মানুষের বয়স তো প্রতিদিনই কিছু কিছু করে বাড়ছে, প্রতি পলে পলে। তবে সবার বয়স বাড়াটা বাড়া নয়, একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে আসলে মানুষের বয়স কমতে থাকে। এই ‘নির্দিষ্ট বয়স’টা সবার জন্য এক নয়। কারো জন্য এটা পঞ্চাশ হতে পারে, কারো ষাট, কারো সত্তর বা তারও বেশি। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিরুদ্ধে আমরা যখন কোন কিছু উঁচুতে নিক্ষেপ করি, একটা নির্দিষ্ট উচ্চসীমায় উঠে সেটা আবার ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে। ভূপৃষ্ঠের যত নিকটবর্তী হয়, পতনের ত্বরণ তত বাড়তে থাকে, যদি না অন্য কোন শক্তি সেটাকে কিছুকাল ঠেকিয়ে রাখে। অন্য কথায় বলা যায়, বয়স যত বারে, আয়ু তত কমে।
এই যে যেটা বললাম, “একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর থেকে আসলে মানুষের বয়স কমতে থাকে”– এই কমার লক্ষণটা আমরা নানাভাবে অনুভব করতে পারি। আমাদের কর্মশক্তি ধীরে ধীরে কমতে থাকে, দৃষ্টি শক্তি, শ্রবণ শক্তি, স্মরণ শক্তি, ধারণ শক্তি ইত্যাদিও এক এক করে কমতে থাকে। এটা সবার জন্য সত্য নাও হতে পারে, আবার সবগুলোই সবার জন্য একসাথে সত্য নাও হতে পারে। তবে একটা লক্ষণ বোধকরি পঞ্চাশোর্ধ্ব সকলের মধ্যেই কিছু না কিছু দেখা দিতেই থাকে, সেটা হচ্ছে ভুলো-মনা হওয়া আর স্মরণশক্তি ধীরে ধীরে লোপ পাওয়া। পরিচিত আত্মীয়-স্বজন, একটু কম ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধব, জ্যেষ্ঠ-কনিষ্ঠ সহকর্মী, অতীতে নিবিড় সান্নিধ্যে কাজ করেছেন এমন কেউ, প্রমুখের নাম ভুলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে বেগ পেতে হয়, কোন কোন সময় লজ্জাও পেতে হয়। একটা বয়সে এসে এমনটা হতেই পারে, এতটুকু ছাড় দিতেও অবশ্য অনেকেই উদারতা দেখান না।
যাহোক, আমার স্মরণ শক্তি এতকাল ভালোই ছিল, কিন্তু অধুনা আমারও প্রায়ই স্মৃতিভ্রম ঘটছে, অসাবধানতা বশতঃ বেশ বড় ভুলভ্রান্তিও ঘটছে। বছর তিনেক আগে দিল্লী থেকে শ্রীনগর যাবার সময় ট্যাক্সিচালকের অজ্ঞতা বশতঃ আমরা একটি ভুল টার্মিনালে উপস্থিত হয়েছিলাম। আসল টার্মিনালটির দূরত্ব সেখান থেকে ছিল দশ মিনিটের ড্রাইভ, কিন্তু ততক্ষণে দিল্লীর অফিস টাইম শুরু হয়ে যাওয়াতে রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফলে দশ মিনিটের দূরত্বের পথ কমপক্ষে ত্রিশ মিনিটের পথে পরিণত হয়েছিল এবং বেলা বাড়ার সাথে সাথে এই ব্যবধানও বাড়ছিল। আমাদের ট্যাক্সিচালক পুলিশের তাড়া খেয়ে গাড়ি একটানে বেশ খানিকটা সামনে নিয়ে যায়, আমিও হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে গিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে বসি এবং চালককে পরের টার্মিনালে যেতে বলি। হৈ-হুল্লোরে সেই ভুল বহির্গমন টার্মিনালের মেঝেতে জরুরি কাগজপত্র রাখা আমার একটা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ ফেলে রেখে আসি। পরের টার্মিনালে নামার সময় সেটা স্মরণ হওয়ায় আবার ঊর্ধ্বশ্বাসে ফিরে এসে সেই ব্যাগ উদ্ধার করতে রীতিমত গলদঘর্ম হই। নিরাপত্তার স্বার্থে দিল্লী পুলিশ ব্যাগটাকে ‘unclaimed baggage’ হিসেবে গণ্য করে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দিচ্ছিল নিরাপত্তা পরীক্ষার জন্য। আমি ফিরে এসে ব্যাগটার খোঁজ করাতে পুলিশ ওয়াকি-টকি’র মাধ্যমে unclaimed baggage বাহী সেই ট্রেইলারটি কোয়ারেন্টাইনে প্রবেশ করার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সেটাকে থামিয়ে ব্যাগটিকে নামিয়ে আনে। একবার কোয়ারেন্টাইনে প্রবেশ করলে দুই দিনের আগে সেটাকে কেউ বের করে আনতে পারতো না। ব্যাগটি উদ্ধারের ব্যাপারে দিল্লী পুলিশ অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল সেদিন। ব্যাগটি নিয়ে সেই একই ট্যাক্সিতে পুনরায় নতুন টার্মিনালে এসে একেবারে শেষ মুহূর্তে প্লেন ধরার শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনীর কথা স্মরণ করতে এখনো ভয় লাগে। তবে সেবারে শেষ পর্যন্ত সব দুশ্চিন্তার সুন্দরভাবে সমাপ্তি ঘটেছিল এবং সফরের বাকি অংশটা ভালোভাবে কেটেছিলো।
এবারে যেদিন আমরা মেলবোর্নে এলাম, তার পরদিন থেকেই রোযা শুরু হলো। তাই প্রথম একটা মাস বলতে গেলে আমরা ঘরেই ছিলাম, হাঁটাহাটি ছাড়া বাইরে খুব একটা যাওয়া হয়নি। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া ছেলের পক্ষে আমাদেরকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া সম্ভব হয় না, তাই আমরা যাতে সহজেই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে আমাদের ইচ্ছেমত ঘোরাঘুরি করতে পারি, সেজন্য শুরুতেই সে আমাদের দু’জনের জন্য দুটো “মাইকি কার্ড” কিনে দিয়েছে। অন্যান্য উন্নত দেশের মত এখানেও একই নিয়ম, একই কার্ড দিয়ে আমরা ট্রেনে, বাসে ও ট্রামে যথেচ্ছা ভ্রমণ করতে পারি। এজন্য সারাদিনে সর্বোচ্চ নয়/দশ অস্ট্রেলিয়ান ডলারের মত কেটে নেয়। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে একটু কম কাটে, সাত/আট ডলারের মত, আর পাবলিক হলিডে তে এখানকার নাগরিকরা (এবং পর্যটকরাও) বিনামূল্যে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করতে পারে, অর্থাৎ একেবারে ফ্রীতে!
ডাক্তারের শিডিউল অনুযায়ী ২৬শে এপ্রিল তারিখে মেলবোর্নের “পেনিনসুলা প্রাইভেট হসপিটাল” এ সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে আমাদের নাতনির জন্ম হবার কথা ছিল। কিন্তু সে দু’দিন আগেই, অর্থাৎ ২৪ তারিখেই সেহেরীর সময় তার আগমনি বার্তা ঘোষণা করে। দিনটি ছিল রবিবার। ছুটির দিনে বিশষজ্ঞ ডাক্তারদেরকে হাতের কাছে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। সৌভাগ্যক্রমে, তার মা যে বিশষজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসাধীন ছিল, তাকে ফোন দেয়ার সাথে সাথে তিনি রোগীকে জরুরী বিভাগে রিপোর্ট করতে বলেন এবং সকাল নয়টায় অপারেশন হবে বলে জানান। জন্মের সময় মায়ের পাশে ওর বাবাও ছিল। আমরা দু’জন বাসাতেই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম। অপারেশনের পাঁচদিন পর, ছয় দিনের দিন মা, বাবা ও সন্তান নিজ গৃহে ফিরে আসে। এই ছয়দিনে আমরা চার দিন হাসপাতালে গিয়ে ওদেরকে দেখে আসি। এই দেখে আসতে গিয়েই আমরা পর পর দু’দিন দুটো ভুল করেছি, স্মরণশক্তি লোপ পাওয়ার কারণে। ভুলের প্রথমটা এখানে বলছি।
আমাদের বাসা থেকে হাসপাতালে যেতে হলে প্রথমে আমরা বাসার কাছ থেকে বাসে উঠে Lynbrook Station এ যাই। সেখান থেকে ট্রেনে করে Cranbourne Station এ যাই। সেখান থেকে আবার বাসে করে “পেনিনসুলা প্রাইভেট হসপিটাল” এ যাই। ট্রেন ও বাস ঘড়ির কাঁটা মেনে চলে। কোনটা কখন আসবে তা সেলফোনে সার্চ দিয়ে আগে থেকে জেনে নেয়া যায়। সময়ের হেরফের সাধারণতঃ হয় না, হলেও দুই-এক মিনিটের বেশি হয় না। সুতরাং বাসে ট্রেনে চলাচল করতে কোনই অসুবিধে হয় না। যদি কোন মাসে বাস ট্রেন চলাচলের সময়ানুবর্তিতা ৯০% এর নীচে নামে, সে মাসে “মাইকি কার্ড” ব্যবহারকারীদেরকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিয়ে কার্ডের ব্যালান্স সমন্বয় করা হয়, অবশ্য তার আগে কার্ড ব্যবহারকারীকে সেটা claim করতে হয়। নয় বছর আগে আমেরিকায় দুই মাস ছিলাম, তার মধ্যে নিউ ইয়র্কে ছিলাম এক মাসের কিছু বেশি। তখন সেখানে ট্রেনের যে সময়ানুবর্তিতা দেখেছি, তার চেয়ে মেলবোর্নের ব্যবস্থাপনা অনেক ভালো পেয়েছি। যাহোক, একদিন আমরা দু’জন হাসপাতালে যাবার সময় স্ত্রী ভুলক্রমে তার সেলফোনটা ট্রেনের সীটে রেখে Cranbourne Station এ নেমে আসে। সাধারণতঃ বাস বা ট্রেন থেকে নামার সময় আমি একবার আসনের দিকে চোখ বুলিয়ে নিই। সেদিন সেটা করতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্ত্রীও সেটা খেয়াল করেনি। হাসপাতালে এসে বাচ্চার ছবি তুলতে গিয়ে সে খেয়াল করে যে তার ব্যাগে সেলফোনটা নেই। তবুও মনে করতে পারছিল না, সেলফোনটা কখন, কোথায় সে ফেলে এসেছে। বাসায় ফিরে এসে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সে যখন ফোনটা পেল না, তখন ভীষণ মর্মাহত হয়ে পড়ে। আমরা ঠিক করলাম, পরের দিন হাসপাতালে যাবার সময় Cranbourne Station এর কাস্টমার সার্ভিসে খোঁজ নেব। তবে পাওয়ার সম্ভাবনা যে প্রায় শূন্য, সেটা ধরেই নিয়েছিলাম।
ইতোমধ্যে আমি ফোনটা আসলেই Cranbourne Station এ রেখে আসা হয়েছে নাকি অন্য কোথাও, বিভিন্ন উপায়ে এবং স্মৃতি হাতড়িয়ে তা যাচাই করতে বসে গেলাম। Cranbourne Station এর কাস্টমার সার্ভিসে গুছিয়ে কথা বলার সুবিধার্থে ঘটনার টাইম টেবিলসহ একটা সামারী তৈরী করলাম। পরদিন আমরা রওনা হবার আগেই ছেলে ফোন করে জানালো, কাস্টমার সার্ভিসের সাথে কথা বলে সে জানতে পেরেছে যে ট্রেনে ফেলে যাওয়া একটি সেলফোন তাদের কাছে রক্ষিত আছে। কখন, কোথায়, কী মডেল এর ফোন পাওয়া গেছে, ফোন সম্পর্কে ইত্যাকার তথ্যাদি দিতে তারা অপারগ, আমাদেরকেই সেখানে গিয়ে ট্রেনের নাম, সময়, রুট, ফোনের মডেল, সনাক্তকরণ চিহ্ন ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্যপ্রমাণ দেখিয়ে ফোনটি সংগ্রহ করতে হবে। ওগুলো নিয়ে কোন সমস্যাই ছিল না, সবগুলো তথ্যই আমি একটা কাগজে টুকে রেখেছিলাম এবং সেলফোনে তার ছবিও তুলে রেখেছিলাম।
আমরা হাতে সময় নিয়ে পরদিন রওনা হলাম। Cranbourne Station এর কাস্টমার সার্ভিসে গিয়ে একজন মধ্যবয়স্কা নারীকে ডিউটিরত পেলাম। তিনি আমাকে ট্রেনের নাম, রুট এবং হারানোর সময় জিজ্ঞেস করলেন। আমি প্রথম দুটোর সঠিক জবাব দিয়ে পনের মিনিটের একটা ব্রাকেট রেখে পরেরটার আনুমানিক সময় বললাম, কারণ একেবারে সঠিক সময়টা আমরা কেউই খেয়াল রাখিনি। আমাদের নিজেদের আইডেন্টিটি ডকুমেন্ট সাথে কী আছে তা জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, কোন হার্ড কপি সাথে নেই, তবে সেলফোনে আমাদের উভয়ের পাসপোর্টের কপি আছে। উনি জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার সেলফোনটা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে বললেন, “সীমস প্রিটী গুড, হিয়ার ইজ ইয়োর ফোন”! এই বলে তিনি ফোনটা আমার হাতে ফেরৎ দিয়ে বললেন, “এনজয় ভিজিটিং অস্ট্রেলিয়া”! আমি আশ্চর্য হলাম এজন্য যে ওরা কোন ডকুমেন্টে কোথাও আমাদের কোন স্বাক্ষর রাখলো না, কিংবা ছবিও তুলে রাখলো না! সভ্য দেশ বলে কথা!
মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
০৩ জুন ২০২২
শব্দসংখ্যাঃ ১২০৮
এর পরের পর্বটি পড়া যাবে এখানেঃ ভুলো মন..... (২)
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুন, ২০২২ বিকাল ৩:৪৬