তখন ২০০৯ সাল। আমাদের স্কুলের এক নাম করা প্রেমিক-প্রেমিকা ছিল,ছোটবড়,ছাত্র,শিক্ষক, দফতর পিয়ন সবাই জানতো তাদের এই প্রেমের কথা।
ছেলেটার নাম ছিল উৎপল,মেয়ের নাম ছিল রুপা।
রুপার বাসা ছিল আমার বাসা থেকে একটু দূরে। তখন গ্রামে ফোন এতটা হাতে হাতে পৌছায়নি আমাদের বয়সী ছেলে মেয়েদের হাতে। উৎপল আর রুপা দি বেশীর ভাগ চিঠি আমাকে দিয়ে চালাচালি করতো।
ওদের প্রেম,স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে পাড়া, মহল্লা, গ্রাম সবার কানে কানে যখন ঢোলের মত বাজতে শুরু করলো৷
তখন রুপা দির বাসায় বিয়ে দেওয়ার জন্য তাড়াহুড়া চললো,একদিন রুপার বাবা পরিমল কাকা এসে আমাকে বেশ শাসিয়ে গেছিল আমার বিনা বেতনের এই পিয়নের চাকরির জন্য।
বিয়ের দিনক্ষন ঘনিয়ে এলো, রুপা দির লাস্ট দেয়া চিঠিটা আমি খুলে পড়েছিলাম। ক্লাস টেনে পড়া একটা মেয়ের প্রিয়জনকে পাওয়ার সে কি আকুতি।
আমার বেশ মনে আছে,উৎপল দাকে লিখছিল......"উৎপল,আমি টাকা পয়সা কিছুই আমার চাইনা। আগামী পরশু সন্ধ্যায় ওরা আসবে। আমার এক পরিচিত মাসির বাসা আছে দৌলতপুর,তুমি এর আগেই চলে এসো তালতলায়৷ আমাকে কোন ভাবে জানিও এসে আমি চলে যাবো"!
উৎপল দার ফিরতি চিঠি আমি পড়িনি। সম্ভবত উৎপল এই প্রস্তাবে সাড়া দিইনি।
সেই রুপদির বিয়ে হল,এখন তার দুই দুটো ছেলেমেয়ে।
উৎপল দা দারিদ্র্যতার কড়াঘাতে দেনা পাওনা পরিশোধ না করতে পেরে ইন্ডিয়ায় পালিয়ে গেছে বেশ কয়েকবছর আগে।
গতবছর আমি ছুটিতে যাওয়ার পরে আমাদের বাড়ি থেকে অদূরে একটা বাজারে রুপাদির সাথে দেখা হয়েছিল,সাথে ছিল একটা বাচ্চা,আর একটা কোলে।
আমাকে দেখে উষ্ণ হাসি হেসে, "তোকে অনেকদিন দেখিনা "
--হুম তোকেও তো দেখিনা দিদি!
দুটো বাচ্চার পরে শরীর বেশ ভেঙে গেছে। চোখের নিচে কালচে দাগ।মুখটা বেশ ভিজে ভিজে,মনে হয় যেন মুখে চুপচুপে তেল মাখা।
দেখে মনে হল না যে রুপাদির উৎপলের কথা মনেই আছে। সংসার জীবনে যেমন দেখায় আর কি।
তারপর আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে বললো,
"জয়নাল তুই উৎপলের কোন খোঁজ জানিস"
আমি বিস্ময় চোখে উত্তর দিলাম, "হ্যা ভারতে পালিয়ে গেছে"।
--কতটাকা দেনা হয়ছে,যে ভারতে যেতে হলো!আর আসবে কি?
-- জানিনা, তোর এখনও মনে আছো উৎপল দার কথা?
রুপা দি আমার কথা শুনে হাসলো,লাল লিপিস্টিক মাখানো ঠোটের মাঝখানে চিক চিক করতেছিল কয়েকটা দাঁত। একটু পরে বাস চলে আাসায় রুপাদির জামাই ওকে ডাক দিল।
রুপা দি বিস্ময় মাখা হাসিতে আমাকে
" আসি রে " বলে চলে গেল। রুপাদির এই হাসিটা খুশির ছিল না। এই হাসি ছিল প্রতীক্ষার।
অপেক্ষা আর প্রতীক্ষার পার্থক্য আমি বুঝিনা।
তবুও আমি নিজেই, "কখনও আর পাওয়া সম্ভব না" জেনেও কারও জন্য এমন উতলা হয়ে অপেক্ষা করার নাম অপেক্ষা দিলাম না,আমি এই অপেক্ষাকে আরও গভীরতা মিশিয়ে নাম দিলাম প্রতীক্ষা।
স্বামী, সন্তান,পরিবার সবকিছু থাকার পরেও রুপার মত একজন নিভৃতচারী নারীর কারো জন্য এই প্রতীক্ষা বড্ড মধুর।
সংসার,সন্ততি, ধর্ম,অর্থ,সবকিছুর মাঝখানে থেকেও এই পৃথিবীতে এমন কতশত অপেক্ষা যে নিভৃতে কাঁদে যা কেউ জানেনা।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:৩৮