বই পরিচিতিঃ
বই এর নামঃ ‘জীবন এমনই’
বই এর ধরণঃ জীবন ঘনিষ্ঠ গল্প
লেখকের নামঃ শামসুদ্দিন আহমেদ
প্রকাশকের নামঃ ফোরকান আহমদ
স্বত্বাধিকারী- পালক পাবলিশার্স,
১৭৯/৩, ফকিরের পুল, ঢাকা-১০০০
প্রচ্ছদঃ সমর মজুমদার
উৎসর্গঃ “পরম শ্রদ্ধেয় ও স্নেহভাজন লেখক ও প্রকাশক ফোরকান আহমদ কে”
প্রথম প্রকাশঃ ফাল্গুন ১৪২১, ফেব্রুয়ারী, ২০১৫
পৃষ্ঠা-১০০, মূল্য: ১৬০.০০ টাকা
লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিঃ
লেখক একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার, ইএনটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদবীতে অবসর নিয়েছেন। ১৯৬৯ সালে তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান হেলথ সার্ভিসে যোগ দিয়ে সিলেট মেডিক্যাল কলেজে এ্যানাটমি’র লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৭০ সালে সামরিক মেডিক্যাল কোরে যোগদান করেন, পরে আইপিজিএমআর হতে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের পর নাক, কান ও গলা রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন সামরিক হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস ‘অন্যরকম’, ‘অবিভাজ্য’ এবং ‘এলোমেলো’ পাঠক সমাজে যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছে।
আলোচনাঃ
বই এর নামটাই- ‘জীবন এমনই’ সহজে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রচ্ছদে চোখ পড়তেই পাঠকের মনে জিজ্ঞাসার উদয় হয়, জীবন এমনই- তবে কেমন? কার জীবন? প্রচ্ছদে আঁকা রয়েছে কিছু বই হাতে দাঁড়ানো এক মানবের প্রতিকৃতি, তার পাশে দাঁড়ানো আরেক মানবী। লেখক কোন ভূমিকা লিখেন নি; গল্পের নায়ক ‘সাবু’র নামোল্লেখ দিয়েই প্রথম শব্দটা শুরু। সাবু একজন ফেরিওয়ালা। ট্রেনে ট্রেনে নানারকম গল্পের বই, কবিতার বই এবং বিভিন্ন ম্যাগাজিন ফেরি করে বিক্রী করে। কোন এক সময় সে একজন চৌকস, মেধাবী ছাত্র ছিল। বাবার অকাল মৃত্যুর পর তাকে বাধ্য হয়ে কলেজ ছেড়ে রোজগারে নামতে হয়। বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের সাংস্কৃতিক অঙ্গণে একসময় সাবু একটি পরিচিত নাম ছিল। তার জলদগম্ভীর কন্ঠে জীবনান্দ দাশের “রুপসী বাংলা” কবিতার আবৃত্তি এখনো তার সতীর্থদের কানে বাজে। দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় তার বাবা বশির হোসেন এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বরণ করেন। অর্থাভাবের কারণে তার বাবাও নবম শ্রেণীতে উঠে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে একসময় রেল স্টেশনে শিশুতোষ বই, কার্টুন, চকলেট, লজেন্স ইত্যাদি ফেরি করতেন। গল্পে সাবুর মত পড়াশুনা থেকে অকালে বিচ্যূত আরো অনেক অভাগাদের জীবন কাহিনী উঠে এসেছে, যেমন শুকুর, সাজু, মধু, বুলু, মহী- এদের সবাই এসএসসি’র আগেই কেউ বাবার মৃত্যুতে, বাবা অসুস্থ কিংবা সংসারত্যাগী হওয়াতে অপরিণত বয়সে সংসারের হাল ধরতে রেল-ফেরিওয়ালার পেশা বেছে নেয়। লেখক বগুড়ার অধিবাসী ছিলেন। এইচএসসি’র পর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে তিনি যখন ডাক্তারী পড়তে গেলেন, তখনও হামেশা তাকে বগুড়া টু রাজশাহী ট্রেনে যাতায়াত করতে হতো। যাতায়াতের পথে তিনি অত্যন্ত দরদভরা দৃষ্টি নিয়ে এসব তরুণ ফেরিওয়ালাদের কার্যকলাপ, কথোপকথন লক্ষ্য করতেন। তাই এ গল্পে বারবার উঠে এসেছে ঐ লাইনের কিছু রেল স্টেশনের নাম- শান্তাহার, সুখানপুকুর, আদমদিঘী, ফুলছড়িঘাট, কাহালু, তালোড়া, বোনারপাড়া, বগুড়া, ইত্যাদি। তিনি তাদের সাথে কথা বলে বলেই এ গল্পের তথ্য উপাত্ত অনেক আগেই সংগ্রহ করে রেখেছিলেন, বই বের করেন তার অনেক পর।
অতি সাধারণ, নিম্ন মধ্যবিত্ত কয়েকটি পরিবারের সংগ্রামী জীবন নিয়ে আবর্তিত হয়েছে এ গল্প। এর মধ্যে কষ্টের কথাও যেমন আছে, তেমন আছে কিছু প্রেম ভালবাসা আর বিরহ বেদনার কথাও। আছে দেশপ্রেম, রাজনীতি আর নৈতিকতার কথাও। সাবু তার নৈতিকতা ও মেধার কারণে সেসব ফেরিওয়ালাদের মধ্যে ছিল নেতৃ্স্থানীয়। এরা একের আপদে বিপদে অন্যেরা নিজের ব্যবসায়িক ক্ষতিস্বীকার করে হলেও এগিয়ে আসতো। অসহায় ঝালমুড়িওয়ালা মধুর ঝালমুড়ির বাক্সটি যখন হন্তদন্ত হয়ে ছোটা এক ভদ্রলোকের সাথে ধাক্কা লেগে ভেঙ্গে যায়, সাবু তখন তার সাহায্যে এগিয়ে এসে যৌক্তিক তর্কের মাধ্যমে অনিচ্ছুক ঐ ভদ্রলোকের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে মধুকে দেয়। এক স্মৃতিভ্রমগ্রস্থ ব্যক্তি যখন তার হাতঘড়িটি ওয়েটিং রুমে ফেলে এসে খামোখা কিশোর ফেরিওয়ালা মহীকে চোর সাব্যস্ত করে মারধর করতে উদ্যত হয়েছিল, এরা সবাই মিলে তখন চুরির প্রমাণ দাবী করে সেই লোককে কোনমতে মারধর করা থেকে নিবৃত্ত করে। পরে যখন এক যাত্রী ওয়েটিং রুম থেকে প্লাটফর্মে এসে ঘড়িটি তার কিনা জিজ্ঞাসা করে, তখন সেই লোক কাঁচুমাচু করতে থাকে। কিন্তু ১৪/১৫ বছরের ন্যাপথিলিন, সেফটিপিন, চিরুণীওয়ালা মহী মোটেই সময় নেয় নি সেই রূঢ় ব্যক্তিটিকে হাসিমুখে ক্ষমা করে দিতে। কারো রোগ ব্যাধিতে এরা একে অন্যকে সাথে করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতো। যেমন বুলু’র মা ফরিদা যখন লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হলো, সবাই মিলে চেষ্টা করেছে তার চিকিৎসার, সুপথ্যের ব্যবস্থা করতে। সাবু’র বাগদত্তা ময়নার মা মর্জিনা যখন পুরাতন বাত রোগে কষ্ট পাচ্ছিলো, তখন সাবুই তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করেছে। এরা একতাবদ্ধ হয়ে একবার ট্রেন ডাকাতি প্রতিহত করেছিল। আরেকবার এক “অজ্ঞান পার্টি”কে সদলবলে ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করেছিল। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সমর্থক দুই দল হকারের মধ্যে যখন তর্কাতর্কি থেকে হাতাহাতির উপক্রম হয়েছিল, তখন সাবু এক বিচক্ষণ, নাতিদীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে সবাইকে থামিয়ে দিয়েছিল এই বলেঃ “আমরা সবাই হকার। পেশার দিক থেকে আমরা সবাই এক, ভাই ভাই। রাজনৈতিক মতবাদ, সেটি নিজস্ব ব্যাপার। এ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ করে আমাদের ঐক্য বিনষ্ট করা সমীচীন হবে না।”
আরেক ফেরিওয়ালা সন্তোষ ঘোষের মুখ দিয়ে লেখক একটি অকাট্য সত্য বলিয়েছেন। সন্তোষ ঘোষ ট্রেনে ফেরি করে সন্দেশ ও ছানা জাতীয় দ্রব্যাদি বিক্রয় করতো। তার স্ত্রী পক্ষাঘাতে দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী ছিল। তার মনে একটা পাপবোধ ছিল যে চিনির বদলে স্যাকারিন দিয়ে সন্দেশ বানানোর ফলে এবং মানুষকে এর মিথ্যে গুণাবলী বলে বলে সে পাপ করেছিল এবং তার স্ত্রী এ কারণেই শয্যাশায়ী ছিল। তার সতীর্থ একজন এসব শুনে যখন তাকে বলেছিল যে এসব তেমন বড় কোন অপরাধ নয়, সন্তোষ তখন দৃঢ়্ভাবে তা নাকচ করে বলেছিল, “অপরাধ যত ছোটই হোক, অপরাধই”। আমাদের মধ্যে অনেকেই বলে থাকেন যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের এক পা থাকে বাংলার এ পারে, আরেক পা ওপারে। কিন্তু যখন দেশ ভাগ হলো, সন্তোষের ঠাকুর্দাদা তখন “চোখের জল ফেলে বলেছিলেন, ‘কি নিষ্ঠুরতা! মাকে তোমরা দু’টুকরো করলে’!” তিনি তৎকালীন তেভাগা আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, এ নিয়ে হাজতও খেটেছিলেন। দেশভাগের পর তিনি দলেবলে এপার ছেড়ে ওপারে যাওয়ার প্রস্তাব দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘দুঃখিনী মাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব না’। এই শোকে তিনি দেশভাগের কয়েক বছর পর দেহত্যাগ করেন। তারা বাংলাদেশেই থেকে যায় এবং তার পুত্র অর্থাৎ সন্তোষের বাবা ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেন।
এভাবেই লেখক ছোট ছোট টুকরো টুকরো কিছু চরিত্রের মধ্য দিয়ে তার দেখা ফেরিওয়ালাদের জীবন যাপনের নিত্য কড়চা বর্ণনা করেছেন। গল্পের মাঝে মাঝে তিনি সাবু ও ময়নার মাঝে কিছু কিছু কথোপকথনের মাধ্যমে তাদের মধ্যকার প্রেম ও প্রণয়ের কিছু কিছু সাবলীল ধারা বর্ণনা দিয়েছেন। ময়নার মা মর্জিনা এক সময় সাবুর বাবার সাথে ট্রেনে ফেরি করতেন। সাবুও যখন এ লাইনে চলে এলো, তখন তিনি সাবুর সাথেও কোন কোন সময় সঙ্গী হতেন। সাবু তাকে খালা ডাকতো। এই খালাই ঘটকালি করে সাবুর হঠাৎ করে বেড়ে ওঠা দু’বোনের এক সাথে বিয়ের ব্যবস্থা করেছিল। তার মায়ের সাথেও এই খালার সুসম্পর্ক ছিল। ময়নার সাথে সাবু যে সম্পর্ক গড়েছিল, তাতে উভয় মা দের সায় ছিল। অতএব, সাবুর দুই বোনের একত্রে বিবাহ অনুষ্ঠানের পর ওদের দু’জনেরও বিয়ে অচিরেই হবে বলে সাব্যস্ত হয়। কিন্তু তখন দেশে লাগাতার হরতাল আর অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে কোন নির্দিষ্ট দিন তারিখ ঠিক করা বিলম্বিত হচ্ছিল। ইতোমধ্যে ময়না এসএসসি দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে কলেজে ভর্তি হলো। ঠিক এ রকম একটা অবস্থায় একদিন বগুড়া ও কাহালুর মাঝমাঝি জায়গায় এক ট্রেন দুর্ঘটনায় সাবু মারাত্মকভাবে আহত হলো আর তার সঙ্গী শুকুর নিহত হলো। সাবুর ডান পা টা গুঁড়িয়ে যাওয়াতে সেটাকে উরু পর্যন্ত কেটে ফেলে দিতে হলো। প্রায় দুই মাস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর সাবু ক্র্যাচনির্ভর হয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করলো।
আহত হবার পর সাবুকে মর্জিনা খালা দু’বার দেখতে এসেছিলেন, কিন্ত তার সাথে ময়না একদিনও আসেনি। আর সাবুর মা সেই যে প্রথম দিন হাসপাতালে এসেছিল, তার পর থেকে কেউ তাকে হাসপাতাল থেকে নাড়াতে পারেনি। রাত্রিবেলা তিনি ওয়ার্ডের করিডোরে ঘুমোতেন। সাবুর মনটা ময়নার সাথে কথা বলার জন্য আকুপাকু করলেও, ময়না একদিনও টেলিফোন না করাতে সাবু ব্যাপারটাকে বাস্তবতার নিরিখে আপন মনে ব্যাখ্যা করে নিয়েছিল। একদিন অনেক কষ্টে ফোনে পাবার পর ময়না যখন তাকে বললো, “আমি জানি তুমি আমার উপর রাগ করেছো। আমার কী করার ছিল বলো! আজ যদি তোমার এ অবস্থা না হয়ে আমার হতো, তুমি কী করতে?” – তখনই সাবু মেনে নিয়েছিল তাদের প্রেমের অসফল পরিণতি। এ নিয়ে তার মা একদিন তাকে সান্তনা দিতে গিয়ে অশ্রুপাত শুরু করলে সাবু তাকে বুঝিয়ে বলেছিল, ‘একজন পঙ্গু মানুষের কাছে কেন আসবে? জীবন তো এমনই মা’!
গল্পটা হয়তো বাস্তব জীবন থেকে নেয়া। জীবন হয়তো এমনই, কিন্তু একজন পাঠক হিসেবে আমি সাবুর প্রেমিকাকে আরেকটু উদার আর নিঃস্বার্থ দেখতে চেয়েছিলাম। কেননা আমি অন্ততঃ দু’জোড়া দম্পতির কথা জানি, চাক্ষুষ দেখেছি। একজন বিয়ের দিন থেকেই তার স্ত্রীকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে সানন্দে সারাজীবন ক্যারী করেছেন। তারা আজ উভয়ে প্রয়াত। অপরজন প্রেমের শেষ পর্যায়ে এসে যখন তার প্রেমিক এক মারাত্মক ব্যাধির কারণে আংশিক পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েন, তখন পরিবারের সকলের বাধা উপেক্ষা করে তিনি তাকেই বিয়ে করেছিলেন। আজও তাদেরকে মাঝে মাঝে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সুখী দম্পতি হিসেবে দেখতে পাই। অবশ্যই, হুইল চেয়ারে আসীন স্বামীর সাহায্যে স্ত্রীই সহাস্যে তার পাশে অথবা পেছনে থাকেন।
ঢাকা
০৩ এপ্রিল, ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৫