তাঁর প্রথম ক্যাসেটটির পেছনে কোম্পানির খরচ হয়েছিল সর্বসাকুল্যে ১৩৬০ টাকা। সেকালে মানুষ ক্যাসেট কিনতো কম, বেশির ভাগ ক্যাসেট টু ক্যাসেট কপি করে গান শুনত। এমত অবস্থায়ও অ্যালব্যামটির ৬০ লাখেরও অধিক কপি বাজারে বিক্রি করেছিল মূল কোম্পানী ‘চেনাসুর’। ধারণা করা হয় এই অ্যালব্যামের নকল ক্যাসেট বিক্রি হয়েছিল আরো ২৫ থেকে ৩০ লাখ কপি, যা বাংলাদেশের অ্যালব্যাম বিক্রির ইতিহাসে এক অনন্য রেকর্ড।
আরো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হচ্ছে, মুজিবুর রহমান মোল্লার গাওয়া এই অ্যালব্যামের এগারোটি গানের সব কয়টি পরবর্তীতে বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়। তন্মধ্যে তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত বেদের মেয়ে জোসনা সিনেমায় ব্যবহৃত “আমি বন্দী কারাগারে” গানটি সর্বাধিক আলোড়ন তোলে। সমালোচকদের ধারণা গানটির জনপ্রিয়তাই “বেদের মেয়ে জোসনাকে” জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আরো একধাপ এগিয়ে দিয়েছিলো। পরবর্তীতে এই সিনেমাটিও বাংলা চলচ্চিত্র জগতের ইতিহাসে সর্বাধিক ব্যবসা সফল সিনেমাদের কাতারে নাম লেখায়।
এতক্ষনে পাঠক অনুমান করতে পেরেছেন এই মুজিবুর রহমান মোল্লা কে?
মুজিবুর রহমান মোল্লা তখন বিক্রমপুরের ওয়াইজ ঘাটে বাবা ইউসুফ আলী মোল্লার সাথে একটা ফলের দোকান চালাতেন। অডিও কোম্পানী “চেনাসুর” এর কর্ণধার,গীতিকার হাসান মতিউর রহমান এখানেই আবিস্কার করেন মুজিবুর রহমান মোল্লা নামের এই শিল্পিকে। পরবর্তিতে যিনি মুজিব পরদেশী নামে পরিচিত হন।
“আমি বন্দী কারাগারে” নামে তার প্রথম অ্যালব্যাম টি তাঁর মুজিব পরদেশী নামেই বাজারে এসেছিলো ৷
“চাতুরী করিয়া মোরে,বান্ধিয়া পিরিতেরই ডোরে’’ “আমি কেমন করে পত্র লিখি রে বন্ধু? গ্রাম পোস্টঅফিস নাই জানা’’- আশির দশকের এমন শ্রোতা খুঁজে পাওয়া যাবেনা যিনি মুজিব পরদেশীর এই গানগুলি শুনেন নি। এককথায় বলতে গেলে ওই সময়ে যার কাছে টেপ (অডিও প্লেয়ার) ছিল তার কাছে অবশ্যই ছিল মুজিব পরদেশীর ‘আমি বন্দী কারাগারে’ ক্যাসেটটি।
এর পর একে একে তার ৪১ টি এলবাম বেরোয়। খ্যাতি চড়িয়ে পড়ে দেশ থেকে প্রবাসে। ইওরোপ,আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর নানা দেশ থেকে শো করার আমন্ত্রন আসতে থাকে।
জনপ্রিয়তার ঠিক এই পর্যায়ে মুজিব পরদেশীর জীবনে ঘটে ছন্দপতন। লন্ডনে গেলেন একটি শো করার জন্য। সেখানে গিয়ে আয়োজকদের পরামর্শে রয়ে গেলেন বেশ কিছুদিন। ৪ মাসের ভিজিট ভিসা শেষ হওয়ার পরেও আরও কিছুদিন রয়ে যান এবং একসময় দেশে ফিরে আসেন। লন্ডনে থাকাবস্থায় আদম পাচারের মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়েন মুজিব পরদেশী। তাদের শেখানো কথা মত দেশে ফিরে এসে লন্ডনে লোক নিবেন বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়ে নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে দিলেন, যিনি ছিলেন বাংলাদেশে ঐ মাফিয়া চক্রের সদস্য। সব টাকা মেরে নুরুল ইসলাম আত্মগোপন করলে মুজিব পরদেশীর উপর পাওনাদারেরা টাকার চাপ দিতে থাকে। কিন্তু মুজিব পরদেশী সব টাকা তো না বুঝেই চক্রের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। যার ফলে পাওনাদারেরা টাকা না পেয়ে মুজিব পরদেশীর নামে মামলা করলেন। মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেন এবং একসময় জামিনে বের হয়ে এলেন। জামিনে বের হওয়ার পর থেকে আর কখনও মামলায় হাজিরা দেননি। আজ অবধি পলাতক রয়ে গেলেন। এইভাবেই একজন দুর্দান্ত শিল্পী হারিয়ে যেতে থাকেন ধীরে ধীরে।
গায়কী আর গানে গানে সরল অনুভূতি বলে যাবার জন্য অসংখ্যবার টিভি-ক্যামেরার মুখোমুখি হওয়া মৃদুভাষী এ মানুষটি হয়তো নিজেকে কোনোদিনই এভাবে দেখতে চাননি। চাননি বলেই চলে গেলেন অখন্ড অবসরে, কেউ তাঁর খোঁজ পায় না; মানুষটি নিভৃতেই গানে মজে থাকেন, কাঁদেন আর পায়চারী করেন আরেকটি সুযোগের জন্য ৷
একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা একটি বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল লিখছেন, এমন সময় তার মনে পড়ে মুজিব পরদেশীর একটি গান। ঐ বিজ্ঞাপনের জন্য এই গান ছাড়া অন্য কোন জিঙ্গেলই পছন্দ হচ্ছিল না নির্মাতার। সেই নির্মাতার নাম – মোস্তফা সরয়ার ফারুকী ৷ ফারুকী নিজেও মুজিব পরদেশীর ভক্ত। সেই ফারুকী মুজিব পরদেশীর “কলমে নাই কালি” গানটি নতুন করে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দর্শকদের সামনে আনতে চান। তাই দরকার গানের মুল শিল্পীকে। অনেক খোঁজা খুঁজির পর তিনি সন্ধান পান মুজিব পরদেশীর। আরেক তরুণ সঙ্গীত পরিচালক অর্ণবের হাত ধরে গানটিকে নতুনভাবে সাজানোর মধ্য দিয়ে মুজিব পুনরায় ভক্তদের মাঝে ফিরে এলেন। আবার সেই রাজকীয় উত্থান, আধুনিক ফোক গানের পুরনো সম্রাটের আরেকবার রাজকীয় প্রত্যাবর্তনের ইশারা।
অর্নব ফারুকির মাঝে শিল্পি
মুজিব রাজকীয় ভাবেই ফিরেছেন। ফেরার আগে তাঁর মোট একক অ্যালব্যামের সংখ্যা ছিলো একচল্লিশটি। নতুন অ্যালব্যাম নিয়ে তিনি শীঘ্রই ফিরবেন ঘোষণা দিয়েছেন। ছেলে সজীব পরদেশীকে নিয়ে স্টেজ শো এবং নিয়মিত লাইভ শো করছেন বিভিন্ন চ্যানেলে, দর্শকরা এখনো উদ্বেলিত তার সুরের মূর্ছনায়; অতটুকু একজন গায়কের জন্য কম কিছু কী? বড় চমকের কথা হলো, তিন দশক পর আবারো মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর “ডুব” চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বড় পর্দায় তাঁকে দেখা যাবে ৷
মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি উপজেলার বেতকা গ্রামে জন্ম মুজিব পরদেশীর। সংগীত জীবনে তিনি বিভিন্ন সময়ে তালিম নিয়েছেন ওস্তাদ গোলাম হায়দার আলী খান, ওস্তাদ কোরাইশী, ওস্তাদ ফজলুল হক ও ওস্তাদ আমানউল্লাহর কাছে। তিনি তবলাতেও পারদর্শী। সুরকার হিসেবেও তাঁর প্রশংসা রয়েছে সংগীতপাড়ায়। বরেণ্য সুরকার এবং সংগীত পরিচালক সত্য সাহা, সুবল দাস, ধীর আলী, খন্দকার নূরুল আলমের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
প্রথম সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন ‘অশান্ত ঢেউ’ চলচ্চিত্রে। এরপর তিনি হাফিজ উদ্দিনের ‘অসতী’সহ আরও প্রায় বিশটি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছিলেন। সর্বশেষ ফিরোজ আল মামুনের ‘দৌড়’ চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স সম্পন্ন করা মুজিব পরদেশী প্রথম অভিনয় করেন সিরাজ হায়দার পরিচালিত ‘সুখ’ চলচ্চিত্রে। সর্বশেষ আশির দশকের শেষ প্রান্তে ফিরোজ আল মামুনের নির্দেশনায় ‘মোহন মালার বনবাস’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এখন অপেক্ষায় আছেন তিনি একটি বড় চমক দেওয়ার। ভারতের একটি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন শিগগিরই। আর যদি তা চূড়ান্ত হয় তাহলে তা হবে তার জীবনের অন্যতম বড় একটি প্রজেক্ট ৷
আধুনিক বাংলা ফোকের এই গুণী শিল্পীর প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
সব শেষে মুজিব পরদেশীর ‘কান্দিস নারে বিন্দিয়া-
তথ্যসূত্র-
https://roar.media/bangla/history/mujib-pordeshi-ekjon-shilpir-bondhur-pothchola/
http://www.bdlive24.com/home/details/
http://mediakhabor.com/?p=12591
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জুন, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১৯