মধ্যরাতে স্বপ্নটি দেখে হক সাহেব গলদঘর্ম হতে থাকলেন। আগেও ঠিক একই ধরণের স্বপ্ন দেখার কয়েকদিন পর তিনি কয়েকটি দুঃসংবাদ পেয়েছিলেন, নিকট কারো চিরবিদায়ের দুঃসংবাদ। ছোটবেলা থেকেই তিনি বড়দের মুখে এটা শুনে বিশ্বাস করে এসেছিলেন যে ভোর রাতের স্বপ্ন নাকি সত্য হয়। অন্ধকারেই তিনি মশারি ফাঁক করে বেড সাইড টেবল এর উপরে রাখা সেলফোনটা হাতড়ে বের করলেন। বাটন টিপে দেখলেন, রাত দুইটা চল্লিশ। মনে মনে ভাবলেন, এটাকে কি ‘ভোর রাত’ বলা যায়? নিজেই নিজেকে উত্তর দিলেন, নাহ! একটু স্বস্তি পেয়ে তিনি চোখ বুঁজে প্রার্থনা শুরু করলেন। বিভিন্ন বিষয়ে, বিভিন্ন সময়ে প্রার্থনার জন্য (যেমন ঘর থেকে বের হবার সময়, রাতে শোবার সময়, কারো মৃত্যু সংবাদ পেলে, মা বাবার জন্য দোয়া, সন্তানদের জন্য দোয়া করার সময়, ইত্যাদি) হক সাহেবের কিছু নিজস্ব ফরম্যাট আছে। স্বপ্ন দেখার উপর হক সাহেবের ফরম্যাটটি এরকমঃ “হে মা’বুদ, একটু আগে যে স্বপ্নটা তুমি দেখালে, সেটাতে যদি আমার কিংবা আমার পরিবারের কারো জন্য কোন শুভ বা কল্যাণের ইঙ্গিত থাকে, তবে মেহেরবাণী করে আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য তা কবুল ও মন্জুর করে দাও। আর যদি এতে কোন অশুভ বা অকল্যাণের ইঙ্গিত থাকে, তবে মেহেরবাণী করে আমাকে এবং আমার পরিবারের সদস্যদেরকে সেই অশুভ অকল্যাণ থেকে সুরক্ষা কর"। হক সাহেব অবচেতনে বুঝতে পারছিলেন, এই প্রার্থনাটুকু শেষ করার আগেই তিনি বারবার ঘুমিয়ে পড়ছিলেন, আবার ঘোর কেটে গেলে পুনরায় সেটা শুরু করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই আর শেষ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছিলেন না। এ কারণে আধো ঘুমের মধ্যেই তার ভয়টা আরো বেড়ে যাচ্ছিল। যেহেতু তিনি প্রার্থনাটা শেষ করতে পারছিলেন না, সুতরাং তার বুঝি আর সুরক্ষা হবে না, স্বপ্নটা বোধহয় সত্যে পরিণত হবে- এ কথা ভেবে তার ঘুমটা পুরোপুরি আসছিল না।
এই ভয়টা তার পরদিন পর্যন্ত থেকেই গেল। প্রতিদিন ভোরে ফজরের নামায পড়ে তিনি হাঁটতে বের হন। কিন্তু সেদিন তিনি বের হলেন না। নামাযের পর মৃত্যুভাবনা নিয়ে কিছু একটা লিখতে বসে গেলেন। প্রথমে কবিতা, পরে গল্প, কথিকা ইত্যাদি। কিন্তু কোনটাতেই তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। লিখেন, আবার মুছে দেন, এভাবেই বেশ কয়েকটা ঘন্টা কেটে গেল, ক্ষণে ক্ষণে লেখার টেবিলে ফিরে এসে চেষ্টা করতে করতে এভাবেই কয়েকটা দিনও কেটে গেল। তারপর একদিন খুব ভোরে উঠে তিনি মাসজিদে যাবেন বলে মনস্থির করলেন, অযু করে এসে আযানের ডাক শুনলেন, ঘড়িতে দেখলেন, জামাত শুরু হতে তখনো চল্লিশ মিনিট বাকী। তাকে আলস্য ঘিরে ধরলো। তিনি ঘরে বসেই ফযরের নামায পড়ে পুনরায় শুয়ে পড়লেন। চোখটা কেবল লেগে এসেছিল, এমন সময় আবার একটা স্বপ্ন দেখে তিনি একটু ধরফর করেই উঠলেন, কারণ স্বপ্নটাকে তার কাছে নেতিবাচক, বিয়োগাত্মক মনে হলো। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন, আকাশটা কেবল ফর্সা হতে শুরু করেছে, কিছু কাক পাখিও ডাকাডাকি শুরু করেছে। তিনি অস্বস্তির সাথে অনুভব করলেন, এটাই তো প্রকৃত “ভোরের সময়”!
হক সাহেব অনেক আলেম উলামা, বুজর্গ ব্যক্তির কাছে এ কথাটা শুনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন যে প্রত্যেক মানুষ তার মৃত্যুর আগে একটা আগাম বার্তা পেয়ে যায়। হয়তো এটাই হবে তার সেই বার্তা। তিনি খুব ধীর স্থিরভাবে লেখা শুরু করলেনঃ আমি অদ্য .... তারিখে ধীর স্থিরভাবে, সুস্থ মস্তিষ্কে আমার ওয়ারিশগণের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত ওসিয়তনামাটি লিখিয়া যাইতেছি.... কিন্তু এটুকু লেখার পর তিনি আর এগোতে পারছিলেন না। কি লিখবেন তিনি ওসিয়তনামায়? স্বপ্নদুটোর কথা ভাবতে ভাবতে, কোথা থেকে শুরু করবেন তা নিয়ে চিন্তা করতে করতে তার মাথায় একটা আজব কল্পনা এসে গেল-তার একটা হার্ট এ্যাটাক হতে যাচ্ছে। তিনি এর আগে বহুবার মুমূর্ষ আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব এবং তাদের পরিবারের সদস্যদেরকে দেখতে হাসপাতালের আইসিইউ তে গিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ কোমায় ছিল, কেউ কেউ সজ্ঞান থাকলেও, নাকে মুখে, পেটে বুকে নানা রকম মেশিনের নল টল ইত্যাদি লাগানো অবস্থায় তারা কথা বলার মত সুস্থ ছিল না। এখন তেমনই একটা অবস্থায় হাসপাতাল শয্যায় তিনি নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি এই ভেবে কষ্ট পাচ্ছিলেন যে যারা তাকে দেখতে আসবে, তারা প্রথমে ব্যথিত হবে, দায়িত্ববোধের কারণে বারবার দেখতে এসে ক্লান্ত হয়ে যাবে, তারপর একদিন তিনি শেষ নিঃশ্বাসটুকু ছেড়ে দিলে তারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়বে।
এইতো কিছুদিন আগেই এক দোয়া মাহফিলে তিনি একজন মাওলানাকে বলতে শুনেছেন, কেউ মারা গেলে তার আখেরী গোসল ভাড়া করা লোক না ডেকে নিকটাত্মীয়দের দ্বারা সম্পন্ন করা উচিত, যেমন বাবা ছেলেদেরকে, ছেলেরা বাবাকে, মা মেয়েকে কিংবা মেয়েরা মাকে, ইত্যাদি। তিনি দেখেছেন যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের মুহূর্তে অনেকেই কষ্টে পায়খানা পেশাব করে দেয়। এটা ভেবে তিনি অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন যে ঐ অবস্থায় কে তাকে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে গোসল দেবে? ছেলেদের মুখ তার মনে ভেসে ওঠে, তিনি তাদের প্রতি ভীষণ মায়া অনুভব করেন, কারণ তারা এর আগে কখনো এ কাজ করেনি। তারপর তিনি ভাবতে লাগলেন, তার প্রস্থানে কে বেশী অসহায় বোধ করবে। প্রথমেই তিনি তার স্ত্রীর কথা স্মরণ করে এতই ব্যথিত বোধ করতে শুরু করলেন যে তিনি লেখা থামিয়ে বেডরুমে গিয়ে তার ঘুমন্ত স্ত্রীর মুখের দিকে নির্বিকার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। আহা! হক সাহেবের তেমন কোন অসুখ বিসুখ ছিল না বলে তার মৃত্যুর কথাটা বেচারা কখনো চিন্তায়ই আনেনি! আচানক যখন খবর পাবে তিনি আর এ জগতে নেই, তখন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে! টেবিলে ফিরে এসে তিনি আবার লেখা শুরু করলেনঃ
১। আমার যদি শেষ সময়ে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছানোর সৌভাগ্য হয়ে থাকে, তবে যারা আমাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাবে, তাদের জন্য আমি আগাম দোয়া করে যাচ্ছি। তারা যেন দুনিয়াতে ও আখেরাতে ভাল থাকেন, ঐশ্বরিক কল্যাণে থাকেন। আমার সন্তানেরাও তাদের সাথে আজীবন সদ্ব্যবহার করবে, বিনয়ী থাকবে।
২। যেসব ডাক্তার, নার্স শেষ সময়ে আমার প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে যাবে, আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন তাদেরকে জাযা খায়ের দিন, হেফাজত করুন! দুনিয়া থেকে আখেরাতে তাদের যাত্রাটাও যেন নির্বিঘ্ন ও শান্তিময় হয়!
৩। যদি হাসপাতালে যাবার ভাগ্য আমার না হয়, তবে যেখানেই মৃত্যু হোক, শেষ সময়ে যারা আমার পরিচর্যা করবে, আল্লাহ পাক তাদেরকেও জাযা খায়ের দিন, হেফাজত করুন!
৪। যারা আমাকে শেষ গোসল দিয়ে পবিত্র করবে, আল্লাহ তাদেরকে সকল পাপ থেকে চিরপবিত্র রাখুন।
৫। যে ইমাম সাহেব আমার জানাযায় ইমামতি করবেন, আল্লাহতা’লা তাকে নির্ভুলভাবে ইমামতি করার তৌফিক দিন। যারা আমার নামাযে জানাযায় অংশ নিবে, আল্লাহ তাদের সকলের সহায় হউন, তাদেরকে জাযা খায়ের দান করুন!
৬। আমার যে ছেলে বা নিকটাত্মীয় জানাযা শুরুর আগে আমার হয়ে উপস্থিত মুসল্লীদের কাছে মা’ফ চাবে এবং আমার রেখে যাওয়া দায় দেনা পরিশোধের দায়িত্ব নেবে, আল্লাহতা’লা যেন তার কাঁধ থেকে সকল বোঝা অপসারণ করে দেন, তাকে দুনিয়াতে ও আখেরাতে অশেষ কল্যাণ দান করেন। এ কঠিন কাজটা করার সময় অনেকে বেদনায় বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, তাদের কন্ঠে দলা পাকিয়ে যায়। তারা অশ্রুসিক্ত, বাষ্পরুদ্ধ হয়ে কিছুই বলতে পারে না। আল্লাহ তার জন্য যেন এ কঠিন কাজটা সহজ করে দেন!
৭। যারা আমার মরদেহ নিজ কাঁধে বহন করে ক্ববরে নিয়ে যাবে, আল্লাহতা’লা তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক বোঝা লাঘব করে দিন! দুনিয়াতে তাদেরকে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত রাখুন!
৮। যেসব গোরখোদক আমার শেষ আশ্রয়স্থল, আমার ক্ববর প্রস্তুত করবে, তারা যখন ক্ববরে যাবে, আল্লাহ তাদের ক্ববরকে শান্তিময় করে দিন।
৯। যারা আমার দাফন কার্যে এবং আখেরী দোয়ায় অংশ নেবে, আল্লাহ রাব্বুল ‘আ-লামীন তাদের সকলের সহায় হউন এবং তাদেরকে হেফাযত করুন।
১০। দাফনের পর হতে ক্বেয়ামত পর্যন্ত যদি কোন সহৃদয় ব্যক্তি আমাকে স্মরণ করে আল্লাহ পাকের দরবারে আমার পারলৌকিক মুক্তির জন্য দোয়া খায়ের করেন, আল্লাহ পাক যেন তাকে সপরিবারে শান্তিতে রাখেন এবং তাকে ইহলৌকিক এবং পারলৌকিক কল্যাণ দান করেন!
১১। দুনিয়াতে থাকা অবস্থায় যারা আমার প্রতি সদয় ছিলেন, আমাকে স্নেহ ভালবাসা, মায়া মমতা, ক্ষমা করুণা, সহানুভূতি সমবেদনা দিয়ে সুরক্ষা করেছিলেন, শান্ত করেছিলেন, সমৃদ্ধ করেছিলেন, আল্লাহতা’লা যেন তাদেরকেও তাঁর রহমতের, বরকতের, হেফাযতের, হেদায়াতের, সালামতের, মাগফিরাতের, কুবলিয়াতের সুশীতল ছায়াতলে সুরক্ষা করে রাখেন, আজীবন আশ্রয় দিয়ে রাখেন!
এটুকু লিখতে লিখতেই হক সাহেবের চোখদুটো আর্দ্র হয়ে আসছিল, চোখের পাতা দুটো খুব ভারী হয়ে আসছিল। কবিতাপ্রেমী হক সাহেবের মননে অনুরণিত হচ্ছিল ওয়াল্ট হুইটম্যান এর একটা বিখ্যাত উক্তিঃ “....Nothing can happen more beautiful than death.''
কলমের খাপটাকে খোলা রেখেই তিনি আস্তে করে টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন।
ঢাকা
৩০ মার্চ, ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১০:০৭