ওয়াট রঙ খুন বা হোয়াইট টেম্পল
আমরা সবাই জানি প্রত্যেক শিল্পীর ভেতরেই কম বেশী কিছুনা কিছু পাগলামী থাকেই। অনেক সময় আমরা সাধারন মানুষ তা নিয়ে হাসি ঠাট্টাও করে থাকি। কিন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন শিল্পীর কঠিন সংকল্প,একাগ্রতা আর পরিশ্রম সত্যি সত্যি পৃথিবীর বুকে এক একটি অমর কীর্তির সৃষ্টি করে থাকে।
ওয়াট রঙ খুন
থাইল্যান্ডের উত্তর সীমান্তের বিখ্যাত শহর চিয়াং রাই গিয়েছিলাম বহু বছর ধরে পরিকল্পনার পর । এই শহরের পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিনে গেলেই মিলবে গতানুগতিকতার বাইরে অলৌকিক এক নকশা আর শেত শুভ্র রঙ এ নির্মিত বৌদ্ধ মন্দির যা ওয়াট রঙ খুন নামে স্থানীয়দের কাছে পরিচিত। তবে বিদেশী পর্যটকরা তাকে সাদা মন্দির নামে এক ডাকেই চেনে ।
হোয়াইট টেম্পল
এর কি এমন বিশেষত্ব আছে যার জন্য প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ পর্যটককে চুম্বকের মত টেনে নিয়ে আসে এখানে এই চিয়াং রাইতে? আর আমাদেরও যেনো টেনে আনলো তেমনি করে সুদুর থেকে। পাহাড়ী পথ পেরিয়ে আমাদের মাইক্রোবাস যাকে ওরা ভ্যান বলে তা এখন সমতলে। একটু বাঁক ঘুরতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো এর শুভ্র চুড়াটি।
দু হাত জোড় করে যেন আমন্ত্রন জানাচ্ছে অতিথিদের
কাছে এসে বিস্ময়াবিভুত কেবল আমিই একাই নই, সাথে আরো বিভিন্ন দেশের এগারো জন সহ পর্যটক ছিল তাদেরও চোখে মুখে একই অনুভুতি প্রকাশ দেখলাম। পাহাড় পেরিয়ে সমতল এক স্থানে তেরো একর জায়গা জুড়ে তৈরী অপুর্ব নকশার সেই চোখকে ঝলসে দেয়া শ্বেত শুভ্র মন্দিরটি দেখে আমাদের সহ-পর্যটক আর্জেন্টিনার একটি মেয়ে অস্ফুটে বলে উঠলো,
"দেখো দেখো, এ যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে"।
স্বর্গের পথে
স্থাপত্য নির্মান রীতির কথা বলতে গেলে ভারতের কথা বাদ ও যদি দেই ্তারপর ও মায়ানমার, থাইল্যান্ড,ক্যাম্বোডিয়া,শ্রীলংকা ছাড়াও অন্যান্য দেশে অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে যার প্রায় সবগুলোই বহু বছরের পুরনো ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত এবং যথারীতি লাল আর হলুদের সংমিশ্রন। কিন্ত আমি যে মন্দিরটির কথা বলছি তা কিন্ত একেবারেই সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত এবং নির্মান রীতিতে পুরোপুরিই ব্যাতিক্রম। প্রথমেই বলতে হয় এ মন্দিরটি কোন রাজা বাদশাহর উদ্যোগে তৈরী হয়নি। এটা পুরোটাই সৃষ্টি হয়েছে থাইল্যান্ডের বিখ্যাত এক শিল্পীর হাত ধরে যার বাড়ী কিনা এই চিয়াং রাইতেই।
ওয়াট রং খুন মন্দির নির্মান শিল্পী Ajarn Chalermchai Kositpipat
বেচে থাকা এই ব্যাতিক্রমী শিল্পী Ajarn Chalermchai Kositpipat এর কথা একটু বলে নেই তার কাজের বিবরনে যাবার আগে। থাইল্যান্ডের ললিতকলার জন্য বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় শিল্পাকর্ন থেকে গৌরবের সাথে শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি শ্রীলংকায় বছর চারেক এ বিষয়ে আরো গভীরভাবে কাজ করেন। সেখানে তিনি দেখেছিলেন গতানুগতিকতার বাইরে সাদা পাথরে নির্মিত বিভিন্ন হাতী ছাড়াও অন্যান্য মুর্তি । এ বিষয়টি তাঁকে ঐতিহ্যবাহী লাল হলুদের বদলে সাদা রঙ দিয়ে মন্দির তৈরীর অনুপ্রেরনা যুগিয়েছিল ।
মন্দির প্রাঙ্গন
তিনি বলেছেন "আমি আমার দেশের কাছে একজন উত্তম এবং মুল্যবান ব্যাক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই নিজস্ব স্টাইলে শিল্প সৃষ্টি করতে চাই এবং থাই বৌদ্ধ শিল্পকে এমন এক মাত্রায় নিয়ে যেতে চাই যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে। আমি চাই পৃথিবীর সব দেশের পর্যটকরা এসে আমার কীর্তির প্রশংসা করবে যা তারা করে থাকে তাজমহল বা এংকরভাটের ক্ষেত্রে"।
বৌদ্ধ পুরাণের স্বর্গীয় পাখি
বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে চিয়াং রাই এর ওয়াট রঙ খুন নামে প্রাচীন মন্দিরটি তহবিলের অভাবে মৃতপ্রায় । সে সময় থাইল্যান্ডের সবচেয়ে নামজাদা এই শিল্পী তার সমস্ত সময় আর অর্থ নিয়ে এগিয়ে আসেন তার সংস্কারে। পুরোনো ঐতিহ্যবাহী নকশায় নির্মিত মন্দিরটিকে আমুল পরিবর্তনের ব্যাপারে তিনি তৎকালীন রাজা ভুমিবলের অনুমোদন পেয়েছিলেন ।
রাহু নাকি মৃত্যুর দেবতা কে জানে ?
১৯৯৭ সাল থেকে শুরু হওয়া স্বপ্নের প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য শিল্পী আজার্ন বছরের পর বছর ধরে শিষ্যদের নিয়ে দিন রাত একটানা কাজ করে চলেছেন। তাঁর মৃত্যুর পরও এর বাকি কাজ যেন বন্ধ না হয়ে যায় সে অভিপ্রায়ে তার দুই ব্যাচ ছাত্রদের প্রশিক্ষিত করেছেন তিনি। শিল্পী আজার্নের মতে এর পুরো কাজ শেষ করতে আরো অনেক বছর লাগবে আর তা হবে আনুমানিক ২০৭০ সালে।
মন্দির সেতুর গায়ে অপরূপ কাঁরুকাজ
প্রতিটি শিল্পীই চায় তার কাজের স্বাধীনতা । ফরমায়েসী কাজে শিল্পীর স্বাধীনতা থাকে না । এই ধারনা থেকেই আজার্ন এই নির্মান কাজে কোন সরকারী বা রাজনৈতিক ব্যাক্তিবর্গ থেকে ধনী ব্যাবসায়ী কারো সাহায্যই নেননি । এ পর্যন্ত খরচ হওয়া ৪০ মিলিয়ন থাই বাথ সম্পুর্নটাই এসেছে তার ছবি বিক্রীর টাকা থেকে। বাংলাদেশী টাকায় তা হবে আনুমানিক দশ কোটি টাকা। এটাই এই শিল্পীর বিশেষত্ব যে টাকার কাছে তার কাজের স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেননি ।
শুভ্র খিলান খচিত প্রবেশ দ্বারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পর্যটকের দল
ওয়াট রঙ খুন মন্দিরটি থাই জনগনের জন্য অবারিত দ্বার হলেও অল্প কিছুদিন হলো রক্ষনাবেক্ষনের উদ্দেশ্যে পর্যটকদের কাছ থেকে ৫০ বাথ প্রবেশ ফি নেয়া হচ্ছে । আমরা দেখেছি বিভিন্ন দেশের মন্দির মঠে সাহায্য নেয়া হয় এবং ডোনেশন বক্স থাকেই, থাইল্যান্ডও তার ব্যাতিক্রম নয় । কিন্ত এখানে সব ধরনের প্রভাব মুক্ত থাকার জন্য সর্বোচ্চ ১০ হাজার বাথের বেশী অনুদান গ্রহন করা হয়না।
কিন্নরী
এখন দেখা যাক থাই এবং ভারতীয় স্থাপত্যকলার সংমিশ্রনে সম্পুর্ন নিজের নকশাঁয় নিজের মত করে কি সৃষ্টি করেছেন শিল্পী আজার্ন কোসিপিপাত। মেয়ে গাইডটি টিকিট কেটে এনে দেয়ার পর আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি সেই আশ্চর্য্য সুন্দরের দিকে। ধর্মীয় স্থাপনা বলে চারিদিকে একটি ভাবগম্ভীর পরিবেশ বজায় ছিল ।
নরকের গভীর থেকে উত্তোলিত সহস্র হাত যেন অনিয়ন্ত্রিত আকাঙ্ক্ষার প্রতীক
মুল মন্দিরে যাবার জন্য ছোট একটি জলাধার যার উপর তৈরী করা শ্বেত শুভ্র এক সরু সেতু পথ। তাকিয়ে দেখলাম তার দুপাশের মাটির গর্ত থেকে আমাদের দিকে বাড়িয়ে দেয়া শত শত উত্তোলিত হাত আর ভয়ংকর মুখের ভাস্কর্য্য। যা দেখে মনে হয় এরা সবাই নরক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি চাইছে। দেখেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো। আর সেই সরু সেতু পথটি যেন বলছে লোভ লালসা আর মন্দ কাজকে অতিক্রম করে গেলেই আসবে সুখের বারতা। সে পথের দুপাশে রয়েছে বৌদ্ধ পৌরানিক কাহিনীর অপরূপা কিন্নরীদ্বয় যা অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক পাখীর আকৃতির।
স্বর্গের পথ যার দুপাশে পাহারায় আছে রাহু আর মৃত্যু
সে সেতু পেরিয়ে আরেকটি সেতু যার নাম স্বর্গের পথ তার প্রবেশ পথের দুপাশে রয়েছে অস্ত্র হাতে সুবিশাল দুটো মুর্তি। দেখে মনে হচ্ছে যেন তারা সে পথের পাহারাদার। শিল্পী আজার্নের লেখা থেকে জানলাম তাদের তিনি রাহু আর মৃত্যুর রূপক হিসেবে সৃষ্টি করেছেন । আর এরাই মৃত মানুষের ভাগ্য নির্ধারন করবে, নির্ধারন করবে কে স্বর্গে আর কেইবা সেই ভয়ংকর নরকবাসী হবে। দুপাশে শ্বেত শুভ্র নাগের শরীর দিয়ে তৈরী রেলিং ঘেরা সেতু পথ ধরে এগিয়ে চলেছি ধীরে ধীরে মুল মন্দিরের দিকে ।
মুল মন্দিরের উপরে ছাদের নকশা
সবার ক্যামেরা বিরামহীন ভাবে ক্লিক ক্লিক করে শব্দ করেই চলেছে। ডিএস এল আর টি ভারী বলে নিয়ে যাইনি । এখন খুব আফসোস হচ্ছে ছোট ক্যানন আর মোবাইলে ছবি তুলতে গিয়ে। বুঝতে পারছি সেই সৌন্দর্য্যকে তুলে ধরার ব্যাপারে অনেক ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ।
মুল মন্দির অর্থাৎ প্রার্থনা কক্ষে প্রবেশের আগে চারিদিকে আলো করে আছে অপ্সরা আর কিন্নরীদের বিভিন্ন মুর্তি । সাদার ভেতর কাচের টুকরা লাগানো যা সুর্য্যের আলোয় প্রতিফলিত হচ্ছে।
বিস্ময়াভুত পর্যটিকদের বিরামহীন ছবি তোলা
মন্দিরের বাইরের দেয়াল আর ছাদটি সাদা হলেও তার নকশায় রয়েছে থাই ঐতিহ্যবাহী নকশার ছাপ। যেমন ছাদটি তিন স্তর বিশিষ্ট এবং ভেতরে পদ্মাসনে বসা বুদ্ধের মুর্তির সাথে রয়েছে নাগ বা সাপের ব্যপক ব্যবহার।
সুপারম্যান থেকে স্পাইডার ম্যান সহ আরো অনেককেই খুজে পাবেন মুল মন্দিরের ভেতরের দেয়ালে আঁকা চিত্রে
ভেতরের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা রয়েছে শিল্পী আজার্ন ও তার শিষ্যদের নিজ হাতে আঁকা সাদা থেকে হটাৎ কমলা রঙের কুন্ডলী পাকানো আগুনের শিখা আর অসুরের চিত্রাবলী । তারই সাথে রয়েছে পশ্চিমা সংস্কৃতির বিখ্যাত আইকনদের চিত্র যা দেখে সত্যি বলতে কি আমি যারপরনাই অবাকই হয়েছি । এর মাঝে মাইকেল জ্যাকসন থেকে সোয়ার্জেনিগার বুশ থেকে লাদেন , সন্ত্রাসী আক্রমন, পারমানবিক যুদ্ধ সবই এসেছে সে সব চিত্রে।
ওপাশের প্রাঙ্গনে যাবার পথের উপরে অপরপা শ্বেত শুভ্র কারুকাজের এক তোরণ
২০১৪ সালে প্রবল ভুমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত মন্দিরটির সংস্কার কাজের জন্য বিশাল এলাকা জুড়ে নির্মিত মন্দিরটির কিছু কিছু জায়গায় প্রবেশ রুদ্ধ । তারপর ও যতটা পারলাম ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলাম।
অত্যন্ত কারুকার্য্যময় এক স্বর্নালী স্থাপনা
শিল্পীর মতে স্বর্নালী বা হলুদ রঙ হচ্ছে জাগতিক ধন সম্পদের প্রতি আকর্ষন । তাইতো শুভ্র সাদা রঙ ব্যবহারের মাধ্যম মানুষকে এই জাগতিক আকর্ষন থেকে বের হয়ে অন্তরের জ্ঞান লাভ করার জন্য শিল্পী আজার্ন আহবান জানিয়েছেন।
যেমন এই অপুর্ব নকশায় তৈরী একটি হলুদ রঙের টয়লেট যা শিল্পীর মতে জাগতিক জীবনের প্রতীক
মুল মন্দিরের পেছন থেকে তোলা
সবুজ ঘাস আর জলাশয় যাতে আছে নানা রঙের রঙ্গীন মাছের দল
এই সুদৃশ্য স্থাপনাটতে রয়েছে একটি কুয়া যেখানে বৌদ্ধমতে মনের বাসনা নিবেদন করলে তা অবশ্যই পুরণ হবে
উইশিং ওয়েলের সামনে ছাতার আকৃতি এই ধাতু দণ্ডে ঝুলিয়ে দিতে পারেন ধাতুর তৈরী পাতা বা ঘন্টা যা আপনার মনের বাসনা পুরণ করবে বলে বিশ্বাস ।
ঠান্ডা আর গরম পানীয় সাথে স্যুভেনীরের দোকান
ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পরেছেন কি ? তাহলে আসুন আমাদের মত আপনিও এখানে এই কাঠ আর লোহায় তৈরি বেঞ্চে বসে পান করতে পারেন থাইল্যান্ডের অত্যন্ত চমৎকার কফি আর অপেক্ষা করতে পারেন আপনার সফর সংগীদের।
সুদৃশ্য স্বর্নালী তোরণের উপর থেকে ঝোলানো ঘন্টাটি বাজিয়ে বিদায় নিতে পারেন আপনিও
আমার দেখা অজস্র মন্দির মঠের মাঝে বিস্ময়কর এবং ব্যাতিক্রমী নকশায় তৈরী এই শ্বেত শুভ্র মন্দিরটি দেখে চিয়াং রাই শহরের দিকে যেতে যেতে মনে হলো আমিও সেই আর্জেন্টাইন সহ-পর্যটকের মত বলে উঠি,
"আহা কি চমৎকার দেখতে , মনে হচ্ছে যেন স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে "।
৫ ছবিটি নেট থেকে .। বাকী সব আমাদের ক্যামেরা আর মোবাইলে তোলা ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:৩৪