নিলীমার বুকের অবারিত নীল উপত্যকায় জমে থাকা খন্ড খন্ড, ছেঁড়াখোড়া রঙিন মেঘের নিষন্ন দেয়াল আচমকা ভেঙে গেলে ওপারে চার ক্রোশ পথ জুড়ে দেখা গেলো তুমুল কালবৈশাখীর আয়োজন । বড় বেশী ঘোর এ আঁধারে নিলীমার বুকের প্রজাপতি সব গেলো উড়ে । উপত্যকার জানালাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেলে নৈঃশব্দের কিশোরীকুল উপত্যকার ঝরনার জলে নেমে গেলো বিপ্রতীপ ছন্দে। থেমে গেলো জল-উপলের সঙ্গম । ঝিঁঝিঁর ডানা ঝাঁপটানো সঙ্গীত, নেশাখোর বাতাসে হারিয়ে গেলে জোনাকিরা মাঝপথে খেলা সাঙ্গ করে ফিরে গেলো ঘরে । জলের নীচে নদীর পাড় ভাঙার মতো নিলীমার বুকের দুয়ারগুলি শব্দহীন ভেঙে গেলে, উঁকি দিয়ে দেখা গেলো উদোম একটুকরো উঠোন; ওধারে ভাঙা বেড়ার দহলিজ । চিরল পাতার মতো ঝিরঝিরে আলো আঁধারিতে নিলীমার ভেতর বাড়ী থেকে উঠে এলো নোনা গাঙের এক যোজনব্যাপী দীর্ঘশ্বাস ।
খুব চতুরতার সাথে নিয়ম করে সূর্য্যটাকে ডুবিয়ে দিয়ে ঘোলা চাঁদটাকে কেন যে ডেকে আনে নিলীমা !
প্রতিবার এমন নিদেন কালে গালে হাত রেখে নিলীমা একা একা কথা কয় - “ অভ্যেস......”
নিলীমার বুকের উপত্যকায় ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়-পর্বতে জোছনার চাঁদ চুমু খেতে চাইলে সে সব দিনে কালো কালো মেঘের ওড়নায় দিগন্ত ঢেকে দিত নিলীমা । তার বুকের জানালা খুলে চাঁদের মুখে মুখ রাখতে গেলে লজ্জায় নিলীমা কালো হয়ে যেতো । ঋতুস্রাবের মতো নিয়মিত বিরতিতে এমনই ম্রিয়মান হয়ে উঠতো নিলীমা ক্ষনে ক্ষনে । কাল-ভ্রমনে এ তার দীর্ঘ লালিত নিত্যকার অভ্যেস । বদলে যাওয়া ক্ষনে ক্ষনে । কখনও গোমড়া মুখে বসে থাকা , কখনও ঝরঝর কান্নার জলে দুকূল ভাসিয়ে উথলে ওঠা , কখনও নূপুরের কিঙ্কন ধ্বনিতে ফুলেদের ডাক দিয়ে প্রজাপতি হয়ে উড়ে যেতো সে । শীতের মঞ্জরীতে জড়সড় হয়ে কাঠকয়লার ওম খুঁজতো কখনও বা । আদরে সোহাগ কাছে টানলেই আলতো সরে সরে যেতো নিলীমা । তখন বুঝে ওঠা ভার হয়ে, পেরেকের মতো গেঁথে রইতো এ বুকে । এ এক নিঠুর দরদির প্রেম অপ্রেমের বৌ-ছি খেলা জীবন ভর । না পারলুম আমি তাকে চিনতে , না সে আমাকে ।
নিলীমার মনে থিতু করে রাখা যতো ঘর-গৃহস্থালী কই কই যে হারিয়ে যেতো এমনি করে ! নিলীমা মনের জানালার গ্রীলে হাত রেখে, গালটি ছুঁইয়ে তাদের আসা যাওয়া দেখতো । যেন জানতো, “ কী চমৎকার দেখা গেলো ” বাইস্কোপের মতো ঘুলঘুলির ওপারে একে একে সারি বেঁধে এক একটি দিনের ছবি ভেসে আসবে অনায়াসে । তার নিজস্ব ঘর-গৃহস্থালীর দরমার বেড়াতে লতিয়ে উঠবে পুঁইশাক , মাচানে ফুঁটবে সতেজ লাউ ।
দেখতে দেখতে বৈশাখের নিদাঘ খরতাপে পুড়বে সে তখন । সে তাপে পুড়ে যাওয়া বুকের সব ঘাস নেতিয়ে গেলে নিলীমার চোখ জলে ভাসবে । ঝরঝর বাদল দিনের মতো অঝোরে ঝরবে নিলীমা ।
ঐ পেতে রাখা চোখে এতো জল কোথায় রাখবে নিলীমা ! বেলা শেষে চোখের জল ফুরিয়ে গেলে মেঘমুক্ত আকাশের ছায়া ফুঁটবে তার চোখে । সে আকাশের দরিয়ায় ছেঁড়াখোড়া সফেদ মেঘের নাও যাবে ভেসে । নিলীমার বুকের চালচিত্র তাতে পাল্টে যাবে সব । সাজানো উপত্যকার ঢালে তখন সোনার বরন ঢেউ খেলে গেলেই অপেক্ষায় থাকবে সে কারো পথ চেয়ে । খুব নিষ্ঠার সাথে তার এই প্রতীক্ষায় সিদ্ধির বরাভয় হয়ে নিয়ম করে কেউ আসবে । আসবেই । শিউলি বকুলের ফুলছাপ কুয়াশার চাদরে গতরটি ঢেকে ............
নিলীমা জানে , এমন আকুলতা কার জন্যে তার !
নিলীমাকে শুধাই ।
এমনি করে নিলীমার শাড়ীর ভাজ খুলে খুলে দেখলে ভেতরের শুভ্র অর্ন্তবাসের মতো জীবনের সত্যটা বেরিয়ে আসে । ডাগর আঁখি তুলে , কোমল অধরে অস্ফুট শব্দ ঢেলে চিরায়ত কথাটি বলে যাবে সে ...বসন্ত ।
সন্দেহের তীরবিদ্ধ ক্ষরনেও নিলীমা অটুট, জানে ; সে আসবেই ।
সে আসবেই ....... এ হলো বিশ্বাস ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুন, ২০১৬ সকাল ১১:০৯