সিন্ডিকেটেড মহোৎসব.....
প্রতিদিন, ঘন্টায় ঘন্টায় বেসামাল হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের বাজার। চাল, ডাল, আটা-ময়দা, সব ধরনের সবজি ও ভোজ্য তেলসহ ভোক্তার প্রয়োজনীয় সব পণ্য অসহনীয় দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় চলছে চরমভাবে বিশৃঙ্খলা ।
এহেন পরিস্থিতিতে বানিজ্যমন্ত্রীর আজকের (০২.০৩.২০২২) বলা কথা শুনে বেআক্কেলের মতো গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসলুম, এ কি বললেন তিনি! নির্ধারিত মূল্যের বাইরে নাকি পন্য বিক্রি করা যাবেনা! শাস্তি পেতেও হবে নাকি! কাউকেই নাকি ছেড়ে দেয়া হবেনা।
এমন কথা শুনে আপনিও কি এই বেকুবের মতো গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেছেন ? ভাবনার কথাই বটে! কারন বাজারে গিয়ে আপনাকেই (ভোক্তা সকলকে) তো বোকা হতে হচ্ছে প্রতিদিন। নির্ধারিত মূল্যের অনেকগুন বেশী দিয়েই তো প্রতিদিনই আপনাকে নিত্যপণ্য কিনতে হচ্ছে! নাকি হচ্ছে না ? এমন চিত্রনাট্যের মঞ্চায়ন কিন্তু চলছে বছরের পর বছর৷
মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, নির্ধারিত মূল্যের বাইরে পন্য বিক্রি করা যাবেনা! শাস্তি পেতে হবে ।
মন্ত্রী মহোদয় মানুষকে আশ্বাসের বাণী শোনাতেই পারেন! মন্ত্রী এও বলেছেন, বাজার মনিটরিং করা হবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রনের জন্যে এ সম্পর্কিত সকল সংস্থাগুলো প্রয়োজনে একই জায়গাতে একযোগে কাজ করবে। এমনকি ডিজিএফআই ও এর সাথে সম্পৃক্ত থাকবে। স্বস্তির কথা বটে!
কিন্তু এই মহাবেকুব ভেবে পায়না কোথায় মনিটরিং করা হবে ! খোলা বাজারে মনিটরিং ?
মূল্য বৃদ্ধি করতে খোলা বাজারের তো উসিলার শেষ নেই। খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে দাম কেন বেড়েছে প্রশ্ন করলেই আপনাকে শুনতে হবে গুচ্ছের উসিলা। সরবরাহ কম, আমদানী আয় বেড়েছে, বিশ্বে বেড়েছে পণ্যের দাম, তেলের দাম বাড়ায় পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়েছে, বৃষ্টিতে ফসল নষ্ট, রোদ্দুরের কারনে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ফসল উৎপাদন কম, পাইকারেরা দাম বাড়িয়েছে, পরিবহন খরচ বেড়েছে , বেড়েছে পথে পথে চাঁদার হার ইত্যাদি হাযারো উসিলা।একই বাজারে একজন বিক্রেতার সাথে অন্য আর একজন খুচরা বিক্রেতার এমন উসিলার মিল খুঁজে পাবেন না। আপনার আক্কেল গুড়ুমই হবে শুধু। বাঙালী উদ্ভাবক জাতি। দ্রব্যমূল্যের এমন অযাচিত বৃদ্ধির স্বপক্ষে সময় বুঝে তাদের এসব উদ্ভাবনী শক্তির প্রশংসা করতেই হয়। খুচরা বিক্রেতাদের চেয়ে পাইকারী বিক্রেতারা এককাঠি সরেস। তাদের আছে বিশ্ববাজারের অস্থিরতা, পণ্যের টেরিফমূল্য, ভ্যাট-ট্যাক্স ইত্যাদি হাযারো অজুহাত।
এই যেমন ইউক্রনের যুদ্ধের উসিলা দিয়ে ৩ মাস আগে আমদানী করা ছোলা-বুট-ডাল- পেয়াজ- ভোজ্যতেল-চিনি- মসলা সহ সকল পণ্য চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের পাইকারী বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করা শুরু হয়েছে অথচ ইউক্রেন থেকে আমরা শুধু গমই আমদানী করি!
এমনটা হলেই আপনার আমার মাথায় যেটা ঘোরে সেটা হলো- “সিন্ডিকেট” নামের ব্যাখ্যাতীত এক ভুত! আম-পাবলিকের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্যে “সিন্ডিকেট” নেতিবাচক আর আতঙ্কের একটি শব্দ ৷ এই সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ শুধু বাজারে পণ্যের দামের কারসাজিতেই সীমাবদ্ধ নয়৷ এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি যেন সরকারও৷দফায় দফায় ব্যবসায়ীদের সাথে সরকারের আলাপ আলোচনার বহর থেকেই তা পরিষ্কার।
অথচ “ সিন্ডিকেট” ব্যাপারটি কিন্তু আদপেই খারাপ নয়। অর্থনীতি আর ব্যবসা-বাণিজ্যে আলাদা একটি গুরুত্ব আছে “সিন্ডিকেট” এর। একটি প্রতিষ্ঠানের একার পক্ষে যখন কোনো উদ্যোগ, বিনিয়োগ বা লেনদেন সম্ভব হয় না, তখন একই ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠান মিলে সেটি করলে তাকে “সিন্ডিকেট” হিসেবে অভিহিত করা হয় ৷ আর্থিক খাতে বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতেও সিন্ডিকেট বেশ গুরুত্ব রাখে। বড় আকারের কোনো ঋণের ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাংক মিলে যখন তার জোগান দেয়, তখন তা “সিন্ডিকেটেড লোন” হিসেবে বিবেচিত হয়৷
অথচ “সিন্ডিকেট” শব্দটি এখন আম-আদমীদের কাছে নেতিবাচক আর আতঙ্কের একটি নাম। এই মহাবেকুবের মতো আপনিও হয়তো ভাববেন - তাইতো! “সিন্ডিকেট” এর উদ্দেশ্য যদি ভালোই হবে তাহলে কেমনে কি!!!! আসলে এই দেশে আপনি অর্থনীতির কোনও সংঙ্গাকেই আগেও যেমন মেলাতে পারেন নি আজও পাবেন না! যেমন, উৎসব ঘিরে সারা বিশ্বেই নিত্যব্যবহার্য পণ্যমূল্য কম থাকে। রমজানে সব মুসলিম প্রধান দেশই নিত্যপণ্যের দাম কমিয়ে রাখে। অথচ এর উল্টো আচরণ দেখা যায় বাংলাদেশের বাজারে। রকেট গতিতে বাড়তে থাকে পণ্যের দাম। উছিলা একটাই, চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম। কিন্তু রোজা-ঈদ -পার্বনে আপনি বাজারে কি পণ্যের সরবরাহ কম দেখেছেন কখনও ?
অর্থনীতিতে “সিন্ডিকেট” এর সংঙ্গা যা-ই থাক, এদেশে সিন্ডিকেটবাজরা সম্মিলিতভাবে ভোক্তাদের ঠকানোর যাবতীয় আয়োজন যাতে করতে পারেন তার একটা শক্তিশালী মেকানিজম তৈরী করে ফেলেছেন পাকাপোক্ত ভাবেই। তাইতো যৌক্তিক- অযৌক্তিক নানা উসিলায় দ্রব্যমূল্য বাড়ানোর জন্যে তাদের কে দেখা যায় সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করতে। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্য বাড়ানোর পাঁয়তারা করে সরকারকে নাজেহাল তো তারাই করেন! এ ক্ষেত্রে ভোজ্য তেল সয়াবিন নিয়ে অতি সাম্প্রতিক তেলেসমাতির কথা আপনি স্মরণ করতে পারেন।
এতোক্ষন তো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের সিন্ডিকেটের কথা বললুম। কিন্তু সিন্ডিকেট নেই কোথায় ? দেশের প্রতিটি পেশাতেই এখন সিন্ডিকেটের দৌরাত্নে আম-আদমীদের জান হাসফাঁস। এদের ভেতরে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও ক্ষমতাধর হলো, পরিবহণ সংগঠনের সিন্ডিকেট যার ভুক্তভোগী আমরা সবাই। শহর এলাকায় সিন্ডিকেটেড “সিটিং সার্ভিস” এর চিটিংয়ে ত্যাক্ত-বিরক্ত হননি এমন মানুষ আছে কি ? হাসপাতালগুলোতে আছে আ্যাম্বুলেন্স মালিকদের সিন্ডিকেট। তারা এতো জঘণ্য যে লাশ বহনের বেলাতেও কোনও ছাড় দেন না।
ছাত্র সমাজ হাড়ে হাড়ে টের পান শিক্ষক সংগঠনগুলোর সিন্ডিকেশনের কারনে যখন তাদের শিক্ষা কার্যক্রম অনেক সময়েই ব্যহত হয়, পেছিয়ে যায় পরীক্ষা। কেবল অপারেটরদের সিন্ডিকেটের কারনে ভোগান্তিতে পড়েননি এমন আম - আদমী খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। মোবাইল ফোনের সংযোগ প্রদানকারী বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেশনের কারসাজিতে পকেটের পয়সা মিনিটে হাপিস হয়ে যাওয়াই বা বাদ যাবে কেন ? ভিক্ষুক সিন্ডিকেটের কথাও আপনাদের অজানা নয়!
আবার ঋণখেলাপিদের সিন্ডিকেটটি এতটাই শক্তিশালী যে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া তো দূরে থাক উল্টো অর্থ ফেরত দিতে নানা ছাড় দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংককে ৷বছর বছর জনগণের কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে যায় ৷ সেই টাকা উদ্ধার করতে পারছে না বা পারে না সরকার৷ খেলাপি ঋণের টাকা আদায় করা যাচ্ছে না, অথচ বছর বছর বাজেট থেকে জনগণের করের টাকায় ব্যাংকের তারল্য সংকট মেটানো হচ্ছে ৷
শুধু সিন্ডিকেট নেই ম্যাংগো পিপলের!
উপরে প্রদত্ত বানিজ্য মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের যে প্রসঙ্গ টেনেছি তার পরিনতিতে বাজারে নেমেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন কমিটির লোকজন। ৩রা ফেব্রুয়ারীর টিভির সংবাদে দেখলুম, কারওয়ান বাজারে ভ্রাম্যমান আদালত খুচরা ও পাইকারী উভয় কিসিমের বেশ ক’জন বিক্রেতাদের তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারনে ও তেল নেই বলে ক্রেতাকে ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনায় আর্থিক জরিমানা ও দোকান সীলগালা করার দৃশ্য। অথচ বাজারে তেলের কোনও ঘাটতি নেই। বিক্রেতারাও বলছেন, বাজারে কোনও পণ্যের ঘাটতি নেই, নেই তেলেরও।
অথচ বলা হচ্ছে বাজারে সয়াবিন উধাও।এই দৃশ্য এবং বিক্রেতাদের কথাবার্তা শুনে এই মহাবেকুবের মাথায় একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে যে - ব্যবহার্য্য জিনিষপত্রের দাম বাড়ানোর জন্য খুচরা-পাইকারি ব্যবসায়ীরাই কি শুধু দায়ী?
মহাবেকুবের বেকুবী ধারনা - সব ধরনের পণ্যে ক’দিন পরপরই মূল্যবৃদ্ধির লাগামহীন ঘোড়াগুলোকে দাবড়ানি দিয়ে বেড়ান বড় বড় আমদানিকারক ও শিল্প গ্রুপ যারা তেল, চিনি,চাল-গমের মতো খাদ্য পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন কিম্বা মিলার্স যারা তেল পরিশোধন বা ধান ছাটাই করেন বা গম পেষেন তারা-ই। এরা দেশের বৃহৎ সব শিল্পগোষ্ঠী। তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযানের খবর কি শুনেছেন আপনি কখনো?
বেকুব হলেও এটা তো বুঝি যে সোজা হিসেবে একটাই, কত টাকায় আমদানি করে কত টাকায় তারা পণ্য বাজারে ছাড়ছে, কীভাবে সরবরাহ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে বাজারে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে সেসব বিষয় খতিয়ে দেখা। সেটা দেখলেই তো হয়! তাহলেই দুধ কা দুধ পানি কা পানির হিসেব মেলে। মূল্যবৃদ্ধির ঘোড়াগুলো দৌঁড়ে কদ্দুর গেলো, কেনই বা গেল, থামছেনা কেন এসব দেখার প্রয়োজন কি মনে করছে না সরকার? তাহলে এই বেকুবের চেয়েও সরকার কি মহা বেকুব ? নিশ্চয়ই নয়! তা’হলে ??
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এর কথাতেই বলতে হয়, “রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে।” কথাটি বললুম এ কারনে যে , স্বাধীনতার পর জাতীয় সংসদে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সাড়ে ১৭ ভাগ ছিলেন ব্যবসায়ী আর একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেওয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই পেশায় ব্যবসায়ী অর্থাৎ মোট সংসদ সদস্যের ৬২ ভাগ ৷ব্যবসায়ীরা এখন শুধু আড়ালেই থাকছেন না, সরাসরি রাজনীতির মাঠেই নেমে পড়েছেন৷ তারাই আইন প্রণয়ন করছেন,রাষ্ট্রীয় নীতি ঠিক করছেন,সরকার চালাচ্ছেন৷বিশ্ব বাজারের দোহাই আর ছুতানাতা দিয়ে ম্যাংগো পিপলদের লুন্ঠনের রাস্তা তৈরী করছেন!
মহাবেকুব জাতক ভেবে পায়না -কেন সরকার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে এতটা নতজানু! ছুতানাতায় পণ্যের দামবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে সরকারের সাথে বাহাস করার সাহস তারা কোথায় পায়? ব্যবসায়ীদের সব উঁচু পর্যায়ের সিন্ডিকেটের অর্থের জোর বেশি বলে, ক্ষমতাও বেশি বলে ?
নাকি, সরকার আর লুণ্ঠনকারী ব্যবসায়ী-পুঁজিপতি মিশে একাকার হয়ে গেছে? নইলে পুঁজিপতিদের অনুকূলে ইনডেমনিটি দিয়ে কুইকরেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের আইন প্রনয়নের মতো আইন তৈরিসহ অন্যায় সব পদক্ষেপ নেওয়া হয় কেন জনগণের স্বার্থকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়ে? তবে কি রাষ্ট্রযন্ত্রও লুণ্ঠনের অংশ হয়ে পড়েছে? তবে এইমাত্র পাওয়া (৩রা ফেব্রুয়ারী রাতে) স্বস্তির কথা হলো, লুন্ঠনকারী ব্যবসায়ীদের সয়াবিনের আবারও মূল্যবৃদ্ধির মামুবাড়ীর আবদারটি বানিজ্যমন্ত্রী নাকচ করে দিয়েছেন। রোজার আগে সয়াবিনের দাম বাড়ানো হবেনা বলেছেন তিনি কিন্তু রোজার পরে কি ?
প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদনে দেখলুম, দেশে বিরাজমান এমন অবস্থাকে তারা বলেছেন - “ক্লিপটোক্র্যাসি বা তস্করের শাসনব্যবস্থা।“
সবটা মিলিয়ে এ যেন এক অত্যাচারের সিন্ডিকেটেড মহোৎসব৷
এই জাতক মহাবেকুব হলেও এই সত্যটুকু বোঝার মতো মাথার ঘিলু তার নিশ্চয়ই আছে!
আছে আপনাদেরও........................
সূত্র - দৈনিক বণিক বার্তা, দৈনিক প্রথম আলো, ডয়েচে ভেল, দৈনিক যুগান্তর।
ছবির কৃতজ্ঞতা অন্তর্জালের কাছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মার্চ, ২০২২ রাত ৯:৫৭