গরম পড়ে গেছে ভালই গরম দেশে। চেক করলুম উড়িষ্যাতে কেমন গরম, জানলুম প্রায় ৩০ ডিগ্রী থেকে ৩৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস! মানে বেজায় গরম! গিন্নীকে বলুম ঠান্ডায়তো সবসময়ই ঘুরি এবার নাহয় একটু অন্য অভিজ্ঞতা নেই, গরমেই যাওয়া যাক। প্রথমে কোলকাতা সেখান থেকে পুরী তারপর পশ্চিমবঙ্গের নবাবী আমলের জেলা শহর মুর্শিদাবাদ।
যথারীতি সাড়ে তিনহাজার টাকা করে একেকজনের ভিসার এপয়েন্টমেন্ট ভারতীয় হাইকমিশনে। ভিসা পেলুম ছ'মাসের।
ভুবনেশ্বরের শুকিয়ে যাওয়া চন্দ্রভাগা নদীর উপকুল।
তারপর একদিন সকালে হালকা বোঁচকা নিয়ে উঠে পড়লুম আমার প্রিয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে, গন্তব্য কোলকাতা স্টেশন।
কোলকাতা স্টেশন
আমার প্রিয় বন্ধু দীলিপ অসুস্হ শরীরেও স্টেশনে হাজির, বৌদিকে নিয়ে যাবে, আমি তো ফালতু!
দুদিন কোলকাতাতেই বেড়ালুম, নেমন্তন্ন খেলুম এর ওর বাসায়। এর মধ্যেই একদিন ডালহৌসী স্কোয়ারে গিয়ে কোলকাতা - পুরী- ভুবনেশ্বর- কোলকাতা'র টিকিট নিয়ে এলুম। আরামে এসি ট্রেনে শুয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া যাবে আর সিট নিশ্চিত। সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে বেশ খানিকটা ডিসকাউন্ট পেলুম, অর্ধ সহস্র রুপী মাফ!
রাতের ট্রেন একটু আগেই হাওড়া স্টেশনে হাজির হলুম। কাঁটায় কাঁটায় ঠিক সময়েই ট্রেন 'পুরী এক্সপ্রেস' ছাড়ল। আমার বার্থ উপরে তিনতলায় আর গিন্নীরটা নীচের বার্থ। আমাদের দেশে বহু ডজনবার ট্রেনে চড়েছি, কোনদিন সময়মত ট্রেন ছেড়েছে বলে মনে পড়েনা! অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে ট্রেনে উঠা হয় না। এত নিকৃস্ট মানের ট্রেন আর আরো ভয়াবহ নীচু মানের সার্ভিস পৃথিবীর কোথাও দেখিনি। বিশ্বাস করুন।
সকালে নামলুম পুরী। স্টেশনে নেমেই ভাবছিলুম হোটেল থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক আসার কথা, আল্লাহ মালুম এসেছে কিনা। ফোন করলুম, হোটেলের লোকটি বলল 'স্টেশনেই আছি'। ওমা কিছুক্ষন পরই দেখি একটা মোটর সাইকেল থেকে আমার সাথেই ফোনে কথা বলছে শার্টে হোটেলের মনোগ্রাম দেয়া একজন সুশ্রী তরুণ। তার কথামত উঠে পড়লুম একটা অটোরিকশাতে। দশ বারো মিনিটেই পৌছলুম আমাদের বুক করা হোটেলে। যারা এর পরে যাবেন তাদের বলছি পুরীতোে গেলে আগেই হোটেল বুক করে যাবেন, না হলে বিপদে পড়বেন।
ছোট সাধারণ মানের হোটেল ভাড়াটাও সহনীয়। কাপড় পাল্টে নাস্তা খেয়েই চললুম বীচে।
বীচ দেখে খানিকটা হতাশ হলুম। এক্কেবারে সাদামাটা বীচ, মাইল দুয়েকও লম্বা হবেনা, যাবার রাস্তাগুলো বাজে। সেখানেই বেড়ালুম, বিকেল অবধি।
পরদিন সকালে গেলুম পুরীর পৃথিবীখ্যাত জগন্নাথের মন্দির দেখতে।
হিন্দুদের জন্য পুরী একটি পবিত্র তীর্থস্হান, বিশেষ করে যারা ভগবান বিষ্নু বা শ্রীকৃষ্নের ভক্ত। আবার হিন্দুদের পবিত্র চার ধাম যেখানে তাদের জীবনে একবার যেতেই হবে তার একটা হল পুরী।
সনাতন ধর্মালম্বীদের পুজোর প্রতিমা সাধারণত পাথর বা ধাতব পদার্থের হয়ে থাকে। কিন্তু জগন্নাথের মন্দিরে জগন্নাথদেবের প্রতিমা কাঠের।
প্রতি ১২ বা ১৯ বছর পর পর কাঠে প্রতিমা পাল্টে ফেলা হয়। সেখানে পবিত্র গাছের কাঠ দিয়ে তৈরী প্রতিমা তৈরী করে রাখা হয়। এটাকে বলা হয় নবকলেবর উৎসব।
জগন্নাথের মন্দিরটি বানানো হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা অনন্তবর্মনের আমলে। মন্দিরটি বার্ষিক রথযাত্রার জন্য বিখ্যাত।
মন্দিরের চুড়ায় প্রতিদিন একজন ভক্ত উঠে পতাকা পাল্টান, কোন সিড়ি নেই, পাশ দিয়ে কসরৎ করেই উঠতে হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত কো্ন দুর্ঘটনা ঘটেনি।
ভেতরে ঢুকতে প্রথম কথা হল আপনার জুতো মোবাইল ফোন ক্যামেরা সব রেখে ঢুকতে হবে। রাখার জন্য জায়গা আছে বিনে পয়সায় রাখতে পারেন ওটা সরকারী আর ১০ টাকা দিয়ে রাখতে পারেন ওটা প্রাইভেট। তবে ভয় নেই চুরি হবেনা বা খোয়া যাবেনা। মন্দিরে এসে কেউ অপকর্ম করেনা বলে শুনেছি।
ভেতরে ডোকার আগেই একজন গেরুয়া বসনধারী এসে সবিনয়ে বললেন আমি আপনাদের পুরো মন্দির ঘুরিয়ে দেখাবো কারণ অত বড় মন্দিরে কোথায় কি আছে না জানা থাকলে অনেক সময় লাগবে আর ক্রনলজিকালী দেখতে পারবেন না। সানন্দে রাজি হলুম। মাত্র কুড়ি টাকার ব্যাপার! ঢোকার চারটে পথ, একটা দিয়ে ঢুকে পড়লুম। হাজার হাজার মানুষ ভিতরে সমুদ্রের ঢেউয়ের মত যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। তবে শব্দ খুব একটা নেই!
ভক্তরা বিভিন্ন জায়গাতে পুজো দিচ্ছে, প্রসাদ খাচ্ছে। প্রতিদিন নাকি এক লক্ষের বেশী লোক খাবার খায়! আর এই খাবার কে খাওয়ায় কে টাকা দেয় তা কেউ জানেনা ভক্তরা জানার দরকার মনে করেনা। ক্যামেরা বা ফোন নেই ভেতরে ছবি তোলা যাবেনা তাই ছবি তোলা গেলনা। ঘন্টা তিনেক ঘুরে ক্লান্ত হয়েই বেরুলুম।
একটা কথা জগন্নাথের মন্দিরের ভেতরে হিন্দু ব্যাতিত অন্য ধর্মালম্বীদেের প্রবেশ নিষেধ।
পরদিন একটা ট্যুর অপারেটরদের বাসে করে ভুবনেশ্বরের কিছু ঐতিহাসিক স্হান দেখতে যাবার জন্য টিকিট কাটলুম। দারুণ সস্তা টিকিট, কল্পনাই করা যায় না। আমরা বিদেশী তাই ভাল সিট দিল। ভুবনেশ্বর হল উড়িষ্যার রাজধানী। আমরা রাজধানীতে যাবনা পথে বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা দেখব।
কোনার্কের (উড়িষ্যা) সুর্য মন্দির
সুর্য মন্দির
পুরী থেকে বাস ছাড়ল সকাল ৭ টায়। বাসের সামনেই গাইড, ঊড়িয়া ইংরেজী আর হিন্দীতে সামনের বেড়ানোর জায়গাগুলো বর্ণনা করবে। প্রথমে কোনার্কের সুর্য মন্দির। অপুর্ব কারুকাজ করা দেয়াল আর উঁচু মন্দির।
মন্দিরটি ১২৩৮ থেকে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে তৈরী করা হয়। বিশেষ একধরণের পাথরের এই মন্দির তৈরী করা হয় পুর্ব গঙ্গা সাম্রাজ্যের সময়কালে রাজা নরসিংহদেব দ্বারা। কয়েক জায়গাতে বিপজ্জনক ভাবে ভাঙ্গা গেলে বৃটিশ শাসক একজায়গার দরজা বন্ধ করে সীল করে দেন তাতে মন্দিরটি রক্ষা পায়। এটা পৃথিবীর একটা হেরিটেজ হিসাবে রক্ষিত। এর রক্ষনাবেক্ষনের পেছনে ভারত সরকারের বছরে কোটি কোটি রুপী খরচ হয়। না, কেউ এর দেয়ালে সেলামী নিয়ে দোকান পাট বসাননি বা এটা ভেঙ্গে চুরে কেউ দখল করছেনা। আমাদের বড় কাটারা ছোট কাটারা তারা মসজিদ লালবাগের কিল্লা সহ অনেক প্রাচীন ঐতিহ্য ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে বা গেছে শ্রেফ দেখাশুনা করার কেউ নেই বিধায়।
উদয়গিরী পাহাড়, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ ধবলগিরী ধাবলগিরী মন্দির। এখানে গিয়ে সিড়ির কাছেই কিছুক্ষন বসে ছিলুম কারণ তখন বেলা বারোটার মত, মন্দিরে যাবার সিড়ি গোটা চল্লিশেক, খোলা আকাশের নীচে। প্রচন্ড রোদের তাপে সিড়িগুলো আগুনের মত গরম হয়ে ছিল আর তার উপর দিয়ে খালি পায়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিিলনা। জুতো পায়ে সিড়িতে উঠা যাবেনা। অভাগা নদী- ভুবনেশ্বর, এখন পানি নেই তবে কথিত আছে বছরে একবার পুর্ণিমার সময়ে এখানে পানি আসে। লিঙ্গরাজ মন্দির, ভুবনেশ্বর।
মন্দিরে ঢুকতে ম্যালা ঝামেলা, তবু ঢুকলুম তারপর বাইরে বসে গুড়া বরফের আইসক্রিম খেলুম, দারুণ স্বাদ। এরপর নন্দনকানন নামক একটা বিশাল চিড়িয়াখানা দেখে সন্ধ্যে নাগাদ ব্যাক টু হোটেল।
পরদিন আবার পুরীর হোটেল ছেড়ে দিয়ে এসি বাসে করে ভুবনেশ্বর আসলুম কারণ এখান থেকেই কোলকাতা যাব। যদিও ট্রেনটি পুরী থেকেই ছাড়ে, কেন যে আমি ভুবনেশ্বর থেকে যাবার টিকিট কেটেছিলুম জানিনা। হোটেল থেকে চেকআউট করলুম ৯ টায় আর ভুবনেশ্বর পৌছলুম বেলা ১২টায়, ট্রেন ছাড়বে রাত ১০ টায়! কি বিপদ! কিন্তু না, সারা ভারতের প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই উঁচু মানের ওয়েটিং রুম আছে যেখানে আপনি আপনার টিকিট দেখিয়ে বসতে পারবেন, এসি আছে সো নো চিন্তা!
ওয়েটিং রুম, চালু এসি লাগানো।
ওয়েটিং রুমে টিকিট দেখিয়ে ঢুকলুম। গেটের মহিলাটি কিচুক্ষন মিন মিন করে বলছিল 'আপকা ট্রেন যানে মে আভি ভি ১০ ঘন্টা বাকি হ্যায়, আপকো এতনা দের তাক রাখনেকা নিয়ম নেহি হ্যায়, লেকিন আপ পরদেশি হ্যায়, তো যাইয়ে'। কোন ঘুষ বকশিশ লাগেনি। তকতকে পরিষ্কার এয়ার কন্ডিশনড ওয়েটিং রুম, উটকো লোকের ভিড় নেই, অন্তত শ'খানেক লোকের বসার সোফা আছে, জায়গা না পেলে পরিষ্কার মেঝেতেও বসতে পারেন। একপাশে ৬-৭ টা পরিষ্কার বাথরুম, আবার বাইরেই চিলারের মধ্যে বিনে পয়সায় ঠান্ডা খাওয়ার পানি!!। বাথরুমগুলো প্রতি আধ ঘন্টা পর পর একজন ক্লীনার এসে পরিষ্কার করছে।
মনে পড়ল আমাদের দেশে স্টেশনগুলোর কথা, কোথাও ভাল ওয়েটিংরুম দেখেছি বলে মনে পড়েনা। আর দুএকটা ওয়েটিংরুম লেখা সাইনবোর্ড দেখেছি, রুমটি সর্বদাই তালা মারা। অবশ্য খুললেও সেগুলোর অবস্হা যে জঘন্যরকম খারাপ হবে এতে আমার কোন সন্দেহ নেই। অবশ্য আমাদের নিজেদের চরিত্রও যে ভাল তা বলা যাবেনা, নীচু ক্লাশের টিকিট কেটে উঁচু ক্লাশের বিশ্রামাগারে বসব, নোংরা করব, বসে তাস পিটাব বা বাচ্চাদের নিয়ে হৈচৈ করব। যেখানে সেখানে খা--ক করে কফ থুতু ফেলা এদেশের কিছু মানুষের অপরিবর্তনীয় স্বভাব!
যাহোক রাতটা ট্রেনে ঘুমিয়ে কাটালুম, ভোর ৬ টার দিকে হাওড়া স্টেশন, সেখান থেকে ট্যাক্সি করে বেলেঘাটা বাসায়। স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে আসা বেশ আরামের। আপনি প্রিপেইড সিস্টেমে লাইনে দাড়ান, কাইন্টারে পুলিশ আর টিকিটম্যান বসে আছে, গন্তব্যস্হান বলুন, টাকা দিন আপনাকে একটা টিকিট দিবে যাতে আপনার জন্য নির্ধারিত ট্যাক্সি নম্বর লেখা আছে, আপনি উঠে পড়ুন কোন দরাদরি নেই, ঝামেলা নেই।
কমলাপুর থেকে ট্যাক্সিতে উত্তরা বা ওয়ারী আসতে হলে আপনাকে বাড়িঘর বেচতে হবে মনে হয়! পারলে লাখ টাকা ভাড়া চাইবে।
এবার মুর্শিদাবাদ।
দুদিন বাদে আবার গেলুম ডালহৌসীতে ফেয়ারলি হাউসে ট্রেনের টিকিট নিব কোলকাতা টু মুর্শিদাবাদ এন্ড ব্যাক। পরদিন আবার ভোরে কোলকাতা (কোলকাতা একটা স্টেশনের নাম, হাওড়া শেয়ালদার মতই) স্টেশন থেকে উঠলুম হাজার দুয়ারী এক্সপ্রেস, যাব মুর্শিদাবাদ। সেই একইরকম এসি কামরা, পরিষ্কার ঝকঝকে। বসে বসে যেতে হবে। সকাল দশটা নাগাদ মুর্শিদাবাদ পৌছলুম। স্টেশন থেকেই অটো পেলুম, সারা মুর্শিদাবাদের সব দর্শনীয় স্হানগুলো দেখাবে।
সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময় বাংলার দেওয়ান মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্হানান্তর করেন আর ঐ জায়গার নাম রাখেন নিজের নামের সাথে মিলিয়ে, মুর্শিদাবাদ। পরে নিজেকে নবাব ঘোষনা করেন।
প্রথমে মুর্শিদকুলী খার কাটারা মসজিদ।
নবাব সিরাজের সেনাপতি মিরজাফরের বাড়ির দরজা, বাড়িঘর পাবলিক ভেঙে ফেলেছে।
মিরজাফরের কবর ও তার ১০১ জন বংশধরদের কবরস্হান।
নবাব সিরাজের আমলে ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী জগৎশেঠের বাড়ি।
জগৎশেঠের বাড়ির ভিতরে।
হাজার দুয়ারী প্রাসাদ। মুর্শিদাবাদের অন্যতম আকর্ষন।
ডানকান ম্যাকলিয়ড নামের ইংরেজ স্হপতি এটার নকশা তৈরী করেন এবং বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব নাজিম হুমাউন ঝা এর সময়ে (১৮২৪- ১৮৩৮) এটা তৈরী হয়। এটাতে এক হাজারটা দরজা আছে, তাই এটার নাম হাজার দুয়ারী।
ভেতরে চমৎকার একটা যাদুঘর আছে, আর তাতে আছে পুরোণো অস্ত্রসস্ত্র পোষাক আরো অনেক কিছু। একটা ঝাড়বাতি আছে যার ওজন কয়েক মন হবে! ছবি তোলা যায়নি। অনেক কড়াকড়ি!
দুপুরে একটা লোকাল হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে মুর্শিদাবাদ স্টেশন, ট্রেনে রাত দশটায় কোলকাতার বাসায়। এত সস্তায় এত সুন্দর একটা ট্রিপ ভাবাই যায় না!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ১০:০৫