জীবন নিয়ে খামাকা আমি কখনই লিখিনা, লিখতেও চাইনা। আমার জীবন কাহিনী হয়তো কাজী নজরুল ইসলামের রুটি বিক্রি থেকে কবি হওয়ার মত না, তবে আমার জীবন ছিল খড়কুটা পুড়ানোর মত। আমি আমার এসব কাহিনী কখনও কাউকে বলতে চাইনা। তবুও নিজেকে গোপন রেখে কিছু কথা বলতে ইচ্ছে করে রংমহলের এই শহরে।
আমাদের আর্থিক অবস্থা চরম খারাপ।খারাপ বলতে এতখানি খারাপ যে আমাকে লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের চালাতে কাজকর্ম করতে হত।
আমাদের বাড়িটা ছিল একবারে অঁজপাড়াগায়ে,২০০৮ সালে আমার বাড়ির পাশে এক বড়লোক বাড়িতে একটা মেয়ে আসে বেড়াইতে,মেয়েটা ছিল ওই বড়লোকের শালী। ওর নাম ছিল নীলু(ছদ্মনাম)।আমি তখন ক্লাস এইটে পড়তাম,নীলু পড়তো ক্লাস সেভেনে।
যাইহোক তখনকার সময়ে আমাদের গ্রামে সবার বাড়ি টিভি ছিল না।খুব রেয়ার কয়েকটা বাড়িতে ছিল।তো সেই বড়লোক বাড়িতে টিভি/সিডি থাকায় আমি প্রায়ই যেতাম টিভিতে সিনেমা দেখতে। আদ্যপরি সেই যাওয়ার কারনেই নীলুর দেখা পাওয়া। তখন ছিল রমজান মাস টিভি দেখতে যেয়ে ক্লাস সেভেনের একটা অবুঝ মেয়ে আমার হৃদয়টাকে এতখানি নাড়া দিয়েছিল, সারাক্ষন ওকে নিয়েই ভাবতে ভাবতে দিন যেত। হয়তো বা তখম ম্যাচিউরড ছিলাম না তবে হৃদয়ে অভ্যন্তরে যে ঝড়তোলা ভালবাসা সৃষ্টি হয়েছিল। হলফ করে বলতে পারি তা ছিল,নিরেট নিঁখাদ।
প্রতদিন টিভি দিখতে গিয়ে আমার টিভি স্ক্রীনটা ছিল নীলুর মুখ। চোখের ভাষায় অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম জানিনা সে বুঝতে পেরেছিল কিনা।
একদিন আমি ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম, দেখলাম ওদের টিভি রুমের জানালা খোলা,ভেতরে নীলু একলা, আমি মনে মনে এমনই একটা মোক্ষম সুযোগ খুজতেছিলাম। হুট করে বৃষ্টি নামলো,শরীরে ছিল শার্ট আর লুঙ্গি।কোনরকমে জানালার পাশে গিয়ে ভিজতে ভিজতে ওকে ডাক দিলাম, ও শুনেও না শোনার ভান করে বসে রইল টিভি মুখী হয়ে,আনি আবার ও ডাক দিলাম কিন্তু শুনলো৷ না। আমি এবার আমার মনের কথাগুলো সব ঝেড়ে বলে দিলাম ওকে। ও সব শুনতে পাচ্ছিল বাট কোন প্রত্যিউত্তর করে নি।
কিন্তু বিধিবাম আমি যখন কথা বলতেছিলাম বা সবকিছু বলতেছিলাম তখন আমার এক আপন চাচাতো ভাই সবকিছু আড়ালে দাড়িয়ে সবকিছু শুনতে পেলো। বিপদ হলো সেখানে। চাচাতো ভাই গিয়া সেই বিকালে ই সেই বড়লোকের সাথে সাথে গিয়া সব খুলে বললো।আমি এসবের কিছুই জানিনা যে তৃতীয় পক্ষের কেউ কিছু শুনতে পেয়েছে কিনা।
তখন সম্ভবত আমার ক্লাস এইটে ফাইনাল পরীক্ষা চলতেছিল। পরদিন সম্ভবত সামাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়া বাসায় ফিরতে গিয়া বাড়ির পাশে এক দোকানে বসেছিলাম। বড়লোক লোকটার আবার তারই পাশে বিশাল চালের আড়ৎ ছিল। যাহোক আমি বসেছিলাম বড়লোক আসলো আমার ধারে। কপাল কুচকে চোখে মুখে উষ্ণ রাগ নিয়া আমায় বললো," কি রে তোরে ডাক দিলাম শুনলি না কেন!"
আমি এরকম অপ্রত্যাশিত কন্ঠ শুনে হাসতে হাসতে বললাম," কই তাহলে হয়তো আমি শুনতে পাইনি"
তারপর অনেকগুলো মানুষের সামনে উনি আমার ডান হাত দিয়া আমার কান ধরে মুড়াইতে মুড়াইতে বললো,"বামুন হয়ে চাঁদের দিকে হাতা বাড়াচ্ছিস শুনলাম,হাত কিন্তু কাটা যাবে বুজছিস"
আমার তখন লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হল,মনে মনে খোদাকে বলতে ইচ্ছে হল,খোদায় মাটি ফাকা করে দাও আমি ভিতরে ঢুকে যায়।
ভিতরে চরম লজ্জা নিয়েও আমি চোখে মুখে হাসি নিয়া দাড়ায়ে রইলাম। কিছুই বললাম না।
আশে পাশের লোক বললো কি হয়ছে ভাই, উনি বললো, যাকে বলছি সে বুঝতে পেরেছে।
যাহোক আনি স্কুল ব্যাগ নিয়া উঠে তখন বাড়ির দিকে রওনা দিলাম মানুষের অগোচরে গিয়া চোখ দিয়া জলোচ্ছাসের মত পানি গড়িয়ে পড়লো। বাড়িতে এসে মাকে বুঝতে দিবনা বলে বললাম চোখে পোকা পড়ছিল।
তারপরে কয়েকটা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি,নীলুর জন্য নয়। নীলুর বড়লোক দুলাভাইএর সেই কথা গুলো আমাকে বারংবার কামানের শেলের মত আঘাত করতো। আমার কান মোড়ানো,বামন বলা, আনি বুঝি কতখানি লজ্জার ব্যাথাতুর। সেদিন ২০০৮ সাল থেকে আজ ১৮ সাল এখনও ক্ষনে ক্ষনে এই কথাটা আমার চোখে ভাসে।
যাগগে এবার ছোট করি,তারপর দিন গেল,দিন আসলো,তারপর থেকে আর কখনই নীলুর সামনে যাওয়া হয়নি,একজনের মাধ্যমে শুনছিলাম সব বলে দিছিল আমার চাচতো ভাই।
একদিন রাত্রে আমার মাকে শুয়ে শুয়ে সব বলছিলাম। আমার মা বলছিল,আল্লাহ সবকিছু দেখছে,তিনি মহা বিচারক।আমি অবশ্য তাকে অভিশাপ ও দিইনি,আল্লাহর কাছে বিচারও দিইনি।
তারপর দেখতে দেখতে ০৯,১০,১১,১২,১৩,ছয়টা বছর কেটে গেল।
১৪ সালে ইন্টার শেষে আল্লাহর রহমতে আমার একটা গভার্নমেন্ট জব হয়ে গেছিল। আনন্দের সীমা ছিল না। সেবার চাকরি তে জয়েন করে কোর্সে গেছিলাম। ৮মাস পরে দেশের বাড়িতে ফিরে শুনলাম বড়লোকের বউটার ক্যান্সার হয়ছে,সেবার ছুটি কাটিয়ে আবার চলে গেলাম আবার ৫ মাসের মাথায় বাড়িতে আসলাম সেবার বাড়িতে এসে শুনলাম, বড়লোক লোকটার ডান হাত আর ডান পা প্যারালাইজড। কোনরকমে লাঠি ধরে হাটতে পারে। বউ আর ওনার পিছে অনেক টাকা পয়সা খরচ করলো জমি জমা বিক্রি করে অসহায়ত্বের অবস্থা,এখন সেই চালের আড়ৎ টা আর চালের আড়ৎ নাই, টং দোকানের মত কেজি দরে চাল বেঁচে। একটা ছেলে তার মদাকসেবী। উনি ডান হাত নড়াচড়া করতে পারে না। দোকানে বসে থাকে কেউ আসলে খরিদ্দার নিজেই চাল মেপে নিয়ে যায়।
এইতো সেদিন, ছুটিতে গিয়া উনার দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি উনি আমাকে ডাক দিয়া বললো,"এদিকে একটু আসো তো, এক লোক বাকি ৫ কেজি চাল নিছে, একটু লিখে দিয়ে যাও। "
আমি সযত্নে খাতা বের করে সুন্দর করে সেই বাকিতে নেওয়া লোকটার নাম লিখতেছিলাম।
হ্যা ডান হাত দিয়ায় লিখতেছিলাম,যে হাত টা বড়লোক কেটে নিতে চাইছিল।
৯ বছর আগের ঠিক মুহুর্তটা চোখের সামনে স্বপ্নের মত ভেসে উঠলো। ভিতরে বিষাদ হুহু করে উঠলো। আমি জানিনা ওনার মনে হইছিল কিনা সেদিনের সেই ঘটনা।
আমার মনে হইলো তীর তীর করে ভিতরে জল বইল দুজনেরই ডান হাত,যে হাত কাটা পড়ে যাওয়ার কথা সে হাত সচল ,যে হাত আমার হাত কাটার কথা সে হাত অচল। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি ওনাকে নেক হেদায়েত দিয়া আল্লাহ ওনাকে সুস্থ করে দিক। তাকে আবার আগের মত সচল সুস্থতা দান করুক।
নীলুর পরে খোঁজ নিছিলাম,নীলুর এখনও বিয়ে হয়নি,নীলুর বাবা মারা গেছিল কয়েক বছর আগে ক্যান্সারে,নীলুর মা এখন ক্যান্সার আক্রান্ত শুনছিলাম,নীলু এখন একা ভাইয়ের সংসারে থেকে খাই। আর বিষদ কিছু জানিনা,জানার চেষ্টাও করিনি।
আমি জানিনা নীলু আদৌ জানে কিনা,এ পৃথিবীর কারও মনে একটু ওর জন্য জায়গা ছিল,যার জন্য কান মোড়া খেয়ে চোখের পানি ফেলতে হয়েছিল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১১:৩৩