আমাদের এ ক্ষুদ্র জীবনে আমরা কতজনের সাথেই স্নেহ ভালবাসা, মায়া মমতার অটুট বাঁধনে আবদ্ধ হই ও থাকি। কারো সাথে জন্ম থেকেই, যেমন বাবা মা, ভাই বোন এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে, আবার কারো সাথে মায়া ভালবাসার ডোরে আবদ্ধ হই জীবন-পথে চলতে গিয়ে। কখনো সে বাঁধন চির অটুট থেকে যায়, আবার কখনো পারস্পরিক দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে সে বাঁধন ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে যায়।
সবচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধন মা ও সন্তানের ভালবাসার বন্ধন। জন্ম দেয়া ও নেয়া থেকেই এ বন্ধনের শুরু। স্তন্যদান এবং পানের মাধ্যমে এ সম্পর্ক নিবিড় হয়। দিন যত গড়াতে থাকে, এ বন্ধন ততই দৃঢ় হতে থাকে। শিশু বড় হয়ে যখন প্রথম স্কুলে যায়, তখন থেকেই সাময়িক এই বিচ্ছেদকালে উভয়ে উভয়ের জন্য প্রথম মনে একটা হাল্কা ব্যথা অনুভব করে। কোন কোন শিশু স্কুলে যাবার সময় তীব্র কান্না জুড়ে দেয়, কিছু কিছু মা ও নীরবে অশ্রুপাত করেন। কেউ কেউ বাচ্চার সাথে স্কুলে গিয়ে সারাটা সময় সেখানেই কাটান, আবার স্কুল ছুটির পর উভয়ে হাসিমুখে বাসায় ফেরেন। যেসব শিশুর বড় বোন থাকে, স্কুলে যাওয়ার সময় তাকে তৈরী করে দেয়ার কাজটা অনেক সময় বড় বোনও পালন করে থাকে- যেমন ঘুম থেকে তুলে মুখ ধুইয়ে দেয়া, কাপড় পরিয়ে দেয়া, গায়ে মুখে লোশন ক্রীম মাখিয়ে দেয়া, চুল আঁচড়িয়ে দেয়া আর তারপরে আদরে গালটা একটু টেনে দেয়া, ইত্যাদি। স্কুল চলাকালীন সময়ে দৃষ্টির আড়ালে থাকার ব্যাপারটি এক সময় গা সওয়া হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘ বিচ্ছেদের পালা শুরু হয় শিশুটি যখন বড় হয়ে ক্যাডেট কলেজে যায় কিংবা এসএসসি পরীক্ষা পাশ করে ভাল কলেজে পড়ার জন্য দূরে কোথাও যায়। শহরের ছেলেমেয়ে কিংবা মা দের এই পরের অভিজ্ঞতাটুকু হয়না কারণ আশেপাশেই তারা ভাল কলেজে ভর্তি হতে পারে, কিন্তু মফস্বলের ছেলেমেয়েদের তা হয়। আমি ঢাকা শহরে বড় হয়েছি। তৎকালীন সময়ে ঢাকার একটা ভাল স্কুলেই পড়ার সময় সপ্তম শ্রেণীতে উঠে ক্যাডেট কলেজে পড়ার সুযোগ অর্জন করি। আমার মনে আছে আমি যেদিন প্রথম ক্যাডেট কলেজে যাই, তার বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই আমার মা আমার জন্য আমার পছন্দের বেশ ভাল ভাল খাবার রান্না করে আমাকে খাওয়াতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু যাওয়ার দিন কোন খাবারই যেন আমার গলা থেকে নীচে নামছিল না। এরকম হতো প্রতিবারই, যখন ছুটিতে এসে কয়েক সপ্তাহ বাসায় থেকে আবার কলেজে ফিরে যেতাম। যেদিন কলেজে ফিরতাম, সেদিন যতদূর দেখা যায় মা আমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতেন, আমিও ফিরে ফিরে তাকাতাম। দৃষ্টির আড়াল হবার পরে হয়তো শূণ্য বুক নিয়ে মা আবার নিজ কাজে মন দিতেন। আমার এস এস সি পরীক্ষার আগের বছরে আমার বাবা সরকারী চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করে গ্রামের বাড়ীতে বসতি গড়েন। তখন কলেজ ছুটি হলে গ্রামের বাড়ীতে যেতাম। সে সময়ে, এবং আরও বড় হয়ে যখন কর্মজীবনে প্রবেশ করি, তখন মাঝে মাঝে কোন খবর না দিয়ে বাড়ী ফিরতাম হঠাৎ হঠাৎ। ট্রেন বিলম্বে চলার কারণে কখনো কখনো অনেক রাত হয়ে যেত। অবাক হয়ে তখন দেখতাম, মধ্যরাতেও মা একডাকে দরজা খুলে দিতেন। এত রাতেও জাগা কেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, আমার মন বলছিল তুই আজ আসতে পারিস। এটাই ভালবাসার টেলিপ্যাথী।
গতকাল আমার মেজ বৌমাকে বিদায় জানানোর জন্য বিমানবন্দরে গিয়েছিলাম। ওর সাথে ওর ছোটভাই এর স্ত্রীও যাচ্ছিল। বৌমা এবং ওর ছোটভাই- ওরা দুই ভাইবোন একসাথে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করেছে। ভাইটি এখন সেখানেই চাকুরী করছে আর বৌমা মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে অপর একটি বিষয়ে মাস্টার্স করছে। ভাইটি কিছুদিন আগে দেশে এসে বিয়ে করে যায়, এখন তার স্ত্রীও তার সাথে যোগ দেয়ার জন্য বৌমার সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। ওদের তিন ভাই বোনের মধ্যে বৌমার ভ্রাতৃবধূ সবার বড়, মাঝে এক ভাই, সবার ছোট এক বোন। তবে দুই বোনের মধ্যে বয়সের ব্যবধান ১৩/১৪ বছরের। তা সত্তেও ওরা একে অপরের সাথে ভীষণভাবে এ্যাটাচড। বড় বোন শৈলীর বিয়ের সময় মহা ধুমধাম আর আনন্দ করার সময় ছোট বোন সুবহা মোটেই বুঝতে পারেনি যে তার এতদিনের নিকটতম সাথী তাদের বাড়ী ছেড়ে অন্য বাড়ীতে চলে যাবে। বিয়ের পর শৈলী যখন শ্বশুরবাড়ী চলে গেল, সুবহা তখন ভীষণ মুষড়ে পড়েছিল। পরিবারের সবাই ওকে স্নেহভরে আদর করে অনেকভাবে বুঝাতে চাইতো, কিন্তু ও কিছুতেই বুঝতে চাইতোনা, শৈলী কেন ওকে ছেড়ে অন্য বাড়ীতে চলে গেল। কেউ বেশী বুঝাতে চাইলে ও চুপ করে থাকতো। রাতে শুয়ে শুয়ে ও নীরবে কেঁদে চলতো। ওর মা সেটা টের পেয়ে ওকে নানাভাবে সান্তনা দিতেন, কিন্তু এতে তার কান্না আরও বেড়ে যেত। ওর বুকটা বড়বোনের জন্য শুধুই হাহাকার করতো। কচি মনে ও ভেবেই পেতনা, কেন ওর এত ভালবাসার বোনটা ওদেরকে ছেড়ে গৃহত্যাগ করে চলে গেল। এভাবে প্রায় বছরখানেক কেঁদে কেঁদে ও যখন এ পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসছিল, তখনই আবার আচমকা ওর বোন ও পরম বন্ধু ওকে ছেড়ে স্বামীর সাথে যোগ দেয়ার জন্য বিদেশ পাড়ি দিচ্ছিল। এটা ছিল তার জন্যে আরো বেশী দুঃখের। এতদিন তাও ও বোনের শ্বশুরবাড়ীতে যাওয়া আসা করে এবং সেখানে মাঝে মাঝে থেকে, কিংবা তার বোনও মাঝে মাঝে তাদের বাসায় এসে থেকে ওর সাথে সময় কাটাতো এবং ওরা উভয়ে সাময়িক বিচ্ছেদের ব্যথাটুকু ভুলে যেত। কিন্তু এখন তো বোন স্থায়ীভাবে বিদেশ চলে যাচ্ছে- এটা ভেবে সুবহা ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিল, বাহিরে দেখা যাচ্ছিল শুধু তার গাল বেয়ে নীরবে ঝরা অশ্রুফোঁটা। ওর বোন যখন চেক-ইন এর লাইনে দাঁড়িয়ে, ও তখন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিল এবং ওর কচি মনে না জানি কত কিছু ভাবছিল। ছোটবেলায় আমার দাদীমা (আমরা আমাদের দাদীকে ‘দাদীমা’ বলে ডাকতাম) আমাকে তার এমনি এক প্রিয় ছোটবোনের গল্প বলেছিলেন। অল্প বয়সে বিয়ের জন্য (দশ বছরে) বোনের কাছ থেকে সেই যে তিনি পৃথক হয়েছিলেন, আর তার সাথে জীবদ্দশায় কোনদিন তাঁর দেখা হয়নি। তিনি বলেছিলেন, বোনেরা নদীর মত। একই উৎস থেকে জন্মলাভ করে তারা কিছুটা পথ একসাথে পাড়ি দেয়। তারপর কোন এক অদৃশ্য শক্তির টানে তাদের যাত্রাপথ পৃথক হয়ে যায়। জগতের বুকে তারা স্বাধীনভাবে ভিন্ন পথ মাড়িয়ে আবার মিলিত হয় কোন মোহনায় (বৃদ্ধ বয়সে), কিংবা সাগরে (মৃত্যুর পরে)। খুব ছোটবেলায় দাদীমার মুখে এ দর্শন বাক্যটি শুনেছিলাম, কিন্তু কথাটা আজীবন আমার মনে গেঁথে আছে। দুই কিশোরী বোনের মাঝে আমি যখনই খুব মিল দেখি, তখনই আমার এ কথাটি খুব মনে পড়ে। আজকের এই আধুনিক যুগে হয়তো কথাটা ততটা সত্য নয়, কিন্তু মূল দর্শন বোধকরি আজও ঠিকই ওরকমটি আছে। চেক-ইন শেষে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাবার আগে শৈলী যখন শেষ বিদায় নিতে ওর কাছে এলো, তখন উভয়ে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলো। ওদের কান্না দেখে আমার গলা শুকিয়ে, বুকটা ভারী হয়ে আসছিল। ভাবছিলাম, স্নেহ-আদর-ভালবাসাকামী মানুষের মনকে বিচ্ছেদ কিভাবে ভেঙেচুরে তোলপাড় করে দেয়!
ওখানে দাঁড়িয়েই দেখছিলাম এক প্রৌঢ়া মা তার যুবক ছেলেকে ইমিগ্রেশনে ঢোকার আগে কিভাবে বুকে টেনে নিয়ে অশ্রুভেজা চোখে তার মাথায়, কপালে, গায়ে মুখে স্নেহচুম্বন দিয়ে যাচ্ছিলেন। ছেলেটিও মাকে বুকে চেপে ধরে রাখছিল। মানুষের গাল দুটো হচ্ছে ভালবাসার মাটি দিয়ে গড়া। কাউকে ভালবাসতে ইচ্ছে হলে, আদর করতে ইচ্ছে হলে আমরা গালে গাল স্পর্শ করি, গালে চুমু দেই। মা তাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল লাগিয়ে অনর্গল উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, ছেলেটাও নীরবে তা শুনে যাচ্ছিল। দুই একজন কাপলকেও দেখলাম তাদের স্পাউসকে (বোধকরি) বিদায় দেয়ার প্রাক্কালে নিবিড় আলিঙ্গণে একে অপরকে শেষ সময়ের কত কথা বলে যাচ্ছে! মনে পড়ে গেল আমেরিকার ডালাস বিমানবন্দরে দেখা এক সাদা যুগলের কথা। শেষ বিদায়ের সময় ওরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো, কারো মুখে কোন কথা নেই। ছেলেটার মুখটা আমার দিক থেকে দেখা যাচ্ছিল। দেখলাম তার দুচোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। ওরা নীরবে নিশ্চুপ শুধু দাঁড়িয়েই থাকলো। মুখে কোন কথা না বললেও মনে মনে নিশ্চয়ই ওদের মাঝে ভাবের আদান প্রদান হচ্ছিল। ভাব প্রকাশের এটাও এক অপরূপ অভিব্যক্তি। অনেকক্ষণ পর ওরা আলিঙ্গণমুক্ত হয়ে একে অপরের দিকে তাকালো। উভয়ের মুখে একটা মলিন কিন্তু স্বর্গীয় হাসি, চোখে জলের চিকিমিকি। তারপর পরস্পরকে আলতো চুম্বন দিয়ে ওরা হাসিমুখেই বিদায় নিল। হাসিটুকুই হয়ে থাকলো শেষ মুহূর্তের স্মৃতি। আমার মনে একটা ভুল ধারণা ছিল, পশ্চিমী দুনিয়ার লোকেরা বোধহয় আবেগ অনুভূতির এতটা ধার ধারেনা। কিন্তু ওদেরকে দেখে আমার সে ভুল ভেঙেছিল। বিদায়লগ্নে এসব অকৃত্রিম ভালবাসার অভিব্যক্তির কথা ভাবতে ভাবতে বাড়ী ফিরে এলাম। তবে মনের কোণে একটা বিষণ্নতা চেপে বসলো। আর ৫/৬ সপ্তাহ পরে আমাকেও আমার ভীষণ আদরের এক ছোট্ট টুনটুনি পাখিকে শুভবিদায় জানাতে হবে। বাবা মায়ের সাথে সে শীতের দেশ কানাডা চলে যাবে, রেখে যাবে আমার শূন্য বুকে ব্যথার বরফ। অবুঝ সেই শিশু হয়তো আমার বুকের এ ব্যথাটা বুঝবেনা, কিন্তু আমি তার বিরহে এ ব্যথা সামলাবো কিভাবে?
(ছবিসূত্রঃ গুগল)
ঢাকা
২৩ জুলাই ২০১৭
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:০৪