[ ২রা জুন’ ২০২২ তারিখে সহব্লগার “ জুলভার্ণের” পোস্ট “জীব দেহের প্রায় পুরোটাই নন-হিউম্যান প্যারাসাইটিক....”য়ে জীব দেহের প্রায় পুরোটাই নন-হিউম্যান প্যারাসাইটিক.... মন্তব্য করতে গিয়ে মনে হলো মন্তব্যের বক্তব্য পোস্ট আকারে দেয়াই যুক্তিযুক্ত কারন মন্তব্যটাই যে বৃহদাকার। তাই এই পোস্ট আকারেই এটা দিলুম!
জুলভার্ন হিউম্যান সাইন্স ম্যাগাজিনের 'হিউম্যান প্যারাইট' অংশ থেকে নিয়ে লিখেছেন। ঠিক আছে এবং তার নিজের ভাষান্তরেও কোন প্রমাদ নেই।
তবে শিরোনামের বাক্যটি এবং বিষয়বস্তু নিয়ে সাধারণ মানুষেরা (ব্লগারেরা) বিভ্রান্তিতে পড়বেন বলে মনে হয় । সাধারণ মানুষেরা ভাবতেই পারেন , বলে কি আমরা “মানুষ” নই প্যারাসাইটিক জীব ?
হিউম্যান সাইন্স ম্যাগাজিন মানুষের শরীরের কোষ নিয়ে যে ভাবে বিষয়টি উপস্থাপনা করেছে সেটাই গন্ডোগোলের। তারা মানুষের কোষ আর নন-হিউম্যান কোষের সংখ্যার ব্যাপারটিকে অতিসরলীকৃত “কোয়ান্টিটেটিভ” দৃষ্টিতে বিবেচনা করে এই যে বলেছে - “জীব দেহের প্রায় পুরোটাই নন-হিউম্যান প্যারাসাইটিক....” এটা আসলেই বিভ্রান্তিকর।
কেন বিভ্রান্তিকর বলি -- যেমন ধরুন, একটি ইটের একপাশে আপনি সিমেন্ট বালুর একটি হালকা আস্তর দিলেন। এখানে ইট মাত্র একটি কিন্তু বালুকণা লক্ষ লক্ষ। এখন আস্তর সহ ইটটাকে বালু-সিমেন্টের ঢেলা বললে ঠিক হবেনা, বিভ্রান্তকরই হবে। আমরাও নিশ্চয়ই সেটাকে ইট-ই বলবো।
আরও সোজা করে উদাহরণ দিই - একটি দালান বানাতে আপনার লাগলো হাযার বিশেক ইট। আর বালি লাগলো দশ বস্তা। দশ বস্তা বালিতে বালুকণার সংখ্যা কোটি কোটি। যেহেতু বালুকনার সংখ্যা বেশী তাই এটাকে “বালিরঘর’ বলাটা ঠিক হবে কি ? নাকি “ ইটেরঘর” বলবো আমরা?
মানুষের শরীরে জীবানু বা মাইক্রোবসের সংখ্যাধিক্য থাকলেও, “জীব দেহের প্রায় পুরোটাই নন-হিউম্যান প্যারাসাইটিক” বলাটাও তেমনি বিভ্রান্তিকর।
খেয়াল করুন- -“জীবদেহের” শব্দটি শুনলেই সাধারণ মানুষেরা একটি মানুষের সামগ্রিক আকৃতির কথা ভেবে নেন। এখন যদি বলা হয় -“জীব দেহের প্রায় পুরোটাই নন-হিউম্যান প্যারাসাইটিক....” তবে সাধারণ মানুষেরা আৎকেই উঠবেন। তাদের এতোদিনের জানা - “মানবদেহ লক্ষ লক্ষ হিউম্যান কোষ দ্বারা গঠিত”, এই কথাটি কি ভুল !!!!!! তার হাত-পা-মাংশপেশী- হৃদয় সবটাই কি পরজীবী কোষ দিয়ে গঠিত!!!!!! তার সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কি আসলেই কিছু নয়, ভুল জিনিষে ভরা !!!!!!
আসল ব্যাপারটি কি তা নিয়ে আলোচনা করা যাক -
এই যে উল্লিখিত পোস্টে বলা হলো - একজন মানুষের শরীরে ১০০ ট্রিলিয়ান কোষ থাকে। এর মধ্যে ৯০ ট্রিলিয়ান কোষ আপনার নয়........মানে, রোজ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে যে তারিফ করেন, ও তারিফের মাত্র ১০% আপনার প্রাপ্য। সেভাবে দেখলে এই শরীর আপনার নয়, এ শরীরের আসল মালিক জীবাণুরা, আপনাকে তারা থাকতে দিয়েছে দয়া করে! তা কিন্তু মানুষের দেহ গঠনের ক্ষেত্রে সঠিক কথা নয়। বরং মানুষের দেহের গঠন নিয়ে অন্যভাবে দেখলে ( যা বিজ্ঞান সম্মত) বলতে হবে, মানুষ তার দেহে বসবাস করা বা লেগে থাকা জীবানুদের থাকতে দিয়েছে দয়া করে। যদিও সত্যিকার অর্থে এটা দয়া নয়, মানুষের প্রয়োজনেই জীবানুদের বসবাস। এটা এক ধরনের “সিমবা্য়োসিস” প্রক্রিয়া। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন।
আশ্বস্ত থাকুন, আপনার আকৃতিটি কেবল “হিউম্যান সেল” দিয়েই রচিত। আপনার হাত-পা -নাক-কান-পেট বুক সবই “ মানব কোষ” । জীবানু কোষ দিয়ে আপনার হাত-পা, আকৃতি তৈরী হয়নি। তাহলে ৯০ ট্রিলিয়ন জীবানু কোষ গেল কই ? সে কথায় পরে আসছি।
উল্লিখিত পোস্টে নন-হিউম্যান কোষ নিয়ে উদৃত হিউম্যান সাইন্স ম্যাগাজিনের মতো কথাবার্তা আপনি পাবেন বিভিন্ন সায়েন্টিফিক পেপার- ম্যাগাজিনের প্রবন্ধ, নিবন্ধে এমনকি জনপ্রিয় সায়েণ্টিফিক বইতেও। পাবেন বিভিন্ন ব্লগেও। কিন্তু এসবের বেশীর ভাগটাই সত্যিকার অর্থে সত্য নয়। এই সমস্ত ফ্যাক্টয়েডগুলোকে বা সত্যের অনুরূপ সত্যগুলোকে প্রমানের কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই। মানব “মাইক্রোবায়োম” নিয়ে বিগত চল্লিশ বছর ধরে চলা গবেষনাগুলো পর্যালোচনার পরেই মাত্র ২০১৬ সালে এমন কথাটি বলা হয়েছে।
তাহলে হিউম্যান সাইন্স ম্যাগাজিনের মতো ম্যাগাজিনগুলো এমন অর্ধসত্য বা সত্য নয় এমন লেখা ছাপায় কেন ?
এইসব ম্যাগাজিন গুলো কিন্তু গবেষনা করেনা, পরীক্ষা -নিরীক্ষা ছাড়াই তারা গবেষনার নিবন্ধগুলো শুধু ছাপিয়ে দিয়েই খালাস। আর এসব নিয়ে বাহাসের লেখাগুলোও তারা ছাপিয়ে থাকে।
তারা এসব ছাপায় সম্ভবত একারনে যে, এসব অপরিশোধিত ও সত্যের কাছাকাছি অনুমানগুলো যারা যারা পড়ে বা শোনে তা যেন টিকে থাকে আর যাতে ম্যাগাজিনগুলোর ব্যবহারিক উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়। যেমন, মানুষ নাকি তার মগজের ১০ শতাংশই মাত্র ব্যবহার করতে পারে এই “মিথ’টি স্নায়ুবিজ্ঞান সম্পর্কে মানুষের কৌতূহলটিকেই জাগিয়ে রাখে বা অনুপ্রানিত করে। এতে এ জাতীয় স্নায়ু সম্পর্কিত লেখাগুলো সে যেখানেই পাবে, পড়বে।
এখন আসা যাক - মানুষের শরীরের ১০ ট্রিলিয়ন কোষ আর ৯০ ট্রিলিয়ন নন-হিউম্যান কোষ বিষয়টিতে ।
মানুষের কোষ গননা মোটেও সহজ একটি কাজ নয় এখন পর্যন্ত। কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের রিপোর্ট করে পুলিৎজার পুরষ্কার পাওয়া ‘দ্য আটলান্টিক’ পত্রিকার ষ্টাফ রিপোর্টার “ এড ইয়ং” সে কথাই বলেছেন, মানব কোষ গননা করা আদপেই অসম্ভব।
তবুও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনিষ্টিটিউট অব হেলথ, বেথেসদা’র মলিকিয়্যুলার বায়োলোজিষ্ট ও জেনেসিষ্ট “জুডাহ রোজনার” বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যে গননা তাতে মানব শরীরের কোষ সংখ্যা ১০ ট্রিলিয়নের ধারে কাছেও নেই। তার মতে, এ সংখ্যাটি ১৫ থেকে ৭২৪ ট্রিলিয়নের মধ্যে । আর নন-হিউম্যান কোষ ( মাইক্রোবস) এর সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০০ ট্রিলিয়নের মধ্যে।
জীবানু বা মাইক্রোবসের সংখ্যা গননা করতে গিয়ে “ওয়াইজম্যান ইন্সটিটিউট অব সাইন্স” এর বায়োলোজিষ্ট “ রন মিলো” এবং তার দলবল মানুষের শরীরে বসবাসরত মাইক্রোবস সম্পর্কে এ যাবৎ প্রাপ্ত সকল লিটারেচার ঘেটে দেখেছেন। দেখতে গিয়ে তারা দেখেছেন - ২০ থেকে ৩০ বছর বয়েসী যার ওজন ৭০ কেজির কাছাকাছি এবং উচ্চতা ১৭০ সেন্টিমিটার; এমন মানুষ ( রেফারেন্স ম্যান)এর দেহ তৈরী হয়েছে আনুমানিক ৩০ ট্রিলিয়ন কোষ দিয়ে। আর মানুষের দেহে জায়গা করে নিয়েছে ৩৯ ট্রিলিয়ন মাইক্রোবস ( নন-হিউম্যান কোষ)। এতে হিউম্যান আর নন-হিউম্যান কোষের অনুপাতটি দাঁড়ায় ১ : ১.৩ অর্থাৎ প্রায় সমান সমান।
তা হলে হিউম্যান আর নন-হিউম্যান কোষের অনুপাত ১ : ১০ এলো কোত্থেকে?
মজার ব্যাপারটি এখানেই!
এখানে একটি তৈরী করা অংককে (numerator)আর একটি তৈরী করা “হর” (denominator) এর উপরে চাপিয়ে একটি সুন্দর ‘বাউন্সিং বেবী ফ্যাক্টয়েড” জন্ম দেয়া হয়েছে।
এই অংকের জন্ম কি ভাবে হলো ?
সন্ধান করে দেখা গেছে, ১৯৭০ সালে প্রকাশিত একটি “পেপার” বা লেখা এই অপরিশোধিত তথ্যের সূতিকাগার। আমেরিকান মাইক্রোবায়োলোজিষ্ট “থমাস ল্যাকি” এই পেপারটি লিখেছেন এবং সেখানে বলেছেন যে, মানুষের শরীরের অন্ত্রের একগ্রাম ( ১ গ্রাম) আন্ত্রিক রস (intestinal fluid) ও মলের (faeces.) মধ্যে ১০০ বিলিয়ন (100 billion) মাইক্রোবসের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। এবং যেহেতু সাধারন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের শরীরে ১০০০ গ্রাম আন্ত্রিক রস ও মল থাকে তাই মানব শরীরে সর্বমোট ১০০ ট্রিলিয়ন (100 trillion) মাইক্রোবস বসবাস করে। মজার ব্যাপার হলো, তার এই তথ্যের স্বপক্ষে এ পর্যন্ত কিন্তু কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমান নেই।
“দ্য আটলান্টিক” পত্রিকার ষ্টাফ রিপোর্টার “এড ইয়ং”ও তাই বলেছেন - “নিঃসন্দেহে মাইক্রোবায়োম সম্পর্কিত এ তথ্যটি একটি প্রখ্যাত “ষ্টাটিসটিকস” এবং সম্ভবত ভুল। এটা যেন খামের পেছনে পেন্সিলে কষে কষে গননা করা একটি পরিসংখ্যান।”
এই ঘটনার সাত বছর পরেই গিট্টুটা লাগিয়েছেন বিখ্যাত মাইক্রোবায়োলোজিষ্ট “ডোয়াইন স্যাভেজ”। মানুষের শরীরে যে ১০ ট্রিলিয়ন কোষ আছে সেটা ধরে নিয়ে তিনি একটি অনুপাতের অংক কষে “বাউন্সিং বেবী ফ্যাক্টয়েড”টির জন্ম দিয়েছেন এই বলে যে, হিউম্যান আর নন-হিউম্যান কোষের অনুপাত ১ : ১০। একদম সরলীকৃত একটি অংক যেখানে কাওরান বাজারে বাজার করতে আসা মানুষের সংখ্যার সাথে বাজারে ওঠা মাছের সংখ্যার অনুপাত করা হয়েছে, এমন কিছু।
এতে মনে হবে যে, আপনার শরীরের ১০ ভাগের ৯ ভাগই আপনার নয়। যেমনটা বলা হয়েছে জুলভার্ণের পোস্টটিতে উল্লেখিত ম্যাগাজিনে।
আসলে আপনার হাত-পা-নাক-কান যা আছে তার শতভাগ আপনারই। আর যে মাইক্রোবস নিয়ে এই গিট্টুটা লেগেছে তাদের বেশীর ভাগই থাকে আপনার অন্ত্রে মানে ইন্টেষ্টাইনে। বলাই তো হয়েছে যে, ১ গ্রাম মলের মধ্যে থাকে ১০০ বিলিয়ন (100 billion) মাইক্রোবস। এরা আপনার হাতে পায়ে বসে থাকেনা। এর বাইরে যা থাকে তা থাকে মূলত আপনার চামড়ার উপরিভাগে, নাক ও কানের নালীপথের উপরি ভাগে "ইপিথেলিয়াল লেয়ার"য়ে। মানব কোষের তুলনায় এই মাইক্রোবসগুলি এতোই ক্ষুদ্র যে আপনার চামড়ায় প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে থাকতে পারে এক ( ১ ) বিলিয়ন মাইক্রোবস । অর্থাৎ আপনি সারা শরীরের উপরিভাগে প্রায় ১.৮ ট্রিলিয়ন মাইক্রোবসকে বসতে দিয়েছেন যেমন আমাদের ফুটপাথে হকারদের আমরা বসতে দিই! এতে উভয়পক্ষেরই লাভ।
আপনার শরীরের কিছুই যে আপনার নয় একথায় ঘাবড়ে যাবেন না । আপনাকে হতবাক করে দেয়া ১ : ১০ এর এই অনুপাতটি আপনি নিজেই পাল্টে দিতে পারেন। এ জন্যে আপনাকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখা বাদ দিয়ে বেশী করে “মলত্যাগ” করতে হবে। প্রতিদিন ১০০০ গ্রাম বা ১ কেজি মলত্যাগ করতে পারলেই আপনি ১০০ ট্রিলিয়ন (100 trillion) মাইক্রোবসকে বের করে দিতে পারবেন ( উপরে দেয়া হিসেব মতে) আপনার শরীরের মধ্য থেকে। তখন হিউম্যান আর নন-হিউম্যান কোষের অনুপাত ১ : ১০ থেকে হবে ১ : ০।
লাগ ভেলকি লাগ.........
এর পাশাপাশি জুলভার্ণের বলা -“ছাত্রাবস্থায় পড়েছিলাম infection and disease are not the same, সংক্রমণ মানেই রোগ নয়। সংক্রমণের চিকিৎসা লাগে না, রোগের লাগে।" কথাটিতে কিছু না বললেও নয়। কারন তিনি পোস্টের শেষে লিখেছেন - “বিজ্ঞান ব্যক্তিগত বিশ্বাস দিয়ে চলে না, যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে চলে। বিজ্ঞান জানুন, সুস্থ থাকুন”। তাই এর পরিপ্রেক্ষিতে “The world is running out of antibiotics... Why? এন্টিবায়োটিকের কথা।“ সিরিজের একটি লিংক দিচ্ছি যাতে সত্যটি কি বুঝতে পারা যায় -The world is running out of antibiotics... Why? এন্টিবায়োটিকের কথা। প্রথম পর্ব
সূত্র --
Here's How Many Cells in Your Body Aren't Actually Human
BEC CREW Click This Link
. You’re Probably Not Mostly Microbes Click This Link
ছবির কৃতজ্ঞতা---
Dreamstime.com
এবং
DCEG - National Cancer Institute
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০২২ দুপুর ১:১০