এক লম্বা গলার কায়ান জাতি বা জিরাফ মেয়ে
একটি মেয়ে দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা গলায় পাঁচ থেকে সাত কেজি ওজনের এক ধাতব রিং এর হার পড়ে থাকছে। আমৃত্যু এই গলায় বাঁধা বোঝা নিয়েই তার জীবন কেটে যাচ্ছে। হয়তো ভাবছেন আমি আবার কাদের কথা বলতে বসেছি! আমি বলছি সেই সব হতভাগ্য মেয়েদের কথা যারা সারা বিশ্বে লম্বা গলার কায়ান জাতির মেয়ে বা জিরাফ নারী নামেই বেশী পরিচিত। চিড়িয়াখানার প্রানীদের মত টাকার বিনিময়ে যাদের মানুষজন কৌতুহলভরে দেখতে ছুটে যায়।
বেঞ্চে বসা মহিলাটির ধুসর মলিন চেহারায় ছাপ পরেছে তার অকাল বার্ধ্যক্যের, মায়ানমারের লেক ইনলেতে তোলা
মায়ানমারের লেক ইনলে ঘুরতে গিয়ে এক স্যুভেনীরের দোকানে দেখা মিলেছিলো দুজন জিরাফ নারী দুজনার। গাইডের সাথে কথা বলে জেনেছিলাম মুলত পর্যটক আকর্ষনের জন্যই তাদের দোকানের এক প্রান্তে এনে বসিয়ে রাখা হয়। কি অদ্ভুত মানুষের মানসিকতা। সেই দোকানে ঢুকতেই টেবিলে সাজিয়ে রাখা তামার সেই পাঁচ কেজির কন্ঠ হার যা আমি দু হাত দিয়েও তুলতে পারি নি। আমার ভাবতেও কষ্ট হচ্ছিল মেয়েগুলো তাদের নরম মোলায়েম কন্ঠদেশে এই হার সারাজীবন পড়ে থাকে কি করে!
আর দশটি সাধারন মানুষের মতই পোশাক পড়া বৃদ্ধাটি ঝুম দুপুরে দোকানে বসে বসে কাপড়ে নকশী কাজ করছে
কায়ান মেয়েদের পাঁচ বছর বয়স হলেই এই ভারী ধাতুর তৈরী রিং এর মত হার পড়া শুরু করে। আর বছরের পর বছর ধরে এই রিং এর পরিমান বাড়তেই থাকে।এ অলংকার শুধু তাদের গলাতেই আছে তা কিন্ত নয়, এটা তাদের দুই হাত পায়েও আমৃত্যু জড়িয়ে আছে বেড়ীর মত করে। মেয়েদের এই লম্বা গলা বানানোর বেশ কিছু মতবাদ থাকলেও আমাদের গাইড জানালো মুলত সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিই এর প্রধান কারন। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছে এই ভারী ধাতব রিং কায়ান মেয়েদের গলা লম্বা না করে তাদের দু কাধের হাড়কে দু দিকে অস্বাভাবিকভাবে ঢালু করে দেয়। যার ফলে তাদের গলা লম্বা বলে মনে হয়। আর এটাই চালচলনে স্থবির কায়ান নারীদের স্বল্পায়ুর অন্যতম একটি কারন বলে তারা উল্লেখ করেছে।
কাঠের পুতুলও পরে আছে সেই স্বর্নালী বেড়ি ।
নিজস্ব ভাষা আর সংস্কৃতি নিয়ে চিয়াং মাই এ বসবাসরত এই কায়ান জাতির আদি বসতি কিন্ত প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারের শান প্রদেশে। শানের সংখ্যাগরিষ্ঠ কারেনরা সমগ্র বিশ্বে ভয়ংকর এক নিষ্ঠুর জাতি হিসেবে কুখ্যাত। মায়ানমার থেকে আলাদা হয়ে নিজেদের স্বাধীন শান রাস্ট্র গড়ার জন্য কারেনরা ১৯৮০ সনে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষনা করে।১৯৯০ সাল পর্যন্ত দশ বছর ব্যাপী চলমান এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ আর সহিংসতাকে ক্ষমতাসীন বর্মী জান্তা বাহিনী কঠোর হাতে দমন করে। সে সময় কারেনদেরই এক উপগোষ্ঠি কায়ানরা বার্মা থেকে প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডে পালিয়ে আসে।বসতি গড়ে তোলে থাই উত্তর সীমান্তবর্তী পাহাড়ী অঞ্চল মায় হং সন, মুয়াং ও চিয়াং দাওতে। অধিকাংশ কায়ানদের মতে তারা মায়ানমারের চেয়ে এখানে অনেক সুখেই আছে।
সবুজ ধান ক্ষেত , দূরে সবুজ পাহাড়ের কোলে কায়ানদের গ্রাম যেখানে নেই হানাহানি কাটাকাটি
কিন্ত কায়ানদের সবাই কিন্ত মনে করে না এভাবে নিদৃষ্ট গন্ডীর মাঝে তারা সুখে আছে। বর্তমানে সচেতন কায়ান নারীদের অনেকেই জিরাফ নারী হয়ে টাকা আয়ের উৎস হতে চায়না। গলার হার খুলে তারা স্বাভাবিক আর দশটা মেয়ের মত সমাজে মিশে যেতে চায়, তাদের প্রতি মানুষের কৌতুহলী দৃষ্টি দেখতে চায় না। কেউ কেউ নিউজিল্যান্ড, সুইডেন এসব উন্নত দেশে নাগরিকত্ব নিয়ে চলে যেতে যায়। তাদের মতে থাই সরকার তাদের বের হওয়ার অধিকার না দিয়ে বাধ্য করছে তিনটি নির্দিষ্ট গ্রামে বসবাস করতে। ঠিক যেন আমাদের রোহিঙ্গাদের মতই তাদের অবস্থা।
সাত কেজির ধাতব হার না পরলেও নিজস্ব ঐতিহ্যে সাজ পোশাক পড়া এক কায়ান মহিলা
অনেকের মতে বিভিন্ন ট্যুরিষ্ট কোম্পানীর যোগসাজশে থাই সরকার তাদের দেশ ত্যাগে বাধা দিচ্ছে কারন তাদের দেখিয়ে মোটা অংকের অর্থ আয়। থাই সরকারের বিরুদ্ধে তাদের এই অভিযোগ আমি অবশ্য বিশ্বাস করি না। তবে বেশ কিছু সামাজিক সংগঠন এভাবে কায়ান নারীদের প্রদর্শন করে টাকা আয় বন্ধের জন্য গত কয়েক বছর ধরেই সোচ্চার ।
এই হলো আমার জানা মতে কায়ানদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ।
কায়ানদের গ্রামে যাবার কাঁচা মাটির পথ
আমরা এখন হাইওয়ে থেকে এক কাঁচা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছি কায়ান গ্রামের উদ্দেশ্যে। দু পাশে সবুজ ধানের ক্ষেত, দূরে দূরে দু একটা বাঁশের বাড়ীঘর চোখে পড়ছে। কাছে আসতেই এক গ্রামের কিনারে হাজির হোলাম। গাইড জানালো এটাই আমাদের গন্তব্য লম্বা গলার মেয়েদের গ্রাম।
দরিদ্র জাতি গোষ্ঠি পরবাসী কায়ানদের এক গ্রাম
ঘাসহীন এবড়ো খেবড়ো কাঁচা মাটির এক চত্বরে বড় বড় কিছু গাছ আর তারই মাঝে মুকুল আসা পরিচিত দু একটা লিচু গাছও দেখতে পেলাম। গাছের ছায়ায় কিছু স্থানীয় পুরুষ বসে আছে। আরো কয়েকটি পর্যটক নিয়ে আসা ভ্যানও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।
ভাঙ্গা চুড়া ঘরদোর হলেও বাসায় বাসায় পাখীর খাঁচা
চত্বরটি একটু ঢালু হয়ে নীচে নেমে গেছে যেখানে কিছু বাঁশের ঘরের পেছন দিকটা দেখা যাচ্ছে। নেমে দেখি মাটির রাস্তার দু ধারে দশ বারোটা ছোট ছোট ছাপরা অস্থায়ী দোকান । আর সেখানে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পড়া কায়ান মেয়েরা নিজ হাতে তৈরী জিনিসপত্রের পশরা সাজিয়ে বসেছে পর্যটকদের কাছে তাদের পন্য বিক্রীর আশায়।
নিজেদের হাতে তৈরী জিনিস
তার মাঝে তাঁতে তৈরী সুতি কাপড়ের কায়ান পোশাক, চাদর, ব্যাগ, কোমর বন্ধনী আর অপুর্ব নকশায় নির্মিত তাদের টুপি। এতে নানা রঙের সুতোর কাজ ছাড়াও রঙ বেরঙের পুতি, কড়ি আর রুপার চাকতি লাগানো রয়েছে। আরো ছিল নানা রঙের অল্প দামের পাথরের মালা, ব্রেসলেট, কাঠের তৈরী বিভিন্ন শো পিস।
উপরে সাজানো রুপোর পাত লাগানো টুপি যা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকের এক উপকরন সাথে কাপড়ের পুতুল
আমি টুকটাক দু একটি জিনিসের সাথে বাঁশের তৈরী একটি কলমদানী কিনলাম।
নিজ হাতে তাঁতে বোনা চাদর ঝুলিয়ে রেখেছে ক্রেতাদের নজর কাড়তে , তবে রঙ আর বুননে নজর কাড়াই বটে
আপনি ইচ্ছে করলে দর্শনীর বিনিময়ে তাদের পোশাক পড়ে তাদের সাথে ছবি তুলতে পারবেন। তবে হিউম্যান জ্যু হিসেবে ছবি তোলাতে যে তাদের অস্বস্তি হয় তা বোঝা যায় তাদের আচরনে। তাদের তৈরী জিনিস কেনা কাটার চেয়েও তারা বেশি খুশী হয় আপনি যদি কোনো ভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন।
অস্থায়ী দোকানে পন্য সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হার না পরা নিজস্ব ঐতিহ্যের পোশাকে এক গরবীনি বিক্রেতা
উল্লেখ্য যে এসব দোকানে কোন লম্বা গলার মেয়ে নেই। তাদের দেখতে এবং তাদের সাথে ছবি তুলতে হলে কাছেই তাদের বাসায় যেতে হবে। আর্জেন্টিনার দুজন সহ-পর্যটক ৩০০ বাথের বিনিময়ে তাদের সাথে ছবি তুলে এনে আমাকে দেখিয়েছিল।তাদের একজন স্পেনীশ ভাষায় বই লিখবে থাইল্যান্ড ভ্রমনের উপর।
পশ্চিমা এক নারী পর্যটক অত্যন্ত রূঢ় ভাবে মেয়েটিকে টেনে নিয়ে ছবি তুলতে লাগলো। পর্যটক হিসেবে লজ্জিত আমি তার সেই কঠিন চেহারাটি ঢেকে দিয়েছি আমার অপটু তুলির আঁচড়ে
এবার আমাদের গন্তব্যের নাম মে সাই এ হচ্ছে থাইল্যান্ড আর মায়ানমা্র বর্ডার এলাকার নাম। মজার ব্যাপার হলো থাই ভাষায় মেসাই শব্দের অর্থ না। উদাহরণ হিসেবে বলি আপনি যদি চা বা কফিতে চিনি না চান তবে অর্ডার দেয়ার সময় বলবেন “মেসাই নামতান” অর্থ চিনি দিও না (no sugar ) । চিনি দুধ আলাদা করে দিলে আপনাকে আর কোন হ্যাপা পোহাতে হবে না ।
থাইল্যান্ডের উত্তর প্রান্ত ঘেষে শেষ সীমানা তোরন
কায়ান গ্রামের মাটির পথ ছেড়ে আমরা এগিয়ে চলেছি মসৃন পাকা রাস্তা দিয়ে মেসাই এর দিকে। অবশেষে দূর থেকেই চোখে পড়লো ঐতিহ্যবাহী থাই নকশার এক সুদৃশ্য স্বর্নালী তোরন সেটা উত্তর থাইল্যান্ডের শেষ সীমান্ত বলে উল্লেখ করা আছে। তোরনের পরেই ছোট একটি খালের উপর সেতু যা দুটি দেশের মাঝে নোম্যান্সল্যান্ড হিসেবে চিনহিত। চারিদিকে কাটাতারের বেড়া দেয়া দুদেশের পতাকা খচিত সেই সেতুর বন্ধ গেটের বাদিকে থাই ইমিগ্রেশন অফিস।
নোম্যান্স ল্যান্ডে প্রবেশের গেট যার ডানদিকে কাস্টমস আর বা দিকে ইমিগ্রেশন অফিস ।
আপনি যদি কিছুক্ষনের জন্য এ পথে মায়ানমারের যেতে চান তাহলে থাই ইমিগ্রেশন অফিসে আপনার পাসপোর্ট জমা দিতে হবে। অল্প সময়ের মাঝেই বিনা হয়রানিতে পাসপোর্টে সীল লাগানো হলে হেটে চলে যান ব্রিজের আরেক মাথায় মায়ানমার ইমিগ্রেশন অফিসে। তারা মাথাপিছু ৫০০ বাথের বিনিময়ে আপনাকে মায়ানমারে প্রবেশের অন এরাইভ্যাল ভিসা দেবে।
মেসাই এর থাই ইমিগ্রেশন অফিস
হাতে পাসপোর্ট নিয়ে এক পা ফেলতেই আপনি এসে পরলেন মায়ানমারের বর্ডার সংলগ্ন শহর তেচেলিক ( Tachileik )।তবে সেখান থেকে আরো ভেতরে যেতে হলে আপনাকে নতুন করে পারমিট নিতে হবে।তেচলিক থেকে ঘুরে ফিরে আসার পর থাইল্যান্ড ইমিগ্রেশন অফিস আপনাকে থাইল্যান্ড থাকার জন্য মাত্র ১৫ দিনের ভিসা দেবে। সুতরাং আপনি আগেই হিসাব করে নিন বাকি ১৫ দিনে আপনি থাইল্যান্ড ট্যুর শেষ করতে পারবেন কিনা ?
থাই মায়ানমার এর মেসাই তে নোম্যান্স ল্যান্ডের উপর ব্রীজ
এখানেও গাইড আমাদের সময় দিয়েছিল ১৫ মিনিট।তাই আমরা নো ম্যান্স ল্যান্ডের ঐ ব্রীজের আশে পাশেই ঘুর ঘুর করে ফিরে আসলাম পথের দুপাশ ঘেষা পর্যটকের উপচে পরা ভীড়ে ভারাক্রান্ত দোকানগুলোতে।
রাস্তার দুধার ঘেষে দোকানের সারি যা পথেও চলে এসেছে ।
মায়ানমারের দামী রত্ন রুবী, নীলা থেকে শুরু করে সবুজ জেডের বিশাল সম্ভার সাথে তানাকা আর আচারে ভরা দোকানেগুলোতে তানাকা মাখা মেয়ে কর্মী দেখে বুঝলাম এরাও জাতিতে মায়ানমারের। দেখতে দেখতে কখন পনের মিনিট কেটে গেলো টেরই পাইনি। গাইড যখন আমাদের খুজতে আসলো তখন আমার সহ-পর্যটক তার ব্যাক্তিগত সংগ্রহের জন্য পাথরের ছোট ছোট হাতি খুজছিল।কিন্ত সময়াভাবে কিনতে না পারায় সেই আক্ষেপ তার এখনো রয়ে গেছে ।
এবার আমাদের চুড়ান্ত গন্তব্য গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল যার জন্য এতদুর আসা।
স্বপ্নের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল
চলবে..
শেষটি ছাড়া সব ছবি আমাদের ক্যামেরা আর মোবাইলে তোলা
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৮:২২