[ ...................বাজারে আসতে থাকলো নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক। চলতে থাকলো মানুষ আর ব্যাকটেরীয়ার মধ্যে অসম এক যুদ্ধ যে যুদ্ধ কখনও থেমে যাবার নয়, চলছে আজ অবধি। এবারে আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন হাযারো এন্টিবায়োটিক কেন বাজারে? ]
আগের পর্বগুলির লিংক -
“The world is running out of antibiotics...” এন্টিবায়োটিকের কথা।
The world is running out of antibiotics... Why? এন্টিবায়োটিকের কথা। প্রথম পর্ব
The world is running out of antibiotics... Why? এন্টিবায়োটিকের কথা। দ্বিতীয় পর্ব
আমাদের বিচারবিবেচনাহীন এবং অপর্যাপ্ত এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার ব্যাকটেরিয়াগুলোকে এন্টিবায়োটিকের কাজের ধরন সম্পর্কে বারেবারে দিনের পর দিন তথ্য যুগিয়ে চলছে। আর এন্টিবায়োটিকের প্রয়োগে সব ব্যাকটেরীয়া মারা গেলেও কোনক্রমে যদি একটি দু’টি ব্যাকটেরীয়া প্রান নিয়ে পালিয়ে আসতে পারে তবে তাদের জিনগুলো দেখে দেখে, শিখে শিখে রেসিষ্ট্যান্ট হয়ে যায় এবং জ্যামিতিক হারে বংশবিস্তার করে ফেলে। এবং বাস্তবে ঘটছে এটাই। এদের হাত থেকে বাঁচতে হলে মানুষকে নতুন নতুন এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করতেই হবে যা দুরূহ একটি কাজ এবং সময় সাপেক্ষ আবার গবেষণার জন্যে লাগে বিলিয়নস অব ডলার। টাকাপয়সার কথা বাদ দিলেও হয়তো বছরের পর বছর লেগে যেতে পারে কোনও নতুন একটি এন্টিবায়োটিকের মলিক্যিউল আবিষ্কারে। তাছাড়া মানুষ যে তা পারবেই এমন কোনও নিশ্চয়তাও নেই। দেখা গেলো, একযুগ ধরে চেষ্টা করেও মানুষ নতুন আর একটি এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার করতে পারলোনা। তখন কি হবে?
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তাই এন্টিবায়োটিক রেসিষ্ট্যান্সের ক্রমাগত সম্প্রসারণ ও ‘মাল্টিপল এন্টিবায়োটিক রেসিষ্ট্যান্স’ প্যাথোজেনিক ব্যাকটেরীয়ার আবির্ভাবের ঘটনাকে পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি মারাত্মক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যা ব্যাকটেরীয়া ঘটিত ইনফেকশানগুলোর চিকিৎসা ক্রমান্বয়েই জটিল করে তুলছে। দীর্ঘদিন থেকেই এর বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলছে সংস্থাটি। এই ব্যবস্থাগুলো হবে - কেবলমাত্র ব্যাকটেরীয়া ঘটিত ইনফেকশানগুলোতে সঠিক এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার, হাসপাতালগুলোর সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, ব্যাকটেরীয়াল সংক্রমনের প্রতিরোধ, এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিষ্ট্যান্সের তত্বাবধান কার্যাবলীর সম্প্রসারণ।
শুধু মানুষের বেলাতেই নয় পশুদের চিকিৎসার উপকরণ হিসেবে কিম্বা তাদের স্বাস্থ্যবৃদ্ধি ও সুরক্ষার বেলাতেও বিশেষ করে পশুখাদ্যে ঢালাওভাবে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার এই দূর্বিপাকে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। যদিও এর পরিমান এতোই অল্প যে ঔষধগুলি গবাদি পশুর সংক্রমনকে ঠেকাতে পারেনা অথচ প্রতিরোধী ব্যাকটেরীয়াগুলোকে আরো শক্তিশালী হিসেবে বংশবিস্তারের সুবিধা করে দেয়ার জন্যে ঐ পরিমানই যথেষ্ট। পোলট্রি শিল্পে এই অযৌক্তিক ও অত্যাধিক এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার রেসিষ্ট্যান্ট ‘ফুড পয়জনিং’ ব্যাকটেরিয়াগুলোর জন্ম দিচ্ছে।
এছাড়াও কৃষিপণ্যে এবং গাছে এন্টিবায়োটিক কীটনাশক স্প্রে করা হয় ব্যাকটেরীয়া ধংশের জন্যে। এই ফল ও শাকসব্জীতে লেগে থাকা এন্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ আমাদের পেটে গিয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রের ভালো ব্যাকটেরীয়াগুলোকে আক্রান্ত করছে আর অধিক শক্তিশালী, ক্ষতিকর প্রতিরোধী ব্যাকটেরীয়াগুলোকে সুযোগ করে দিচ্ছে।
ছবি -পোলট্রির মাংশ থেকেও ছড়ায় রেসিষ্ট্যান্ট ব্যাকটেরীয়ার দল।
এখন সবচেয়ে সঙ্গত একটি প্রশ্ন আপনি করতেই পারেন -তাহলে আমরা এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করবো কিসের উপরে ভিত্তি করে?
এন্টিবায়োটিকের অঢেল ও অযথা ব্যবহার রুখতে হলে উত্তরটি আপনার অবশ্যই জানা দরকার।
সংক্ষেপে উত্তরটি হবে অনুজীব চিহ্নিতকরণ এবং কোন ধরনের এন্টিমাইক্রোবিয়াল ড্রাগ সেই অনুজীবের উপরে কার্যকর তা নিরূপন। সাধারণভাবে একটি ছোট্ট ল্যাবরেটরী টেষ্ট দিয়ে এগুলো জানা সম্ভব। এটি হলো C/S বা Culture & Sensitivity Test. যে টেষ্টের মাধ্যমে আপনি জানতে পারবেন আপনার রোগটি কোনও অনুজীব দ্বারা সংগঠিত হয়েছে কিনা । পাশাপাশি জানতে পারবেন , রোগের কারনটি অনুজীব হলে তা কোন কোন এন্টিবায়োটিকের প্রতি সংবেদনশীল বা সেনসেটিভ এবং কোন কোন এন্টিবায়োটিক রেসিষ্ট্যান্ট বা প্রতিরোধী।
উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিলে সমগ্র ব্যাপারটি আপনার কাছে জলবৎ তরলং মনে হবে-
ধরা যাক আপনার প্রস্রাবে জ্বালা যন্ত্রনা হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে প্রস্রাব করতে। ধরে নিতে হয় আপনার মূত্রনালীতে সম্ভবত ইনফেকশান হয়েছে। আপনার ডাক্তার আপনাকে বলবেন, একটি ইউরিন টেষ্ট করিয়ে আনতে। তিনি আপনাকে Urine for C/S এ্যাডভাইস করবেন। আপনি আপনার প্রস্রাব বা মূত্র প্যাথলোজিক্যাল ল্যাবরেটরীতে দিয়ে এলেন। প্যাথলোজিষ্ট আপনাকে ৭২ ঘন্টা পরে এসে রিপোর্ট নিয়ে যেতে বলবেন। রিপোর্টটি হাতে পেলে দেখবেন, ফাইন্ডিংস’য়ে হয়তো লেখা আছে মোটামুটি এরকম কিছু -
Organism found -E.Coli.
Sensitivity- [ S= Sensitive (+). R= Resistant (-) ]
Penicillin -R. Ampicillin -R. Doxycycline - S++. Ciprofloxacin -R
Levofloxacin - R. Azythromycin - S+. Cefixime - R.
Cefpodoxime - S+. Ceftriaxone - R. Cefepime - S++.
এ থেকে নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে আপনার মূত্রনালীতে E.Coli. নামের ব্যাকটেরীয়ার সংক্রমন ঘটেছে। এবং এই ব্যাকটেরীয়াটি Doxycycline ও Cefepime এর প্রতি অতিমাত্রায় (++) সংবেদনশীল অর্থাৎ ঐ দু’টি এন্টিবায়োটিকের প্রয়োগে মারা পড়বে খুব দ্রুত। আর Azythromycin ও Cefpodoxime এর প্রতি অনুজীবটি সংবেদনশীল (+) । মারা পড়বে কিন্তু আগের দু’টোর মতো দ্রুত নয়। এর মানে, আপনার ঐ প্রস্রাব সংক্রান্ত রোগে Doxycycline ও Cefepime হলো সবচেয়ে কার্যকরী ঔষধ তার পরে Azythromycin ও Cefpodoxime.
এইগুলো থেকে একটাকে আপনার ডাক্তার আপনাকে খেতে বলবেন। কতো মাত্রায়, দিনে কয়বার করে এবং কতোদিন ধরে তা খাবেন তেমন পরামর্শ দেবেন।
বাকী সব এন্টিবায়োটিক রেসিষ্ট্যান্ট। ঐগুলো টনকে টন খাওয়ালেও আপনার ঐ মূত্রনালীর সংক্রমন ( Urinary Tract Infection) ভালো হবার নয় জিন্দেগীতেও।
ছবি - একটি কালচার মিডিয়াতে ই-কোলাই ব্যাকটেরীয়া
আর রিপোর্টে যদি লেখা থাকে - No Organism found তবে বুঝতে হবে আপনার রোগটির পেছনে কোনও অনুজীব বা ব্যাকটেরীয়ার হাত নেই মোটেও। এক্ষেত্রে কোনও এন্টিবায়োটিকই আপনার প্রয়োজন হবেনা। বেশী করে পানি খাওয়াই হবে আপনার রোগের মূল চিকিৎসা। নতুবা অন্য কারন খোঁজার জন্যে অন্য ধরনের প্যাথলোজিক্যাল পরীক্ষায় যেতে হবে আপনাকে।
এন্টিবায়োটিক প্রয়োগের বেলায় একজন চিকিৎসককে অবশ্য-অবশ্যই এইভাবে এগুতে হয় এবং এটাই তাকে শেখানো হয়ে থাকে মেডিসিন বিদ্যায়। পাশাপাশি এটা তার প্রফেশনাল ইথিকস বা পেশাগত নৈতিকতাও।
অনেকে বাইরের দেশের কথা বলে থাকেন যেখানে প্রেসক্রিপশান ছাড়া এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা যায়না। পেশাগত নৈতিকতাকে সেখানে উঁচ্চে তুলে রাখা হয় বলেই তা সম্ভব। তাছাড়া এন্টিবায়োটিকের যে সব পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে তার কোনওটিতে ভুগলে রোগী ডাক্তারের বিরূদ্ধে মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণের মামলাও করে বসতে পারেন সে সব দেশে। সেক্ষেত্রে যদি প্রমানিত হয় যে, কোনও C/S ছাড়াই রোগীকে এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়েছে তবে ডাক্তার সাহেবের কম্ম সাবার। তাকে ক্ষতিপূরণ তো দিতেই হবে এবং ডাক্তারী লাইসেন্সও বাতিল হয়ে যেতে পারে। আর যদি তিনি C/S করেই সেই মতো ঔষধ দিয়ে থাকেন তবে তিনি বেকসুর খালাস কারন প্রতিটি এন্টিবায়োটিকের (সব ঔষধেরই) পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকেই। তা এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াতে যে সব রোগীরাই ভুগবেন এমন কোনও কথা নেই। হয়তো দেখা যাবে হাযারে ভুগছেন মাত্র একজন। উপরের উদাহরণে রোগীটির দূর্ভাগ্য যে তিনি সেই হাযারের একজন।
এমনটা কি আমাদের দেশে আদৌ সম্ভব?
মোটেও সম্ভব নয়, আমাদের আর্থ-সামাজিক এবং অশিক্ষা ও অজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে। উপরের আপনার উদাহরণটি দিয়েই বোঝাই --ঐ C/S পরীক্ষায় আপনার টাকা লাগবে ৪ থেকে ৫ শত। লাগবে কমপক্ষে ৭২ঘন্টা সময় অর্থাৎ তিন দিন। এখন টাকাপয়সা খরচ করে তিন তিনটি দিনের বেশী অপেক্ষা করে যদি আপনাকে ঔষধ নিতে হয় তবে ঐ তিন দিন প্রস্রাবের জ্বালা-যন্ত্রনা আপনি সইবেন ? আপনি তো চাইবেন তৎক্ষনাৎ প্রস্রাবের জ্বালা-যন্ত্রনা যেন দূর হয়ে যায়। আপনি যদি শিক্ষিত আর বুঝদার হন তবে হয়তো ঐসব পরীক্ষার ভেতর দিয়ে যাবেন, ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করবেন রিপোর্টের। কিন্তু দেশের আর্থিক দৈন্যতায় পড়ে থাকা অগনিত রোগীরা কি তেমনটা করবেন বা তেমন সামর্থ্য আর ধৈর্য্য কি তাদের সবার আছে? তারা তো চাইবেনই ডাক্তারসাহেব যেন তক্ষনি একটা “হাই-পাওয়ার” এর এন্টিবায়োটিক লিখে দেন যাতে প্রস্রাবের জ্বালা-যন্ত্রনা মূহুর্তে উধাও হয়। ডাক্তার সাহেবেরও তখন অনুমান ভিত্তিক কিছু একটা না লিখে উপায় থাকেনা। নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল কে মারতে চায়? ডাক্তার সাহেবেরাও ( আমাদের দেশে যার গলায় একটি ষ্টেথোস্কোপ ঝুলানো আছে, আমরা ধরেই নেই তিনিই ডাক্তার) চাইবেন না রোগী হাতছাড়া হবার ভয়ে!
সর্দিকাশি বা কিছু একটা হলেই এন্টিবায়োটিক না দিলে আমাদের দেশের সাধারন রোগীদের ধারনা, ডাক্তার সাহেব কোনও ডাক্তারই না। তারা চলে যাবেন ঔষধের দোকানে, সেখান থেকে ঔষধ বিক্রেতার পরামর্শে বা নিজের ইচ্ছেতে এক বা একাধিক এন্টিবায়োটিক কিনে নেবেন। এই তো আমাদের দেশের আনাচে-কানাচের চিত্র ?
এই চিত্র পাল্টবো আমরা কি করে ?
প্রেসক্রিপশান ছাড়া এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারে আমরা যতোই আইন করিনে কেন তা কি ফুলপ্রুফ হবে? যে দেশে আইনের প্রয়োগ নেই, নেই আইনের প্রতি সামান্য সম্মান প্রদর্শনের সদিচ্ছা সেখানে প্রেসক্রিপশান ছাড়া এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার কমানো যাবে কি?
উত্তরটি - কিছুতেই না ।
আর আইন হলেও আইনগুলোর মনিটরিং বা তদারকি করবে কে ? যত্রতত্র লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসী গজিয়ে ওঠার হাত থেকেই আমাদের যেখানে রেহাই নেই সেখানে এমন তদারকি কি করে সফল হবে?
দরকার, চিকিৎসক থেকে শুরু করে সবারই এন্টিবায়োটিকের ব্যবহারের খুটিনাটি জানার, তা থেকে এন্টিবায়োটিকের সঠিক প্রয়োগ ও সেবনের অভ্যেস তৈরী করা, অপ্রয়োজনে তা থেকে বিরত থাকা। এজন্যে সবার আগে চাই মানুষের সচেতনতা।
এই সচেতনতা জাগাতেই চেল্লাতে হচ্ছে বিশ্ব সংস্থাগুলোকে। এই এতোক্ষন ধরে চেল্লালুম আমিও…………………..
[ ছবির জন্যে ইন্টারনেটের কাছে কৃতজ্ঞ । ]
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০১৯ রাত ৮:৫১