একজন লেখকের লেখার মান কে বা কারা বিচার করবে? কয়েকজন ‘সমালোচক’ নাকি কয়েক লক্ষ্য পাঠক?
এখানে কয়েক জন যখন তাঁর উপন্যাসকে ‘অপন্যাস’ বলছে আরেকদল তখন তাঁর বাড়ির সামনে গিয়ে তাঁরই সৃষ্ট কাল্পনিক চরিত্রের ফাঁসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে।
সারা দেশে বিক্ষোভ হচ্ছে ,’’হুমায়ূন আহমেদের চামড়া , তুলে নেব আমরা । বাকের ভাইর কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।‘’
ঘটনাটা ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটক প্রচার সময় কালের ।
নাটকের নায়ক বাকের ভাই । এনটি সোশ্যাল ক্যারেকটার (দর্শকের দৃষ্টিতে হিরো)। সাথে দুই চেলা । মহল্লার প্রভাবশালী ‘কুত্তাওয়ালী’ তার পরিচালিত প্রাইভেট ব্রথেল ব্যবসা নির্বিঘ্ন করতে অন্যায় ভাবে বাকের ভাইকে খুনের মামলায় ফাঁসীয়ে দেয় । শেষ পর্বের কয়েক পর্ব আগে বাকের ভাইএর এক চেলা বদি (আব্দুল কাদের , বহুজাতিক কোম্পানি বাটা’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) ভয় ভীতির কারণে রাজসাক্ষী হয়ে বাকের ভাইর বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয় । দর্শক হতাশ , তারা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় বাকের ভাইর ফাঁসি হয়ে যাবে । এর পরেই ঘটতে থাকে উপরোক্ত ঘটনাগুলি ।
বাকের ভাইয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়ায় রাস্তায় গণপিটুনির শিকার হন আব্দুল কাদের । অল্পের জন্য তিনি প্রাণে রক্ষা পান । বহু দিন তাঁকে পুলিশ প্রোটেকশনে চলতে হয়েছে ।
শেষ পর্ব প্রচারের দিন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হুমায়ুন আহমেদের নিরপত্তা জোরদার করে । খারাপ কিছুর আশংক্ষায় তাঁকে গোপনে সরিয়ে নেয়া হয় অন্য বাসায় ।
রাত ৮টা ৪৫ মিনিট । সারা বাংলাদেশ বাংলাদেশ টেলিভিশনের সামনে । শেষ পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি হয়ে যায় বাকের ভাইর । সারা দেশে শোকের মাতম উঠে । উন্মত্ত দর্শক হামলা চালায় হুমায়ুন আহমেদের বাড়িতে । তারা ককটেল আর হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটায় ।
দেশের বিভিন্ন স্থানে রীতিমত গরু জবাই করে বাকের ভাইয়ের কুলখানি করা হয় ।
এ নজীর পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল । কত বড় মাপের লিখক হলে একজন লিখক তাঁর সৃষ্ট চরিত্রের সাথে সারা দেশকে একাত্ম করে ফেলতে পারেন তার দৃষ্টান্ত হুমায়ুন আহমেদ ।
তাঁর লিখা যতটুকু পড়েছি-যতটুকু জেনেছি...শুধু একটা কথাই বলতে পারি, সাহিত্যাকাশে হুমায়ুন নক্ষত্রের যে দীপ্তি তা অন্য যেকোন লেখিয়ের মনে হিংসার উদ্রেক করার জন্য যথেষ্ট।
• হুমায়ুন আহমেদের কয়েকটি উৎসর্গপত্রে তার মৃত্যু চিন্তা পরিস্ফুট হয়েছে -
"চলে যায় বসন্তের দিন" উৎসর্গ করা হয়েছে মেহের আফরোজ শাওনকে। (তখনো তারা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন নাই।) উৎসর্গপত্রে লেখা :
"আমার একটি খুব প্রিয় গান আছে, গিয়াসউদ্দিন সাহেবের লেখা 'মরণ সঙ্গীত'- 'মরিলে কান্দিস না আমার দায়।' প্রায়ই ভাবি আমি মারা গেছি, শবদেহ বিছানায় পড়ে আছে, একজন কেউ গভীর আবেগে গাইছে- 'মরিলে কান্দিস না আমার দায়।' 'নক্ষত্রের রাত' নামের ধারাবাহিক নাটকের শ্যুটিং ফ্লোরে আমি আমার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম। এবং একজনকে দায়িত্ব দিলাম গানটি গাইতে। সে রাজি হলো। উৎসর্গপত্রের মাধ্যমে তাকে ঘটনাটি মনে করিয়ে দিচ্ছি। আমার ধারণা সময় এসে গেছে।
"দেখা না-দেখা" গ্রন্থটি উৎসর্গ করেন তাঁর পুত্র নিষাদকে । উৎসর্গ বাণীটি এরকম:
"নিষাদ হুমায়ূন, তুমি যখন বাবার লেখা এই ভ্রমণ কাহিনী পড়তে শুরু করবে তখন আমি হয়তোবা অন্য এক ভ্রমণে বের হয়েছি। অদ্ভুত সেই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা কাউকেই জানাতে পারব না। আফসোস!"
কিংবদন্তী এই লিখকের আজ চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী । তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৬ সকাল ৯:৪৮