সে অনেক অনেক দিন আগের কথা, আমি তখন ছোট আমার পিঠেপিঠি ভাইবোনরাও ছোট ছোট। আমি আগেও বলেছি আমার আব্বা উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা হলেও তার মনটি ছিল অনেক নরম আর সবুজ। যেমন ন্যায়বান, তেমনি ধার্মিক, তেমনি স্মার্ট আবার তেমনি সাহিত্য প্রিয়। আব্বা খুব সৌখিন ছিলেন, আমাদের বাসায় যেমন প্রচুর গল্পের বই ছিল সাথে ছিল নানা রকম ফুল-ফলের গাছ। এ ছাড়াও ছিল বিদেশি কুকুর, বিড়াল, টিয়া, ময়না, হাস, আর মুরগীর দল। বড় বড় মুটু মুটু মোরগ-মুরগীগুলো ছিল বিখ্যাত লেগহর্ন জাতের। এই মুরগী পরিবারে আব্বা কোথা থেকে যেন উপরের ছবির মত দুটো বড় বড় মোরগ এনেছিল। তাদের অসাধারণ সৌন্দর্য নিয়ে তারা গর্বিত ভংগিতে আমাদের বাসার পেছনের ঘেরা দেয়া উঠানে ঘুরে বেড়াতো আর খানিক বাদে বাদেই কোকোর কো বলে ডাক দিয়ে উঠতো।
আমাদের প্রিয় মোরগ দুটোকে দেখলেই সদ্য বানান করে পড়া মোরগ আর খেকশেয়ালী উপকথার ছড়াটা মনে পড়তো। ভাইয়া একটু বড় ছিল বলে আমাদের দলে থাকতো কম। আমরা তিন ভাই বোন হাতে চাল নিয়ে বারান্দার রেলিং এ ভর দিয়ে সেই উপকথার ছড়া বলতাম,
"মোরগ ভায়া,মোরগ ভায়া
মাথায় ঝুটি, হলুদ ছায়া,
তেল চুকচুক তোমার গা
রেশমি তোমার দাড়িটা,
জানলা দিয়ে মুখ বাড়াও
মটরশুঁটি নিয়ে নাও "
মোরগ গুলো কাছে না আসলে ছড়াটার বাকি অংশ বলতাম
"ছড়িয়ে দিলাম গমের দানা,
মুরগীরা সব খুটে খেল,
পায়না কেন মোরগগুলো"!
এরপর কোকর কো কোকর কো করতে করতে মোরগদুটো এসে আমাদের ছিটানো চাল খেত। একবার ঈদের সময় আব্বা আম্মা সিদ্ধান্ত নিল বাইরে থেকে কেনা কিছু মুরগীর সাথে একটা মোরগ জবাই করা হবে। আমরা কিছু জানিনা হঠাৎ মোরগের চিল চিৎকারে আমরা ছুটে আসলাম। কি ব্যাপার জবাইর জন্য আলী ভাই আর আমাদের গৃহকর্মীর হাতে মোরগ। আলী ভাইর হাতে ছুরি। আমরা সাথে সাথে এমন কান্না জুড়ে দিলাম যাকে বলে মড়াকান্না। পাড়া প্রতিবেশীদের ছুটে আসার অবস্থা। আমার ছোট ভাইতো মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কাদছে। এমনকি আমার বড় ভাইও খেলা ফেলে হাজির। আমাদের এই অবস্থা দেখে দুই বার ধরে দুই বার ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন আব্বা।
আমার এত কাহিনীর মুল বিষয় হলো সেদিন একটা ভিডিও দেখছিলাম, তাতে নায়ক হলো উপরে ছবির মত এক মোরগ এক সবুজ ঘাসের উঠানে চরে বেড়াচ্ছে সাথে অদেখা দুজন মানুষের কন্ঠ। শুনে মনে হলো একজন প্রাপ্ত বয়স্ক আর একজন নিতান্তই বাচ্চা মেয়ে শিশুর কচি কন্ঠ। মোরগটা দেখেই শিশুটি বলে উঠলো, ওকে আমি খাবো,বাবা ওকে আমি খাবো আমি বিস্মিত এবং ব্যাথিত হয়েছিলাম ঐটুকু ভিডিও দেখে। পুরোটা দেখার ইচ্ছে হয় নি। আমাদের কিশোর সন্তানরা কুকুর জবাই করে মাংস বিক্রি করছে। অকারণে ঢিল মেরে পাখির বাসা ভেংগে বাচ্চাগুলোকে পা দিয়ে চেপে মারছে!
আমরা পশ্চিমাদের বকাবকি করি, তাদের অনুভূতিহীন হার্টলেস বলি, কিন্ত কিছু কিছু ভিডিওতে দেখি ক্রিসমাস বা কোন উপলক্ষে বাবা মায়েরা বাচ্চাদের বিড়াল বা কুকুর ছানা উপহার দিলে তারা খুশিতে কাদতে থাকে।
এসব দেখে আজ কদিন ধরে আমার শুধুই মনে হচ্ছে আমরা আমাদের সন্তানদের কি শিখাচ্ছি! আমরা কি একদল কঠিন হৃদয় আর দয়ামায়াহীন নিষ্ঠুর সন্তানদের রেখে যাচ্ছি এই ধরনীতে!!
ছবি নেট।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:১৬