ঠিক দুক্কুর বেলা ভুতে মারে ঢিল ..... গানটি নিশ্চয়ই শুনেছেন ?
দুপুর বেলা না হোক রাতের বেলাতে আপনাকে কি কখোনও ভুতে ঢিল ছুড়েছে বা কখনও কি আপনাকে ভুত বা শয়তানে আছর করেছে ? কিম্বা জ্বীন-পরীতে পেয়েছে কখনও ? পায়নি ..? গুড ! পাওয়ার অবশ্য কোনও কারনও নেই ।
আপনাকে না পেলেও হয়তো শুনেছেন, অমুক কে ভুতে ধরেছে । ওঝা-ফকির চলছে । কেউ ছুটছে পানি পড়া আনতে । কেউ বিশ্বাস করেন, কেউ করেন না ।
আসলে আপনার শরীরটি একটি সর্বন্নোত প্রানীর শরীর এবং সঙ্গত কারনেই তা বেশ জটিলতায় প্যাঁচানো । আর এর মধ্যে আপনার মগজটি হলো সবচেয়ে জটিল এবং দুর্বোধ্য । অথচ আপনি জেনে অবাক হবেন, এই মগজটি খুবই শান্তিপূর্ণ আর সার্বক্ষনিক ব্যস্ত । আমাদের মতো আকামে ব্যস্ত থাকার তার কোনও সুযোগ নেই । এর সকল ক্রিয়াকান্ডই সুক্ষ ভাবে ব্যালান্সড । তারপরেও এখানে মাঝে মাঝে ঝড় উঠতে পারে । এই ঝড় হতে পারে বাইরের পরিবেশগত কারনে অথবা শরীরের ভেতরের রাজনৈতিক কারনে । এই ঝড় বা গন্ডগোল হলেই আমরা বলি- ভুতে আছর করেছে, জ্বীন-পরীতে পেয়েছে । শরীর বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের অনেকেরই জানা নেই বলে এমন ভুতুড়ে কান্ডকারখানা কে অলৌকিক বলে বিশ্বাসও করে বসি ।
কিন্তু জেনে রাখুন, এই গন্ডগোলগুলি মোটেও ভুত, শয়তানের আছর অথবা অপদেবতাদের রোষ থেকে হয়না ।
এগুলো সবই আপনার মগজে ঘটতে থাকা জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়াকান্ডের উল্টোপাল্টা ফল । তাই আপনার মগজে কি ঘটছে আর কি করেই বা ঘটছে তা জেনে রাখা ভালো যাতে ভুত-শয়তান-জ্বীন-পরী আপনার ত্রি-সীমানায় ঘেসতে না পারে । আর ঘেসলেও যেনো বুঝতে পারেন , কি করতে হবে তখন।
তাহলে জম্পেশ করে বসুন, কেন ভুত-শয়তান-জ্বীন-পরী আপনাদের সবাইকেই তেতুল গাছের মগডালে ওঠায় না, গল্পে গল্পে তা শুনি…………..
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দূর্ভাগ্য হলো, এ পর্য্যন্ত মানুষের মস্তিষ্ক বা হিউম্যান ব্রেইন রয়ে গেল মানুষের কাছেই অচেনা আর অনেকটা অবহেলায় ।
ইতিহাসের সমস্ত কালটা জুড়েই এই মস্তিষ্ক মানুষের মানবতা এবং মানবিক গুনাবলী প্রকাশে সক্রিয় থেকেছে । আর এ কারনেই পাখা না থাকতেও মানুষ পাখীর মতো উড়ছে আকাশে, লেজ না থাকতেও মানুষ ডুব দিচ্ছে সাগরের গহীন তলে । মস্তিষ্কের কারনেই মানব ইতিহাসের দূর্যোগময় সময়গুলো কাটিয়ে মানুষ আশার আলো জ্বেলেছে । আর ধ্বংশকে রূপান্তর করেছে সৃষ্টিতে । শতাব্দীর পর শতাব্দী চলে গেছে বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষা (Scientific Exploration) আর ধারনার (Speculation) গবেষনায় তার পরেও মানুষের মস্তিষ্ক রয়ে গেছে এখোনও মানুষের নিজের কাছেই রহস্যময় । এমনকি এটি ফিজিওলজী ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের কাছেও রয়ে গেছে প্রায় অচেনা । কারন কি ?
কারনটি তাহলে খুলেই বলি –
আমাদের মাথার খুপড়িতে (Skull) যে মগজটুকু (Brain) আছে তার ওজন মাত্র ৩ পাউন্ড । অল্প জায়গা জুড়ে থাকা এই ব্রেইনটিতে আছে ১৬ বিলিয়ন স্নায়ুকোষ বা নিউরোন (Neuron)। কেবলমাত্র এই এতোগুলো কোষকে ( কোষ যে আপনার জীবনের একক তা নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে । ) নিয়ন্ত্রন করা খুব সহজ একটা কাজ নয় । তার উপর রয়েছে নিউরোগ্লিয়া (Neuroglia) বা সংক্ষেপে “গ্লিয়া” নামক আর এক ধরনের কোষ যারা সর্বক্ষন নিউরোনগুলোকে পরিচর্যা আর সংস্কার করে চলেছে । এদের সংখ্যা মাত্র ১৫০ বিলিয়ন । তার উপরে আছে এদের কানেকটিং ফাইবারগুলি (Connecting Fibres)। পুরো নার্ভাস সিষ্টেম বাদ দিয়ে কেবলমাত্র মস্তিষ্কের গঠনটাই এমোন জটিল । আর এই জটিলতার কারনেই একে বুঝে ওঠা আসলেই কষ্টকর ।
কতোখানি কষ্টকর, তার একটা তুলনা করলে মন্দ হয়না । সারা পৃথিবীর সকল টেলিফোন সেটের কথাই ধরুন । পৃথিবীতে এখোন প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন এর বেশী লোকের বাস । এই হিসেবে সারা বিশ্বের সকল টেলিফোন সেট, তাদের সংযোগ লাইন এবং সারাদিনে এর মধ্যে দিয়ে যে শত শত কোটি টেরাবাইট কথাবর্তা আদান প্রদান হচ্ছে তার বিশালতার কথা চিন্তা করুন, বুঝতে চেষ্টা করুন তার জটিলতা । আমরা যদি এই বিশালতা আর জটিলতাকে মাথায় রাখি তবে একজন মানুষের মস্তিষ্কের জটিলতার তুলনায় পার্থিব এই জটিলতা মোটেও তুলনার যোগ্য নয় । আপনার মগজের তুলনায় তা যেন সমুদ্র সৈকতের একটি বালুকনা মাত্র।
এই জটিলতার কথা জানার কি প্রয়োজন আপনার, এমোন প্রশ্ন উঠতেই পারে ।
এই যেমন আপনি, এই মূহুর্তে আমার এই লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন কিম্বা ভাবছেন “আজাইররা পোষ্ট” অথবা বিরক্ত বোধ করছেন এটা ভেবে যে কি কুক্ষনে আপনি এই ব্লগে ঢুকেছিলেন; ইত্যাকার যে প্রতিক্রিয়া আপনার ভেতরে ঘটে চলেছে তা আর কিছু নয়, আপনার মস্তিষ্কের জটিলতারই বা জৈব-রাসায়নিক ক্রিয়াকান্ডেরই ফল ।
আপনার কি এটা জানতে ইচ্ছে করেনা, কেনই বা আপনি রেগে যাচ্ছেন, কেনই বা আপনার ভেতরে একটুখানি ভালোবাসা দানা বাঁধছে ধীরে ধীরে ? কেনই বা আপনার মনখানা হঠাৎ হঠাৎ উদাস হয়ে যাচ্ছে ? কেনই বা ভাল্লাগছেনা কিছুই ? কেনই বা আপনি এরকমটি না হয়ে ওরকম ?
এগুলো জানতে হলে আপনাকে মগজের ভেতরে একটু ডুব দিতেই হবে । কারন জটিল বলে একে এড়িয়ে গেলে, জ্বীন-পরী বা শয়তানের আছর হয়েছে এমোন আজগুবী ধারনা থেকে কখনও মুক্ত হতে পারবেন না । আবার সবকিছুকেই মনস্তাত্বিক ধাঁধা (Psychological Puzzle) বলে ধরে নেয়াও ঠিক হবেনা । তাহলে মস্তিষ্কের পাহাড়-উপত্যকার মনোরম পরিবেশে একটু ঘুরে এলে দোষ কি ? ঘুরে আসা না বলে, ডুব দিয়ে আসা বললেই বোধহয় বেশী যুক্তিযুক্ত হবে ।
কারন মগজে ডুব দিতে গেলেই প্রথমে যে বাঁধাটা আসবে তা হলো ২০টি হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত মাথার খুলি বা Skull. এটি পেরিয়ে যখন আমরা মস্তিষ্কের উপরি ভাগে পৌছবো তখন সত্যিকার ভাবেই আমাদের লাগবে ডুবরীর পোষাক । কারন মস্তিষ্কের উপরিভাগে যে তিন স্তর বিশিষ্ট একটি আবরন Meninges রয়েছে তার মধ্যেই রয়েছে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুয়িড (CSF) যা আপনার মগজে পুষ্টির যোগান দেয় আর বাইরের আঘাত থেকে রক্ষা করে । এই ফ্লুয়িড বা তরলের ভেতর ডুব দিয়েই আপনি যেখানে পৌছে যাবেন সেটি হলো সেরিব্রাল হেমস্ফিয়ার (Cerebral Hemisphere)। এখানেই ভুত-প্রেত-পরীরা বাস করে । দেখতে পাবেন এটি বাম এবং ডান, দুটি ভাগে বিভক্ত । মজার ব্যাপার হলো, ডান হেমস্ফিয়ারটি আপনার শরীরের বামদিকের সকল কাজ আর বাম হেমস্ফিয়ারটি আপনার শরীরের ডানদিকের সকল কাজ নিয়ন্ত্রন করছে । এই যেমন আপনি এখন ডান হাতটি দিয়ে মাউসটিকে ঘোরাচ্ছেন, তা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে আপনার মগজের বাম সেরিব্রাল হেমস্ফিয়ারটি দিয়ে । এগুলো একটি ভৌতিক ছবিতে দেখা সাপের মতো আঁকাবাঁকা পাহাড়-উপত্যকায় ঘেরা এলাকা । এই পাহাড়ের মতো উঁচু উঁচু জায়গাগুলোকে বলা হয় Gyrus আর উপত্যকা বা নীচু জায়গাগুলোকে বলা হয় Sulcus ।
ছবি - ২ . আপনার মস্তিষ্ক দেখতে এমনই, ভৌতিক ছবিতে দেখা সাপের মতো আঁকাবাঁকা পাহাড়-উপত্যকায় ঘেরা একটি এলাকা যেন !
সব মিলিয়ে (সামনে-পেছনে-পাশে-উপরে) আপনার মগজটিকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে Frontal, Occipital, Temporal এবং Parietal Lobe বা অঞ্চল, এই হিসেবে ।
ছবি - ৩. মস্তিষ্কের অঞ্চলগুলো ।
এই এলাকাগুলিই ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আমাদের যাবতীয় কাজগুলি নিয়ন্ত্রন করে থাকে । যেমন Frontal Lobe আমাদের মাংশপেশীর কার্য্যক্রমকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে । Parietal Lobe আমাদের যাবতীয় অনুভুতিগুলোকে সংগ্রহ করে থাকে । দৃষ্টিকে শাসন করে থাকে Occipital Lobe আর Temporal Lobe আমাদের কথা বলাকে নিয়ন্ত্রন করে থাকে । এছাড়াও আরো শতশত রহস্যজনক কাজকর্ম যেমন সচেতনতা,রাগ-অনুরাগ, আবেগ, অনুভুতি, সৃজনশীলতা, মোহ-মায়া ইত্যাদিও নিয়ন্ত্রন করে থাকে এই এলাকাগুলিই ।
একটু পেছনে আর নীচে ডুব দিলেই আপনি গিয়ে পড়বেন সেরেব্লাম (Cerebellum) এলাকায় । এই এলাকাটি মস্তিষ্ক এমনকি আমাদের শরীরের ভারসাম্য রক্ষার কেন্দ্র । এই এলাকার নিয়ন্ত্রনের কারনেই আমরা সাধারনত “হেট-মুন্ড উর্দ্ধ-পদ” হয়ে থাকিনা । মাথা উঁচু করেই চলি । এখানেই আপনার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়াকে পরিমার্জিত (Refined) ও সমন্বিত (Co-ordinated) করা হয় । যখন আপনার চলাচলে একটি কাব্যিক ভাব এসে যায় তখন আপনার ঐ নড়নচড়নের ছন্দময় কবিতাটি এই এলাকাতেই লেখা হয় । ভালো একটা উদাহরন হলো র্যাম্পে মডেলদের ক্যাট-ওয়াক । যার Cerebellum যতো ছন্দময়তা সৃষ্টি করতে পারে র্যাম্পে সে ততো দৃষ্টি নন্দন তার চলাফেরায় ।
আরো নীচে নামলে আপনি পৌছে যাবেন Lower brain stem এলাকায় । এন্টার্কটিকার মতো মস্তিষ্কের সর্ব দক্ষিন (নিম্ন) এলাকাই এটি । এখানে আছে আবার দুটো আলাদা ষ্ট্রাকচার, একটি Pons অন্যটি Medulla. এরাই সেরিব্রাল হেমস্ফিয়ার কে স্পাইনাল কর্ড (Spinal cord) বা মেরুরজ্জুর সাথে সংযুক্ত করেছে । আপনি যদি সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রকে (Nervous System) বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে তুলনা করেন তবে আপনার মস্তিষ্কটি হলো একটি বিদ্যুত কেন্দ্র । যেমন ঘোড়াশাল বিদ্যুত কেন্দ্র । আর স্পাইনাল কর্ড হলো সেই বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে যে মোটামোটা কেবল (Cable) মাটির নীচ দিয়ে প্রতিটি শহরে শহরে চলে গেছে সেরকম । এই স্নায়ু কেবলগুলো চলে গেছে আপনার হাড়-মাংশের উপর নীচ দিয়ে আপনার শরীরের বিভিন্ন শহর এলাকায় মানে অঙ্গ-প্রতঙ্গে । বিদ্যুত সরবরাহ ব্যবস্থায় যেমন সাব-ষ্টেশন, ট্রান্সফর্মার ইত্যাদি থাকে তেমনি স্নায়ুতন্ত্রেও এই রকম ব্যাপার স্যাপার আছে । এই ধারনাটুকু মাথায় থাকলে স্নায়ুতন্ত্রকে বুঝতে আপনার সুবিধে হবে ।
ছবি - ৪. আপনার মস্তিষ্কের এলাকা ও সেই এলাকার কাজগুলোর ধারনা পাবেন এখানে ।
আপনার স্পাইনাল কর্ডটি যেখানে মস্তিষ্কের সাথে যুক্ত হয়েছে সে এলাকাটি হলো Medulla । এই এলাকাটি চীরজাগ্রত একটি দেশ । এখানে আপনি ঘুমপরীদের খুঁজে পাবেন না । কারন এই এলাকার জনগণ (মানে নিউরোন) ঘুমায় না কখোনও কারন এরাই আপনার জীবনের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় কেন্দ্র যেমন হার্ট-রেট নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র (Heart rate control centre), শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রন কেন্দ্র (Centre for Breathing) কব্জা করে রেখেছে । তাই এদের ঘুমানোর কোনও সুযোগ নেই ।এরা যদি ঘুমিয়ে পড়ে, জানবেন আপনি দুরযাত্রার “ওয়ান-ওয়ে টিকিট” কেটে ফেলেছেন । এই Medullaই স্পাইনাল কর্ডে এসে শেষ হয় । আপনার স্পাইনাল কর্ডটিই মস্তিষ্কের প্রধান কমিয়্যুনিকেশন কেবল যা আপনার মেরুদন্ডের হাড়ের ভিতর দিয়ে নীচে নেমে গেছে ।
ছবি - ৫ মেরুদন্ডের হাড়ের ভিতর দিয়ে নীচে নেমে যাওয়া স্পাইনাল কর্ড বা মেরুরজ্জু।
এই কর্ডের মাধ্যমেই আপনার শরীরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে মস্তিষ্কে চলে আসে যাবতীয় সংবাদ । সংবাদগুলো হতে পারে স্পর্শ, স্বাদ, ব্যথা, শীত কিম্বা গরমের অনুভুতি । নিউটনের তৃতীয় সূত্র – এ্যাকশান ইক্যুয়াল টু রিএ্যাকশানের মতো এই অনুভুতিগুলোর প্রতিক্রিয়াই আবার আপনার মস্তিষ্ক থেকে স্পাইনাল কর্ড বেয়ে প্রয়োজনীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌছে যাবে । সুতরাং স্পাইনাল কর্ডে দু’ধরনের তার (Cable) থাকতে হবে । আপনার গৃহকর্মে ব্যবহৃত প্রচলিত ইলেকট্রিক তারে যেমন দু’রঙের তার দেখতে পান তেমনটি । এর একটিকে আমরা বলি – Sensory fibre যা অনুভুতিগুলোকে মগজে নিয়ে আসে আর অন্যটি হলো Motor fibre যা মগজের নির্দেশকে পৌছে দেয় প্রান্তীয় অঞ্চল পর্য্যন্ত ।
এ পর্য্যন্ত আপনি মগজের ভৌগলিক (Geographical Areas) ও জনসংখ্যাগত (Neural Population) তথ্য সম্পর্কে জেনেছেন । এবারে আসুন এই Neural Population এর পলিটিক্যাল সিচ্যুয়েশানে । এতো শক্তিশালী হয়েও মগজের কিন্তু নিজস্ব কোনও প্রাকৃতিক সম্পদ (Natural Resources) নেই । মগজের জন্যে জ্বালানী হিসেবে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন এবং পুষ্টিকে ( প্রধানত গ্লুকোজ ) আনতে হয় বাইরে থেকে । তাই হার্ট, ফুসফুস, পাকস্থলীর উপর তাকে দখলীসত্ব কায়েম রাখতেই হয় । অর্থাৎ এ্গুলোর সাহায্য ছাড়া মগজ অচল । এই আভ্যন্তরীন চাহিদা মেটাতে মগজকে তাই নিয়ন্ত্রন রাখতে হয় শরীরের শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্যবস্তু হজম, রক্ত-সঞ্চালন ইত্যাদি জীব-দৈহিক কাজকর্মের উপরে । নিজের জন্যে আপনার মগজটি শরীরের রক্ত-সঞ্চালনের এক তৃতীয়াংশই বরাদ্দ দিয়ে রাখে, যদিও আপনার মগজটির ওজন আপনার শরীরের ওজনের ২% মাত্র । জাষ্ট লাইক আ ডিক্টেটর …..
ছবি - ৬. আপনার শরীরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ।
এইসব করতে গিয়ে আপনার মগজকে একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার ভেতর দিয়ে যেতে হয় । তাই আপনার সম্পূর্ণ স্নায়ুতন্ত্রটি একটি কেন্দ্রীয় (Central) এবং একটি প্রান্তিক (Peripheral) স্নায়ুতন্ত্র নিয়ে গঠিত । একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে যদি একে তুলনা করা যায় তবে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, যা Brain এবং Spinal cord নিয়ে গঠিত তা সংসদ, মন্ত্রী-পরিষদ, সচিবালয় ইত্যাদির মতোই উচ্চ প্রশাসনিক সংগঠন যারা কেন্দ্রীয় সরকারের মতোই কাজ করে থাকে । আপনার মগজটিকে যে Frontal, Occipital, Temporal এবং Parietal Lobe এই হিসেবে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে সেইসব এলাকাতেই আছে এক একটি মন্ত্রীর দফতর । আর মন্ত্রীর দফতরে যেমন আছে সেক্রেটারী, সেকশন অফিসার, অফিস কারনিক ইত্যাদিরা যারা একই দফতরের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত, তেমনি আপনার মগজের সেইসব এলাকাতেও আছে একই মন্ত্রনালয়ের আলাদা আলাদা কাজের জন্যে এক একটি করে টেবিল অর্থাৎ সক্রিয় এলাকা । যেমন এই লেখাটি পড়তে গিয়ে আপনাকে মাউসটিকে নাড়াতে হচ্ছে । খেয়াল করুন, আপনার হাতের কোন কোন আঙুল এই কাজে ব্যস্ত । জেনে রাখুন, আপনার প্রতিটি আঙুলের নড়াচড়া বা মুভমেন্টের জন্যে আলাদা আলাদা এলাকা বা “সেন্টার” রয়েছে । এখোন ধরা যাক, আপনার তর্জনীকে (ইনডেক্স ফিঙার) নাড়াতে পারছেন না । কি হয়েছে ? আপনার তর্জনীকে নাড়াতে যে সেন্টারটি দায়ী তাদের লোকজন (নিউরোনগুলি) হরতাল ডেকে বসেছে । অথবা সেখানে লোড-শেডিং হয়েছে যাতে কাজকর্ম সাময়িক ভাবে বন্ধ রয়েছে । আর যদি সেখানকার নিউরোনগুলিকে ক্রস-ফায়ারে ফেলে দেন (অর্থাৎ নিউরোনগুলি মরে যায়) তবে ইহজন্মে আপনি আর তর্জনী তুলে কাউকে শাসাতে পারবেন না । খুব সহজ ভাবে এটুকু মনে রাখুন । এবং ছবিতে দেখুন ।
হরতাল, লোড-শেডিং, ক্রস-ফায়ার ইত্যাদির পেছনে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু কারন আছে, তাইনা ? এইগুলি হলো প্রচলিত নিয়মের ব্যতিক্রম অর্থাৎ প্যাথোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার ।
তাহলে আসুন, মগজের লক্ষ লক্ষ কাজের পেছনে প্রচলিত নিয়মটি কি কিম্বা স্বাভাবিক কাজটি কি করে হচ্ছে জেনে নেয়া যাক –
আগেই জেনেছেন আপনার স্নায়ুতন্ত্রে Sensory fibre এবং Motor fibre নামের দুধরনের “তার” রয়েছে । এই তারগুলো আর কিছুই নয়, এক একটি নিউরোন বা স্নায়ুকোষ পরষ্পর জোড়া লেগে লেগে একটি তার/সুতো বা আঁশ (fibre) তৈরী করেছে । যেখানে একটি নিউরোন অপরটির সাথে সংযুক্ত হয়েছে সে স্থানটিকে বলা হয় “সিন্যাপস” (Synapse) বা নার্ভ জাংশান। নিউরোন বা স্নায়ুকোষ একটি আজব ধরনের কোষ । শরীরের অন্য সব কোষ থেকে এটি সম্পূর্ণ আলাদা কিসিমের । কিম্ভুতকিমাকার । এদের রয়েছে শাখা প্রশাখা । দেখতে ঠিক যেন আঙুল সহ আপনার হাতটি । এই স্নায়ু কোষের প্রশাখাগুলো যা আপনার আঙুলের মতোই ছড়ানো তাকে বলা হয় “ডেনড্রাইট” (Dendrite)। এগুলো স্নায়ুকোষের সংকেত রিসিভার । হাতের তালুর মতো অংশটি হোল মূল ‘সেল বডি” । আর আপনার হাতটির মতো স্নায়ুকোষের অংশটুকু কে আমরা বলি “এ্যাক্সন” (Axon)। এই এ্যাক্সনটি হলো সেন্ডার যা পরবর্তী কোষে সংকেতটিকে প্রেরন করে থাকে । এই Axon গুলিই পরস্পর মিলেমিশে তৈরী করেছে সংকেত আদান প্রদানের Communication Systemটির যাকে আমরা মস্তিষ্কের White Matter বলি । আপনি অনেক সময় বুদ্ধিসুদ্ধিহীন কাউকে বলে থাকেন, “তোর মাথায় গোবর ভরা, মাল নাই ” । আসলে আপনি না জেনেই তার মগজে যে White Matter এর ঘাটতি আছে তাকেই বোঝান । প্রায় ৩০০ মিলিয়ন এ্যাক্সন মিলেমিশে কর্পাস ক্যালোসাম (Corpus callosum)নামের এই সাদা অঞ্চলটি গঠন করে মস্তিষ্কের ডান ও বাম অঞ্চল দুটোকে সংযুক্ত করেছে । গুচ্ছ গুচ্ছ White Matter মিলেমিশে আবার তৈরী করেছে এক একটি Nerve Tracts এর । এই Tractsগুলি আপনার মস্তিষ্কের সকল অঞ্চলগুলির পরস্পরের মধ্যে সংবাদ আদান প্রদানের একটি জটিল নেটওয়ার্ক তৈরী করেছে যেমনটি আপনি দেখে থাকেন আমাদের প্রচলিত টেলিফোন সিস্টেমে ।
ছবি - ৯. নিউরোনের নেটওয়র্ক ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন এই নেটওয়ার্ক আপনার মস্তিষ্কে জন্ম থেকেই “ফিক্সড” নয় । আপনার প্রতিদিনকার নতুন নতুন অভিজ্ঞতার আলোকে আপনার আগে থেকেই থাকা নেটওয়ার্কে নতুন নতুন সংযোগ তৈরী হয়ে যাচ্ছে । ঠিক যেন নতুন নতুন সার্কিট ।
এই সংকেত আদতে একটি জৈব-রাসায়নিক সংকেত অর্থাৎ বায়োকেমিক্যাল মেসেজ ।
বিভিন্ন Synapse এলাকাতেই যে বায়োকেমিক্যাল ক্রিয়াকান্ড ঘটে থাকে তা-ই আপনার জীবনের ছন্দ । এই বায়োকেমিক্যাল ক্রিয়াকান্ডের ফলাফলের নামই Life বা জীবন ।
কখোনও কখোনও এমোনটা হয়, আমরা জীবনের হিসাব মেলাতে বসি ।
অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে থাকেন “জীবনের খাতায় সব শূন্যই জমা হলো যোগ হয়নি কিছুই ” । আপনি যদি এরকমটা বলে থাকেন তবে আপনি Life বা জীবনের গূঢ় তত্ত্বটিই জেনে বা না বুঝেই বলে ফেলেছেন । কারন জীবনের সব বায়োকেমিক্যাল ক্রিয়াকান্ড আর কিছুই নয়, যোগ-বিয়োগের খেলা । সাদামাটা কথায় আমরা যাকে বলি “প্লাস” আর “মাইনাস” । কিন্তু একজন বায়োকেমিষ্ট এগুলোকে বলবেন, “পজেটিভ আয়ন” আর “নেগেটিভ আয়ন” । আয়ন হলো বৈদ্যুতিক আবেশ যুক্ত একটি কনা । আপনি কেমেষ্ট্রির ছাত্র হলে বুঝেই ফেলেছেন এই “পজেটিভ আয়ন” আর “নেগেটিভ আয়ন” আর কিছুই নয়, আপনার দেহ কোষ গঠনের উপাদানগুলো যেমন সোডিয়াম, ক্যালশিয়াম, ক্লোরিন, বাই-কার্বোনেট, পটাশিয়াম ইত্যাদি আয়ন । আপনার দেহকোষ তথা এই নিউরোনগুলির ভেতরে বাইরে এদেরই আদান প্রদান চলে । যোগ বিয়োগের খেলা ।
আপনি একটি ব্যাটারীতে দেখবেন একপ্রান্তে “+” অন্যপ্রান্তে “-” এইরকম চিহ্ন দেয়া আছে । আপনি এটা জানেন যে, এই ব্যাটারীর যোগ বিয়োগের কারনেই ব্যাটারী থেকে বিদ্যুত উৎপন্ন হয় আর গাড়ী চলে । আপনার জীবনটাও একটি গাড়ী বা যন্ত্র । একে চালাতে হয় । আর্ চালাতে গেলে ব্যাটারী ( শক্তি) লাগে । আপনার দৈনন্দিন জীবনটাও অর্থাৎ সমস্ত কর্মকান্ডই এই যোগ বিয়োগের কল্যানেই চলতে থাকে । এই প্রক্রিয়াটিই হলো মূল । জীববিজ্ঞানীরা বলেন “এ্যাকশান পটেনশিয়াল” ।
আপনার দেহের যে কোনও Synapse এলাকাতেই যে বায়োকেমিক্যাল ক্রিয়াকান্ড ঘটে থাকে তার শুরুটাই “এ্যাকশান পটেনশিয়াল” দিয়ে । একটি লাইট জ্বালাতে গেলে যেমন আপনাকে সুইচ টিপতে হয় এই “এ্যাকশান পটেনশিয়াল” হলো তেমন একটি সুইচ । এই এ্যাকশান পটেনশিয়াল শুরু হলেই আপনার Synapse (দুটি নিউরোনের সংযোগ) এর প্রথম নিউরোনটির ডগা (নার্ভ এন্ডিং) থেকে একধরনের রাসায়নিক রস (Chemical substance) নিঃসৃত হবে । যাকে আমরা বলি “নিউরোট্রান্সমিটার” (Neurotransmitter)। প্রথম নিউরোনটির ডগা (নার্ভ এন্ডিং) থেকে যে নিউরোট্রান্সমিটারটি নিঃসৃত হবে সেটি Synapse গঠনকারী দ্বিতীয় নিউরোনে প্রবেশ করবে । এটি হলো একটি অনুভুতির বা Impulse এর যাত্রা শুরুর পদ্বতি যা একইভাবে তৃতীয় সেখান থেকে চতুর্থ এইভাবে একটি নার্ভ ফাইবারের পরবর্তী সবগুলি নিউরোন বেয়ে আপনার মস্তিষ্কের যেখানে যেখানে যাবার সেখানে হাজির হবে । আর আপনি একটি অনুভুতি পেয়ে যাবেন । আপনার শরীরে এই রকম অনেক নিউরোট্রান্সমিটার রয়েছে যাদের কাজ আবার ভিন্ন ভিন্ন । এক এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার আপনাকে এক এক ধরনের অনুভুতি বা Information দেবে আর তার বিপরীতে আপনার দেহযন্ত্র এক এক নির্দিষ্ট ধরনের সাড়া দেবে ।
ছবি - ১০. খালি চোখে দেখা যায়না এমন একটি সিন্যাপস এলাকায় জীবনের সব জটিল রসায়ন ঘটে চলেছে আপনার অজান্তেই !
মনে করা যাক, আপনি একটি বিছুটি পাতা ছুঁয়ে ফেলেছেন । আপনার স্পর্শ এলাকার নার্ভ এন্ডিং থেকে “হিস্টামিন” নামের একটি নিউরোট্রান্সমিটার নিঃসৃত বা Release হবে । এই নিঃসৃত নিউরোট্রান্সমিটারটি পরবর্তী নিউরোনের রেসেপ্টরের সাথে সংযুক্ত হবে । অর্থাৎ সংকেতটি বা Information টি গ্রহন করা হলো এবং তা এভাবেই আপনার মস্তিষ্কে পৌছে যাবে আর এই “হিস্টামিন” নিঃসরনের ফলে আপনি চুলকানীর অনুভুতি পাবেন । তখন আপনার বিছুটি পাতা ছোঁয়ার স্থানে আপনি চুলকোতে থাকবেন । আপনার শরীরে যদি হিষ্টামিনের ঘাটতি হয় তবে আপনার চুলকানী খুব কম হবে বা একবারেই হবেনা । এন্টি-হিস্টামিন জাতীয় ঔষধ খেয়ে আপনি এই কাজটিই করে থাকেন । আবার ধরুন, আপনার আঙুল আপনার প্রেমিক বা প্রেমিকাকে স্পর্শ করেছে । এবারে কিন্তু হিস্টামিন নয়, আপনার নার্ভ এন্ডিং থেকে বেরুবে “এ্যাড্রেনালিন”। আপনার শরীরে এই স্পর্শের কারনে যা যা ঘটবে তা এই “এ্যাড্রেনালিন” এর কাজ । আপনার হার্ট রেট বেড়ে যাবে, শরীরে উষ্ণতা ছড়াতে থাকবে ইত্যাদি ইত্যাদি । স্পোর্টসম্যানরা অনেক স্পোর্টস মেডিসিনের ভেতরে এই “এ্যাড্রেনালিন” ও নিয়ে থাকেন “ডোপ’ (Dope) হিসেবে যাতে তাদের রক্ত চলাচল বেড়ে গিয়ে অতিরিক্ত শক্তির যোগান দেয় ।
এখন কথা হলো আপনার শরীর বুঝবে কি করে এটা বিছুটি পাতা নাকি প্রিয়ার ঠোট !
এর জন্যে আপনার শরীরের সর্বত্র আছে বিভিন্ন রকমের রেসেপ্টর । যাদের কাজ হলো পরিবেশ থেকে অনুভূতি গ্রহন করা । এরকমের রেসেপ্টরগুলো হলো - মেকানোরেসেপ্টরস (Mechanoreceptors ) যাদের কাজ হলো স্পর্শ, চাপ, কম্পন ইত্যাদি যান্ত্রিক অনুভূতিতে সাড়া দেয়া ।
নসিসেপ্টরস (Nociceptors) গুলো আবার সাড়া দেয় গরম, ঠান্ডা, টিস্যু ড্যামেজ ইত্যাদি অনুভূতিগুলিতে ।
ফটোরেসেপ্টরসগুলো (Photoreceptors) আলোর ঝিলিকে নড়েচড়ে বসে । আপনার চোখের এই রেসেপ্টরগুলোর কারনেই আপনি আলোতে প্রতিক্রিয়া দেখান , বিশ্ব-জগতকে দেখতে পান ।
থার্মোরেসেপ্টরস (Thermoreceptors) আপনার শরীরের আভ্যন্তরীন ও পরিপার্শ্বের তাপমাত্রার তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে ।
আর পঞ্চ ইন্দ্রিয় তো আছেই যাদের ভেতরে ঠাসা আছে এরকমের ভিন্ন ভিন্ন রেসেপ্টর ।
আসলে পরিবেশ থেকে অনুভূতি গ্রহন আর তার সাপেক্ষে আপনার শরীরের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন ব্যাপারটির ব্যাখ্যা অনেক অনেক জটিল । “বিছুটি পাতা নাকি প্রিয়ার ঠোট” , এর ব্যাখ্যাটি খুব সহজ করে দিই -আপনার মেকানোরেসেপ্টরস আর ফটোরেসেপ্টরসগুলোর মিলিত কাজের ফল এগুলো । আপনার মগজ এদের পাঠানো তথ্য ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে তবেই আপনার অঙ্গ-প্রতঙ্গে প্রতিক্রিয়া জাগিয়ে তুলবে নিউরোট্রান্সমিটারের মাধ্যমে।
আর এভাবেই আপনার শরীর বিভিন্ন নিউরোট্রান্সমিটারের কারনে বিভিন্ন অনুভুতি লাভ করবে আর সাড়া দেবে । অর্থাৎ আপনার রাগ-অনুরাগ, মায়া-মমতা, ঘৃনা-ভালোবাসা, উদ্বেগ-উৎকন্ঠা ইত্যাদি কেবল এই নিউরোট্রান্সমিটারগুলির খেলা । অর্থাৎ নিউরোট্রান্সমিটারগুলিকে যদি আপনি স্নায়ুর শব্দ (Neural Words) হিসেবে ধরে নেন তবে নিউরোনগুলি বিভিন্ন ভাষাতে কথা বলে ।
বেঁচে থেকে ঠিকঠাক কাজ করতে হলে আপনার মস্তিষ্ককে অবশ্যই এই রকম জটিল একটি মিডিয়া-নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে যাতে করে যে কোনও অনুভুতি যেমন তাপ, চাপ, স্পর্শ, ব্যথা ইত্যাদির জন্যে আপনি সঠিক রেসপন্স করতে পারেন । এই নেটওয়ার্কের তারগুলি স্পাইনাল কর্ড থেকে ব্রেইন এবং ব্রেইন থেকে স্পাইনাল কর্ডের মধ্যে সংযোগ দিয়ে থাকে । আর মস্তিষ্কে এভাবেই Information এর পাহাড় জমা হতে থাকে । মজার ব্যাপার হলো, আপনার মস্তিষ্ক এইসব ইনফর্মেশানের অধিকাংশরই সরাসরি কোনও জবাব দেবার বা রেসপন্স করার প্রয়োজন বোধ করেনা । আপনার মাথা পরিবেশ থেকে পাওয়া সব ধরনের সংবেদনশীলতার ( ইম্পালস ) ৯৫% কে নিয়ে মাথা ঘামায় না । সব কিছু নিয়ে মাথা ঘামালে তার চলেও না । কারন, আপনার মাথা হলো শরীর রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকার । যেমন , জব্বারের গরু যদি আব্দুলের গাছ খেয়ে ফেলে তবে এর বিচার আচারের জন্যে কি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে যাবার দরকার আছে ? নেই । এই বিচার স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যই করে দিতে পারেন । আমাদের শরীরও ৯৫ ভাগ সংবেদন নিয়ে তেমনটা করে থাকে অর্থাৎ লোয়ার কোর্টের কাজটি করে থাকে। মস্তিষ্ক কেবল মাত্র সুপ্রিম কোর্টের কাজটি করবে যেখানে চুলচেরা বিশ্লেষনের প্রয়োজন হয় ।
উদাহরণ --- আপনি একটি জুতো পায়ে দিয়েছেন যা আপনাকে আরাম দিচ্ছে । এইরকম একটি Sensory Input এর জন্যে আপনার মগজটি মোটেও মাথা ঘামাবেনা । এটাকে সম্পূর্ণ ইগনোর করবে । আবার যদি দেখা যায় একটি পেরেক জুতোর নীচে ঢুকে আপনাকে ব্যথা দিচ্ছে তখনও কিন্তু আপনার মগজটি মাথা ঘামাবে না । এসব ব্যাপারে যা যা করার তা স্থানীয় সরকার অর্থাৎ স্পাইনাল কর্ডের নির্দেশে হবে । এর ফলে আপনি হয় জুতোটিকে খুলে ফেলার জন্যে যা যা করার তাই করবেন অথবা “ ওমমমমা...” বলে চেচিয়ে উঠবেন ।
এখন যদি এই ঘটনাটি রোকেয়া হলের সামনে ঘটে আর আপনার আশেপাশে মেয়েরা থাকে তবে আপনাকে অনেক কিছু ভাবতে হবে , অর্থাৎ চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে । এই সময়ই আপনার মগজটি মাথা ঘামাতে শুরু করবে । পরিবেশ , পরিস্থিতি বুঝে সে আপনাকে প্রয়োজনীয় নির্দেশটি দেবে -“ওই ব্যাটা ওমমমমা করে চিল্লিয়ে উঠিস না । দাঁতমুখ খিচে ব্যথাটা হজম করে যা !” এই রকম কিছু একটা আর কি !
এই Sensory Input এর জন্যে আপনার মগজটি Motor Output অর্থাৎ কার্যকরী নির্দেশ প্রদান করবে যথাযথ অঙ্গপ্রতঙ্গকে । স্পাইনাল কর্ড এর মধ্যে দিয়ে প্রান্তীয় এলাকা পর্য্যন্ত বিস্তৃত এই যে Sensory আর Motor Fibre এর নেটওয়ার্ক তাকে আমরা বলি Spinal Nerves । আপনার শরীরে এইরকম ৩১ জোড়া Spinal Nerves আছে । এরাই হলো আপনার শরীর-রাষ্ট্রযন্ত্রের স্থানীয় সরকার বা Local Government বা প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্র ।
সেন্সরি ফাইবার তো আপনার মগজে তথ্য (Information) পাঠিয়েই ক্ষান্ত । সংবাদ মিডিয়ার মতো কাজ করছে এরা । কিন্তু Intelligence Report পাঠানো তো তাদের কাজ নয় । তাই মানুষের তৈরী সরকার যেমন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের জন্যে তার নিজস্ব বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ বা অন্যান্য সংস্থার কাছে একটি ঘটনার পেছনের Intelligence Information চেয়ে থাকে তেমনি আপনার মগজেরও রয়েছে Intelligence Services যারা আপনার মগজকে তথ্যসমূহের ভেতরকার গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট পাঠিয়ে থাকে । এরা হলো “ক্রানিয়াল নার্ভস” (Cranial Nerves)যারা আপনার কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের অধীন । আপনার রয়েছে এরকম ১২ জোড়া Cranial Nerves যাদের কাজ হলো বিশেষ সংবাদ প্রদান । যেমন, Optic Nerve টি আপনার দৃষ্টিকে ধারন করবে; Olfectory Nerve কোনও কিছুর গন্ধকে ধারন করবে আবার Cochlear Nerve আপনার শ্রুত শব্দাবলীকে ধরে রাখবে । এদের পাঠানো তথ্যের বিচার বিশ্লেষনের উপর ভিত্তি করেই আপনার শরীর পরবর্তী পদক্ষেপটি নেবে ।
মনে করা যাক, একটি খাদ্যবস্তু হাতে নিলেন, আপনার চোখ বললো এটি তেতুল । এই তথ্যটি চলে গেল আপনার লালা গ্রন্থিতে । অমনি আপনার মুখে লালা ঝড়তে লাগলো । গন্ধ নিয়ে দেখলেন গন্ধটা কেমন কেমন । এই তথ্যটিও চলে গেল আপনার মগজ হয়ে লালা গ্রন্থিতে । আপনার লালা ঝড়া বন্ধ হয়েও যেতে পারে । এই সময় আপনার বন্ধুটি বললো , এটা মুখে দিস না- কারন এটা অনেক পুরোনো , নষ্ট হয়ে গেছে । আপনি তা শুনলেন । এখন কি করবেন ? আপনি এখোন যা করবেন তা কিন্তু করবেন প্রাপ্ত সব তথ্যের বিচার বিশ্লেষন করেই । অর্থাৎ আপনার কেন্দ্রীয় এবং প্রান্তিক স্নায়ুতন্ত্র এখানে এক যোগে কাজ করে যে সিদ্ধান্তে আসবে আপনার এ্যাকশানটি হবে তা-ই ।
ব্যক্তি আপনি এখানে আপনার স্নায়ুতন্ত্রের ক্রীড়ানক । আপনার স্নায়ুতন্ত্র ব্যক্তি-আপনাকে দিয়ে শুধু কাজগুলো করিয়ে নেবে ।
ছবি - ১১. ব্যক্তি আপনি শুধু আপনার স্নায়ুতন্ত্রের ক্রীড়ানক ।
এবারে আসুন আমরা জীবনের চমকপ্রদ অংশে প্রবেশ করি । আবেগপ্রবনতা আর অনুভুতি ছাড়া জীবনের কোনও রং নেই, এটা আমরা সকলেই জানি । কিন্তু জানিনা যে এগুলো হলো কতকগুলি জৈব রাসায়নিক ক্রিয়ার ফল । এগুলো হলো আপনার মগজের প্যাসনেট সার্কিট (Passionate Circuits) এর কাজ । এই সার্কিটের প্রধান অংশই হলো লিম্বিক সিস্টেম (Limbic System) যার কিছু অংশ Corpus callosum, Frontal এবং Temporal Lobe এ অবস্থান করে এবং অংশ বিশেষ Hypothalamus নামক এলাকায় প্রবেশ করে । এই সিষ্টেমের মধ্যে আরো আছে Cerebral Cortex এর অংশ বিশেষ এবং Amygdala নামের এলাকাগুলি । আপনার মগজের এই লিম্বিক সিষ্টেমের বিভিন্ন অংশকে উত্তেজিত করা গেলে আপনি ভয়ঙ্কর রেগে যেতে পারেন, ভয় পেতে পারেন, আক্রমনাত্মক আচরন করতে পারেন এবং যৌনতার সাথে সম্পৃক্ত অনুভুতিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে পারেন । আপনার এই মানসিক পরিবর্তনগুলো লিম্বিক সিষ্টেমের নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে মগজের হাইপোথ্যালামাসে পৌছুবে । আর এখান থেকেই আপনার শরীরের মহামূল্যবান ও অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গপ্রত্যঙ্গে যে সিগনাল যাবে তাতে ঐ অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নাটকীয় ঘটনাবলী ঘটতে থাকবে । মনে রাখতে হবে মানুষ এ পর্য্যন্ত এই কৌতুহলোদ্দীপক লিম্বিক সিষ্টেমের কনামাত্র জানতে পেরেছে । যেমন আপনি “স্বপ্ন” কেন দেখেন তার রহস্য এখনও মানুষ ভেদ করতে পারেনি । গবেষনা চলছে । চলবে !
ছবি - ১২. আপনি মানুষটি কেমন তা নির্ভর করবে এই লিম্বিক সিস্টেমের ( রঙিন অংশ ) আচরনের উপর ।
এই লিম্বিক সিষ্টেমের মধ্যেই আছে আপনার শিক্ষার এলাকা । Hippocampus হলো আপনার শিক্ষামন্ত্রনালয় । মগজের এই এলাকাটি আপনাকে শিখতে সাহায্য করবে । যেমন আপনি এই লেখাটি থেকে যদি কিছু শিখতে চান তবে এই এলাকাটিই আপনার মগজকে সাহায্য করবে কতোটুকু তথ্য আপনি আপনার মগজে জমা রাখবেন “মেমরী” হিসাবে তা ঠিক করতে । অর্থাৎ Hippocampus এলাকাটি যার যতো বেশী সক্রিয় তিনি ততো বেশী মেমরীতে রাখতে ও বেশী শিখতে পারবেন । এই লেখাটি পড়তে পড়তে আপনি এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনার Hippocampus কতোটুকু সক্রিয় ?
আপনার Amygdala এলাকাটি আপনার মগজের Cortical Area থেকে পাঠানো শ্রবন ও দৃষ্টির বিশদ তথ্য গ্রহন করবে আর তা থেকে আপনার রাগ-ক্রোধ বা ভীতি জন্ম নেবে । এবং এই এলাকাটিই আপনার মগজকে সাহায্য করবে ঐ পরিস্থিতিতে আপনার ব্যবহার ঠিক কি ধরনের হওয়া উচিৎ তা নির্ণয় করতে । অর্থাৎ আপনি যদি আপনার প্রেমিকাকে আসতে দেখেন তখন আপনার এই Amygdala এলাকাটিই আপনাকে পরিস্থিতি বুঝে নির্দেশ দেবে আপনি পালিয়ে যাবেন (যদি পকেটে পয়সা না থাকে ) নাকি তাকে নিয়ে চাইনিজ খেতে (যদি পকেট ভারী থাকে) যাবেন ।
আপনার মগজে যে উঁচু উঁচু পাহাড় আছে তাদের একটির নাম Cingulate gyrus (সিঙ্গুলেট জাইরাস /গাইরাস)যা তার অবস্থানগত কারনেই গুরুত্বপূর্ণ । এই অংশটি আপনার মগজের মূল অংশের (Cerebral Cortex) Sensory এবং Motor এলাকার সাথে লিম্বিক সিষ্টেমের যোগাযোগ ঘটিয়ে থাকে । এবং সম্ভবত এটিই মগজের উচ্চ Neural regions বা বিশেষ ভাবে সমৃদ্ধ স্নায়ুকোষ এলাকা ও মগজের সবচেয়ে মৌলিক অংশ আবেগ এলাকার (Passionate core) মধ্যে দালালীর (mediator) ভুমিকায় নেমে পড়ে । এই Cingulate gyrus এর কর্মক্ষমতার কারনেই কেউ আপনাকে আবেগপ্রবন, আবার এর কারনেই কেউ আপনাকে আবেগহীন বলে ভাবতে পারেন । এখানেই - "সখি ভালোবাসা কারে কয়" গল্পটি লেখা হয় ।
আর শেষমেশ আপনার Hypothalamus । মস্তিষ্কের এই এলাকাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ । আপনার সকল কাজের নিয়ন্ত্রন করবে এই এলাকাটিই, ঠিক প্রধানমন্ত্রীর কার্য্যালয়ের মতো । এই Hypothalamus নামের অংশটি লিম্বিক সিষ্টেমের সকল অংশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য পেয়ে থাকে আর সেই তথ্যের বিচার বিশ্লেষনের উপর ভিত্তি করেই আপনার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিশেষ করে ভাইটাল অর্গান সমুহকে যথাযথ কাজের নির্দেশ প্রদান করে । আপনার শরীরের অতি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন “হরমোন”ও এই এলাকা থেকেই নির্গত হয় । যেমন আগের উদাহরনটিতে আপনার প্রেমিকার কথা বলা হয়েছে তাকে দেখলেই আপনার Hypothalamus আপনার হার্টকে বলবে বেশী করে লাফাতে ।এই নির্দেশগুলো বা সংকেত যাবে নিউরোট্রান্সমিটার আর হরমোনের বেশ ধরে , ইলেক্ট্রিক্যাল এবং কেমিক্যাল সংকেত হিসেবে । খেয়াল করে দেখুন, প্রেমিক বা প্রেমিকাকে দেখতে পেলে কার না বুক লাফাতে থাকে ? এসবই কিন্তু জ্বীন-পরীতে পাওয়া নয়, আপনার নার্ভ এন্ডিং থেকে বিশেষ বিশেষ নিউরোট্রান্সমিটারের নিঃসরনজনিত ইলেক্ট্রিক্যাল ও তার কারনে হরমোন গ্রন্থি ( এন্ডোক্রাইন গ্লান্ড ) থেকে নিঃসৃত হরমোনের বায়োকেমিক্যাল রি-এ্যাকশান যা আগেই আপনি জেনেছেন ।
আসলে আপনার মগজটি একটি জটিল অধ্যায় আর এতে যে নিউরোন জগৎ রয়েছে তা খুবই শান্তিপূর্ণ এবং সার্বক্ষনিক ব্যস্ত । আর এগুলো খুব সুক্ষভাবে ব্যালান্সড । তারপরেও এখানে মাঝে মাঝে ঝড় উঠতে পারে । এই ঝড় হতে পারে বাইরের পরিবেশগত কারনে অথবা ভিতরের রাজনৈতিক কোন্দলের কারনে । আর এই কারনেই সাইকিয়াট্রিক সমস্যাগুলোর জন্ম । এই সমস্যাগুলো ঘটে থাকে মূলত নিউরোনগুলির কমিয়্যুনিকেটিং সার্কিটের গন্ডগোলের কারনে । সার্কিটের গন্ডোগোল আপনার আচার আচরনে অস্বাভাবিকতা এনে দেবে যার কারনে লোকে বলবে আপনাকে শয়তানে আছর করেছে, জ্বীনে-ভুতে ধরেছে । আপনি তো জানলেন , এ অস্বাভাবিকতা মোটেও ভুতের ভয়, শয়তানের আছর অথবা অপদেবতাদের রোষের ফল নয় । সবই আপনার মগজের এবং স্নায়ুতন্ত্রের জৈব রাসায়নিক ক্রিয়া । বিজ্ঞান এগুলোকে জানছে প্রতিদিন একটু একটু করে ।
এই সাইকোলজিক্যাল সমস্যা, নিওরোসিস বা সাইকিয়াট্রিক অসুস্থতা যাই বলুন না কেন এগুলো আর দশটা রোগ যেমন ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস এর মতোই একটি শারীরিক রোগ । আপনার আমার মতো ৪৮ শতাংশ লোকদের ভিতরেই জীবনে তা একবার না একবার জন্ম হতে পারে আর তা দেখা দিতে পারে বিভিন্ন ফর্মে । কিন্তু মানসিক রোগের এই লক্ষনগুলি যতোই বিরক্তিকর আর অস্বস্তির হোক না কেন তারা আসলেই কোনও না কোনও ভাবে আপনার চিন্তা অথবা কাজের গন্ডোগোলের ফল । আর যেহেতু আপনার সব কাজের পেছনেই রয়েছে নিউরোন, তাই মানসিক অসুস্থতা মানেই নিউরোনের অসুস্থতা (Neuropsychiatric illness)।
এই অসুস্থতার আসল কারন এখনও অজানা । যে ডিজিজ প্রসেস এদের পেছনে কাজ করছে তা এতোই সুক্ষ যে আপনি যদি একটি শক্তিশালী অনুবীক্ষন যন্ত্র দিয়ে তাকে দেখতেও চান, খুঁজে পাবেন না । তবে অনেক বিজ্ঞানীই মনে করছেন যে, মানসিক এই রোগগুলি আপনার মগজের বিশেষ বিশেষ অংশে নিউরোট্রান্সমিটারগুলির পরিবর্তিত কর্মের (Altered Activity) ফল । সোজা কথায় - আকামের ফল ।
মানসিক অসুস্থতার, অস্বাভাবিক চিন্তার অথবা উল্টোপাল্টা কাজের লক্ষনগুলি আর কিছুই নয় আপনার মগজের নিউরোট্রান্সমিটারগুলির অস্বাভাবিক বা পরিবর্তিত কার্য্যকলাপ। তাহলে আপনাদের জানা উচিৎ মগজের নিউরোট্রান্সমিটারগুলির কার কি আসল কাজ । সবগুলি নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই তাই বেছে বেছে প্রধান কয়েকটি নিয়ে আমি আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই ।
প্রথমেই Serotonin (সেরোটোনিন)এর কথা দিয়ে শুরু করি । এটা হলো আপনার সুখের চাবি । এটা আপনাকে সবকিছু পজিটিভলি নিতে শেখাবে ।
ছবি - ১৩ সুখের চাবি দিয়ে সুখরাজ্যের তালা খোলা ...................
আপনার শরীরে ৫ থেকে ১০ মিলিগ্রাম Serotonin আছে যার ৯০% ই থাকে আপনার অন্ত্রে আর বাকী অংশ থাকে অনুচক্রিকা আর মগজে । এটি আপনার শিক্ষা (Learning), আপনার ঘুম (Sleep) এবং মানসিক ভাব (Mood)এর নিয়ন্ত্রক । আপনার মগজে বা শরীরে এর ঘাটতির বা উল্টোপাল্টা কাজের কারনে আপনাকে বিষন্নতা রোগে (Depression) পেয়ে বসবে । এমোনকি আপনি কখনও খানিক উত্তেজিত আবার পরক্ষনেই ম্রিয়মান হয়ে পরবেন । ঘন ঘন কোনও একটা কিছু করার বাতিক চেপে বসবে । আপনার এমোনটি হলে , আপনাকে ভুতে বা পরীতে পেয়েছে এটা ভেবে বসলে দোষ কার ? আবার এই Serotonin ঠিকঠাক থাকলেও, হতে পারে এটি সিন্যাপসে (Synapse)বেশীক্ষন স্থায়ী হচ্ছেনা । অর্থাৎ তার কাজের স্যিগনাল মগজে পাঠাতে পারছেনা ঠিকমতো সঠিক সময় ধরে। কি হবে ? আপনার বিনিদ্র রাত কাটবে বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে অথবা ঘুম আসছেনা বলে রাত দু’টোর সময়ে উঠে ঘরে পায়চারী শুরু করে দেবেন । আপনার মেজাজ-মর্জির কোনও ঠিক-ঠিকানা থাকবেনা । শেখার আগ্রহ কমে যাবে । কেউ বোঝাতে আসলেও আপনি বুঝতে চাইবেন না । এখোন লোকে যদি ভেবে বসে, আপনাকে শয়তানে আছর করেছে তবে তাদের খুব একটা দোষ দেয়া যাবে কি ?
এবারে Dopamine (ডোপামিন) এর কথা । মগজের একটি প্রধান নিউরোট্রান্সমিটার যা আপনাকে জীবনের সকল লক্ষ্যে পৌঁছুতে সাহায্য করবে ।
ছবি - ১৪ দু'য়ে দু'য়ে চার মিলে যায় এর কারনে ....
আপনার মগজের Frontal Lobe এলাকায় Dopamine এর উপস্থিতি অন্যএলাকা থেকে প্রাপ্ত তথ্যসমূহকে নিয়ন্ত্রন করবে । যার ফলে আপনার স্মৃতি, একাগ্রতা, সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা জাতীয় বুদ্ধিদীপ্ত কাজগুলি নিয়ন্ত্রিত হবে । আর যদি Dopamine এর ঘাটতি কিম্বা এদের কমিয়্যুনিকেটিং সার্কিটের গন্ডোগোল হয় তবে কি হবে ? আপনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হবে, একাগ্রতা হারিয়ে যাবে, বুদ্ধি যাবে ঘোলাটে হয়ে । সহজ অংক, দু’য়ে দু’য়ে যে চার হয় তাও আপনি সহজে বুঝে উঠতে পারবেন না । শিলা বৃষ্টিকে আপনার মনে হবে , ঢিল ছুঁড়ছে ভুতে ।
আপনার মগজের “Pleasure System” বা আনন্দ উৎপাদনকারী এলাকা সমূহ যা আপনাকে কোনও কিছুর আনন্দ উপভোগ করতে অনুভুতির যোগান দিচ্ছে, অথবা আপনাকে কোনও কিছু করার অনুপ্রেরনা যোগাচ্ছে তার পেছনেও রয়েছে এই Dopamine এর ভূমিকা । তাই Dopamine System এর ছন্দপতন হলে আপনার ফিলিংসগুলোর ও ছন্দপতন ঘটবে । আপনার ভেতর Psychosis বা মনোরোগ অথবা Schizophrenia বা আতঙ্করোগ জন্ম নেবে । আর এ জাতীয় রোগ হলে আপনাকে যে জ্বীন-ভুতে ধরেনি একথা কি সাধারন মানুষকে বোঝাতে পারবেন ? এটি আবার মগজের বিশেষ একটি এলাকায় (Basal Ganglia) কাজ করে আপনার নড়াচড়া বা মুভমেন্টকে নিয়ন্ত্রন করে । হয় Dopamine বা Dopamine Neurones এর স্বল্পতা আপনার নিয়ন্ত্রিত এবং সাবলীল চলাফেরাকে বিঘ্নিত করবে । হাত-পা কাঁপতে পারে এবং শেষমেষ আপনাকে Parkinson’s disease এ পেয়ে বসতে পারে । এর লক্ষন হলো থেকে থেকে শরীর ঝাঁকুনী দিয়ে ওঠা । লোকে ভাববে আপনার শরীরে অপদেবতাদের ভর হয়েছে ।
গামা এ্যামিনো বিউটারিক এসিড বা গাবা (GABA ) হলো প্রকৃতির ঘুম পাড়ানীয়া গান । কিছু কিছু সময় এমন হয় আপনাকে মানসিক ভাবে খানিকটা বিশ্রাম নিতেই হয় । প্রকৃতিই এটা ঠিক করে দেয় । ২৪ ঘন্টাই আপনি শুধু টেনশান আর টেনশানের ভেতর দিয়ে যেতে পারেন না কিছুতেই। গাবার ঘাটতি আপনার এই টেনশান সুইচটিকে “অন” করে রাখবে সারাক্ষন। কিছুতেই আপনি শান্ত হয়ে দু’দন্ড বসে থাকতে পারবেন না । যখন তখন উত্তেজিত হয়ে থাকবেন । আতঙ্ক পেয়ে বসবে । হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসতে চাইবে, বুকের ধরফড়ানি বেড়ে যাবে । আপনাকে অস্বাভাবিক লাগবে । ভুতে ধরেছে ?
এবারে Epinephrin বা Norepinephrin এর কথা । আমেরিকার বাইরে এদের যথাক্রমে Adrenaline এবং Noradrenaline নামে ডাকা হয় । আপনার শরীরের জরুরী অবস্থায় যেমন শীতে, অবসাদে, শক (Shock) এ এরাই আপনাকে সামাল দেয় ।
Noradrenaline আপনার মগজের সেই অংশকে নিয়ন্ত্রন করে যেখান থেকে আবেগময়তা (Impulsivity)সৃষ্টি হয় । তরুন পাঠক এদের উপস্থিতি হাড়েহাড়ে টের পান যদিও জানেননা না আসল কেমিষ্ট্রি কি ঘটছে তার শরীরে । তার প্রিয়লোকটির সান্নিধ্যে তার শারীরবৃত্তীয় যে অনুরণন উনি টের পান বা যে ঝংকার ওঠে তার শরীরে তা আর কিছু নয় এই Adrenaline এবং Noradrenaline এর দোলাচল । আপনি মানুন আর না-ই মানুন, আপনি স্বাভাবিক মানুষ হলে এই কেমেষ্ট্রির হাত থেকে আপনার রেহাই নেই । আপনার শরীরের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে " আই লভ য়্যু" সঙ্গীত বাজবে ।
আর এদের ঘাটতি বা কাজের অসংলগ্নতা (Imbalance) আপনার ভেতরে জন্ম দেবে কোনও কিছুতেই মনোসংযোগ করতে না পারার , অপরাধবোধের, নিজেকে অপদার্থ ভাবার, অবসাদের, অস্থিরতার, উৎসাহ হারিয়ে ফেলার, মৃত্যুভয়ের এমোনকি আত্মহত্যার চিন্তারও ।
তবে হ্যাঁ, আপনি এগুলোকে নিয়ন্ত্রন করতে পারবেন । আর এখানেই রয়েছে আপনার “কারিশমা” ।
আপনি কি জানেন, আপনার শরীর প্রকারান্তরে একটি “বায়োলজিক্যাল ওয়াচ” বা “Circadian watch” এটাকে আপনি যে ভাবে টিউন করবেন বা এ্যালার্ম দিয়ে রাখবেন আপনার শরীর স্বয়ংক্রিয় ভাবে ঠিক সেভাবেই কাজ করে যাবে । আপনার নিত্য নৈমত্তিক কাজগুলো আপনি একটি নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরেই করে থাকেন । যেমন খাওয়া , ঘুম ইত্যাদি । এতে আপনার মগজেও ঐ সব কাজের ধরন আর সময়ের একটি প্যাটার্ণ তৈরী হয়ে গেছে । আপনি চান বা না চান আপনার মগজ ঠিক ঠিক সময়ে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নির্দেশ পাঠিয়ে দেবে কাজটি করার জন্যে । এই কারনেই সকালে ব্রেকফাষ্টের সময়েই ( মনে করা যাক সকাল ৭ টা ) আপনার ক্ষুধা লাগে । তখন খাবার আসুক আর না-ই আসুক মগজের নির্দেশ মতো আপনার মুখ থেকে লালা নিসৃত হবে , পাকান্ত্র সংকোচন প্রসারন শুরু করে দেবে , পাকস্থলীতে এসিড ও অন্যান্য জারক রস নিসৃত হতে থাকবে । এটাকেই ক্ষুধা বা হাঙার পেইন বলে থাকি আমরা । খাবার গ্রহন এবং হজমের কাজটি সেরে নিদৃষ্ট সময় পরে (ধরুন এই সময়টা ১ থেকে ১.৫ ঘন্টা ) আপনার শরীরের সব নিউরোট্রান্সমিটার , হরমোন পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবে কারন তাদের ওয়ার্কিঙ আওয়ার বা ডিউটি শেষ । আপনি হয়তো খেয়াল করে থাকবেন , সকাল ৭টায় আপনি ব্রেকফাষ্ট না করলেও ৮ টার দিকেই আপনার ক্ষিধে মরে যাবে । কারন ৮টার পরে খাবার হজম করার লোকজন ডিউটি শেষে ঘুমাতে গেছে । এতে আপনার লালা নিঃসরণ বন্ধ হয়ে যাবে , পাকান্ত্র সংকোচন প্রসারন বন্ধ হবে , পাকস্থলীতে এসিড ও অন্যান্য জারক রস নিঃসরণ হবে না । এই জন্যেই আপনি আর ক্ষুধা অনুভব করবেন না ।
ছবি - ১৫ মাথায় ঢুকছে যতো নির্দেশ .....
এই যে রোজা গেল, আপনার খাদ্যাভাসের সময় উল্টেপাল্টে গেছে প্রথম ক’দিন । প্রথম প্রথম ক্ষুধার কষ্ট হয়েছে, পরে আর কষ্ট হয়নি । অর্থাৎ আপনার শরীরের নিউরোট্রান্সমিটারগুলিকে তথা আপনার মগজকে আপনি নির্দেশ দিয়েছেন (আপনার অজান্তেই ) সকালবেলা নো ব্রেকফাষ্ট, দুপুরে নো লাঞ্চ, সন্ধ্যায় ইফতার খাওয়া মানে ব্রেকফাষ্ট । আবার রাত তিনটেয় সেহরী অর্থাৎ ডিনার । অর্থাৎ আপনি আগের দৈনন্দিনের খাওয়ার রুটিন পাল্টে দিয়েছেন । প্রথম দুয়েক দিন আপনার মগজ বুঝে উঠতে পারবেনা ঠিক কখন কাজটি করতে হবে তাই প্রথম দুয়েক দিন আপনার সকালে বেলাতেই ক্ষুধা লাগবে । অবশ্য আপনার শরীর ক’দিন পরে এই নতুন সিডিউলেই অভ্যস্ত হয়ে পড়বে । য়্যু হ্যাভ রি-টিউনড ইয়োর বডি টাইমিং সিষ্টেম । খেয়াল করেছেন হয়তো, ঈদের দিন সকালে আপনার ক্ষিধে লাগেনি । আপনার শরীর রোজার মাসটিতে জেনেছে সকালে তার “Hunger Center”কে কাজ করতে হবেনা । তাই ঈদের দিন সকালে আপনার ক্ষিধে পায়নি । ঠিক ইফতারের সময়টাতেই ক্ষিধে পেয়েছে । ঈদের ক’দিন পরেই আবার তা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে কারন আপনি আবার মগজটিকে নির্দেশ দিয়েছেন- সকালে ব্রেকফাষ্ট, দুপুরে লাঞ্চ ইত্যাদি ইত্যাদি ।
তেমনি আপনার ভালোলাগা, মন্দলাগা, রাগ-অভিমান ইত্যাদিকেও আপনি নিয়ন্ত্রিত করতে পারেন যদি প্রাকটিস করতে পারেন নিয়মিত । মেডিটেশানের ধারনা সম্ভবত এখান থেকেই সৃষ্টি । আপনি নিজেই নিজের সব কাজের নিয়ন্তা । কারো সাহায্যের প্রয়োজন নেই এখানে ।
শুধু লাগবে আপনার সদিচ্ছা, একাগ্রতা আর নিজের প্রতি ভালোবাসা ।
ছবি - ইন্টারনেট এর সৌজন্যে
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০১৭ সকাল ১০:০২