এবারের বাজেটে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার প্রস্তাব ঘোষণার পর আলোচনা সমালোচনা হয়েছে অনেক। বাজেটে তিনি ১৬ কোটি মানুষের দেশে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ব্যায় করবেন ২১ হাজার ২৮৮ টাকা। এর মধ্যে বেতন ভাতা-সুদ পরিশোধের মতো অনুন্নয়ন ব্যায়ে যাবে মাথাপিছু হিসাবে ১৩ হাজার ৪৮৪ টাকা। আর উন্নয়ন বাজেটের মাথাপিছু ব্যায়ের হিসাব হচ্ছে ৬ হাজার ৯১৮ টাকা (প্রাপ্ত তথ্যমতে)।
অন্যদিকে, বিদায়ী অর্থবছরে মাথাপিছু ১১ হাজার ৮৭ টাকা কর দিতে হলেও এবার দিতে হবে ১৫ হাজার ১৭২ টাকা করে। এখন অনেকেই অতীতের রবিন হুডের সাথে বর্তমান বাংলার রবিন হুডের মিল খুঁজতে চাইবেন হয়তো! আশা করছি মিল পাবেন, তবে বাস্তবিক রবিন হুডের পুরোপুরি বিপরীত বাংলার রবিন হুড! কারণ বাস্তবিক রবিন হুডের কাজ ছিলো, ধনীর সম্পদ নিয়ে গরীবের মাঝে বিতরণ করা কিন্তু বাংলার রবিন হুড, গরীবের ধন লুটে ধনীর পকেট ভরিয়ে দিচ্ছেন!
প্রতিবারের মতো এবারেও দেশের বাজেটে ভিন্ন কিছু দেখা যায় নি। বরং তুলনামূলক হতাশ করা বাজেটে এবার, বেকার থেকে বক্সার, গরীব থেকে ধনী, মেথর থেকে মেয়র, জেলে থেকে জমিদার, কৃষক থেকে কোটিপতি সব ধরণের ব্যক্তি করের আওয়াত এসে গেছেন। বাংলার রবিন হুডের সবকিছু ঠিক থাকলেও মারাত্মক প্রস্তাব করেছেন বিশেষ বিশেষ কিছু ব্যাক্তি এবং খাত বিশেষে। যেমন : এবারে বেকার, কৃষক সবাই কর দিতে হবে অন্যদিকে প্রয়োজনীয় দৈনন্দিন ব্যবহারিক পড়াশোনা, মোবাইল এবং কৃষিখাত সহ সেক্টরগুলোতে কর বাধ্যতামূলক করেছেন! যেখানে কৃষক, কৃষির নায্যমূল্য না পেয়ে কৃষি কাজ ছেড়ে দিতে শুরু করেছে, সেখানে তাদের জন্য ভালো কিছু ঘোষনা না করে কর দেয়া বাত্যতামূলক ঘোষণা করেছেন! অন্যদিকে কোটিপতিদের করের ব্যাপারে রেয়াত দেয়া হয়েছে! কি আশ্চর্য বাংলার রবিন হুডের প্রস্তাব!?
এখন ধারনা করি, দেশের সভ্য-অসভ্য লোকদের শাসন করার প্রয়োজনে বাংলার রবিন হুড তার বাজেটের পরিধি বাড়িয়েছেন। বড় বড় অবকাঠামো বানাতে উন্নয়ন বাজেটকেও বড় করেছেন। সরকারী লোকদের খুশি করার রাজনৈতিক কৌশলে সমর্থন দিতে বেতন ভাতা বাড়িয়েছেন। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সরকারী চাকুরীজীবিদের বেতন ভাতা ব্যয় দ্বিগুনেরও বেশি বাড়িয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লালন-পালন এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধি ও তাদের অবকাঠামো বাড়াতে খরচ বৃদ্ধি করেছেন। শক্তির জোরে প্রতিবাদীদের কন্ঠরোধ করতে কিংবা দমননীতি গ্রহন করতে বাড়তি পুলিশ, বিজিবির প্রয়োজনে স্বাভাবিকের চেয়ে খরচ দ্বিগুন করেছেন। এসব ব্যাপারে হয়তো রবিন হুড স্বায় দেয়া ছাড়া তার কিছু করার ছিলো না।
তাই এবার বাজেটের ধরণ ও করণ নিয়ে হঠাৎ জামান সাহেবের কবিতাটি মনে পড়ে গেলো। “বাজেট বাজেট মরার বাজেট/বাজেট আলুর দম/বড়র পাতে পড়ল বেশি/ছোটর পাতে কম!
সাধারণত বাজেটে করের মাধ্যমে সরকার যে রাজস্ব সংগ্রহ করে থাকে, তার মধ্যে অপেক্ষাকৃত ধনীর কাছ থেকে আদায় করা হয় প্রত্যেক্ষ কর। সাধারণ ভাবে এধরনের রাজস্ব “আয়কর” করদাতাকেই বহন করতে হয়। আয় করের বড় অংশ আসে কর্পোরেট ব্যবসায়িক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। (যেমন আমি আমার প্রতিষ্ঠানের আয়কর দিয়েছি) ব্যাক্তি আয়করের যে ব্যবস্থা এবারের বাজেটে রাখা হয়েছে, তাতে একজন ব্যক্তি যখন রির্টাণে আয় ১০ লাখ টাকা বাড়তি দেখাবেন তখন তার আয়কর বাড়বে ৩২ শতাংশ, যখন রির্টাণে আয় ১১ লাখ টাকা বাড়তি দেখাবেন তখন তার আয়কর বাড়বে ২৯ শতাংশ, যখন রির্টাণে আয় ১৭ লাখ টাকা বাড়তি দেখাবেন তখন তার আয়কর বাড়বে ২০ শতাংশ, যখন রির্টাণে আয় ৪৭ লাখ টাকা বাড়তি দেখাবেন তখন তার আয়কর বাড়বে ১৩ শতাংশ!
এবারে রবিন হুডের বাজেট প্রস্তাবে আয় যত বেশি হবে তিনি তত কম কর দেয়ার চাপ অনুভব করবেন! এর মাধ্যমে বাংলার রবিন হুড আমেরিকার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এর ভাবাদর্শের প্রতিফলনই ঘটালেন বলে মনে হচ্ছে।
আসুন এবার বাজেটের ব্যাপারে দেশের কিছু জ্ঞানী-গুণী, ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ সহ কিছু চাটুকারের মন্তব্যের সারমর্ম জেনে নিই…
দেশের ব্যাংকগুলো সুদের হার কমালেও ব্যাংকে আমানতের টাকা অলস পড়ে আছে বিনিয়োগের সুবিধাজনক অবস্থান না থাকার কারণে। কেউ শিল্প স্থাপনেও ঋণ নিচ্ছে না। ফলে গত কয়েক বছর ধরেই বেসরকারী বা ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২১ থেকে ২২ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে। যদি এই আস্থা ফিরিয়ে আনা না যায় তাহলে আগামীতে দেশে কর্মসংস্থান চরমভাবে হুমকির মধ্যে পড়বে। বিভিন্ন খাতের সেবা পাওয়া সহজ না করলে এবং নীতি সহায়তা না দিলে বেসরকারী বিনিয়োগ নিয়ে মহাবিপদে পড়তে হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অন্যদিকে এফবিসিসিআই সভাপতি জনাব মাতলুব বলেন, বাজেটের নামে একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। তার কথায়-গত চার মাস ধরে দফায় দফায় যে আলোচনা করেছি তা বৃথা গেছে! বজেটের নামে এনবিআর আমাদের ওপর একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে! তিনি আরো প্রশ্ন রেখে বলেন, তাহলে এই প্রহসনের ডায়ালগ কেনো!? দীর্ঘ চার মাসের আলোচনা নিয়ে ভাবতে লজ্জাবোধ হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিশুদ্ধ নাগরিকের মন্তব্য : জনাব মাতলুব সাহেব গত কয়েক দিন আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮শত কোটি টাকা গায়েব হয়ে যাওয়া অর্থ খুবই সামান্য বলেও মন্তব্য করেছেন। এও বলেছেন, হ্যাকার পুরো টাকা তো নেয় নি! অথচো আজকে তিনি, তার প্রস্তাব বাংলার রবিন হুড রাখতে পারেন নি বলে লজ্জাবোধও করছেন। তিনি বুঝতে পারেন নি যে, ৮শত কোটি টাকাও কিন্তু ঐ প্রস্তাবে উত্তাপিত বস্তু কিংবা জিনিস থেকে আদায়কৃত সামান্য কর থেকে নেয়া টাকারই অংশ বিশেষ।
পাদটিকা : মনে রাখতে হবে, ক্যান্সার যখন সুস্থ শরীরে বাসা বাঁধে তখন হৃষ্টপুষ্ট সবল শরীরটা অনুভব করতে পারে না কিংবা অনুভুতি হয় না যে, সে অসুস্থ। দীর্ঘদিন সেই জার্মটি যখন ঐ হৃষ্টপুষ্ট শরীরে লালন হতে থাকে, একদিন সেই জার্মটি বাহ্যিক ভাবে শরীরে প্রদর্শিত হয়; যেই দিন সেই শরীরে ক্যামো দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। হয়তো কিছু দিন শরীরটাকে ধরাদামে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় বিভিন্ন প্রকার ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে কিন্তু পরিপূর্ণ ভাবে সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয় না। যার শেষ পরিণতি ঘটে মৃত্যুর মাধ্যমে। তাই বলবো, সমাজের অলিখিত সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিয়ে পক্ষাবল্বন করলে সমাজ, জাতি তথা দেশের ক্ষতি বৈ লাভ হবে না। যার পরিণতি সমাজের সর্বস্তরের লোকদের বয়ে বেড়াতে হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১৬ বিকাল ৪:২২