১/ 'লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন' বলে একটা কথা আছে। এই গৌরী সেন এর পুরো নাম গৌরীশঙ্কর সেন, তিনি ভারতের হুগলির বড়াই লেনের গৌরীশঙ্কর শিব মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। তবে এই গৌরী সেনকে আমি চিনিনা। আমি চিনি আরেক গৌরীসেনকে, যার নাম 'প্রবাসী'।
মায়ের কুলখানী, বাপের চিকিৎসা,বোনের বিয়ে, ভাইয়ের কলেজ ভর্তি,ভাগিনার বিদেশ যাত্রা, মসজিদের ছাদ ঢালাই, মাদ্রাসার নতুন ভবন, সব কাজেই দিয়ে যাচ্ছেন এই গৌরি সেনরা। ছোট বোনের মেয়ে হয়েছে, স্বর্ণের চেইন দিতে হবে, আরেক বোনের ননদের বিয়ে, সেখানেও স্বর্ণের চেইন, ছোট ভাই গোঁ ধরেছে আই ফোনের জন্য, বড় বোনের মেয়েটার অনেক দিনের শখ একটা গ্যালাক্সি ট্যাবের । এসব ছাড়াও পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও সমাজের বিচিত্র চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন আমাদের এই গৌরী সেনরা।
আমরা কি কখনো ভেবে দেখেছি প্রবাসে কেমন সুখে আছেন আমাদের এই গৌরী সেনরা?
আমি কখনো বিদেশ যাইনি, তাই সঠিক পরিস্থিতি জানিনা, আবার একদম জানিনা এটাও ঠিক নয়। নিজ ভূখণ্ড পার হয়ে প্রবাসী নাম নিয়ে দূর দেশে পড়ে থাকা এসব প্রবাসীদের সুখের(?) খবর মাঝেমধ্যে আমরা পত্র পত্রিকা বা ফেইসবুকের বরাতে পাই।
ওমুক প্রবাসীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার, সোনা গয়না সহ ওমুক প্রবাসীর স্ত্রীর পলায়ন, পরকীয়ার জেরে ওমুক প্রবাসীর দুই সন্তান হত্যা,এসব তো নিত্য দিনের ই খবর।
সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর যে লোকটার বাসায় এসে রান্না করে খেতে হয় সে কতটা সুখি আমি জানিনা, নিজের ভালবাসার মানুষটার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে অন্যের সাথে তা জেনেও কিছু করতে না পারা লোকটা কতটা সুখি আমি জানিনা, নিজের পরিবারের সদস্যকে (মা, বাবা,ভাই, বোন) শেষ বিদায় বেলা দেখতে না পারার মাঝে কি সুখ তা আমার জানা নেই,প্রিয়তমা স্ত্রীকে আজ আসব কাল আসব এসব মিথ্যে সান্ত্বনা দিয়ে টাকার অভাবে ১০ বছরের মাঝেও দেশে আসতে না পারার মাঝে কি সুখ, কলিজার টুকরা সন্তান কে বুকে নিয়ে ঘুমাতে না পারার মাঝে কি সুখ তাও আমার জানা নেই।
এসব জানার দরকারও আমরা মনে করি না। আমাদের দরকার টাকা,প্রবাসী লোকটি সেই টাকার গাছ,,যখন চাই তখনি যেন পাই কাঙ্ক্ষিত সেই টাকা। এর অন্যথা হলেই 'ছেলে বখে গেছে' কিংবা অপবাদ- বউ 'তাবিজ' করেছে,শ্বশুর বাড়িতে টাকা জমাচ্ছে ।
২/ “উন্নয়নের পথে র্দূবার এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ এটা এখন আর স্বপ্ন কিংবা কল্পনা নয়, বাস্তবতা। উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রায় অর্থনীতিকে সর্বাধিক সহায়তা করছে সারা বিশ্বের প্রায় ১৬০ টিরও অধিক দেশে কর্মরত ১ কোটি ২০ লাখেরও অধিক প্রবাসীর পাঠানো রেমিটেন্স।সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ১৬ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ বিদেশ থেকে রেমিটেন্স বাবদ পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।(১৬ বিলিয়ন ডলার প্রবাসীদের অর্জিত অর্থের ৭৭ দশমিক ৯০ শতাংশ বাকি ২২ দশমিক ১০ শতাংশ আসছে নানা অবৈধ উপায় ও হুন্ডির মাধ্যমে, যা দেশের কোন উপকারেতো আসিনা উপরন্ত ক্ষতিকর নানা কর্মকান্ডে ব্যবহার হয়।)
রেমিটেন্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে বিশাল বৃদ্ধি ঘটিয়ে প্রায় ৩১,৩৭১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করেছে, যা দেশের নয় মাসেরও বেশি আমদানি ব্যয় মেটাতে সক্ষম। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে, ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বলে অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করছেন।।রিজার্ভের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। এই রেমিটেন্সের কারনে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ কয়েক বছরের ভিতর চীনের স্থান দখল করবে বলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। প্রবাসী এসব শ্রমিক যে পরমিাণ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠাচ্ছেন, তা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় অর্ধেক।
৩/ মোট রপ্তানী আয়ের অর্ধেকের যোগানদাতা এই প্রবাসীদের জন্য কি করছে দেশ, জাতী তথা সরকার?
যৌবনে প্রবাসে পাড়ী দেয়া মানুষটি ৫/৭ বছর পর দেশে এসে বিয়ে করে দুই মাস থেকে আবার প্রবাসে পাড়ী জমায়। দুই তিন বছর পর আবার দুমাসের জন্য এসে আবার প্রবাস।এইভাবে ৩০ বছরের দাম্পত্য জীবনে হিসাব করলে দেখা যায় সে স্ত্রীর সাথে দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেছে মাত্র দুই বছর। দূর প্রবাসে থাকার কারনে সন্তানের সাথে তৈরী হয়না আত্মিক সম্পর্ক। পরবর্তিতে অনেক সন্তান পিতার সাথে দুর্ব্যবহার করে। চোখের সামনে না থাকায় অন্য আত্মীয়রাও হয়ে যায় পর।
এক সময় বয়সের ভারে ন্যুজ প্রবাসীটি শরিরে নানা রোগের বাসা নিয়ে দেশে ফিরে। দেখেন তার পাঠানো টাকা আপন জনরা কাজে অকাজে খরচ করেছে, সঞ্চয় বলতে কিছু নেই। নেই বাকি জীবন অতিবাহিত করার অবলম্বন, নেই চিকিৎসা খরচ। অনাগত অনিশ্চিত জীবনের কথা ভেবে ঝাপসা হয় প্রবাসীর চোখ!
এমতাবস্থায় দেশ তথা সরকারকে এঁদের সহায়তায় এগিয়ে আসা দরকার। নিজের রক্ত পানি করে দেশের অর্থনিতির চাকা সচল রাখা এই সব রেমিটেন্স যোদ্ধাদের এই দুঃসময়ের জন্য চালু করা যেতে পারে পেনশন প্রথা । যা এখন সময়ের দাবী ।
বিষয়টি হতে পারে এরূপ - ন্যুনতম ১০ বছর প্রবাসে কর্মরত ব্যক্তি পেনশনের আওতাভুক্ত হবেন।
এই ১০ বছরে ঐ প্রবাসী বৈধ চ্যানেলে দেশে যে পরিমান অর্থ প্রেরন করবেন, তার উপর ভিত্তি করে ১ম, ২য়, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেনীর পেনশন ভোগী ক্যাটাগরী নির্ধারিত হবে।
এতে করে বন্ধ হয়ে যাবে হুন্ডি সহ নানা অবৈধ উপায়ে অর্থ প্রেরণ।
বিষয়টি নিয়ে সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যান মন্ত্রণালয়ের আশু সুদৃষ্টি কামনা করছি।
বিঃদ্রঃ- লিখাটির লিঙ্ক প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় (Ministry of Expatriates' Welfare and Overseas Employment)এর সমিপে এই ঠিকানায় ([email protected]) মেইল করা হবে। পক্ষে বা বিপক্ষে পাঠক মতামত জানাতে পারেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১১:৩৯