হক সাহেব কবিও নন, লেখকও নন, তবে একনিষ্ঠ সাহিত্যানুরাগী। জীবনে খুব যে বেশী সাহিত্য পড়েছেন তাও নয়; কিন্তু সাহিত্য, সঙ্গীত ও শিল্পকলার প্রতি তার একটা আকর্ষণ সেই ছেলেবেলা থেকেই ছিল। নিজে ভাল গাইতে না পারলেও ভাল লাগা গানের কলি সবসময় তার কন্ঠে আশ্রয় খুঁজতো। গলা যেমনই হোক, সময় সুযোগ পেলেই তিনি নিবিষ্ট মনে সেসব কলি মেলে ধরতেন, সুর মেলাতেন। বিশ্বের বড় বড় কবি লেখকদের সম্পর্কে তিনি কিছুটা ধারণা রাখতেন, তাদের অমর সৃষ্টিসমূহের নাম জানতেন, কিন্তু আগ্রহ এবং আকর্ষণটা খুব বেশী তীব্র না থাকায় সেগুলো সংগ্রহ করে পড়েন নি। নিজে কখনো আঁকাআঁকি করেন নি, এ ব্যাপারে একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু তার বাসার নিকটস্থ ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে কোন আর্ট এক্সিবিশনের খবর পেলেই হাজির হতেন, প্রদর্শিত ছবিগুলো দেখে শিল্পীর ভাবনার কথা ভাবতে ভালবাসতেন। বয়ঃসন্ধিকালে একটি হিন্দী গান তার মনে গেঁথে গিয়েছিল- “সাওয়ান কা মাহিনা পাওয়ান কারে শোর”। সে সময় তিনি হিন্দী মোটেই জানতেন না, বুঝতেন না। জীবনে তখনো একটিও হিন্দী ছবি দেখেন নি, কিন্তু তবুও নুতন ও সুনীল দত্ত অভিনীত “মিলন” ছবির এ গানটি তিনি যখনই শুনতেন, তখনই একটা ঘোরের মধ্যে চলে যেতেন। কিন্তু কেন? তিনি কি গানের কথাগুলো তখন বুঝতেন? তখন কেন, এখনও কি বুঝেন? না, বুঝতেন না, এখনো তেমন বুঝেন না। কিন্তু তিনি আচ্ছন্ন হন সুরে। প্রথম যখন তিনি এ গানটা শোনেন, তখন তিনি ডর্মে থাকতেন। তার এক রুমমেট খুব ভাল গান গাইতে পারতো, কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই। সেই রুমমেট যখন এই গানটি গাইতো, তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন। গান শেষ হলে তার কাছে উঠে গিয়ে তিনি গানের অর্থ জিজ্ঞেস করতেন। তার বন্ধুটিও জানতো না। ডিশ টিভি তখন ছিলনা, তাই হিন্দীও লোকে বুঝতো না। তবে এ গানটি তারা উভয়ে না বুঝেই ভালবাসতেন, গাইতেন। গানের সুরের সাথে একাত্ম হয়ে যার যার নিজের মত করে ভাবতে ভাবতে কল্পনার ডানা মেলে সপ্তাকাশে বিচরণ করতেন।
এর অনেক পরে মধ্যবয়সে এসে হক সাহেব “মিলন” ছবিটি দেখেছিলেন। গানের পিকচারাইজেশন দেখে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিলেন। গান শেখার সময় নায়িকার অভিব্যক্তি, নীলাকাশের ছায়া প্রতিফলিত নীল জলের নদীবক্ষে দোদুল্যমান নৌকোয় মাঝি এবং নায়িকা মিলে ময়লা ও তালিযুক্ত পাল ওড়ানোর দৃশ্য (বাস্তবচিত্র), মাস্তুলে বেঁধে রাখা মাঝির খোরাক বহনকারী টিফিন ক্যারিয়ার, ইত্যাদি খুঁটিনাটি বিষয়ে চিত্র পরিচালকের সজাগ দৃষ্টি দেখে তিনি খুবই ইমপ্রেসড হয়েছিলেন। শিল্পী, কবি, লেখকদের এই দৃষ্টির সাযুজ্য দেখে তিনি সৃষ্টির অভিন্ন যোগসূত্রতা অনুভব করেছিলেন। সাঁঝের নদীতে প্রতিফলিত অস্তগামী সূর্যের সোনালী রশ্মিতে ভাসমান ঢেউ এ নৌকো চালিয়ে ওদের গান গাওয়া, চন্দ্রালোকিত রাতে লন্ঠনের মৃদু আলোয় নির্জন নদীর বুক চিরে নৌকো বেয়ে চলার সময় গানের সুরে ওদের কথোপকথন, ইত্যাদি তিনি মোহাবিষ্ট হয়ে শুনেছিলেন, দেখেছিলেন। বিশেষ করে মাঝি যখন বলছিল, নদীর জলধারা তাকে জিজ্ঞেস করছে ‘কোথায় চলেছো’? নায়িকা তখন বলেছিল ‘মর্জি তোমার, যেখানে খুশী নিয়ে চলো’ – তাদের এই প্রেমের কথোপকনটুকু তাকে জীবনের গন্তব্য সম্বন্ধে ভাবিয়েছিল।
এর পর তিস্তা যমুনা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে, প্রমত্তা নদীগুলো শীর্ণ হয়ে গেছে। সেই নদীগুলোতে হক সাহেব এখন নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পান। শীর্ণ হলেও, সেসব নদী দিয়ে এখনো পাল তোলা নৌকো চলে, নারীরা সে নৌকো চড়ে ছেলেপুলে নিয়ে নাইওর যায়, চন্দ্রালোকিত জ্যোৎস্না রাতে মাঝির দল কন্ঠে ভাটিয়ালি সুর ধরে। হক সাহেব দু’চোখ বন্ধ করে এসব দেখতে পান, এবং মনে মনে একটা প্রচ্ছন্ন সুখ অনুভব করেন। মাঝে মাঝে তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন, তিনি কি জীবনে সুখী? অধুনা তিনি নিজেও কিছু লেখালেখি শুরু করেছেন। এটা করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছেন, কবি লেখকেরা মানুষের দুঃখবোধ নিয়ে নাড়াচাড়া করেন, কখনো কখনো তা নিজের দুঃখবোধ কিংবা অভিজ্ঞতার সাথে মিলিয়ে দেখেন, আর তার পরে হয়তো লিখে ফেলেন একটি অনবদ্য কবিতা, গল্প কিংবা গদ্য। কিন্তু আদতে মানুষ নিজে সুখী না হলে অন্যের দুঃখ নিয়ে লিখতে পারে না, কারণ দুঃখী লোকের সময় কোথায় এসব নিয়ে লেখার? এ ছাড়া একজন দুঃখী লোক যতক্ষণ দুঃখী থাকে, ততক্ষণ সে নিজের দুঃখটাকে কিংবা তার জানা অন্যের দুঃখকেও গোপনই রাখতে চায়। তবে নিজেকে সুখী ভাবলেও, হক সাহেবকে অন্যের দুঃখ খুব সহজেই স্পর্শ করে। তখন তিনি মনে একটা ভার অনুভব করেন। তার চিন্তাভাবনা, গতিবিধি, কাজ কারবার সব কিছুই শ্লথ হয়ে যায়। তিনি আশ্রয় খুঁজেন কোন কল্পনায়, কবিতায়, প্রার্থনায় কিংবা সঙ্গীতে।
হক সাহেব সেদিন হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, তার দেখা জীবনেও তো এমন অনেক উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যেগুলো দিয়ে বেশ চমৎকার কিছু গল্প লেখা যায়। তিনি বসে গেলেন একটা গল্প লিখতে। গল্পটা লিখা শুরু করে তিনি এগোতে পারছিলেন না। তিনি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে উপলব্ধি করলেন, এ গল্প লেখা তার কাজ নয়। গল্পের নায়িকাকে তার কাছে মনে হচ্ছিল দেবীতুল্য। তার অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক সৌন্দর্যকে কিছুতেই তিনি সঠিক মাত্রায় উপস্থাপন করতে পারছিলেন না। তার মুখে কোন সংলাপই তুলে দিতে পারছিলেন না। দেবী না মানবী, সারল্য না সৌন্দর্য, বাস্তব না কল্পনা, ইত্যাদি দ্বন্দ্ব তার কলমকে নিশ্চল করে দিচ্ছিল। তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল, কন্ঠে বাষ্প দলা পাকাচ্ছিল। উপায়ন্তর না দেখে তিনি কলম থামিয়ে দিলেন, ইউ টিউবের আশ্রয় নিলেন। খুঁজে বের করলেন একটি গান, যে গানের অর্থ তিনি আজও ঠিকমত জানেন না, কিন্তু যে গান তাকে সহজেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়- “সাওয়ান কা মাহিনা পাওয়ান কারে শোর”।
ঢাকা
১২ মার্চ, ২০১৮
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সাওয়ান কা মাহিনা পাওয়ান কারে শোর
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৮ সকাল ১১:৪৭