প্রতি বছর শীত আসলে বোঝা যায় আমাদের দেশের গরীব মানুষগুলোর কষ্টের মাত্রা কতটা তীব্রতর
ছোট এই গরীব দেশের গ্রামের বেশীর ভাগ লোক দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে । আর আমাদের উত্তরাঞ্চল মঙ্গা পীড়িত অঞ্চল নামে বেশি পরিচিত বলতে আমার আপত্তি নেই, তবে এটা বলতে পারি গরীব এই মানুষগুলার মন যে কতটা আকাশের মত বিশাল, তা নিজের চোখে না দেখলে বুঝতে পারবেন না কেউ!!!!!!
পড়াশুনার জন্য রাজশাহীতে জীবনের পাঁচ পাচটি বছর কাটাতে হয়েছে। আমের জন্য বিখ্যাত এই শহরের আবহাওয়া যে কি পরিমান অদ্ভুত তা বুঝতেই আমার কয়েক বছর লেগেছে। দেখা গেল প্রচন্ড মেঘলা আকাশ ,মনে হচ্ছে এই বুঝি আকাশ থেকে অঝোর ধারায় বর্ষন শুরু হবে কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টা। মূহুরতের মধ্যে আকাশ পরিস্কার। গরমের দিনে যেমন গরম, শিতের দিনে তেমন প্রচুর ঠাণ্ডা!
ক্যাম্পাসে থাকা অবস্থায় রাতে ঘোরা ফেরা করা এক প্রকার নেশা হয়ে গিয়েছিল আমার। শীতের রাতে চাদর মুড়ি দিয়ে পিঠা খেতে প্রায়-শ বের হতাম হল থেকে।
ঠিক বছর দুয়েক আগে কন কনে এক শীতের রাতে বের হয়েছি, গন্তব্য রাজশাহী রেল স্টেশন। সঙ্গী হিসেবে পেলাম মারুফ, রবিন, দিনার, আলভী, সায়মন ও রাগীবকে।
হাটতে হাটতে আমরা তালাইমারী থেকে রেল স্টেশনের কাছাকাছি চলে এলাম। গায়ে চাদর মাথায় হরেক রকমের টুপি আর বুট পরে যখন আমার ফুর্তি করছি আর তখন রেল লাইনের ধার ঘেঁসে উদ্বাস্তু মানুষগুলা প্রচন্ড শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে, এই দৃশ্যটা প্রথম অবলোকন করল আলভী। গায়ের চাদর খুলে এক বৃদ্ধার গায়ে জড়িয়ে দিল আলভী, সাথে সাথে আমরাও সবাই আলভীকে অনুসরন করলাম। তারপর কি যে হল কেউ আর পিঠা খেলাম না। সবাই মিলে চিন্তায় মগ্ন হলাম, অসহায় এই মানুষগুলার পাশে কিভাবে হাতটা বাড়িয়ে দেওয়া যায়।
রুমে ফিরতে ফিরতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললাম কিছু একটা করার। পরেরদিন সকালে আরও কিছু বন্ধুদের ডেকে আমরা জানালাম বিষয়টা। সবাই খুব পজিটিভ ভাবে নিল। ক্যাম্পাসে আমরা তখন থার্ড ইয়ারের ছাত্র, আমাদের উপরে এক ব্যাচ আর নিচে দুই ব্যাচ। সব ব্যাচের ক্যাপ্টনেদেরকে ডেকে বিষয়টা উথথাপন করলাম। ফেসবুকের মাধ্যমেও প্রচারণা চালালাম। পুরা ক্যাম্পাসের সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের সাথে যোগ দিল।
স্বপ্নের সেই প্রজেক্টের নাম দিলাম দুর্বার বাংলা – বাংলার ডাকে, অসহায়ের পাশে এই ব্রত নিয়ে আমদের পথ চলা ।
টানা এক সপ্তাহ ঘুম হারাম করে টাকা পয়সা, নতুন-পূরানো মোট কথা যার কাছে যাই পেলাম তাই সংগ্রহ করলাম। আশার কথা আমাদের সম্মানীত স্যাররাও সতঃস্ফ্রুত ভাবে আমাদের সহযোগীতা করল।
চল্লিশ হাজারের মত নগদ টাকা আর প্রায় পনের বস্তা কাপড় পেলাম। ঢাকা থেকে ১৫০ পিস নতুন কম্বল কেনা হল। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা কাজ শুরু করেছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাক মত গুছিয়ে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের ঠিক ২ তারিখ যাত্রা শুরু করলাম রাজশাহী থেকে, গন্তব্য মঙ্গা পীড়িত সীমান্তবর্তী জেলা কুড়িগ্রাম। রাজশাহীর তালাইমারী থেকে বি.আর.টি.সি বাসে করে যাত্রা শুরু। সবার মনে এক অন্যরকম অনুভুতি!!!! সত্য কথা ভাল কাজ করার মধ্যে কি যে আনন্দ তা সেইদিন বুঝতে পারছিলাম। পথে যাত্রাবিরতীতে বগুরায় বন্ধু দিনারের ভাইয়ের হোটলে সবাই দুপুরের ভোজটা সারলাম।
ঘড়ির কাটায় তখন বিকেল ৩টা ছুঁই ছুঁই,আমরা কুড়িগ্রাম পৌছালাম। সেখানে আমাদের সাথে নতুন করে যোগ দিল আমার দুই খালাত ভাই শামীম ,সাদ্দাম আর মামাতো ভাই আরমান।
শামীমদের বাসায় হালকা নাস্তা করেই আমরা প্লান করলাম কোথা থেকে কিভাবে শুরু করা যায়। যার কোথা না বললেই নয়, আমার শ্রদ্ধেয় খালু রিটিয়ারড আর্মি অফিসার। উনি আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেলেন তার জাতিসংঘ মিশনে অর্জিত অভিজ্ঞতা দিয়ে। তারপর উনি একটা লিস্ট তৈরী করলেন, যেখানে প্রায় ৭০ জন দুঃস্থ মানুষের নাম ছিল। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে রাত দশটা পর্যন্ত আমরা নিজ হাতে অসহায় এই মানুষগুলাকে কম্বল বিতরন করলাম। খালুর লিস্ট করা ব্যাক্তি গুলা যে এই কম্বলের দাবিদার তা আমরা সচক্ষে প্রত্যক্ষ করলাম। মোটকথা খালু যে কোন স্বজন প্রীতি করেননি তা বুঝতে আমাদের দেরি হয়নি। যেহেতু আমার জেলায় বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিলাম তাই এই ব্যাপারটা নিয়ে আমি একটু চিন্তিত ছিলাম। যাই হোক ভাল ভালই প্রথম পর্বটা সারলাম.
প্রচন্ড ক্লান্ত, রাতের খাবার খেয়েই সবাই ঘুমে অচেতন। ঘুম থেকে উঠার আগেই দেখি শামিমদের বাড়িতে লোকজনের ভিড় , কম্বল বিতরণের কথা ছড়িয়ে পরেছে গোটা গ্রামে।
হাতে আছে ৭০ টা কম্বল যা আর এক গ্রামে বিতরনের জন্য রেখে দিয়েছিলাম। কি উপায় এখন! এই লোকগুলাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে খারাপ লাগছে, পরে বুদ্ধি করে আমাদের সংগ্রহীত কাপড়ের ৫ টা বস্তা খুলে সবাইকে দিয়েই তাড়াহুড়া করে পলায়ন করলাম।
গন্তব্য এবার এক অজপারা গাঁয়ে যেখানে নেই বিদ্যুৎ নেই ভাল একটা রাস্তা। মেঠোপথ ঘোড়ার গাড়িতে করে পাড়ি, কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে এবার আসলাম কাচিচর গ্রামে যেখানে কেটেছে আমার শৈশব।
এখানে আমাদের সার্বিক সহযোগিতা করল আমার শ্রদ্ধেয় আসাদুজ্জামান মামা। এখানেও খুব দ্রুত সব কাজ সেরে ফেললাম। কম্বল, কাপড় সব শেষ কিন্তু এখনো অনেক মানুষ আশায় হাত পেতে রইল। শেষমেশ পকেট থেকে যে যা পারলাম তাই দিয়েই তাদের পাশে হাত বাড়ালাম। রাতে স্থানীয় মেম্বারের সাথে মত বিনিময় হল। উনি আমাদের খুব উৎসাহ দিলেন, আমাদের জন্য দোয়া করলেন।
খুব ইচ্ছা ছিল বন্ধুদের নিয়ে গ্রাম ঘুরে দেখাবো, পুকুরের মাছ খাওয়াবো। কিন্তু তা আর পারলাম না। ওইদিন রাতেই রাওনা হলাম রাজশাহীর উদ্দেশ্যে।
অসহায় এই মানুষগুলা কম্বল,কাপড় আর টাকা পেয়ে কি যে খুশি হয়েছিল তা ভাষায় প্রাকাশ করতে পারব না।
বলাবাহুল্য আমার বন্ধুদের মধ্যে দিনার ছাড়া সবাই ছিল দক্ষিণ অঞ্চলের। ওরা এতটা খুশি হয়েছিল গ্রামের সহজ সরল মানুষদের আতিতিয়থ্যায় যে সারা রাস্তায় এই নিয়ে আলোচনা চলল।
জীবনে ভাল কাজ খুব বেশি করতে পারিনি। শীতার্ত মানুষগুলার পাশে হাত বাড়াতে পেরে নিজেকে অনেক ভাগ্যমান মনে হচ্ছিল। পরম করুণাময়ের কাছে হাজার শুকুরিয়া যে তিনি আমাদেরকে এই রকম একটা কাজ করার সুযোগ দিয়েছেন।
গল্পটা আর দীর্ঘায়িত না করে এখনেই শেষ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বিবেক বার বার তাড়া দিচ্ছে সত্যকে উম্মেচিত করবার। তাই আর না লিখে পারলাম না Crazy .
খ্যাতির জন্য মোটেই আমরা এই কাজটা করিনি। একান্ত নিজের বিবেকবোধ থকে আমরা এটাকে দায়িত্ত হিসেবে করেছিলাম। বলা বাহুল্য আমাদের যাতায়ত ও খাওয়ার টাকাও আমরা নিজেদের পকেট থেকে খরচ করেছিলাম, দুর্বার বাংলার একটা টাঁকাও যেন কারো পারসোনাল কাজে ব্যায় না হয় সে ব্যাপারে খুব সচেতন ছিলাম আমারা সবাই।
পরের দিন জেলা স্থানীয় পত্রিকায় আমদের নিয়ে নিউজ ছাপা হল, অনলাইনে বিডি ২৪ এও নিউজ এল। সবাই খুব খুশি। ভাবলাম আগামী বছর আরও বড় পরিসরে করব। জায়গাও নির্ধারণ করলাম, খুলনা বিভাগের কোন জেলা।
জীবনে যেটা কল্পনা করিনি, সেটাই হল Sad( ক্যম্পাসে ফেরার পর তৎকালীন ছাত্রনেতা আমাদের সবাইকে তার রুমে ডাকলেন। আমাদের কাছ থেকে হিসেব চাওয়া হল। হিসাবও দিলাম, সবি ঠিক আছে কিন্তু তারপরেও ছাত্রনেতা আমাদেরকে নিয়ে মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমাদেরকে মানসিকভাবে হেয় এবং হয়রানি করল। আমাদের অপরাধ আমারা তাকে কেন জানাইনি। আমাদেরকে বলা হল পরেরবার আয়োজন করলে তাকে যেন এই গ্রুপের প্রধান করা হয়।
এই বিষয়টা নিয়ে আমরা অনেক হতাশ হলাম, কারণ সবার নজরে আমরা পরে গিয়েছিলাম। পরেরবার ফাইনাল ইয়ারে সবাই ব্যস্ত হয়ে পরলাম। পারলাম না দুর্বার বাংলাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে। পর্দার আড়ালে থেকে ছোট ভাইদের সাহায্য করলাম। এবার ওরা নাম পরিবর্তন করে নতুন নামে যাত্রা শুরু করল। শত চেষ্টা করে ওরাও পারল না সফল হতে ।
প্রথমবার দুর্বার বাংলায় কুড়িগ্রামে যাদের পাশে দাড়তে পারিনি তাদের কথা দিয়েছিলাম আবার তাদের হাতে হাত মিলাব। কিন্তু না, তা আমি আর পারিনি। পরের বছর শীতের সময় যখন বাড়িতে গেলাম তখন অনেকেই দুর্বার বাংলার খোঁজ নিতে চাইল, তাদেরকে সত্য কথাটা বলতে পারলাম না। বুকে একরাশ চাপা কষ্ট নিয়েই থাকলাম ................
দেখতে দেখতে দুইটা বছর পার হয়ে গেল। আবার শীত নেমে এল। শীত এলেই মনে পরে যায় সেই সৃতি, দুর্বার বাংলার কথা .............
বিবেকের যে তাড়না থেকে দুর্বার বাংলা গড়েছিলাম, সেই দুর্বার বাংলা হয়তো আজ নেই, কিন্তু বিবেকের সেই তাড়না আজ ও আমায় ভাবায়। অনেক প্রশ্নের উত্তর আজও পাই না, হয়তো পাব না।
ভাল কোন কাজের উদ্যোগ যখন নোংরা রাজনীতির কারনে ব্যারথ হয় তখন সার্বিকভাবে সমগ্র দেশের উন্নয়ন ও পিছে পরে যায়। তাই তো আজও মাথা উঁচু করতে গিয়ে বার বার পড়ে যাচ্ছি আমরা। এর পরিত্রান কি নেই????
আর কতকাল এভাবে চলবে...............খুব কষ্ট লাগে মাঝে মাঝে । ইচ্ছা করে চলে যাই এদেশ থেকে
কিন্তু পারি না ,
চিৎকার করে গাইতে ইচছা করে
তুমি মিশ্রিত লগ্ন, মাধুরীর , জলে ভেজা কবিতায়
আছো সারওয়ার্দি, শেরেবাংলা ভাসানির শেষ ইচ্ছায়
তুমি বঙ্গবন্ধুর রক্তে আগুন জ্বলা জ্বালাময়ী সে ভাষণ
তুমি ধানের শীষে মিশে থাকা শহীদ জিয়ার স্বপন।
তুমি ছেলে হারা মা জাহানারা ইমামের "একাত্তরের দিনগুলি"
তুমি জসীমউদ্দীনের "নক্শী কাথার মাঠ" মুঠো মুঠো সোনার ধুলি।
তুমি ত্রিশ কিমবা তার অধিক লাখো শহীদের প্রাণ।
তুমি শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরীর , ভাই হারা "একুশের গান"।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।
জন্ম দিয়েছো তুমি মাগো, তাই তোমায় ভালোবাসি।
আমার প্রাণের বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।
প্রাণের প্রিয় মা তোকে , বড় বেশি ভালোবাসি।
তুমি কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা, "উন্নত মম শির"।
তুমি রক্তের কালিতে লেখা নাম "সাত শ্রেষ্ঠ বীর"।
তুমি "সুরের পাখি" আব্বাসের দরদ ভরা সেই গান।
তুমি আব্দুল আলিমের সর্বনাশা "পদ্মা নদীর টান"।
তুমি সুফিয়া কামালের কাব্য ভাষায় নারীর অধিকার।
তুমি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শাণিত ছুরির ধার।
তুমি জয়নুল আবেদিন, এস. এম. সুলতানের রং তুলির আচর।
শহীদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরির নতুন দেখা সেই ভোর।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।
জন্ম দিয়েছো তুমি মাগো, তাই তোমায় ভালোবাসি।
আমার প্রাণের বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।
প্রাণের প্রিয় মাগো তোকে , বড় বেশি ভালোবাসি।
তুমি একটি ফুলকে বাচাবো বলে - বেজে ওঠো সুমধুর।
তুমি রাগে অনুরাগে, মুক্তি সংগ্রামে সোনাঝরা সেই রোদ্দুর।
তুমি প্রতিটি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার অভিমানের সংসরার।
তুমি ক্রন্দন, তুমি হাসি, তুমি জাগ্রত শহীদ মিনার।
আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।
জন্ম দিয়েছো তুমি মাগো, তাই তোমায় ভালোবাসি।
আমার প্রাণের বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ।
প্রাণের প্রিয় মাগো তোকে , বড় বেশি ভালোবাসি।
প্রিন্স মাহমুদের অসাধারণ কথা, আর জেমস এর গাওয়া।
অ্যালবাম: পিয়ানো
কথা ও সুর : প্রিন্স মাহমুদ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:০৪