালো হলেও তার ভাষ্যমতে কোকড়া চুল তার পার্সোনালিটির সাথে যায় না। আর তাই প্রায়ই আবদার ধরে "আপু আমার চুল গুলো তোমার হেয়ার স্ট্রেটনার দিয়ে স্ট্রেট করে দাওওওনা " একদিন তার আবদার পূরণ করে দিলাম।
দেখতে সদ্য জন্মানো শজারুর মত লাগলেও নিজেকে আয়নায় দেখে বেশ খুশি আমার ছোট ভাই।
ঠিক সেই মুহুর্তেই রুমে ঢুকলেন বাবা। ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলেন বাবা। তারপর খুব সিরিয়াস টাইপ চেহারা করে বললেন "তোর মত চুল যদি আমার হতো তবে আমি জীবনেও বাড়ির বাহিরে যেতাম না " কথাটা শুনে আমি আর ছোট খুব মজা পেলেও বাবা যে সিরিয়াসলি বলেছেন তাও জানতাম। প্রত্যেক মাসে একবার নর সুন্দরের কাছ থেকে চুল কাটিয়ে আসতেন। কিন্তু তার ধারনা কোন নর সুন্দর ই পেছনে সমান করে চুল কাটেনা। আর তাই সেলুন থেকে বাসায় এসেই চিরুনি আর ছোট্ট আয়না নিয়ে আমার কাছে আসতেন। বলতেন পেছন দিয়ে একটু সমান করে দে তো। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বাবার চুল সমান করে দিতাম।
একবার কি হলো, বাবার চুল নাপিত সেইরাম ছোট করে দিলো। ভ্রু কুচকে বাসায় এসে বাবা বললেন "আমি এখন বাহিরে কিভাবে যাবো" আমি তার দিকে তাকিয়ে এমন ভাব করলাম যেন মহা সমস্যার ব্যাপার। আর তাতে বাবার টেনশন তো কমলোই না ; আরো কয়েক গুন বেড়ে গেলো। সত্যিই সেই একমাস বাবা বাসা থেকে তেমন বের হননি।
কোন এক কুরবানী ঈদের আগের কথা। বাবা বাসায় নেই। দেশেও নেই। হজ্বে গেছেন। এর আগে বাবা কখনো বাসার বাহিরে ছিলেন না এতোদিন। কেমন জানি খালি খালি লাগতো বাসাটা। খুব মনে পরতো বাবাকে। জানালার ধারে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম
বাবকে জড়িয়ে ধরে বলি বাবা আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। প্রত্যেক কুরবানী ঈদের আগে যখন তুমি গরুর হাটে যেতে তখন ফিরতে একটু দেরি হলেই আমি লুকিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতাম।
যদি তোমায় অনেকটুকু হেটে আসতে হয় গরু নিয়ে! তারপর যদি তোমার পা ব্যাথা করে!
যদি তোমাকে গরু গুতো দেয়। এইসব অহেতুক সংকায় আরো কান্না পেতো।
রাস্তায় তোমার বয়সি কোন লোককে অফিস করে ক্লান্ত হয়ে কাধে ব্যাগ আর দুহাতে বাজার নিয়ে ফিরতে দেখলেই আজো তোমার কথা মনে পরে। ইসস.. ঠিক এইভাবেই তুমি অফিস থেকে ফিরতে তাইনা বাবা!
বাবা আমি আজো অনেক অনুশোচনা বোধ করি সেই দিনটির জন্য। আমি অনেক ছোট তখন। প্রথমবারের মত চাপকল দেখে খুশি সামলাতে না পেরে চাপতে গিয়েছিলাম। আর আমাকে সামলাতে গিয়ে কলের হ্যান্ডেল লেগে তোমার চিবুক ফেটে রক্ত ঝরছিলো। যদিও ব্যাপারটাএক্সিডেন্ট ছিলো তবুও আজো সেই দৃশ্য আমার চোখে ভাসলে ঘোলাটে হয়ে আসে চোখ দুটি।
আমাদের একটা স্টিলের আলমারি ছিলো। আমি ছোট বেলায় পা উচিয়ে সেই আলমারির আয়নায় নিজেকে দেখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমার চোখ দুটোই কেবল দেখতে পারতাম। বাবা আমায় উচু করে ধরে বলতেন আরেকটু বড় হলেই আমার মেয়ে আয়না দেখতে পাবে।
বাবা কলামিস্ট ছিলেন। সেই সুবাদে টুকিটাকি লিখার অভ্যাস আমারো হয়েছিলো। বাবা একদিন বললেন তোর কবিতাগুলো দে। আমি বললে ওরা ছাপিয়ে দিবে। ক্লাস ফোরে থাকা আমি সেদিন বাবাকে বলেছিলাম লিখা ভালো হলে ওরাই ছাপাবে। বাবা সেদিন কিছুই বলেননি।
টিফিনের টাকা জমিয়ে ইনভেলাপ কিনে কবিতা পাঠিয়ে ভুলেই গিয়েছিলাম আমি।
একদিন বাবা অফিস থেকে এসে ব্যাগটা খুলে একটা পেপার বের করে আমাকে কোলে বসালেন। ছোটদের পাতার ১৪ টা কবিতার প্রথম কবিতাটা আমার ছিলো। এক গাল হাসি নিয়ে আমাকে দেখালেন পেপারটা। বাবাকে এতো খুশি আমি আর কোনদিন হতে দেখিনি।
এই দেখুন না মূল গল্প ছেড়ে কই চলে গেছি।
হজ্ব পালন শেষে রাতের ফ্লাইটে দেশে ফিরছিলেন। জীবনের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন পূরণ করে ফিরছেন। অবশ্যই অনেক খুশি লাগছে। কিন্তু খারাপ লাগছিলো এই ভেবে, চুল নিয়ে এতো সিরিয়াস মানুষটাকে চুল ছাড়া কাল দেখবো কিভাবে। হয়তো এই টেনশনে প্রচন্ড টায়ার্ড শরীর নিয়েও ঘুম আসছিলোনা । হয়তো বাপের একমাত্র মেয়েরা এমনি হয়। হামি তুলতে তুলতে চোখের কোন বেয়ে পানি পরে কিন্তু চোখের পাতা এক হয়না..... .
বাবা দিবসে পৃথিবীর সব বাবারা ভালো থাকুক।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০২০ রাত ১০:২৮