হাত থেকে বারেবারে ফসকে যাওয়া সোনার হরিনটি অবশেষে ধরা পড়লো বাংলাদেশের হাতে। খোলা বাসে সাফ ট্রফি জয়ী নারী ফুটবল দল উন্মাদনা ছড়িয়ে বিমান বন্দর থেকে বাফুফে ভবনে এলেন । পথের স্বতঃস্ফুর্ত উন্মাদনায় মেতে ক্রিকেটের কাছে হেরে যাওয়া একসময়ের জনপ্রিয় খেলা ফুটবল যেন তার হারানো মুখখানি একবার নতুন করে দেখিয়ে গেলো।
লেখাটি শুরু করেছিলুম সাফ ট্রফি বগলদাবার দিনটি থেকে। সে দিনটিতে মহাবেকুবেরই আহাম্মক হবার বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে
বলেই কী-বোর্ড আঙুল রেখেছিলুম। লিখেছিলুম -
পেপারে দেখলুম, টিভিতে শুনলুম; বাফুফে এমন কি দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন সাফের সভাপতি হয়েও কাজী সালাউদ্দিন সাহেব নাকি ফাইনাল দেখতে নেপাল যাননি! বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর খুশিতে মুর্ছা গেছেন বলে তিনি কারও ফোনই নাকি ধরেননি। এমন করে আহাম্মক বানালে, আহাম্মক না হয়ে উপায় কি ?
এমন কি, বাংলাদেশ ক্রিকেট কট্রোল বোর্ড (বিসিসিবি) বাংলাদেশের মেয়েদের বিজয়ের পরপরই তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে মেয়েদের একটা ছবি পোস্ট করে, যেখানে তারা লিখেছে “ইতিহাস গড়ার জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে শুভেচ্ছা। বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল এখন দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন” সেখানে বাফুফে সাফ জয়ী সোনার মেয়েদের বিজয়ের পোস্ট দিয়েছে প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা দেরিতে। তাতে না ছিল বিজয়ীদের প্রতি শুভেচ্ছা, না কিছু! ছবির সাথে একটি সংক্ষিপ্ত ম্যাচ রিপোর্ট তুলে ধরে বাফুফে দায় সেরেছে কিন্তু কর্তাদের খুশি রাখতে শুধু তাদেরকেই আস্তরিক অভিনন্দন জানাতে ভুল করেনি!
ছবি- ৭১ টিভির “একাত্তর জার্নাল” থেকে।
লজ্জিত হয়ে ভাবছিলুম, হায়রে অভাগা মেয়েরা!!!! নাকি পুরো বাংলাদেশ ?
কাজী সালাউদ্দিন সাহেব অভিজাত পরিবারের সন্তান জানি। তাই কি তিনি পেটে খিদে নিয়ে দিন গুজরান করা, অজ পাড়া-গা থেকে উঠে আসা অন্ত্যজ কিন্তু “আন-বিটেন”এই ফুটবলারদের তাচ্ছিল্য করেছেন, নিজের ফুটবল আভিজ্যাত্যে একদল অন্ত্যজ আর ব্রাত্যরা ভাগ বসিয়েছে বলে ?
মহাবেকুব বলে এমন বেকুবী ভাবনাতে পেয়ে বসলে দোষ দেবো কাকে ? বিধাতাকে ?
তুলে ধরেছিলুম, নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে শেষ যুদ্ধটির আগে সানজিদার নিজের ফেসবুকের একটি পোস্ট ।
বুকের গভীরে টনটনে ব্যথার ঝংকার তুলে দেয়ার মতো করে সানজিদা সেখানে লিখেছেন –“ পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়ব এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাব। জয় – পরাজয় আল্লাহর হাতে। তবে বিশ্বাস রাখুন, আমরা আমাদের চেষ্ঠায় কোনো ত্রুটি রাখবো না ইনশাআল্লাহ। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”
এমন লেখা যেন ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার অজ- অখ্যাত পাড়া-গাঁ কলসিন্দুর দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা সানজিদা, আঁখি খাতুন, কৃষ্ণা রানি, মারিয়া মান্ডা; রাঙামাটির রুপনা আর ঋতুপর্ণা, ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার সোহাগী কিসকু আর স্বপ্না রানী এমন অনেক নারীর বুকের গহন থেকে উঠে আসা এক একটি নতুন গল্প, যে গল্প পূর্ণতা পেয়েছে কাঠমান্ডুর দশরথে।
গতকালকে এটুকুও লিখে রেখেছিলুম –
এই অপরাজিত সাফল্যে দেশ কতখানি আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে জানিনা তবে এই সাফল্যের মূল্যায়ণ যে করতে পারে নি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন তা পানির মতো পরিষ্কার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাফুফে আগাগোড়াই সাফ এর এই টুর্ণামেন্টটাকে একপ্রকার অবজ্ঞা করেই এসেছে। এখন মেতেছে এই অবজ্ঞার সাফাই গাইতে। সাফ ফাইনালে কেন যান নি, কেনই বা বিমানবন্দরেও যাবেন না বাফুফে সভাপতি তা নিয়ে পাবলিককে আহাম্মক বানিয়ে একটা ফতোয়াও দিয়েছেন।
শুনেছি, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বলকারী সাফ মহিলা ফুটবল জয়ী মেয়েদের দলকে ছাদ খোলা বাসে চড়িয়ে বিমান বন্দর থেকে বাফুফে ভবন পর্য্যন্ত নিয়ে যাবেন জাঁক জমকের সাথে সম্বর্ধনার অংশ হিসেবে। শুধু এইটুকুই কি তাদের প্রাপ্য ? আমাদের কি মনে নেই, সেই কয়েক বছর আগে ( সম্ভবত ২০১৫তে) যখন এমন একদল মেয়েরাই দেশের বাইরে থেকে বিজয়ী বীরের বেশে দেশে ফিরেছিলেন দেশের মুখ উজ্জ্বল করে, সেদিন তাদের কে ভিখিরির মতো নিজ নিজ গ্রামের বাসে উঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ? পথে পথে যেদিন তারা লাঞ্ছনার শিকার হয়েছিলেন পুরুষের কাছে ?? এবার সেই ভুলের মাশুল পরিশোধ করতেই কি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীকে ছাদ খোলা বাস খুঁজতে হচ্ছে ? খুঁজতে হবে কেন ? মহাবেকুব জাতক যদ্দুর মনে করতে পারে, এই রকম ছাদ খোলা বাস তো পর্যটন করপোরেশনের কাছেই থাকার কথা যেটা দিয়ে তারা পর্যটকদের ঢাকা শহর ঘুরিয়ে দেখায়। নাকি এরই মধ্যে সেগুলিকেও লাটে ওঠানো হয়েছে ?
লিখে ছিলুম এটুকুও-----
গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের ফুটবলে একমাত্র মেয়েদের সাফল্য ছাড়া বাফুফে আর কি সাফল্য দেখিয়েছে ? পুরুষ ফুটবল দলকে নিয়ে বাফুফের যে নাচানাচি তা বৃথাই গেছে সব সময়। এই নাচানাচিটা অবহেলিত মেয়ে ফুটবল দলকে ( প্রশিক্ষন নিতে থাকা অনুর্ধ ১৪, ১৫, ১৬ ইত্যাদি দল) নিয়ে করলে একদিন তারাই বিশ্ব কাপ জিতে এনে দিতে পারতো ।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এই জয়ে কেবল খুশি হয়েছেন কোন্ও পুরস্কার ঘোষনা করেন নি। মহাবেকুব জাতকের ভাবনা, কেন ? ক্রিকেটে কিছু একটা সাফল্য ঘটলেই প্রধানমন্ত্রীর পুরস্কার দেয়ার হাতটা যেখানে দরাজ হয়ে যায় সেখানে তার হাত আজ গোটানো কেন ? অথচ শিরোপা জেতার খবরে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের খাগড়াছড়ির তিন ফুটবলার ও এক কোচের জন্য চার লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক । কি আশ্চর্যজনক ব্যতিক্রম !!!!!!!
আজ ২১ শে সেপ্টেম্বর আবহাওয়ায় অন্য এক আমেজ। ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বিআরটিসির সহযোগিতায় শেষ পর্য্যন্ত ছাদ খোলা বাসের ব্যবস্থা করছেন। তাকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কিন্তু এটা কি ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীর জয় নাকি সানজিদার ?
বাফুফের দীর্ঘদিনের অযোগ্যতা আর অকর্মন্যতাকে মনে রেখে এবং প্রকারন্তরে তা তুলে ধরতে সানজিদা আকাঙ্খা করেছিলেন, স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি ছাদ খোলা বাসের। সানজিদার সে স্বপ্ন পুরন হয়েছে। কিন্তু একটি দৃশ্য পরিষ্কার হয়েছে। বাফুফে সভাপতি তার ফতোয়ায় যে বলেছিলেন, তিনি বিমান বন্দরে গেলে নাকি মিডিয়ার সব আলো তার উপরেই থাকবে, বিজয়ী দল অন্ধকারে ঢেকে যাবে। তাই তিনি সেখানে যাবেন না। হায়রে নার্সিসিষ্ট! অথচ আজ বিমান বন্দর থেকে শুরু করে বাফুফে ভবনের ভেতর পর্য্যন্ত মানুষের আর মিডিয়ার স্বতঃস্ফুর্ত উন্মাদনার যে ছবি দেখলুম তাতে মনে হয়েছে, মহা-মহিম বাফুফে সভাপতি ছিটকে পড়তেন রাস্তার একপাশে। মানুষের উল্লাসের কাছে তিনি পাত্তাই পেতেন না এতোটুকু।
মহাবেকুবের মতো এরকম একটা বেকুবী ভাবনা আপনারও হয়তো হয়েছে।
ধরে নেবেন না, মহাবেকুব জাতক “বাফুফে”কে খাটো করতে চাইছে! মহাবেকুব অতোখানি বেকুব এখনও হয়নি। মহাবেকুবের ভাবনা অন্যত্র।
অজ- অখ্যাত পাড়া-গাঁ আর দারিদ্রতা থেকে উঠে আসা সানজিদা, মারিয়া মান্ডা, কৃষ্ণাদের মতো রয়েছে আরো আরো কৃষ্ণারা। পেটে ক্ষুধা নিয়ে দেশের আনাচে কানাচে এমন অনেক মারিয়া মান্ডা, সানজিদারা শীর্ণ পায়ে লড়ছে ফুটবলের সাথে। ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ততার দৃশ্য ধারন করতে আসা সব মিডিয়ার ধারাভাষ্যে এমন গল্পগুলোর কথাটিই উঠে এসেছে বারেবারে, খানিক পরে পরেই।
কাকে ছেড়ে কার কথা লিখবো?
গোপালপুর উপজেলার পাথালিয়া গ্রামের কৃষ্ণা । বাবা অসুস্থ্য আর মা বাড়ী বাড়ী কাজ করেন। কলসিন্দুরের মেয়ে মান্দ্রা। বাবা গত হয়েছেন। সহায়-সম্বলহীন মা এনাতো মান্দ্রা। বাড়ী বাড়ী গিয়ে গৃহপরিচারিকার কাজ করে তার মুখে ভাত তুলে দিয়েছেন। পয়সার অভাবে ২০১১ সালে বঙ্গমাতা টুর্নামেন্টে যাকে খালি পায়ে ফুটবলের মাঠে নামতে হয়েছে।
বঞ্চনার চিত্রটা এমনই। পুরুষের পথে এই মেয়েরা যেন বড় বাঁধা। পুরুষ খেলোয়ারদের নিয়ে বাফুফে থেকে শুরু করে বিসিসিবি আর অন্যেরা যেভাবে মাতম করেন তার সিকি ভাগও যদি মেয়েদের নিয়ে করতেন তবে বিশ্ব না হোক এশিয়া ক্রীড়ায় আমাদের স্থানটি হতে পারতো শীর্ষ ১ নম্বরে। বঞ্চনার নীচের চিত্রটা দেখে এই বেকুবেরও আরো বেকুব হবার পালা ---
ছবির কৃতজ্ঞতা - ৭১ টিভির “একাত্তর জার্নাল”।
শুধু নারী আর পুরুষ খেলোয়ারদের বৈষম্যই নয় আছে দেশীয় কোচদের প্রতিও উন্নাসিকতা। নারী দলের কোচ হিসেবে থাকা গোলাম রব্বানীর খেদ থেকেই বোঝা যায় এর সত্যতা। সাফের ট্রফি জয়ের পর রব্বানী বলেছেন,শুরুতে সবাই তাকে তাচ্ছিল্য করতেন। দেখা হলে উপহাস করতেন। তার বন্ধুরা বলতেন- ওই যে মহিলা কোচ যাচ্ছে।
সেই রব্বানীকেই এখন সমাদর করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে – বাফুফেতে অন্য কোচ আসলেও রব্বানী থাকবেন তার জায়গাতেই।
একথা সাফের ট্রফি জয়ের পর কেন ? আগে বলা যেতনা ?
পুরুষকে পিছে ফেলে নারীদের এই সাফল্যটুকুও মনে রাখুন- নারী ফুটবল দলের পর এবার জয় পেয়েছে নারী ক্রিকেট দল। নারী টি-২০ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে দাপুটে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। স্কটল্যান্ডকে ৬ উইকেটে হারিয়েছে তারা। খেলার মাঠে এই মেয়েদেরই জয়জয়কার।
এই অদম্য মেয়েদের কোন কারনে পেছনের সারিতে রাখবো আমরা ? কেন তাদের প্রতি আমাদের সব সামর্থ্য আর সদিচ্ছা নিয়ে হাত বাড়িয়ে দেবোনা ? না দিলে তা যে হবে আমাদেরই আত্মহনন!
মহাবেকুবের বেকুবীয় ভাবনা - এই –ই কি শেষ ? নাকি বিজয়ের শুরু ????????
সূত্র – ৭১ টিভির একুশে জার্নাল , দৈনিক কালের কন্ঠ, দৈনিক প্রথম আলো ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৫৬