পেছন থেকে ডাক ভেসে এলো
" হোসেন ভাই, উঠেন"
চেনা কন্ঠ, ঘাড় না ঘুড়িয়েই বোঝা যায়, মনা ড্রাইভার। রিকশা টা ব্রেক করে সামনে দাড়াতেই হোসেন উঠে পড়ল রিকশায়।
শীতের রাত্রি, ল্যাম্পপোস্ট হলুদ আলো গুলো কুয়াশায় কেমন যেন ঘোলাটে, সেই আলো যেন কুয়াশায় ভর করে সারা রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। তৈরী হয়েছে অদ্ভুত মায়া।
চায়ের বিরতি নেবার সময় হয়েছে। মনা কে বললাম চা খাব।
এ শহরে শীতের রাত্রে একটাই টং খোলা থাকে। টং দোকানের ভেতর শাল জড়িয়ে বসে আছে হোসেন তার পাশেই মনা।
-চা খাবে
- নাহ
- কি খাবে?
- একটা বিড়ি লন
চা আসার আগেই মনার সিগারেট চলে এলো।
ম্যাচ কাঠি দিয়ে সিগারেট ধরিয়ে এক বুক নিকোটিন মনা বুকে টেনে নিয়ে ছাড়ল। কুয়াশা আর সিগারেটের ধোয়া মিলে মিশে একাকার। আলাদা করা যায় না। কোনটা কুয়াশা আর কোনটা ধোয়া।
মনা দীর্ঘ, খুব দীর্ঘ একটা দীর্ঘ নিঃশাস ফেলল।
- মনা ঠিক আছো?
- ছিলাম না এতক্ষন, তয় এখন হইলাম।
- কিভাবে
- অই যে, দম ছাড়লাম যে একটা, শান্তি লাগতেসে।
- ও আচ্ছা।
- এই দম ছাড়া বিষয়টা বড্ড রহস্য ভাই
- কেমন রহস্য।
- সবাই দম ছাড়তে দেখে, কিন্তু সবার কিন্তু একই উদ্দেশ্য ছাড়ে না।
- তুমি কি জন্য ছাড়লে?
- শান্তি পাইলাম। আপনার সাথে দেখা, এরপর আজ সারাদিন ভালো কামাই হয় নাই৷ একটা বিড়িও খাইতে পারি নাই৷ এখন খাইলাম। তাই শান্তির দম ছাড়লাম। এইটা একটা মজার বিষয়, এই দেখেন মানুষ হাসলে বুঝেন খুশি, কানলে বুঝেন দুখি,কিন্তু এই দম যে কিসের তা কিন্তু বুঝার উপায় নাই আপনি ছাড়া। হা হা।
- হুম।
ছোটবেলায়, হোসেনের পোষা একটা কুকুর ছিল। গ্রামে এমন কোথাও নেই তাকে নিয়ে ঘোরাঘুরি হত না, খেলা হত না। সেবার শহরে চিরতরে চলে আসবার সময় নৌকা ছেড়ে দেবার পর ও কুকুর টা দাঁড়িয়ে ছিল। আস্তে আস্তে ছোট হয়ে আসছিল, একটা সময় ঘোলা হয়ে আসছিল। কুকুরটাও দাড়িয়েই ছিল। শেষ বার বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এসেছিল। তখন বোঝেনি।
এরপর জীবনে কত কিছু এসে গেছে, সাদা কাগজ এ চোখা পেন্সিলের ভাংগা শিষ ছড়িয়েছে, খড়ায় মাটি ফেটে চৌচির হয়েছে তো কাদায় লেপে গেছে, বসন্তে বাগানে ফুল এসেছে। কত কিছু। কত দীর্ঘশ্বাস পড়েছে।
ভাগ্যিস এর কোনো রঙ নেই। আহ, একান্তই ব্যক্তিগত। কাউকে বোঝাবার ও কিছু নেই, কৈফিয়ত দেবার ও কিছু নেই।
চায়ে চুমুক দিল আনমনেই, ঠান্ডা হয়ে গেছে। চায়ের মতই শীতল হয়েছে কত কিছু, কত শরীর, কত সম্পর্ক।
হোসেন অনেক বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, বুকের গভীর থেকে গভীরতম স্তর থেকে। যদি মাপা যেত তাহলে হয়ত দেখা যেত, শীতের এই রাত্রি থেকেও তা অনেক দীর্ঘ, অনেক ঘোলাটে।