news_imgকয়েছ আহমদ বকুল::
ডেইলী ষ্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারি করা হয়েছে। যতদূর জানি এই গ্রেফতারী পরওয়ানা জারিটা বে-আইনি। আওয়ামীলীগ সরকারের গত টার্মের কোন এক সময় সংসদে ফৌজদারী কার্যবিধির একটি সংশোধিত বিল পাস করা হয় যাতে মানহানিকর সংবাদ প্রকাশ প্রচারের বিরুদ্ধে করা মামলায় সাংবাদিক সম্পাদক প্রকাশকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারির বিধান বাতিল করা হয়। ঐ সংশোধিত বিলে স্পষ্ট করে বলা হয় এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তির বিরুদ্ধে সমন জারি করতে হবে। নারায়াণগঞ্জ আদালতে করা মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মানহানি মামলাটিতে আদালত তাহলে গ্রেফতারী পরওয়ানা জারি করে কিভাবে?
আইনের এই অপব্যবহারের ব্যাখ্যা হয়তো আইনবিদরা দেবেন কিন্তু সাংবাদিক বা গণমাধ্যম ব্যক্তিরা কী কেবল বসে আঙুল চুষবেন? মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে পরিচালিত চলমান অন্যায় ও স্বেচ্চাচারিতা কি একজন ব্যক্তি মাহফুজ আনামকেই কেবল আক্রান্ত করবে? আমাদের গণমাধ্যম বা সাংবাদিক সমাজ কি এতে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার কোন সুযোগ নেই?
মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে আজ মঙ্গলবার সারাদেশের ১৭টি জেলায় ২০ টি মামলা করা হয়েছে এর মধ্যে ১৯ টি মানহানি মামলা ও একটি রাষ্ট্রদ্রোহ। সোমবার একই ভাবে ১৭ জেলায় দায়রা জজ আদালতে ১৭টি মামলা করা হয় তাঁর উপর এবং রবিবারে দেশের বিভিন্ন স্থানে ১৩টি মামলার আসামি হোন মাহফুজ আনাম। এর আগে গত সপ্তাহে পাঁচটি মানহানি মামলা সহ এখন পর্যন্ত মোট ৫৫টি মামলায় বর্ষিয়ান এই গণমাধ্যম ব্যক্তি আক্রান্ত। প্রত্যেকটি মামলার কারণ একটিই, মাহফুজ আনামের সত্যবাদিতা। আজন্ম সংবাদ মাধ্যমে নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটি গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি একটি বে-সরকারী টিভির টক-শো অনুষ্টানে কথা প্রসঙ্গে স্বীকার করে বলেন যে বিগত মঈন-ফখরুদ্দিন সরকারের আমলে গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে প্রেরিত সংবাদ যাচাই না করে প্রকাশ করা ছিলো তাঁর সাংবাদিক জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। সেদিন সেই ভুল স্বীকার করানোতে কোন চাপ ছিলোনা, কোন প্রাভাব ছিলোনা, বলা চলে স্ব-প্রনোদিত হয়েই তিনি তা বলেছেন।
বলেছেন কারণ তাঁর বিবেকবোধ তাঁকে তা বলতে বাধ্য করেছে, তাঁর দেশপ্রেম ও জবাবদিহিতাপূর্ণ মানষিকতা থেকেই নিজের ভুলটুকুকে অকপটে স্বীকারে করে গেছেন তিনি। তাঁর এই সততা ও সদাচারণ ধারণের ক্ষমতা এই সরকারের বা সরকারের পাচাটা তোষামোদী মহলের নেই তিনি তা বুঝতে পারেননি। যেখানে সত্য বলা ও নিঃসংকোচে দায়ভার গ্রহণের কারণে মাহফুজ আনাম প্রশংসিত হওয়ার কথা সেখানে তথাকথিত দেশপ্রেমিক নামধারী ভন্ড মাতালদের ষড়যন্ত্রমুলক মিথ্যা মামলায় মাহফুজ আনাম বিপর্যস্ত। এই ব্যক্তি কি কেবল এক ব্যক্তি নাকি একটি প্রতিষ্টান, বিচারিক আদালতে কাকে রাষ্ট্রের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে, কেবল মাহফুজ আনামকে নাকি আমাদের পুরো সাংবাদিক সমাজকে? এই প্রশ্নগুলোর খুব দ্রুত সমাধান না হলে আমাদের দেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম বলে আর কিছু থাকবেনা। আরো একশোটি টিভি চ্যানেল জন্ম নেব, কাগজ হবে অগনন কিন্তু সেই প্রতিষ্টানগুলোতে সাংবাদিক থাকবেনা, থাকবে কেবল হলুদ আর কালোয় পূর্ণ সরকারের সুবিদাভোগী কতক স্তাবক।
মাহফুজ আনামের অপরাধ কি? এক-এগারো পরবর্তী সময়ে হাসিনা-খালেদার দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশ করা! গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করা সংবাদগুলোতে তো তথ্য দাতার নাম স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিলো যারা ডি জি এফ আইকে তথ্যগুলো দিয়েছিলো।তাদের অনেকের স্বীকারোক্তি মূলক ভিডিও ফুটেজ অনলাইন সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখনো বর্তমান। গোয়েন্দা সংস্থা নিউজ দিলো, স্বীকারোক্তি দিলো শেখ হাসিনা সরকারের বর্তমান অনেক মন্ত্রি আর মামলা মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে! কারণ কি? কারণ স্পষ্ট, বিভিন্ন ধারা উপধারায়, দলে গোত্রে ভাগ হতে হতে সবচেয়ে শক্তিশালী সাংবাদিক সমাজটি এখন বিচ্ছিন্ন ভঙ্গুর এবং কর্পোরেট দালালদের কাছে বিক্রিত পণ্য।এখন সাংবাদিকদের যত সহজে আঘাত করা যায় বোধহয় দেশের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদেরকেও এতো দ্রুত আঘাত আক্রমণ করা সম্ভব নয়।
কারণ দেশের সাংবাদিক ভায়েরা এখন আর সাংবাদিকতা করেননা, করেন কেবল চাকরি। কিন্তু এদেশ বাঁচাতে তার গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের মৌলিক অধীকার রক্ষা করতে এই একটি প্রতিষ্টান সাংবাদিক সমাজকে কোনভাবেই ভূলন্টিত ক্ষতিগ্রস্থ হতে দেয়া যাবেনা আর এর জন্য সর্বপ্রথম জরূরী সকল সাংবাদিকদের ঐক্যমত ও একতা। ফেডারেশন ও ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন ভাবে সাংবাদিকদের বিভক্ত হওয়ার কুফল আমরা পাচ্ছি। নিজের ঘরে খুন হওয়া সাংবাদিক দম্পত্তি সাগর – রুনীর খুনিরা এখনো এই সমাজে দাপটের সাথে বেঁচে আছে, ৪৮ ঘন্টার হাস্যকর আশ্বাস আজ ৪৮ মাস পেরিয়েও অপূর্ণ। কোন গ্রেফতার নেই, নেই দৃশ্যত কোন অগ্রগতি। বিভিন্ন মহল কর্তৃক সাংবাদিক নির্যাতন সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে তীর্যক কথা এসব তো খুবই সাধারণ আজকাল। সাংবাদিকদের মধ্যকার বিভক্তি দূর করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে আরো খারাপ পরিণতির দিকে যাবে এই সম্প্রদায়।
মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে একটি তথাকথিত গুরুতর অভিযোগ তিনি মাইনাস টু অর্থাৎ রাজনীতি থেকে ‘হাসিনা-খালেদা’কে বাদ দেয়ার প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করেছেন।এটা কি কোন ভুল ছিলো? একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন দুজন বা ততোদিক নেতাদের তার বা তাদের রাজনৈতিক ভুল ও অদুরদর্শিতার কারণে অবসরে পাঠানোর প্রক্রিয়াকে সমর্থন করাকে যারা রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলে প্রচার করতে চায় তারা কেবল জ্ঞানপাপী ভন্ড নয় তারা নিজেরাই চরম ভাবে রাষ্ট্রদ্রোহী।
শেখ হাসিনাকে অপছন্দ করেন, মাইনাস টু প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এমন অনেকেই আজ শেখ হাসিনার মন্ত্রীসভার মন্ত্রী কারণ সেই সংস্কারপন্থিরা ঐক্যবদ্ধ ও সাহসী ছিলো, তাঁরা তখনো অন্তর মনে বিশ্বাস করতো এখনো করে তাঁরা ভুল করেনি। নিজের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও অনঢ় থাকা অনেক বড় একটি শক্তি। অনেকে বলেন সেদিন নিউ এজ ও যায়যায় দিন ছাড়া সকলেই ডি জি এফ আই এর সরবরাহকৃত খবর ছেপে ছিলো, এতে করে নুরুল কবির শফিক রেহমানদের সম্মান করা হচ্ছে নাকি অসম্মান বুঝা কঠিন। কিন্তু যে পরিস্থিতিতে এক এগারো সংঘঠিত হয়েছিলো খালেদা জিয়ার ঘনিষ্টজন বলে পরিচিত শফিক রহমান সেটা সমর্থন না করলেও নুরুল কবির তো না করার কথা নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা গণতন্ত্র ও সামগ্রিক উন্নতির চিন্তা যারাই করে ছিলো তারা সকলেই সেদিন চেয়েছিলো মাইনাস টু ফরমুলা কার্যকর হয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি সুষ্ঠ ধারা ফিরে আসুক যাতে আর কোনদিন এক- এগারো আসার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়। সাংবাদিক ভায়েরা কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন তাঁরা সেটা চাননি। তাহলে আজ কেন মাহফুজ আনাম একা আক্রান্ত হবেন?
দলীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন চেয়েও তোফায়েল আহমদ মোহাম্মদ নাসিম, ওবায়দুল কাদের, আমীর হোসেন আমু প্রমূখরা যদি আজ মন্ত্রী। নিজের বিশ্বাস ও ধারনার প্রতি আস্থাশীল ও নিজেদেরকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারলে সাংবাদিকদের কাছেও সরকার নতজানু হতে বাধ্য। একদিন সাংবাদিক হিসেবে একটি অক্ষর লিখেছেন এমন সাংবাদিকরা সহ দেশের সর্বস্থরের সাংবাদিকরা যদি মাহফুজ আনামের উপর আসা এই আক্রমণকে নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবিক মুল্যবোধের উপর আক্রমণ ভাবেন তবেই জয় নিশ্চীত, তবেই সাংবাদিকতার আসল ঐতিহ্য ফিরে আসবে।
মাহফুজ আনামের উপর এক সাথে এতো মামলা হওয়ার আসল মাহাত্ম কিন্তু অন্য জায়গায়। মামলাকারীদের মুল উদ্দেশ্য যুবরাজের দৃষ্টি আকর্ষন। আমাদের যুবরাজরা আর শুধরালোনা, আমাদের এই ভু-খন্ডে দেখে শেখার সংস্কৃতিটা কেন যে মানুষ রপ্ত করতে পারেনা বুঝিনা। প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা ও তাঁর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ৪ঠা ফ্রেব্রুয়ারিতে মাহফুজ আনামের স্বীকারোক্তিমুলক সেই টক-শোটি শুনে তাঁর ফেইসবুক পেজে খুব রাগান্বিত হয়ে লিখেছিলেন মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিৎ। সেই উচিৎ কাজটিই করছেন তাঁর ভক্ত অনুরাগীরা। এটা যদি মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে অন্যায় হয়ে থাকে তবে সেই অন্যায়ের প্রধান অভিযুক্ত কিন্তু সজীব জয়। নিজেক নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিণতি কেমন হয় এই শিক্ষা দেবার সত্যি কোন শুভাকাঙ্খি কি জনাব জয়ের নেই?