somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

(রিপোস্ট) টাইম ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে এশিয়ার সেরা স্থাপত্য

২৬ শে এপ্রিল, ২০১০ সকাল ৯:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৫৯ সালে প্রথম ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন কমপ্লেক্সটির পরিকল্পনা গৃহীত হয়। তৎকালীন সামরিক সরকার পাকিস্তানের প্রস্তাবিত দ্বিতীয় রাজধানী শেরে বাংলা নগরে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংসদ ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা থেকে বর্তমান সংসদ ভবনটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখনকার খ্যাতনামা স্থপতি লুই কান ভবন কমপ্লেক্সটির নকশা প্রণয়নের জন্য প্রাথমিক ভাবে নির্বাচিত হন। তাঁকে সরাসরি কাজে নিযুক্ত না করে ভবনের প্রাথমিক নকশা প্রদানের জন্য বলা হয় এবং ১৯৬২ সালের মার্চ মাসে তিনি আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পান। ১৯৬১ সালে বর্তমান মানিক মিয়া এভিনিউ- এর উত্তর পাশে ২০৮ একর জমি দ্বিতীয় রাজধানী প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ করা হয় এবং ১৯৬২ সালে মূল নকশা প্রস্তুত হয়। ১৯৬৪ সালে ১৫ মিলিয়ন ডলারের অনুমিত ব্যয় ধরে কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। সমস্ত সুবিধাদিসহ ৩২ মিলিয়ন ডলারের পরিবর্তিত ব্যয়ে কমপ্লেক্সটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৮২ সালে। কমপ্লেক্সটির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত আছে মূল সংসদ ভবন, সংসদ সদস্য, মিনিস্টার ও সেক্রেটারিদের হোস্টেল, অতিথি ভবন ও কমিউনিটি বিল্ডিং। রাস্তা, হাঁটার পথ, বাগান ও লেক দ্বারা এ সমস্ত কিছুই আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্ট, গ্র্যান্ড মসজিদ ও প্রেসিডেন্টের বাসভবনের ক্ষেত্রে মূল মাস্টার প্লানে পরিবর্তন সাধিত হয়। এ ভবনগুলো যতটা কম আকর্ষণীয় করা যায় সেদিকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে এগুলো প্রধান সংসদ ভবন এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মিত ভবনগুলোর মধ্যে প্রেসিডেন্টের বাসভবন (বর্তমানে গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন) ছিল একটি। ১৯৬৪ সালে সংসদ ভবনের নকশা সম্পন্ন হয় এবং এর পরপরই নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নির্মাণাধীন প্রধান অবকাঠামোটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার ভবনের মূল নকশায় কোন রকম পরিবর্তন না এনে নির্মাণ সম্পন্ন করার কৃতিত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
জাতীয় সংসদ ভবনের প্রধান বৈশিষ্ট্য এর বিশালত্বের মাঝে নিহিত । মার্বেল পাথর সংযুক্ত বিপুল কংক্রিটের বহির্দেয়ালের মাঝে মাঝে রয়েছে নিখুঁত জ্যামিতিক আকৃতির প্রবেশদ্বার। বৃত্তাকার ও আয়তাকার কংক্রিটের সমাহার ভবনটিকে দিয়েছে এক বিশেষ স্থাপত্যিক সৌকর্য যা এর মহান উদ্দেশ্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভবনের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে হলো সংসদের প্রধান হল, যেখানে সংসদ সদস্যগণ পার্লামেন্টে বসেন। সমকেন্দ্রিক নকশার মূল হলরুমকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন অংশগুলো গড়ে উঠেছে। ছাদ দিয়ে প্রবেশ করা আলোর মালা দ্বারা সাত তলা উঁচু গোলাকার মূল হলরুমটি এমনভাবে বেষ্টিত ঠিক যেন দেবীর মঞ্চকে ঘিরে উন্মুক্ত গোলাকার পথ। মূল ভবনের চার বাহু বরাবর চার কোনে অন্যান্য কাজের জন্য রয়েছে চারটি একই ধরনের অফিস ব্লক। যোগাযোগের জন্য রয়েছে বিভিন্ন প্রকার সিঁড়ির ব্যবস্থা। বর্গাকার নকশার হলেও এটি নিপুনভাবে অস্টভুজের মধ্যে স্থাপিত হয়েছে। নয়তলা বিশিষ্ট হলেও অনুভূমিক যোগাযোগ রয়েছে মাত্র তিনটি তলায়। মাটির উপরে কাঠামোটির উচ্চতা ৪৯.৬৮ মিটার। মূল ভবন কমপ্লেক্সটির নয়টি স্বতন্ত্র্য বিভাগে বিভক্ত। এর মধ্যে আটটি ৩৩.৫৩ মিটার এবং কেন্দ্রীয় অষ্টভুজাকার ব্লকটি ৪৭.২৪ মিটার উঁচু। কেন্দ্রীয় ব্লকটি ৩৫৪ আসন ধারণক্ষম অ্যাসেম্বলি কক্ষ নিয়ে গঠিত। সমগ্র কমপ্লেক্সটির আয়তন হলো মূল ভবনে ৭৪,৪৫৯.২০ বর্গমিটার, দক্ষিণ প্লাজায় ২০,৭১৭.৩৮ বর্গমিটার এবং উত্তর প্লাজায় ৬,০৩৮.৭০ বর্গমিটার। দক্ষিণ প্লাজার মূল প্রবেশ পথটি একটি প্রশস্ত সিঁড়ির আকারে ধীরে ধীরে ৬.২৫ মিটার উচ্চতায় উঠে গেছে। এর বেসমেন্টে রয়েছে পার্কিং এরিয়া, তত্ত্বাবধায়ক এজেন্সির অফিস ও মূল ভবনের সুবিধাদি প্রদানের জন্য স্থাপিত বিভিন্ন ব্যবস্থা। একটি কৃত্রিম লেক ভবনের চারপাশের প্রাচীর ঘিরে আছে এবং এটি উত্তর ও দক্ষিণ প্লাজাকেও সংযুক্ত করেছে। সমস্ত ভবনটাকে মনে হয় যেন পানির উপরে ভেসে উঠেছে। পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশের জন্য রয়েছে দক্ষিণের গ্র্যান্ড প্লাজা ও উত্তরে সবুজ ঘাসে আচ্ছাদিত বাগান ও ইউক্যালিপ্টাসের সারি শোভিত প্রেসিডেন্সিয়াল স্কয়ার। উত্তর প্রবেশ পথের দিকে রয়েছে একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার যেখানে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। উত্তর প্লাজা পেরিয়ে ক্রিসেন্ট লেকের পাশে রয়েছে একটি রাস্তা। ভবনের কোথাও কোন কলাম নেই। শূন্য স্থানের অংশ হিসেবে ফাঁপা কলাম রয়েছে ঠিকই কিন্তু তা শুধুই কাঠামো নকশায় ভারসাম্য রক্ষার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এটি অনেকটাই বিশাল কংক্রিটকে খোদাই করে পরিণত করা হয়েছে একটি অসাধারণ কার্যকর ভাস্কর্যে। নির্মাণ মসলা হিসেবে কংক্রিট ব্যবহৃত হয়েছে এবং ভেতরের ও বাইরের অংশে ব্যবহৃত হয়েছে ঢালাই কংক্রিট। যে দক্ষতার সাথে আলোকে প্রয়োগ করা হয়েছে তাই হলো কান- এর নকশার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। ছাদ দিয়ে প্রবেশকৃত আলো বিভিন্ন জায়গাকে যেভাবে আলোকিত করেছে তাতে মনে হয় আলোকচ্ছটা ঝরে পড়ছে স্বর্গ থেকে।
জাতীয় সংসদ ভবনের নকশায় সূর্যের আলো এবং বৃষ্টির প্রতিরোধকে বিবেচনা করা হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে। অন্যদিকে বাতাসের বাধাহীন চলাচলকে সম্ভব করেছে বহিঃস্থ ফাসাদের বিশাল জ্যামিতিক ত্রিভুজ, আয়তক্ষেত্র, সম্পূর্ণ বৃত্ত ও বৃত্তাংশ এবং সমতল খিলানসমূহ। ভবন কাঠামোটি একটি অসাধারণ সৌধ হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে বাইরের দিকে গতানুগতিকভাবে জানালা স্থাপন পদ্ধতিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে এবং মূল দেওয়ালে ফাঁক সৃষ্টি করে বিশাল স্থাপত্যের অসুবিধাকে দূর করা হয়েছে। স্থাপত্যিক শৈলীতে ভবনটি ঢাকার আধুনিক ভবনসমূহ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এ ভবনের প্রধান সমালোচনার বিষয় এর অত্যধিক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। ৫৮,৩২৭.৫৯ বর্গমিটার (পার্লামেন্ট ভবন ৩.৪৪ একর; উত্তর প্লাজা ১.৪৬ একর; দক্ষিণ প্লাজা ৪.৯৮ একর এবং আবাসিক ভবন, হোস্টেল, বাগান, রাস্তা, লেক ইত্যাদি) এলাকার এ ভবন কমপ্লেক্সটির সর্বমোট নির্মাণ ব্যয় ১২৮ কোটি টাকা। ভবন কমপ্লেক্সে ৫০টি সোপান, ৩৪০টি শৌচাগার, ১৬৩৫টি দরজা, ৩৩৫টি জানালা, ৩০০টি পার্টিশন দেওয়াল, ৩৩৩০.৫৭ বর্গমিটার কাঁচের শাটার, ৫৪৩৪.৮৩ বর্গমিটার কাঠের শাটার, ৩৭৩৮ ঘনমিটার কাঠের প্যানেল রয়েছে। ভবনের বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় সাড়ে ৫ কোটি টাকা। ভবনের সর্বোচ্চ তলাটি বা লেবেল ১০ ব্যবহার্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতির জন্য ব্যবহৃত হয়।
১৯৮২ সালের প্রথমদিকে ভবনটির কাজ সম্পন্ন হয় এবং একই বছর ২৮ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট জাস্টিস আব্দুস সাত্তার এটির উদ্বোধন করেন। ১৯৮২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এ ভবনে জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথিবীর প্রায় সকল স্থাপত্য বিষয়ক পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ভবন আলোচিত হয়েছে এবং এটি আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। পুরস্কার প্রদানের সময় প্রকাশিত সম্মাননা পত্রে বিধৃত উক্তি এ প্রকল্পের একটি প্রকৃষ্ট মূল্যায়ন করে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে ‘অসাধারণ সামর্থ্যতায় স্থাপত্যিক গুরুত্বসহ অবয়ব ও সৌন্দর্যের মাপকাঠিতে উর্ত্তীর্ণ এ ভবনটি জুরি বোর্ড কর্তৃক প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এ বলে যে, এ গরীব দেশটির নিকট শেরে বাংলা নগরে স্থাপিত এর প্রয়োজন কতটুকু। তারপরও ভবনটির নকশা ও নির্মাণ পরিকল্পনা প্রকাশ করে যে কালক্রমে এটি ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতীক হয়ে এটি দাঁড়িয়ে আছে এবং বিভিন্ন কল্যাণকর উপায়ে দেশটিকে অনুপ্রেরণা যুগিয়ে চলেছে।

১৫টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্তর্বর্তী সরকারে উপদেষ্টা নিয়োগ কারা দেয় ?

লিখেছেন মেঠোপথ২৩, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

বৈষম্যবিরোধি আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তির পর আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কেরা ডক্টর ইউনুসকে দেশের ক্ষমতা গ্রহন করার আহবান সেই শহীদ মিনার থেকেই জানিয়েছিল। ডক্টর ইউনুস প্রথমে অরাজি হলেও পরে ছাত্রদের হাজারো অনুরোধের মুখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণমুখী একটি চাওয়া

লিখেছেন ডঃ এম এ আলী, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১০:২০


মানুষের মুখে হাসি ফুটুক,
আঁধার মুছে আলোর ছোঁয়া,
ক্লান্তিহীন পথ চলুক,
নতুন স্বপ্ন আনবে জোড়া।

দিনবদলের শপথ নিয়ে,
কাঁধে কাঁধ মিলে কাজ করে যাই,
নদীর স্রোতে ভেসে ভেসে
একটি স্রোতে মিলিয়ে যাই।

সবার তরে সমান বিচার,
ধনীর দুঃখীর,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলার একমাত্র অভিশপ্ত রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ

লিখেছেন জ্যাকেল , ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সকাল ১১:৫০

২৩শে জুন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব জনাব সিরাজ উদ দৌলা ব্রিটিশদের কাছ হেরে যান কেবলমাত্র মীরজাফর, জগৎশেট, রাজভল্লভ, ঘষেটিদের কারণে। বাংলার ইতিহাসে এই দিনটি একটি অভিশপ্ত দিন। এর পর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের গ্রামের বিয়ের বর দেখা

লিখেছেন প্রামানিক, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ২:১৩


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

একদিন পরেই শুক্রবার। সকালেই বাবাকে ঐ বাড়ির ঘরবর (অর্থাৎ বর দেখা অনুষ্ঠানকে আঞ্চলিক ভাষায় ঘরবর বলে) উপলক্ষে ডাকা হয়েছে। বাবা সকালে গিয়ে বর দেখা উপলক্ষ্যে কি কি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ওবায়েদুল কাদের কি মির্জা ফখরুলের বাসায় আছেন?

লিখেছেন রাজীব, ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৮

"পালাবো না, পালিয়ে কোথায় যাবো? দরকার হলে মির্জা ফখরুলের বাসায় আশ্রয় নেবো। কি ফখরুল সাহেব, আশ্রয় দেবেন না?" ওবায়েদুল কাদের একটি জনসভায় এই কথাগুলো বলেছিলেন। ৫ই আগষ্টের পরে উনি মির্জা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×