ভোর বেলায় কলকাতার বিখ্যাত এস এস হগ মার্কেট তথা নিউমার্কেটের সামনের দৃশ্য
সময় বিকেল ৫টা, আমরা ৩২ জন ছাত্র ছাত্রী অপেক্ষা করছি ঢাবির আমাদের বিভাগের এক নির্জন শ্রেনী কক্ষে।আমাদের চেয়ারম্যান স্যার ভারত ভ্রমনের আগে ওরিয়েন্টেশনের জন্য ডেকেছেন। উনি আমাদের টিম লিডার।এর আগে আরো ১৬টি টিম নিয়ে উনি ভারত সফরে গিয়েছেন।এ ব্যাপারে ওনার বিশাল অভিজ্ঞতা।
আমরা গভীর মনযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনছি। স্যারের বক্তব্যের সারমর্ম হলো ইন্ডিয়া গিয়ে আমরা কি করবো আর কি করবোনা। প্রথম শর্ত হলো আমাদের যেমন হোটেলেই উঠাক না কেন আমরা কোন আপত্তি করতে পারবো না। আর যাই খেতে দিক তা নিয়ে কোন উচ্চ বাচ্য করা চলবে না !
আমরা বেশিরভাগই ছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। স্যারের কথা শুনে আমরা মিনমিন করে বল্লাম, 'জী স্যার'।
কিন্ত আমাদের যেসব বন্ধুরা শিল্পপতি বা ধনীর পুত্র কন্যা তারা সমস্বরে চেচিয়ে বল্লো ' স্যার নো প্রবলেম, এনিয়ে একদম চিন্তা করবেন না'।
আরো অনেক ওয়াজ নসিহতের পর স্যার সবশেষে বললেন;
'আর হ্যা আরেকটা কথা মনে রেখো সেটা হলো তোমরা সবাই বেশী বেশী করে পানি খাবে । আমি কাউকে নিয়ে গতবারের মত ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি করতে চাইনা, পানি কেনার টাকা না থাকলে আমি দেবো'।
এ কথা শোনার সাথে সাথে আমাদের ছাত্রীকুলের মন বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। ইশ স্যার আর কথা খুজে পায়না ! পানি খাই আর টয়লেট খুজে মরি আরকি ! স্যার আমাদের চেহারা দেখেই মনের কথা টের পেয়ে বল্লেন, 'শোনো তোমরা যা নিয়ে ভাবছো তা নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না'।
আমাদের ফিশফিশ বন্ধ।
ঢাকা থেকে ভোরবেলা বাসে যাত্রা শুরু হলো।প্রথম গন্তব্য যশোর সার্কিট হাউস ।পরদিন যশোর থেকে বেনাপোল আসলাম বাসে ,বেনাপোল থেকে বনঁগা রিকশা, বনঁগা থেকে কলকাতা ইলেকট্রিক ট্রেন।বনঁগায় বেলা তখন সকাল ১০টা, অফিস টাইম। ডেইলী প্যাসেন্জারে পরিপুর্ন সেই ট্রেনে আমরা ঠেলে ঠুলে উঠলাম।
এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমাদের কারোরই নেই । আমাদের ছেলেরা ভদ্রতা করে সেখানকার অনেক স্থানীয় মহিলাদের সীট ছেড়ে দিল। আরেক কামরায় আমরা কয়েকটা মেয়ে দাড়িয়েছিলাম কিন্ত লোকাল কোন লোক আমাদের সীট ছেড়ে দেয়নি।
এই সেই বিখ্যাত সাদার স্ট্রীট
ভর দুপুরে শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশনে পৌছালাম। স্যার আমাদের কলকাতার বিখ্যাত বাজেট হোটেল এলাকা নিউমার্কেটের কাছে সাদার স্ট্রীটের এক হোটেল নিয়ে প্রবেশ করলেন।এলাকাটি পর্যটনের উপর বিখ্যাত লোনলি প্ল্যানেট বইয়েও উল্লেখ করা আছে। সেই হোটেলের চেহারা দেখে আমরা হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারলাম না। এজন্যই বোধহয় স্যার আমাদের হোটেল বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন !
বৃটিশ আমলে তৈরী পলেস্তরা খসা লাল রংগের ক্ষয়ে যাওয়া ইট বের হওয়া দালানের নিচতালাটা পুরোটা জুড়ে ডরমিটরী। সেখানে সারি সারি চৌকি পাতা আর তার উপর পনের বিশ জন শ্বেতাংগ নর-নারী চিৎপাত হয়ে শুয়ে আছে । তাদের হাত পায়ের সবটা জুড়ে উল্কি কাটা আর সাথে বিচিত্র তাদের বেশভুষা। কেউ কেউ নেশার ঘোরেই উঠে বসে ইতি উতি তাকিয়ে আবার ধপাস করে শুয়ে পরছে। বিষয়টি আমাদের কাছে সেসময় ভীষন অভিনব ছিল।আমরা বন্ধু বান্ধবরা দরজার কাছে জড়োসরো হয়ে দাড়িয়ে অবাক বিস্ময় নিয়ে এ দৃশ্য দেখছিলাম।
পরে আমরা জেনেছিলাম ওই এলাকার পুরোটা জুড়েই নেশাখোরদের স্বর্গরাজ্য।স্যার আমাদের আশ্বস্ত করলেন আমরা যেন ভয় না পাই। কারন হিপ্পিগুলো নাকি ভারি নিরীহ!
হোটেল মালিক বেরিয়ে এসে স্যারকে জড়িয়ে ধরলো।প্রতি বছর স্যার ছেলেপুলে নিয়ে এই হোটেলে আসায় ওনারা এখন বন্ধু !
দোতালায় আমাদের রুম দেয়া হলো । হাত মুখ ধুয়ে খেতে গেলাম সেসময় সেখানকার বিখ্যাত রাস্তার পাশের বাংগালী খাবারের একমাত্র পুচকে এক রেস্তোরা তাজ কন্টিনেন্টালে ।
তাজ কন্টিনেন্টাল !
চার পাঁচটা সাদা মাটা কাঠের টেবিল আর কাঠের চেয়ার। ক্ষুধার জ্বালায় সবাই চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। কোন মতে কেউ বসে কেউ দাড়িয়ে ডাল, ভাজি আর রুই মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে রুমে এসে সোজা বিছানায়।
২৪ শে অগাষ্ট ২০১২ এবার যখন আবার পনেরতম বারের মত কলকাতা গেলাম তখন ঐ এলাকায় রাধুনী, কস্তুরী, প্রিন্স ছাড়াও ভোজ নামে একদম খাঁটি বাংলাদেশী খাবারের খুবই পরিচ্ছন্ন রেস্তোরা হয়েছে। এসব রেস্তোরায় কলার মোঁচা দিয়ে চিংড়ী আর বিশাল পাবদা মাছের চরচরি খেলেও আমার প্রথম জীবনের স্ব্বতি বিজড়িত রেস্তোরা তাজ কন্টিনেন্টালে খেতে ভুলিনি।
চল্লিশ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত তাজের সবচেয়ে পুরোনো কর্মী ইসলাম ভাই
তাজের এই খাবারই পরবর্তী পনেরদিন কি মিস করেছি তা বলার নয়। মনে আছে আগ্রায় হোটেলের ভেতরে সিড়ির সামনে দিয়ে যাবার সময় দোতালায় বেয়ারাদের সাথে আমাদের ক্লাশের ছেলেদের উত্তেজিত কন্ঠে ভুলভাল হিন্দী শুনে হাসতে হাসতে শেষ ।
' ইয়ে কেয়া হ্যায়! ইয়ে কেয়া খানা! লে যাও, লে যাও, বিরিয়ানি লে আও, পোলাও লে আও' ।
কারন সেদিন স্যারের নির্দেশিত মেন্যু ছিল আমাদের অনাভ্যস্ত মুখে বিশ্রী স্বাদের চানা ডাল, পালং শাক আর প্লেইন চাপাতি ! স্যার যে কেন আগেই আমাদের খাবার নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করতে মানা করেছিলেন সেদিন বুঝেছিলাম। বহুদর্শী মানুষ উনি!
মে মাসের গরমে আমাদের প্রান যায় যায়। স্যারের কথা শোনার দরকার নাই, আমরা নিজেরাই পাগলের মত বোতলের পর বোতল আর গ্লাসের পর গ্লাস নিম্বু পানি খাচ্ছি । কিন্ত কই যাচ্ছে সেই লিটার লিটার পানি ! শরীর যেন নিজেই মরুভুমি।মুহুর্তে সব পানি শুষে নিচ্ছে।আর এর জন্য কিনা আমাদের ঢাকায় বসে কত টেনশন!
মাস্টার্সে আমাদের একটি পাঠ্যবিষয় ছিল মুঘল আর্কিটেকচার ইন ইন্ডিয়া। স্যার চাইছেন আমরা যেন সব কিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখি । এটা ওনার সাবজেক্ট,১০০ মার্কের পরীক্ষা।
কিন্ত আর কত দেখবো , সম্রাট আকবর, শাহজাহান আর জাহাংগীরের সমস্ত বিস্বয়কর স্থাপত্যকলা ! সব কিছুই তখন একই রকম লাগছে । তাছাড়া আমাদের সবার মন তখন পরে আছে রাস্তার পাশের রকমারী দোকান, শপিং সেন্টার আর সিনেমা হলে!
স্যারও সহজে ছাড়ার পাত্র নন।শেষমেষ উনি যখন আমাদের জয়পুরে আর কিছুদিন পরেই বিলীন হয়ে পরবে এমন টাইপের এক চিড়িয়াখানায় নিয়ে হাজির করলেন তখন ছেলেদের আর বাঁধ মানলোনা।নোয়াখালির বন্ধু শহীদ চেঁচিয়ে উঠলো,
‘বিলাইর লাহান দুঈখান বাঘের বাইচ্চা দেহানের লাই আঙ্গোরে ঈয়ানে আইনছে কিত্তো’!!
কি যে এক অবস্থা! অবশেষে ছুটি মিল্লো।আমরা দৌড় হাওয়া মহলের দিকে রাস্তার পাশের বাজারে।
ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে জয়পুর থেকে খুব ভোরে রওনা দিয়ে আজমীঢ়ে পৌছালাম। সেদিনটি ছিল উপমহাদেশের বিখ্যাত সুফী সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশ্তী রঃ এর ওরসের শেষদিন। স্যার আমাদের বিকেলে মাজার যিয়ারত করতে নিয়ে গেলেন। সে যে কি প্রচন্ড ভীড় বলার মত নয়।সবাই খাজাবাবার কবরের চারিদিক ঘুরে ঘুরে জিয়ারত করছে।
আমি সেই ঘুর্নায়মান ভক্তদের মাঝে কি করে পরে গেলাম জানি না কিন্ত আর তো বের হতে পারিনা! আমার ডান দিকে দু স্তর লোক আর বাদিকে পাঁচ স্তর। আমি তো চক্রবুহ্যের মত ঘুরেই যাচ্ছি,ঘুরেই যাচ্ছি। আমার ডান হাত সামনের দুজনের মাঝখানে লম্বা হয়ে আটকে আছে। টেনে বের করা যাচ্ছেনা কিছুতেই।
অবশেষে আমারই এক ক্লাসমেট বুঝতে পেরে সেই চক্রের মধ্য ঝাপিয়ে পড়লো। ঠিক যেমন মুসা নবীর লাঠির আঘাতে লোহিত সাগর দুভাগ হয়ে পড়েছিলো তেমনি ওর বিশাল দেহের পতনে লোকজন দুভাগ হয়ে পরলো আর ও আমাকে টেনে বের করে আনলো। বন্ধু আসিফ ভালোমানুষের মত মুখ করে বল্লো,
'কি ব্যাপার জুন তুমি অমন করে লোকগুলোর সাথে পাগলের মত ঘুরছিলে কেন শুনি'!
রাগের চোটে আমি চুপ করে রইলাম।
সন্ধ্যা থেকে রাত আমরা আজমীঢের বিখ্যাত আনা সাগরের শ্বেত পাথরের চাতালে বসেছিলাম। আজমীঢে গিয়েছে আনা সাগর যায়নি এমন লোকের সংখ্যাই প্রচুর। আমার চেনা জানা অনেকেই এর খবরই জানে না । আমি মনে করি এই অপরুপ লেকটি সবার দেখা উচিৎ।
ভারতের বিখ্যাত রাজা পৃথ্বিরাজ চৌহানের দাদা আনাজী এই কৃত্রিম লেকটি তৈরি করেন। এর এক পাশ শ্বেত পাথরের চাতাল আর ক্যানোপি নির্মান করেন সম্রাট শাহজাহান আর ১৩ কিমি জায়গা নিয়ে দৌলাতাবাগ বাগান তৈরী হয় সম্রাট জাহাংগীরের নির্দেশে।
আনা সাগর
মরু এলাকা বলে রাত আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে আসছে। বিশাল লেকের পানি থেকে ঠান্ডা বাতাস ভেসে আসছে। খুব সুন্দর পরিবেশ। স্যার সবাইকে গান গাইতে অনুরোধ করায় বেসুরো গলার যে এক ঐক্যতান শুরু হল সে আর না বললেই না। উনি তাড়াতাড়ি আমাদের চুপ করতে বল্লেন। কারণ শিয়াল দেখা না গেলেও আশ্চর্যজনক ভাবে কোথা থেকে যেন দুএকটা সারমেয় এসে হাজির!
পরদিন সকালে দিল্লী চলে আসবো । আবার গেলাম মাজারে। এবার একটা অদ্ভুত দৃশ্য। সেখানকার বিশাল ডেগে ওরসের খিচুরী রান্না হয়েছে। উল্লেখ্য যে, সেই হাড়িতে মানত করে যত প্রকার খাবার জিনিস ফেলা হয় তা সব একসাথে মিশিয়ে এই খিচুড়ি রান্না হয়ে থাকে। মই দিয়ে নীচে নেমে সেখানকার লোকজন খিচুরী তুলে ভক্তদের মাঝে বিলিয়ে দেয় তোবারক হিসেবে।
আপাদমস্তক খিচুরি শোভিত এক লোক যখন বাল্টি ভরা খিচুড়ি নিয়ে এগিয়ে আসলো আমাদের দিকে , আমরা লাফ দিয়ে পিছনে সরে গেলাম। বুঝলাম না কেন এত দ্রুত তোবারকের প্রতি আমাদের ভক্তি শ্রদ্ধা উবে গেল !! হয়তো এ দৃশ্য চোখে না দেখলে এই খিচুরী মাথায় ঠেকিয়ে ভক্তি ভরে খেয়ে নিতাম।
খাজা মইনুদ্দিন চিশতি রঃএর দরগার বিখ্যাত ডেগ।
এই সফরে আমাদের সাথে এক ম্যাডামও ছিলেন। আমরা তাকে সবাই মিলে খুব এড়িয়ে চলছিলাম। কারন তার সামনে পড়লেই বলে উঠতো, ' এই মেয়ে আমার ছাতাটা ধরতো, এই ছেলে আমার ফ্লাক্সটা নাওতো', কি যে জ্বালা, না বলাও যায়না। ঝামেলার জন্য আমরা যেখানে সবাই খালি হাতে বের হোতাম।সেখানে ওনার জিনিস নিয়ে আমাদের হাটতে হতো।
রুম সংকটের কারনে ম্যাডামের রুমেও দুটো মেয়েকে থাকতে হয়েছিল। ওদের প্রতিটি মুহুর্ত ছিল রোজ কেয়ামত। আমরা যেখানে অনেক রাত ধরে আড্ডা মারছি আর বেচারা ওদের রাত নটার মধ্যে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়া বাধ্যতামুলক ছিল।ওরা যে বের হয়ে আমাদের রুমে আসবে সেই পারমিশন ও নেই।তার উপর এটা করো, ওটা করো। একদিন গিয়ে দেখি ওরা ম্যাডামের নতুন কেনা শাড়ীতে ফল লাগাচ্ছে !
স্যার জানতো ওনার নেচারটা , তাই আমরা বেশি দুস্টামি করলে ম্যাডামের রুম মেট করার ভয় দেখাতো।
এর প্রতিশোধ হিসেবে আসার সময় বেনাপোল সীমান্তে ম্যাডামের কিনে আনা ফলগুলো আমরা কয়েকজন মিলে চুরি করে খেয়ে শেষ করেছিলাম। এতে উনি এমন ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যা বলার নয়। কিন্ত চোর ধরতে পারে নি ! এটা দেখে স্যার মুচকি হেসে রাতে আমাদের যশোর সার্কিট হাউসে ৫০০ লিচু কিনে দিয়েছিল খাবার জন্য।
প্রথম জীবনের ছাত্র অবস্থার সেই ভারত ভ্রমন আমাদের স্ব্বতির মনিকোঠায় এখনো ভাস্বর হয়ে আছে।কত অকারন হাসাহাসি, কত খুনসুটি, কত অভিমান, কত টুকরো টুকরো কথা কাটাকাটি পনেরদিন ধরে। এখনো বন্ধু বান্ধবরা দেখা হলে সেদিনগুলো নিয়ে কথা উঠলে বলে এর পর সবাই অনেকবার ইন্ডিয়া গিয়েছে কিন্ত তেমনটি নাকি আর কখনোই লাগে নি।
জেনারেশন সুপারস্টারের জন্য নিজামের এই ছবি