জেটিতে বাঁধা টায়ারের উপর ঝিনুক দিয়ে প্রকৃতির নিজস্ব কারুকাঁজ যা এখন এক কফি শপের দেয়ালের শোভাবর্ধন করছে
সে অনেক বছর আগের কথা, আমার বই পাগল বাবা এক সন্ধ্যায় নীল মলাটের দুটো বই নিয়ে বাসায় ঢুকলেন। বই এর পোকা আমরা ভাই-বোনেরা ঝাপিয়ে পড়লাম বাবার হাতের উপর। বাবা আমাদের সরিয়ে দিয়ে বই দুটোতে নাম- ধাম, সন- তারিখ লিখে আমাদের হাতে তুলে দিলেন। দেখি সেই নীল মলাটের উপর মোটা করে সোনালী হরফে লেখা জেলের ছেলে আর তার উপরে আমাদের অচেনা এক লেখকের নাম ভিলিস লাৎসিস।
জেলের ছেলে বইটির মলাটের ভেতরের দিকে লেখা নাম
লেখক ভিলিস লাৎসিস ছিলেন তদানীন্তন সোভিয়েত রাশিয়ার অধীন বাল্টিক সাগরের তীর ঘেষা ক্ষুদ্র রাজ্য লাৎভিয়ার রাজধানী রিগার এক সাধারন দিনমজুর, অবসর কাটতো তার লেখালেখি করে। পরবর্তীতে নিষিদ্ধ ঘোষিত কম্যুনিষ্ট পাট্টির কট্টর এক সদস্য লাৎসিস ঐ মজুর জীবনে থাকার সময়ই এই গল্পের প্লট খুজে পান আর রচনা করেন জেলের ছেলে উপন্যাসটি যা তাকে বিখ্যাত করে তুলেছিল একজন লেখক হিসেবে। বলা নিস্প্রোয়জন দরিদ্র জেলেদের সংগ্রাম ও তার সাফল্য নিয়ে দুটো খন্ডের এই উপন্যাসটি লাৎসিস রাশিয়ান সাহিত্যের উচুতলার ক্রিটিকদের পাতে তুলে ধরতে না পারলেও সাধারন জনগনের কাছে বইটি ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
গম চোর ধরতে এসে বোকা ইভান খুজে পেয়েছিল আকাশে উড়তে পারা এই যাদুকরী ঘোড়া যার নাক আর কান দিয়ে আগুন বের হতো, নাম সিভকা বুর্কা ।
রুশ উপকথা সিভকা-বুর্কা আর মাশা ও ভালুক পড়া বছর দশ বারোর আমি সেই বই এর প্রথম পাতাতে চোখ বোলাতে পারলেও দাত ফোটাতে পারি নি। শুধু এটুকুই বুঝি ওস্কার ক্ল্যাভা নামে এক জেলের ছেলে বহু দুরে এক সাগরপাড়ের গ্রাম থেকে সাদা বরফে ঢাকা পথে স্লেজ চালিয়ে শহরে এসেছে। শীতের ছুটিতে বাড়ি নিয়ে যাবে রিগার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছোট ভাই রবার্ত ও তাদের পুরো গ্রামের মাঝে সবেধন নীলমনি একটি মাত্র মনহোরী দোকানের ধনী মালিক কন্যা আনিতাকে।
চীনা মন্দিরের সামনে এক ঐতিহ্যবাহী চৈনিক নকঁশা
পরবর্তীতে যখন বুঝতে শিখি তখন থেকে এ পর্যন্ত বোধ হয় হাজার বার পড়া হয়ে গেছে বইটি। জেনেছি রিগা উপসাগরের দুই তীরের গ্রামগুলোতে দারিদ্রের যাতাকলে নিস্পেষিত হতভাগ্য জেলেদের জীবন সংগ্রামের এক করুন কাহিনী। বৈরী আবহাওয়ায় ভাংগা নৌকা আর ছেরা-ফুটো জাল নিয়ে সাগর থেকে মাছ ধরার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ, সেই সাথে ঋনের উপর উচু হারে দেয়া সুদ আদায়ের জন্য রক্ত চোষা মহাজনের শোষন-নিপীড়ন। শেষ পর্যন্ত একদিন কঠিন সংগ্রামী, শক্ত-পোড় খাওয়া যুবক ওস্কার ক্ল্যাভার নেতৃত্বে সমস্ত প্রতিকুলতা কাটিয়ে মাথা তুলে দাড়ালো ভিদজেমে গ্রামের জেলে সম্প্রদায় ।
মাঝ দুপুরে ভাটার টানে সরে যাওয়া সাগর। হুয়া হিন হোটেলের বারান্দা থেকে।
জেলের ছেলে ওস্কার ক্ল্যাভার সংগ্রাম আজ আমার লেখার বিষয়বস্ত না, আমি লিখতে বসেছি থাইল্যান্ডের একটি বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত নিয়ে, নাম তার 'হুয়া হিন'। আমাদের অনেকের কাছেই থাইল্যান্ডের সমুদ্র সৈকত মানেই হলো পাতায়া বা ফুকেট। তাই বাইরের বিশ্বে অনেকটা অপরিচিত হুয়া হিনের বেলাভুমি পর্যটকদের পদভারে এখনো পর্যদুস্ত হয়ে ওঠেনি ।
এক দিকে অনুচ্চ সবুজ পাহাড় শ্রেনীর শান্ত,সৌম্য সমাহিত স্বর্গীয় রূপ-সুষমা আর অন্যদিকে শ্বেত শুভ্র বালির বিস্তৃত বেলাভুমির নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য ভরপুর জেলে পল্লী হুয়া-হিন বহু বছর লোকচক্ষুর অন্তরালেই ছিল। হুয়া হিন তার সকল সৌন্দর্য্যটুকু নিয়ে প্রথমবারের মত আত্মপ্রকাশ করে যখন ১৯২০-২১ খৃষ্টাব্দে জাতীয় সিয়াম রেলওয়ের প্রধান হিসেবে রাজপরিবারের এক সদস্য থাইল্যান্ডের দক্ষিন উপকুলে রেললাইন প্রতিষ্ঠা করতে গেলেন। পরবর্তীতে হুয়া হিনের রূপে মুগ্ধ সে সময়ের থাই রাজা সপ্তম রামা প্রজাধীপকের নির্দেশে সমুদ্র সৈকতের কিনারে বিশাল এলাকা জুড়ে তৈরী হয় রাজকীয় গ্রীস্মাবাস। সবুজ শ্যমলে ঘেরা দৃষ্টি নন্দন এই গ্রীস্মাবাসটি বাইরে থেকে দেখার কোন উপায় নেই পথ চলতি জনগনের।
রাজকীয় প্রাসাদ থেকে সমুদ্র দর্শনের দৃষ্টি নন্দন এক পথ।
ব্যস্ত কোলাহল মুখর ব্যংকক থেকে ১৯৯ কিঃমিঃ দূরে এই সমুদ্র নিবাসে নিশ্বাস ফেলতে আসতেন থাইল্যান্ডের রাজারা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সদ্য প্রয়াত রাজা ভুমিবল। সিরিরাজ হাসপাতালে রাজা তাঁর জীবনের শেষ কটি বছর কাটানোর আগে বছর দুয়েক হুয়া হিনের রাজকীয় গ্রীস্মাবাসেই কাটিয়ে গেছেন। রাজাদের সাথে সাথে অভিজাত থাইদের কাছেও প্রিয় হয়ে ওঠে হুয়া হিন।বৃষ্টির মৌসুম ছাড়া সবসময়ই অত্যন্ত গরম আবহাওয়ার হুয়া হিন বিদেশী পর্যটকদের কাছে খুব জনপ্রিয় না হলেও সাধারন থাই বাসীদের কাছে খুবই আদরের।
ছোট এক রেস্তোরার সামনে অপরুপ শোভা ছড়িয়ে ফুটে থাকা এক লাল পদ্ম
মে মাসের শেষে ব্যাংকক থেকে এক শনিবার সকালে রওনা দিলাম হুয়া হিনের উদ্দেশ্যে। আবহাওয়া অফিসের তথ্য অনুযায়ী সে দুদিন সেখানে বৃষ্টি থাকবে । বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়ায় সমুদ্রের রূপই হয় অপার্থিব যার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার প্রিয় সমুদ্র তীর কক্সবাজারে গিয়ে।
শান্তশিষ্ট হুয়া হিন বিচে সাগর প্রেমিরা
ব্যাংককের সাথে সরাসরি রেল পথ থাকলেও হুয়া হিন যেতে হলে ভ্যানে যাওয়াটাই সুবিধাজনক। কিছুদিন আগেও বিভিন্ন প্রদেশের উদ্দেশ্যে সব ভ্যান ছেড়ে যেতো ব্যাংককের কেন্দ্রস্থল আনুসভারি থেকে যা পর্যটকদের কাছে ভিক্টোরি মনুমেন্ট নামে বেশি পরিচিত। যানজট নিরসনের জন্য সরকারী আদেশে বর্তমানে শহরের কেন্দ্রস্থলের কিছুটা বাইরে থেকে ভ্যান ছাড়ে। আমাদের জন্য ছাও ফ্রায়া নদীর অপর পারে পিনক্লাও বাস/ভ্যান টার্মিনালটি সুবিধাজনক। সেখান থেকে ৩ ঘন্টার পথ হুয়া হিন, ভ্যান ভাড়া মাথাপিছু ১৮০ বাথ।
মেঘে আচ্ছন্ন হুয়া হিনের আকাশ
গাড়ী ছাড়ার আগেই ড্রাইভার জানিয়েছিল হুয়া হিন যেতে সময় লাগবে ৩ ঘন্টা লাগবে। এক মিনিটও এদিক ওদিক না, ঠিক তিন ঘন্টা পরেই আমরা এসে হাজির হোলাম গন্তব্যে। বলে রাখা ভালো হুয়া হিনে সাধারন যাতায়তের জন্য রয়েছে মটর সাইকেল আর কিছু টুকটুক। অনলাইনে আগে থেকেই বুকিং দেয়া গেষ্ট হাউসে উঠলাম । ভাড়া প্রতিরাত ৯৫০ বাথ।
গেস্ট হাউস গুলো পরস্পরের গা ঘেসে চলে গেছে বেশ খানিকটা পথ
সাধারন পর্যটকদের কাছে প্রিয় জেলে পল্লীর একটি অংশে এখন বাড়ি ঘরের বদলে লঞ্চের আদলে গড়ে উঠেছে হোটে্লে- মোটেল আর গেস্ট হাউস । ডেস্কে একটি মেয়ে অল্প স্বল্প ইংরেজী জানে সেই আমাদের ঘর বুঝিয়ে দিল। মাঝখানে চওড়া কাঠের পাটাতনে তৈরী করিডোরের দুপাশে লঞ্চের কেবিনের মত ছোট ছোট রুম। সেই কাঠের পাটাতনের নীচ দিয়ে সাগরের পানি এসে খেলা করে জোয়ার ভাটায়। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রুমে বিছানা, তোয়ালে ছাড়াও রয়েছে এসি, টিভি, ঠান্ডা গরম পানি সহ এটাচ বাথ। সকালে নাস্তা খাবো শুনে মাথাপিছু ৬০ বাথ আগেই জমা দিতে হলো। ।
ডেকের বারান্দায় চেয়ার টেবিল সাজিয়ে রাখা
জিনিস পত্র রেখে আমরা সামনে এগিয়ে গেলাম ডেকের মত বারান্দার দিকে । সেখানে বড় বড় কাঠের চেয়ার টেবিল পাতা । ইচ্ছে করলে সেখানেই বসেই অর্ডার করে খাবার খেতে পারেন। আমরা এগিয়ে গেলাম রেলিং এর দিকে। ডেক থেকে বেশ খানিকটা দূরে নীল চাদরের মত বিছিয়ে থাকা শান্ত শিষ্ট সেই সমুদ্র দেখে সাথে সাথে আমার কক্সবাজারের কথা মনে হলো।
ঢেউহীন নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের বুকে নিঃসঙ্গ এক জেলে নৌকা
এই কি সমুদ্র! এমন নিস্তরংগ সমুদ্রের রূপ দেখে হতাশায় আমার মন ভরে উঠলো। কোথায় আমাদের সেই প্রিয় কক্সবাজারের বিস্তীর্ন সমুদ্র সৈকত, কোথায় সেই গর্জন করে ধেয়ে আসা ফেনিল জলরাশি যা আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়, তারপর আবার ফিরিয়ে দেয় ঢেউয়ের মাথায় তুলে ! সহ পর্যটক সমুদ্র প্রেমিক সান্তনা দিল বল্লো “এখন ভাটার সময়” ।
ভাটায় পানি সরে গেছে বেশ দূরে
যাই হোক খিদেয় পাগল আমরা বের হোলাম খাবারের খোঁজে। রেডিমেড খাবারের জন্য আদর্শ জায়গা হলো সেভেন ইলেভেন। কিন্ত তা না পেয়ে আমি ঢুকলাম এক মিনি মার্টে। বুড়ো দোকানদারটা খুব আন্তরিকতার সাথে গরম পানি দিয়ে আমাকে একটি কাপ নুডুলস বানিয়ে দিল। সেই নুডুলস আর জ্যুস নিয়ে ফিরতেই দেখি সহ পর্যটক হাত ভরা খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের সামনে।
হুয়া হিন সৈকতের তীর ঘেষে আমাদের গেষ্ট হাউস
একটু রেস্ট নিয়ে বিকেলে বের হোলাম উদ্দেশ্য সমুদ্র সৈকত। আমাদের ঘরের পাটাতনের নীচে পানির আওয়াজ ভেসে আসছে। ডেক রুপি বারান্দা থেকে দেখে ডান দিকে চোখ ফেরাতেই নজরে পড়লো বেলাভুমি থেকে খানিকটা উপরে ছোট এক টিলার উপর কারুকার্য্যময় এক মন্দির।
চীনা মন্দিরের সামনে ঐতিহ্যবাহী কারুকাঁজ করা এক ফলক
আমাদের গেষ্ট হাউস থেকে বেরিয়ে দু তিনটি দোকান পেরিয়ে রাস্তাটি বাঁ দিকে চলে গেছে। তার ঢোকার মুখেই উপরে একটি তোরণ তাতে লেখা এপথ চলে গেছে এক চাইনীজ মন্দিরে।
চৈনিক মন্দির
ভাবলাম মন্দিরটাতে একটু নজর বুলিয়েই না হয় সাগর দর্শনে যাবো। ছোট্ট চীনা মন্দিরের বারান্দায় পা দিতেই দেখি সামনে এগিয়ে এক বাধানো পাথরের সিড়ি নেমে গেছে সমুদ্র সৈকতে। তাড়াতাড়ি মন্দির দেখেই নেমে পড়লাম সেই বালুকাবেলায় তাতে সাদা বালি আর বড় বড় শিলা খন্ড যার জন্য টানা লম্বা দীর্ঘ সৈকত হুয়া হিনের নয়।
খানিক পর পর এমন বিশাল শিলায় পথ আটকে আছে সমুদ্র সৈকত
ঝকঝকে পরিস্কার পানিতে পা চুবিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকে। অনেকে এসেছে পরিবার নিয়ে, ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা বালুর প্রাসাদ তৈরী করছে। কেউবা বাবা মায়ের হাত ধরে অল্প পানিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।পুরো সৈকতের অনেকখানি ঘুরে বেড়ালাম কিন্ত কোন অশালীন পোশাক বা দৃশ্য চোখে পড়লোনা।
থাই ছেলে মেয়েরা উপভোগ করছে সাগর সৈকতকে
এখানেও রয়েছে সেই ঘোড়া, ঘোড়া চালক খুব হাল্কা চালে কাছে এসে একটু হাসি দিয়ে ইশারায় জানতে চাইলো আমরা চড়বো কি না? এই বুড়ো বয়সে ঘোড়ায় চড়ে পড়ে গিয়ে খোড়া হওয়ার রিস্ক নিলাম না । তাই আমরাও হাসি মুখে তাদের ইশারায় জানালাম আমাদের অপারগতার কথা।
সেই ঘোড়াওয়ালারা আর পেছনে হিলটন হোটেল থেকে বিচে নামার পথ
সন্ধ্যা নেমে এসেছে সাথে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। গরমটা উধাও হয়ে গেল সেই বৃষ্টিতে। প্রথমে কথা ছিল সেখান থেকেই আমরা সরাসরি নাইট মার্কেটে যাবো সেখানকার বিখ্যাত সি ফুড খেতে। টাটকা ধরে আনা মাছ আর ঝিনুকের সমাহারে তৈরী সে খাবারের জন্য সন্ধ্যার পর থেকে প্রচুর মানুষের ঢল নেমে আসে রাস্তায়।
নাইট মার্কেটের বিখ্যাত সি ফুড । অনভ্যস্ত জিভ স্বাদ পেলোনা সেই ঝিনুক শামুকের
কিন্ত সমুদ্রের সেই নোনা পানিতে ভেজা কাপড় বদলে হাত মুখ না ধুয়ে নিলেই নয়। তাছাড়া ছাতাও নিতে হবে রুম থেকে। নিজেদের হোটেলে ফিরে যাচ্ছি তখন নজরে পড়লো দোকানগুলোর উল্টোদিকে কিছু ছবি সাজানো। রাত হয়ে গিয়েছিল আর খাবার তাড়া ছিল তাই আর সেগুলো দেখা হলো না । নাইট মার্কেটে খেতে গিয়ে দেখি বিদেশী টুরিষ্টের সাথে স্থানীয় লোকে লোকারন্য। সামনে বরফের উপর সাজিয়ে রেখেছে সমুদ্র থেকে ধরে আনা টাটকা মাছ সাথে কাকড়া ঝিনুক শামুক । আপনি অর্ডার করলে কয়েক মিনিটের মধ্যে রান্না করে সামনে সাজিয়ে দিচ্ছে। আমরা যেটা অর্ডার করেছিলাম , আমার ধারনা ছিল সেটা তেলে ফ্রাই করে দিবে। ভাষা না বোঝার কারনে একটি আইটেম ছাড়া বিশাল এক মাছ সহ ঝিনুক শামুক কাকড়া সবই সেদ্ধ করে এনে দিল। অনাভ্যস্ত মুখে আমার কিছুই রুচলো না। অনেকে কি মজা করে যে খাচ্ছে তাই তাকিয়ে দেখলাম ।
সাঝের আঁধার নেমে আসছে সাগর তীরে
পরদিন খুব ভোরে উঠে ডেকে গিয়ে দেখি মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নীচে সমুদ্রের সেই অসাধরন রূপ । দূরে কালো কালো বিন্দুর মত দেখা যাচ্ছে মাছ ধরা ট্রলারগুলো । তারা হয়তো সারা রাত ধরা মাছগুলোকে জেটিতে নামিয়ে দিয়ে আবারো চলেছে সমুদ্র মন্থনে । আমাদের দুর্বল ক্যামেরা আর মোবাইল সেই রূপের আংশিকও ধরতে সক্ষম হলো না ।
মেঘাচ্ছন্ন আকাশ
হাত মুখ ধুয়ে রওনা দিলাম সেই জেটির উদ্দেশ্যে যেটা আমাদের বারান্দা থেকেই দেখা যায় । তখনো সব দোকান পাট খুলেনি । কেউ কেউ উঠে উঠোনটুকু ঝাট দিচ্ছে । আমরা নিরিবিলি সেই রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি জেটির উদ্দেশ্যে। এই জেটিতেই জেলেরা তাদের ধরা মাছ দিয়ে যায় ।
জেলেদের জন্য তৈরী জেটি ।
তখনই আবার নজরে পড়লো গত কালকের সেই পোস্টারগুলো। প্রতিটি দোকানের সামনে সাজিয়ে রাখা। কাছে গেলাম দেখি অনেক প্রাচীন সেই হুয়া হিনের ছবি আর তাতে লেখা রয়েছে বিভিন্ন স্লোগান। নীরব সেই সব ছবি আর স্লোগানের মাঝে তারা তাদের প্রতিবাদ তুলে ধরছে সবার কাছে।
দোকানের সামনে সাজিয়ে রাখা প্রতিবাদ লিপি
থাইল্যান্ডের দক্ষিনে লেজের দিকে হুয়া হিনের রাজকীয় গ্রীস্মাবাসের সীমানা ছাড়ালেই গালফ অফ থাইল্যান্ডের তীর বরাবর পুরো এলাকাটিই নিরিবিলি এক জেলে পল্লী । ১৮৩৪ খৃষ্টাব্দে প্রচন্ড খরার কবলে পরে পেচা বুরির কিছু কৃষক ভাগ্যন্বেষনে দক্ষিনের পথে চলতে শুরু করে।
পুরনো দিনের হুয়া-হিন
অবশেষে তারা সমুদ্র তীরের এমন একটি গ্রামে এসে হাজির হলো যার সৈকত জুড়ে বিছিয়ে আছে সাদা বালি আর কঠিন শিলা পাথর। কৃষিজীবিরা সেখানে বসতি গড়ে তোলে আর কৃষিকাজের বদলে আস্তে আস্তে মাছ ধরাকেই তাদের একমাত্র জীবিকা হিসেবে বেছে নেয়। আর এ জায়গাটিই হলো আজকের হুয়া হিন।
বিশাল দেহী হিলটনের মতই আরো হোটেল মোটেলের কালো হাত এগিয়ে আসছে শান্ত এই জেলেপল্লীর দিকে
আজ বিশাল বিশাল হোটেল মোটেল আর বিনোদন কেন্দ্রগুলো শকুনের মত কালো থাবা বাড়িয়ে দিয়েছে সমুদ্র তীরের সবচেয়ে আকর্ষনীয় জায়গা আদিবাসি জেলে পল্লীর দিকে। দেবতার গ্রাসের মতই কিছু কাঁচা টাকার লোভ দেখিয়ে দরিদ্র জেলেদের কাছ থেকে তারাও গ্রাস করে নিচ্ছে ১৮৩৪ সাল থেকে পত্তন করা তাদের পিতৃপুরুষের ঘর বাড়ি।
প্রতিবাদ লিপি
জেলের ছেলেরাও অসম প্রতিযোগীতার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সর্বগ্রাসী এই সব লোভী অসুরদের বিরুদ্ধে। তারা মাছ ধরা ছাড়াও পর্যটকদের জন্য খুলে বসেছে রেস্তোরা,কফি-শপ, স্যুভেনীরের দোকান এসব। কেউবা সমুদ্রের উপর কাঠের খুটির উপর তৈরী করা ঘরগুলোকেই পরিবর্তন করে তৈরী করেছে ছোট ছোট হোটেল মোটেল। যে হোটেলের কাঠের পাটাতনের নীচ দিয়ে জোয়ার ভাটার পানি খেলে যায় রাতদিন।
মাথার উপর কালো মেঘ আর আমরা খুব ভোরে এগিয়ে চলেছি জেটির শেষ মাথায়
এই সংগ্রামে তাদের মাঝ থেকে রুশ সাহিত্যিক ভিলিস লাৎসিসের সৃষ্ট সেই বিশালদেহী শক্ত পোড় খাওয়া একক সংগ্রামী ওস্কার ক্ল্যাভার মত কোন নেতৃত্ব বেরিয়ে এসে নিজেদের দাবী আদায় করতে কতটুকু সফল হবে তা ভবিষ্যতই বলতে পারবে।
এই হলো আমার হুয়া হিন দেখা যেখানে শুধু সমুদ্র সৈকতই নয়, জানা হলো বেনিয়াদের বিরুদ্ধে তাদের নিরন্তর সংগ্রামের কাহিনী ।
নাকি এই মৃত স্টার ফিশের মতই মৃত্যু হবে সকল সংগ্রামের কে জানে ?
অটঃ ফিরে আসার পথে চোখে পড়লো মাইলের পর মাইল রাস্তার ধারে দু-সারিতে লাগানো সেগুন গাছের সারি যা আর কয়েক বছর পরেই বিক্রীর উপযোগী হয়ে উঠবে। অমনি মনে পড়লো আমাদের এয়ারপোর্ট রোডে লাগানো বনসাই এর কথা । কি দুরদর্শী জাতি আমরা !
দ্রুত গতির চলন্ত গাড়ি থেকে নেয়া সেগুন গাছের সারির ছবিটি, তাতে সামনে ঝোলানো নানা রকম জিনিস পত্র । ভালো হয়নি ।
২, ৩ আর রাজ প্রাসাদের ছবিটি ছাড়া আর সব ছবি আমাদের ক্যামেরা আর মোবাইলে তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ৭:১৯