আকাশ দীপিকা
কোন এক ব্যস্ত নগরীর তার চেয়েও ব্যস্ত এক বানিজ্যিক এলাকার সুউচ্চ-সুরম্য ভবনগুলোর মাঝে ৪১ তালা ভবনটি মাথা তুলে রাস্তার বাঁ পাশে যেন সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। মুনিয়া শুনেছে সে ভবনের অনেক উপরের এক নিভৃত কোঠায় আছে একাকী নি:সংগী এক আকাশ দীপিকা ।
আগে আগে পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে যাচ্ছে সুমন। সেই অট্টালিকার ৩৫ তালা পর্যন্ত উঠতে উঠতে দুবার লিফট বদলাতে হলো মুনিয়া আর মাসুদকে। অটোমেটিক তালা লাগানো কাঠের দরজাটি চাবি ঘুরিয়ে খুলতেই ঘরের ভেতর থেকে ভ্যাপসা গরমের সাথে এক বিশ্রি বোটকা গন্ধ ঝট করে নাকে এসে লাগলো মুনিয়ার। সাথে সাথে নাক কুঁচকে উঠে তার।
ঘরের ভেতর পা রেখে মুনিয়ার মনে হলো কতদিন পরিস্কার করা হয়নি কিছু। লজ্জিত সুমন তাড়াতাড়ি এক হাতে নোংরা কোচকানো টু সিটার সোফার কভারটি হাত দিয়ে ঝেড়ে টেনেটুনে সমান করতে করতে বসতে বল্লো তাদের।
“ভাবী বসেন, বসেন, কিছু মনে করবেন না, আমার স্ত্রী অসুস্থ, তাই ঘর বাড়ীর এমন অবস্থা। গন্ধের উৎস খুজতে গিয়ে মুনিয়া তাকিয়ে দেখলো ঐ ঘরেরই এক কোনায় থাকা ছোট্ট কিন্ত আধুনিক রসুই ঘরের তাকের উপর থেকে মেঝে পর্যন্ত বাসী খাবারের খালি প্যাকেট এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।পাশেই বেসিনের ভেতর একগাদা ময়লা বাসন কোসন ডাই হয়ে পরে আছে।
‘না না এটা কোন ব্যাপার না সুমন সাহেব । বিদেশ বিভুই এমন তো হতেই পারে’, মাসুদ বলে ওঠে।
ওদের বসিয়ে সুমন পাশের রুমে গেল। ফিরে আসতেই মুনিয়া প্রশ্ন করে,
“কেমন আছে আপনার স্ত্রী” ?
‘ভালো নেই, দেখি বিকেলের দিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো। বমি হচ্ছে ভীষন , কিছুই খেতে পারে না’।জীবনে প্রথম বারের মত পিতা হতে যাওয়া বাংগালী যুবকটি লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় ।
তার স্ত্রীকে দেখার জন্য মুনিয়াকে ভেতরে যেতে অনুরোধ করলো সুমন। দুটো ছোট ছোট রুম নিয়ে তৈরি সেই ফ্ল্যাটটির একটি সেই বসা আর রান্নার জন্য আর এটা হলো তাদের শয্যাকক্ষ।সে ছোট্ট ঘর জুড়ে ঢাউস এক ডাবল বেড তাতে কুচকে থাকা চাদরের আধখানা গায়ে টেনে শুধু ফোমের উপর ঐদিকে মুখ ফিরিয়ে কাত হয়ে শুয়ে আছে আকাশ দীপিকা।
আসতে আসতেই সুমন বলেছিল এখানে ইলেকট্রিসিটি বিল অনেক ঊঠে তাই এসি ব্যাবহার না করে একটা ফ্যান কিনে নিয়েছে।সার্বক্ষনিক এসি চালানোর উপযোগী করে তৈরী সেই বাড়ির দুটো কক্ষই বাইরের প্রখর রোদ আর আদ্রতা মিলিয়ে যেন ভেপসে আছে। বদ্ধ ঘরের সেই আগুন গরম ভাপকে প্রানপনে দমাতে চেষ্টা করছে মাঝারী সাইজের এক টেবিল ফ্যান।
সামনে এসে দাড়াতেই মুনিয়া দেখতে পেলো শ্যামল পলি মাটিতে তৈরী সদ্য কৈশোর পেরুনো একটি মেয়ে প্রতিমার মত মুখ নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। কালো ধনুকের মত বাঁকা ভুরুর নীচ থেকে এক জোড়া পটল চেরা চোখ তুলে মৃদু ম্লান গলায় সে মুনিয়াকে বসতে অনুরোধ করে।তার কাজল কালো চোখের অতল দিঘীতে কি এক অজানা আশংকার ছায়া।
বিস্মিত মুনিয়ার মনে হলো বিধাতা যেন তার অকৃপন হাতে বাংলার সমস্ত সৌন্দর্য্যকে ঢেলে দিয়েছে সন্তান সম্ভবা এই কচি মেয়েটির দেহে। খুচরো কিছু আলাপের ফাকে ফাকে মুনিয়া চারিদিকে তার দৃষ্টি বুলিয়ে নেয়। ঘরের সব কিছুর মাঝেই যেন অযত্নের ছাপ ।এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় চোপড়গুলো পড়ে আছে ঠিক সামনের ঘরের সেই বাসি খাবারের প্যকেটে গুলোর মতই। খাটের পাশে একটা ছোট্ট তেপয়ার উপর সাত সকালেই দুটো জ্যুসের প্যকেট আর গ্লাস সাজিয়ে রেখে গেছে সুমন, কিছু খেতে পারছে না যখন তখন সে যেন শুয়ে শুয়েই জ্যুস ঢেলে খায় ।
সুমন সকাল দশটা থেকে রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত তার বিভিন্ন রকম ব্যবসা নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত থাকে। ভালোবাসার কমতি না থাকলেও আকাশ দীপিকাকে দেয়ার মত সময় তার হয়ে উঠে না। ভয়ানক প্রতিযোগীতার এই বাজারে বাড়ীতে বসে থাকলে চলে না সুমনের। এসবই আসতে আসতে সুমন অস্ফুট গলায় বলছিল মুনিয়া আর মাসুদকে।
মুনিয়া চেয়ে দেখে ঘরের একদিক জুড়ে থাকা কাচের দেয়াল ভেদ করে মেয়েটির কালো হরিণ চোখের ভেজা দৃষ্টি চলে গেছে সীমানা পেরিয়ে বহু বহু দুরে তার নিজ দেশে, নিবিড় ছায়ায় ঘেরা গ্রামের বাড়ীতে যেখানে আছে তার প্রিয়জনেরা। সেই প্রিয় মুখগুলো বিশেষ করে তার মাকে দেখার জন্য সমস্ত অন্তর যেন ব্যাকুল হয়ে আছে।
‘আপনার বাড়ী থেকে কেউ আসে নি’! মুনিয়ার প্রশ্নের জবাবে মেয়েটি জানায় তার এ অবস্থার কথা শুনে অবিবাহিতা এক ছোট বোন এসেছিল। তারপর একটু দম নিয়ে বল্লো :
“জানেন আমি এদেশের খাবার খেতে পারি না, এখানে কেউ নেই আমাকে দেখবে। আমার মায়ের হাতের রান্না খেতে খুব ইচ্ছে করে আপা, আমার মা যে কি অসাধারন রান্না করে কি বলবো আপনাকে’।
সব সন্তানের সেই চিরন্তন কথা শুনে মুনিয়ার মনে হলো শুধু মায়ের হাতের রান্নাই নয়, এই বালিকা বধুটি যেন তার অনাগত দিনের সমস্ত ভয়-ভাবনা নিয়ে মা এর আঁচলের ছায়ায় আশ্রয় নিতে ব্যাকুল ।
“তাহলে ভাইকে বলে আপনার মা কে কিছুদিনের জন্য এখানে আনিয়ে নেন।এ ভাবে সারাদিন একা একা ঘরে পড়ে থাকা”... কথা শেষ করতে পারে না। !
কিন্ত মা যে তার আসতে পারে না, বাবা, ভাই-বোনরা ছাড়াও গরু, বাছু্র, হাঁস মুরগী নিয়ে তাঁর মা এর এক বিশাল পরিবার। বিশেষ করে হাস মুরগীগুলো কি করে রেখে আসবে, কে দেখবে মা ছাড়া ! অবলা জীবের কাছে মেয়ের ভালোবাসা পরাজিত হয়ে গেছে যেন।
“তাছাড়া আপনার ভাই চায় আমি এখানে থাকি, বলে এদেশে চিকিৎসা ভালো, বলেন দেখি আমাদের দেশে মেয়েদের কি বাচ্চা হয়না, সবার বাচ্চাই কি বিদেশে হয়”!
খাঁচায় আটকে থাকা পাখির মতন বদ্ধ ঘরের ভেতর ক্লান্ত বিপর্যস্ত এক আর্ত কন্ঠের ছুড়ে দেয়া প্রশ্নের জবাব দিতে পারে না মুনিয়া। তার নিজেরও যেন সুউচ্চ অট্টালিকার অনেক উপরের সেই ছোট্ট ঘরের ভেতর বসে দম আটকে আসছিল। তাড়াতাড়ি মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সামনের ঘরে এসে দাড়ালো মুনিয়া ।
‘কেমন দেখলেন’ ? সুমন এর উদবিগ্ন প্রশ্নের উত্তরে মুনিয়া জানালো সে যেন কিছুদিনের জন্য হলেও অন্ততঃ তার স্ত্রীকে দেশে তার আপনজনের মাঝে পাঠিয়ে দেয়, না হলে কোন রকম মানসিক রোগে সে আক্রান্ত হতে পারে ।
‘দেখি কি করা যায়, এই মন্দার বাজারে ব্যবসা রেখে কিছুদিনের জন্য যাওয়া মুশকিল, দেশ থেকে কাউকে এনে পাঠিয়ে দেবো কি না বুঝতে পারছি না, টাকা পয়সার তো একটা ব্যাপার আছে,’, বলে চুপ হয়ে গেল সুমন।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত আকাশ দীপিকা সুউচ্চ ভবনের অনেক উপরের সেই খাচায় বন্দী হয়েই আছে। চারিদিক আবদ্ধ সেই বাসায় রাপুনজেলের মত জানালা দিয়ে তার দীর্ঘ কেশ ঝুলিয়ে দেবার কোন উপায় নেই যা বেয়ে কেউ এসে তাকে উদ্ধার করে দেশে নিয়ে যাবে । কি অসহায় ..।।
এক ক্রন্দসী হিরন্ময়ী উর্বশী
আজ একটি জরুরী কাজে মুনিয়াকে সরকারী একটি অফিসে যেতে হলো । টাচ স্ক্রীন থেকে সিরিয়াল নাম্বার বের করে দিল এক হাসি খুশী যুবক। কাউন্টার থেকে কাজ সেরে তাকে এক অফিসারের সামনে বসিয়ে দিয়ে গেল একজন । মুনিয়া চেয়ে দেখে হালকা নীলের উপর স্ট্রাইপ দেয়া শার্ট, টাই, কালো কোট আর স্কার্ট পড়া সেই দুর্দান্ত স্মার্ট অফিসার তরুনী ডান দিকে সামান্য মুখটি ঘুরিয়ে কার সাথে জানি ফোনে কথা বলছে।
মাঝখানে সিঁথি করা হালকা বাদামী রঙ এর কাধ পর্যন্ত কাটা ক্লিপ দিয়ে আটকানো চুলগুলো লুটিয়ে পড়ে আছে তার শঙ্খের মত ঘাড়ের ওপর। একবার এক সেকেন্ডের জন্য এদিকে মুখ ঘোরাতেই মুনিয়া অবাক হয়ে গেল মেয়েটির রূপ দেখে!
ভাষা না জানার জন্য মুনিয়া কিছুই বুঝতে পারছিল না । কিন্ত তার গলার স্বরে বোঝা যাচ্ছিল সে তার খুব প্রিয় একজনের সাথে কথা বলছে ।তার অভিব্যক্তির সাথে সুর আর স্বরের ওঠানামায় মিশে ছিল মান অভিমান, ঈর্ষা, রোষ, বেদনা যা মিলিয়ে প্রেমের করুন সব অনুভুতি্র প্রকাশ ।
তার উপস্থিতি সম্পর্কে মনে হলো সম্পুর্ন অজ্ঞাত সেই অপরূপা মুখ ফিরিয়ে ফোনে কথা বলছেই । দীর্ঘ সময় ধরে তার ক্লান্ত ও আকুল কন্ঠ কোন এক জনের মিথ্যা অভিযোগ খন্ডনে বার বার সনির্বন্ধ অনুরোধ করে চলেছে, তারই সাথে ক্ষোভ-দুঃখ একসাথে ঝরে পরছে তার সুরেলা কন্ঠ বেয়ে।
এমন সময় স্লিপ দেয়া সেই ছেলেটি লাজুক লাজুক ভাবে মুনিয়ার পাশের চেয়ারে এসে বসলো আর তাকিয়ে দেখতে লাগলো সেই মেয়েটির দিকে। মুনিয়াও অবাক হয়ে ভাবছিল সার্ভিসের ব্যাপারে তাদের এত সুনাম সেখানে তাকে বসিয়ে মেয়েটি কার সাথে এতক্ষন ধরে কথা বলছে!এমন ঘটনা তো সে কখনো এর আগে দেখেনি ! আর অফিসিয়াল কথা যে নয় তা সে আগেই বুঝতে পেরেছিল। তারপর ও সেই রূপসীর রূপে বিস্মিত মুনিয়া অবাক হলেও এক বারের জন্যও বিরক্ত বোধ করে নি ।
প্রায় ৭/৮ মিনিট পর মেয়েটি ফোন রেখে রিভলভিং চেয়ারটি ঘুরিয়ে মুনিয়ার দিকে পুরো চোখ মেলে তাকালো। তার সেই চোখে এক গভীর বেদনাক্লিষ্ট দৃষ্টি। তাড়াতাড়ি মাথা নীচু করে বুকের কাছে হাতদুটো নিয়ে করজোড়ে ইংরাজীতে বার বার বলতে লাগলো “আমি দুঃখিত, আমি অত্যন্ত দুঃখিত”।
কিন্ত মুনিয়া মুখে বলছে ‘ইটস ওকে’, কিন্ত সে বিস্মিত নয়নে চেয়ে আছে মেয়েটির দিকে। মানুষ ও এত সুন্দর হয়! ঠিক যেন ঊষার মত, ভরা পুর্নিমার চাঁদের মত এক নির্মল, কোমল আর রৌদ্রকরোজ্জ্বল সুর্য্যের মত উজ্জ্বল সেই রূপ।
দুধের সাথে আলতা নয়, খানিকটা হলুদ ছেচে যেন মিশিয়ে দিয়েছে এমনি মসৃন তার গায়ের রঙ, সামান্য লম্বাটে মুখটিতে অত্যন্ত আকর্ষনীয় এক জোড়া চোখের দীর্ঘ ঘন কালো পল্লব, হয়তো মাসকারা দিয়েছে। চোখের পাতার উপর চিক চিক করছে আফসানার মতন খানিকটা আই শ্যডো। গোলাপী গাল দুটোয় ব্লাশ অন লাগানো , অথবা এমনই লাল আভাময় কে জানে! তার সাজ সজ্জা দেখে মনে হলো কোনটাই অতিরঞ্জিত নয়, কোন কিছুই যেন তার নিজস্ব সৌন্দর্য্যকে ছাপিয়ে যায় নি ।
তার কাছে কি কাজে এসেছে মুনিয়া জিজ্ঞেস করতেই গাঢ় গোলাপী একজোড়া ঠোটের ফাকে সাদা ধবধবে দাতের সারি দেখা গেল। মুনিয়ার মনে হলো এই অপরূপ রূপসী মেয়েটি কিছুতেই পার্থিব জগতের নয়, এ যেন, এ যেন ঠিক স্বর্গের কোন এক হিরন্ময়ী উর্বশী।
প্রাচীন কবি রাজশেখরের কবিতার ভাষায় বলতে হয় ...
নীল সরোজে নয়ন গড়া,মুখ গড়েছে শ্বেত কমল ,
পল্লবেরি রক্ত অধর, দন্তে ঝোলে কুন্দ দল ।
তবে এই মুহুর্তে মুনিয়ার কাজ নিয়ে দারুন ব্যস্ত হলেও ক্রন্দসী হিরন্ময়ী তার সমস্ত সৌন্দর্য্য দিয়েও লুকিয়ে রাখতে পারছে না আহত হৃদয়ের গভীর সেই বেদনাকে। দীর্ঘ পল্লব ঘেরা আয়ত চোখের কোনায় জমে থাকা চিক চিকে হীরের কুচির মত অশ্রু কনাগুলো যেন মুনিয়ার সামনে পড়ে না যায় তার আপ্রান চেষ্টায় রত।
চোখের কোনে জমে থাকা হীরের কুচির সাথে খানিক আগে ফোনের সেই মিনতি ভরা ক্লান্ত কন্ঠের ভাষা মুনিয়া না বুঝলেও এটুকু বুঝেছিল যে বহুদিনের একটি গভীর সম্পর্কের আজ ইতি ঘটলো ।
ছবি সুত্রঃ নেট থেকে, জ্যামাইকান র্যগে সিংগার বব মার্লের একটি বিখ্যাত গানের কলি ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:৪৪