ঈশ্বর কি আছেন না নেই যৌক্তিকভাবে সেই সিদ্ধান্তে আসতে গেলে আমাদেরকে যুক্তিবিদ্যার মৌলিক নিয়মানুযায়ী অনুসন্ধান করা এবং নিজেদেরকে দু'টো মৌল প্রশ্ন করা দরকার : (১) ঈশ্বরের অস্তিত্ব থাকার ব্যাপারে যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ আছে কি? এবং (২) ঈশ্বর না থাকার ব্যাপারে শক্তিশালী কোন যুক্তি আছে কি না?
দ্বিতীয় প্রশ্নটা আমি ডক্টর ফ্লু (প্রতিপক্ষ)'র উপরই ছেড়ে দেব। কেন তিনি মনে করেন যে ঈশ্বর নেই, সেই কারণসমূহ উপস্থাপনা করার জন্য। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করে দেখবেন, যদিও নাস্তিক দার্শনিকরা শত শত বছর ধরে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব প্রমাণের জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছেন, কিন্তু কেউই এখন পর্যন্ত ফলপ্রসূ কোন যুক্তি নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন নি। কাজেই হাওয়ায় তলোয়ার না ঘুরিয়ে আমি বরং দেখি 'ঈশ্বর নেই তার সপক্ষে কী কী যুক্তি আছে', এই প্রশ্নের উত্তরে ডক্টর ফ্লু কী বলেন।
আসুন, তাহলে আমাদের প্রথম প্রশ্ন 'ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষে কী কী যুক্তি আছে?' সেটা নিয়ে আলোকপাত করি। আস্তিকতা কেন নাস্তিকতার চেয়ে যুক্তিসঙ্গত সে বিষয়ে পাঁচটি যুক্তি বা কারণকে আজকে আমি উপস্থাপন করবো। এর একেকটিকে নিয়েই গোটা গোটা বই লেখা হয়েছে। কাজেই আমি এখানে সেগুলোকে সংক্ষেপে আলোচনা করবো এবং সেগুলোর বিষয়ে ডক্টর ফ্লুর মতামত পাবার পর বিস্তারিত আলোচনায় যাবো হয়তো। এই যুক্তিগুলো একে অন্যের থেকে স্বাধীন এবং আলাদা। কিন্তু যখন সবগুলোকে একসাথে সমন্বিত করা হয় তখন তারা সমষ্টিগতভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে শক্তিশালী কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১. মহাবিশ্বের সূত্রপাত
কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে, এই মহাবিশ্ব কোথা থেকে এসেছে? নিঃসীম শূন্যতার বদলে কেন সব কিছু বিদ্যমান? নাস্তিকেরা সাধারণত বলে থাকেন যে, মহাবিশ্ব অনন্তকাল ধরে আছে এবং কোনোরকম কারণ ছাড়াই তৈরি হয়েছে। রাসেল যেমন কপলস্টনকে বলেছিলেন, 'মহাবিশ্ব সবসময়ই বিদ্যমান ছিল, এর বাইরে আর কোন কথা নেই, ব্যস'। কিন্তু এটাই কি আসল বাস্তবতা? মহাবিশ্বের যদি কোন সূচনা না থেকে থাকে তাহলে বলতে হবে যে মহাবিশ্বের অতীত ইতিহাসের ঘটনাসমূহের পরিমাণও অসীম। কিন্তু গণিতবিদরা দেখিয়েছেন যে, সত্যি সত্যি অসীমের উপস্থিতি আমাদেরকে স্ববিরোধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, অসীম থেকে অসীমকে বিয়োগ করলে কী থাকে? গাণিতিকভাবে আপনি পরস্পরবিরোধী উত্তর পাবেন। এর অর্থ হচ্ছে অসীম কোন বাস্তবতা নয় বরং এটা মূলত আমাদের মস্তিষ্কের একটি ধারণা মাত্র। এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম গণিতবিদ ডেভিড হিলবার্ট বলেন যে, 'বাস্তবে কোথাও অসীমকে খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা প্রকৃতিতেও নেই, আবার যুক্তিসঙ্গত চিন্তার বৈধ ভিত্তিও জোগান দেয় না..... অসীমের জন্যে যে ভূমিকাটি পড়ে থাকে তা হচ্ছে একমাত্র ধারণা'। কিন্তু এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে যে, যেহেতু অতীত ঘটনাসমূহ ধারণা নয় বরং বাস্তব, কাজেই অতীতের ঘটনাসমূহ অবশ্যই সসীম হতে বাধ্য। ফলে, অতীতের ঘটনাসমূহ অতীতের দিকে অনন্তকাল পর্যন্ত যেতে পারে না। বরং, বিশ্বজগত কোথাও না কোথাও থেকে শুরু হয়েছে।
এই উপসংহার এস্ট্রোনমি এবং এস্ট্রোফিজিক্সের অসাধারণ সব আবিষ্কার দিয়ে সমর্থিত হয়েছে। এস্ট্রোফিজিক্যাল প্রমাণসমূহ ধারণা দেয় যে এই বিশ্বজগত ১৫ বিলিওন বছর আগের মহা বিস্ফোরণ 'বিগ ব্যাং' থেকে সূত্রপাত হয়েছে। সময় এবং স্থানসহ বিশ্বজগতের সকল পদার্থ এবং শক্তিও তৈরি হয়েছে ওই ঘটনা থেকেই। কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, জোতির্বিজ্ঞানী ফ্রেড হোয়েল যেমন বলেছেন, বিগ ব্যাং তত্ত্ব এই মহাবিশ্ব শূন্য থেকে তৈরি হয়েছে সেই ধারণাকে সমর্থন করে-- এর কারণ হচ্ছে যে, আপনি যখন সময়ের বিপরীতে যেতে থাকেন একটা পর্যায়ে গিয়ে হোয়েলের ভাষ্য অনুযায়ী 'বিশ্বজগত সঙ্কুচিত হতে হতে শূন্যতে পরিণত হয়ে যায়'। অর্থাৎ বিগ ব্যাং মডেল অনুযায়ী বিশ্বজগত কোন এক সময়ে সৃষ্টি হয়েছিলো এবং তা তৈরি হয়েছিলো শূন্য থেকে।
এই বিষয়টা নাস্তিকদের জন্যে খুবই বিব্রতকর। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির এন্থনি কেনি (Anthony Kenny) আবেদন জানিয়েছেন এই বলে যে, 'বিগ ব্যাং' এর সমর্থক কেউ যদি নাস্তিকও হয়, তাহলেও তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে বিশ্বজগত শূন্য থেকেই এবং শূন্যের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে'। কিন্তু এই বক্তব্য কোন অর্থ বহন করে না। শূন্য থেকে কোন কিছু তৈরি হতে পারে না। শূন্যের বদলে বিশ্বজগত কেন উপস্থিত হয়েছে? কোথা থেকে এসেছে এই বিশ্বজগত? নিশ্চয়ই এমন কোনো কারণ রয়েছে যার ফলে বিশ্বজগত তৈরি হয়েছে?
আমরা আমাদের যুক্তিকে সারসংক্ষেপ করতে পারি এভাবে :
১. যা কিছু তৈরি হয়েছে তার পেছনে কারণ রয়েছে।
২. বিশ্বজগত তৈরি হয়েছে।
৩. কাজেই বিশ্বজগতের পেছনেও কারণ রয়েছে।
স্বাভাবিক ব্যবস্থা অনুযায়ীই স্থান এবং কালের কারণ অবশ্যই কারণহীন, সময়হীন, পরিবর্তনহীন এবং অকল্পনীয় শক্তি যা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছে। অধিকন্তু, আমি বলবো যে, এটা ব্যক্তিগতও হতে বাধ্য। তা না হলে কীভাবে একটা সময়হীন কারণ (timeless cause) বিশ্বজগতের মতো একটা সাময়িক প্রতিঘাত (temporal effect) সৃষ্টি করতে পারে? এই কারণ যদি প্রয়োজনীয় এবং পর্যাপ্ত অবস্থার নৈর্ব্যক্তিক সমষ্টি হতো, তবে প্রভাব ছাড়া কারণ কখনোই থাকতে পারতো না। কারণ যদি সময়হীনভাবে থেকে থাকে তবে প্রভাবও থাকবে সময়হীনভাবেই। মাত্র একটাই কারণে কারণ হতে পারে সময়হীন এবং প্রভাব শুরু হতে পারে সময় দিয়ে। আর তা হচ্ছে যদি কোনো ব্যক্তিগত প্রতিভূ কোন পূর্ব শর্ত ছাড়াই মুক্তভাবে সময়যুক্ত প্রভাব তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। কাজেই এইখানে আমরা শুধু বিশ্বজগতের যৌক্তিক কারণই খুঁজে পাচ্ছি না, সেই সাথে একজন ব্যক্তিগত সৃষ্টিকর্তারও অস্তিত্ব টের পাচ্ছি।
খুব অবাক ব্যাপার না যে, বিগ ব্যাং এর তত্ত্ব, খ্রিস্টান আস্তিকেরা সবসময় যা বিশ্বাস করে এসেছে – 'আদিতে ঈশ্বর স্বর্গ এবং পৃথিবী তৈরি করেছেন' – তাকেই সমর্থন দিচ্ছে। আমি আপনাদের জিজ্ঞেস করতে চাই, কোনটা বেশি যুক্তিসঙ্গত -- আস্তিকেরা সঠিক নাকি নাস্তিকদের ভাষ্য অনুযায়ী মহাবিশ্ব কোনো কারণ ছাড়াই শূন্য থেকে টুপ করে তৈরি হয়ে গিয়েছে? আমার অবশ্য বিকল্পগুলোকে মূল্যায়ন করতে তেমন কোনো আপত্তি নেই।
২. বিশ্বজগতের জটিল বিন্যাস
গত তিরিশ বছর ধরে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব যে সূক্ষ্ম এবং জটিল বিন্যাসের উপর নির্ভর করে তা বিগ ব্যাং নিজেই জোগান দিয়েছে। আমরা এখন জানি যে প্রাণ-অবান্ধব বিশ্বজগতের সৃষ্টির সম্ভাবনা আমাদের মতো প্রাণ-বান্ধব বিশ্বজগতের তুলনায় বেশিই ছিলো। প্রশ্ন হচ্ছে যে সেটা কতোখানি বেশি ছিলো? এর উত্তর হচ্ছে বিশ্বজগত প্রাণ-বান্ধব হওয়ার সম্ভাবনা এতই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে তা অচিন্তনীয় এবং অপরিমেয়। উদাহরণস্বরূপ, স্টিফেন হকিং (Stephen Hawking) হিসেব করে দেখেছেন যে, বিগ ব্যাং এর এক সেকেণ্ড পর মহাবিশ্বের বিস্তৃতির হার যদি কয়েক হাজার মিলিওন মিলিওনের চেয়ে ছোট হতো তাহলে মহাবিশ্ব জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড হয়ে ধ্বংস হয়ে যেতো। পল ডেভিসের (Paul Davies) হিসেব অনুযায়ী, নক্ষত্র বিন্যাসের জন্যে উপযোগী (নক্ষত্র ছাড়া গ্রহ থাকতে পারে না) প্রাথমিক পরিবেশ থাকার সম্ভাবনা হচ্ছে হাজার বিলিওন বিলিওন ভাগের একভাগ। ডেভিস আরো বলেছেন যে, মহাকর্ষের ১০১০০ ভাগের একভাগ পরিবর্তন হলেই তা প্রাণ-বান্ধব মহাবিশ্বের জন্যে বিপুল বাধা হয়ে দাঁড়াতো। মহাবিশ্বকে প্রাণ-বান্ধব হওয়ার জন্যে বিগ ব্যাং এ প্রায় পঞ্চাশটার মত চলক (quantities) এবং ধ্রুবককে (constants) সূক্ষ্ণ-সমন্বিত (fine-tuned) হতে হয়েছে। শুধু চলকগুলোকেই যে সূক্ষ্ম-সমন্বিত হতে হয়েছে তাই নয়। তাদের অনুপাতগুলোকেও সেই সাথে দারুণভাবে সূক্ষ্ম-সমন্বিত হতে হয়েছে। কাজেই অসম্ভাব্যতা ক্রমবর্ধিত হয়ে পরিণত হচ্ছে এরূপ কোনো অসম্ভাব্যতায় যতক্ষণ না আমাদের মনন কোনো অচিন্তনীয় সংখ্যার মুখোমুখি হচ্ছে।
এই চলক এবং ধ্রুবকগুলোর যে মান, কেনো সেগুলো সেই মান পেলো সেই সম্পর্কে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। অজ্ঞেয়বাদী পদার্থবিজ্ঞানী পল ডেভিস একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, 'আমার বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমি ক্রমাগত এই দৃঢ় বিশ্বাসে উপনীত হচ্ছি যে, মহাবিশ্ব এমন বিস্ময়কর বিচক্ষণতার সাথে তৈরি হয়েছে যে একে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেওয়া কঠিন'। একইভাবে, ফ্রেড হোয়েল বলেছেন যে, 'তথ্যসমূহের সাধারণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ধারণা দেয় যে, কোনো এক অতি-প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা পদার্থবিজ্ঞানকে নিয়ে খেলা করেছে'। নাসার গডার্ড ইন্সটিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজের প্রধান রবার্ট জাস্ট্রো (Robert Jastrow) একে 'বিজ্ঞান থেকে আগত' ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রমাণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
কাজেই, আবারো দেখা যাচ্ছে যে, খ্রিস্টান আস্তিকেরা সবসময় যে দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে আসছেন যে, এই বিশ্বজগতের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন -- তা নাস্তিকদের দৃষ্টিভঙ্গি, এই মহাবিশ্ব কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে শূন্য থেকে উদ্ভব হয়েছে এবং এমনভাবে সূক্ষ্ম সমন্বিত হয়েছে যে এখানে বুদ্ধিমান প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে, তার তুলনায় অধিকতর অর্থবহ।
আমরা আমাদের যুক্তিকে নিচের মত করে সারসংক্ষেপ করতে পারি :
১. মহাবিশ্বের প্রাথমিক অবস্থার সুক্ষ্ম সমন্বয় প্রাকৃতিক নিয়ম, দৈবতা বা পরিকল্পনার মাধ্যমে হয়েছে।
২. সেটা প্রাকৃতিক নিয়ম বা দৈবতার কারণে হয় নি।
৩. কাজেই তা হয়েছে পরিকল্পনার মাধ্যমে।
৩. মানব সমাজের নৈর্ব্যক্তিক নৈতিক মূল্যবোধ
অনেক আস্তিক এবং নাস্তিক এই বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, ঈশ্বর না থাকলে মানুষের নৈর্ব্যক্তিক নৈতিক মূল্যবোধও থাকতো না। রাসেল যেমন বলেছেন,
"ব্যক্তির নৈতিকতা তৈরি হয় তার উপর সম্প্রদায়ের চাপ থেকে। মানুষ..... সবসময় সহজাতভাবে উপলব্ধি করে না যে কোনটা তার সমাজের জন্য উপকারী। ব্যক্তি স্বার্থপরভাবে কাজ করতে পারে এই দুশ্চিন্তা থেকেই সমাজ মূলত ব্যক্তির স্বার্থকে সমাজের স্বার্থের সাথে সুগ্রন্থিত করার জন্যে অসংখ্য পদক্ষেপ উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে নৈতিকতা।
ইউনিভার্সিটি অব গুয়েলফ এর দার্শনিক বিজ্ঞানী মাইকেল রুজও (Michael Ruse) রাসেলের বক্তব্যের সাথে একমত হয়েছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :
হাত, পা বা দাঁতের চেয়ে নৈতিকতা কম জৈবিক অভিযোজন নয় । নৈতিকতাকে নৈর্ব্যক্তিক ভাবাটা পুরোপুরিই অলীক ভাবনা। কেউ যখন বলে যে, ''প্রতিবেশীকে নিজের মতো করেই ভালবাসো"। আমি তখন তাকে বাহবা দেই। তারা মনে করে যে, তারা নিজেদের সীমারেখার উর্ধে উঠতে পেরেছে.... তা সত্ত্বেও ওই ধরনের বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। নৈতিকতা শুধু অস্তিত্ব বজায় রাখা এবং বংশবৃদ্ধির একটা সহায়ক শক্তি মাত.... নৈতিকতার এর চেয়ে বেশি অন্য কোনো অর্থ খুঁজতে যাওয়া বিভ্রম ছাড়া আর কিছু নয়।
ঈশ্বরের মৃত্যু ঘোষণাকারী ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত নাস্তিক ফ্রিয়েড্রিক নিৎশে ( Friedrich Nietzsche) উপলব্ধি করেছিলেন যে, ঈশ্বরের মৃত্যু মানে জীবনের সব অর্থ এবং মূল্যবোধের ধ্বংস। আমি মনে করি যে, ফ্রিয়েড্রিক নিৎশে তার এই ধারণায় অভ্রান্ত ছিলেন।
আমাদের এখানে অবশ্য খুব খেয়াল করা প্রয়োজন। নৈতিক জীবন যাপনের জন্য আমাদেরকে কি অবশ্যই ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে হবে? বিষয়টা এখানে কিন্তু সেরকম না। আমি বলছি না যে, তা করতে হবে। আমরা কি ঈশ্বরে বিশ্বাস না করেও নৈতিক মূল্যবোধকে স্বীকৃতি দিতে পারি? প্রশ্ন সেটাও না। আমি মনে করি যে, আমরা তা পারি। বরং প্রশ্ন হচ্ছে যে, ঈশ্বর যদি না থাকতেন তবে সেক্ষেত্রে নৈতিক মূল্যবোধ বলে আদৌ কিছু থাকতো কি না?
রাসেল এবং রুজের মত আমিও ভাবার কোনো কারণ দেখি না যে, ঈশ্বরের অনুপস্থিতিতে মানুষের তৈরি সামাজিক নৈতিকতা নৈর্ব্যক্তিক হতো। ঈশ্বর যদি নাই থাকেন তাহলে আর মানুষের বিশেষ গুরুত্ব বলে কি কিছু থাকে? বৈরী এবং চৈতন্যহীন মহাবিশ্বের কোথাও হারিয়ে যাওয়া ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা থেকে প্রাকৃতিক দুর্ঘটনার উপজাত হিসেবে তুলনামূলকভাবে অতিসম্প্রতি বিকাশ হয়েছে মানুষের। এবং খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগতভাবে তারা বিলোপও হয়ে যাবে। নাস্তিকতার দৃষ্টিভঙ্গিতে কিছু কার্যকলাপ -- যেমন ধরুন ধর্ষণ -- সামাজিকভাবে উপকারক নয়, তাই মানব সমাজ বিকাশের সাথে সাথে তা নিষিদ্ধ হিসেবে গণ্য হয়েছে। কিন্তু এতে প্রমাণ হয় না যে, ধর্ষণ আসলেই অন্যায় কিছু। নাস্তিকতার দৃষ্টিতে আপনি কাউকে ধর্ষণ করলেও সেটা অনৈতিক নয়। কাজেই, আমাদের বিবেকের উপর চেপে বসা চরম ন্যায় বা অন্যায় বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব ঈশ্বর ছাড়া হতে পারে না।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, নৈর্ব্যক্তিক মূল্যবোধ আমাদের সমাজে বিদ্যমান রয়েছে এবং আমি বিশ্বাস করি, অন্তরের গভীর থেকেই আমরা সবাই সেটা জানি। বস্তুজগতের নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতার চেয়ে মূল্যবোধের নৈর্ব্যক্তিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করার খুব বেশি কারণ নেই। ধর্ষণ, নিষ্ঠুরতা, শিশু নির্যাতন শুধুমাত্র সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য আচরণই নয়। এগুলো নৈতিকভাবেও ঘৃণ্য কাজ। কিছু কিছু জিনিস সত্যি সত্যিই অন্যায়। একইভাবে, ভালোবাসা, সমতা এবং আত্মত্যাগ সত্যি সত্যিই মহৎ কাজ।
তৃতীয় বিবেচনাকে আমরা নিম্নোক্তভাবে সারসংক্ষেপ করতে পারি :
১. ঈশ্বরের অস্তিত্ব না থাকলে নৈর্ব্যক্তিক মূল্যবোধও থাকতে পারে না।
২. মানব সমাজে নৈর্ব্যক্তিক মূল্যবোধ রয়েছে।
৩. কাজেই ঈশ্বরেরও অস্তিত্ব রয়েছে।