“মাগো, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফেরে .....” [ ছবি ও লেখা ব্লগ ]
[ দ্বিতীয় পর্ব ]
ছোট্ট এইটুকুন পৃথিবীর জানালায় যে রঙের আকাশ তার পাখা মেলে থাকে, তাকে ছাড়িয়ে অসীম নিশ্চুপ আকাশ আরও আরও রঙের ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে সততই জেগে আছে সেই অনাদি কাল থেকে । তাকে দেখে দেখে আপনার মনবীণায় বেজে উঠতে পারে এই ঝংকার .......
“ সীমার মাঝে, অসীম, তুমি বাজাও আপন সুর - ”
জ্বলে জ্বলে পুড়ে গেছে যে তারা
সে যে আজও হয়নি হারা ।
গোপন এক ক্রন্দন সে গেছে রেখে
রঙের অবগুন্ঠনে মেখে......
ছবি : ভেইল নেবুলা যেন হাওয়ায় ওড়া বাহারী ওড়না এক ........
হাবল স্পেস টেলিস্কোপে এমন রূপেই ধরা পড়েছে সে ।
আকাশকে রাঙিয়ে দেবে বলে কবে কোন কালে একটি তারা বিদীর্ণ করেছিলো তার বুক । সে বুকে লুকিয়ে থাকা আয়নিত গ্যাস ভালোবাসার উষ্ণতায় ফুলে ফেঁপে ছড়িয়েছে রঙ । প্রায় আট হাযার বছর আগে নাম না জানা এক সুপারনোভা থেকে উগরে দেয়া এই ভালোবাসার রঙ ১৪৭০ আলোকবর্ষের পথ পাড়ি দিয়ে উঁকি দিয়েছে আপনার খোলা জানালায় । এই যে আলোর মেলা, তার মুখটি আপনি দেখবেন খৃষ্টীয় দ্বিতীয় শতকে জ্যোর্তিবিদ টলেমী যে ৪৮টি কনষ্টিলেশন এর কথা বলে গিয়েছেন, তারই একটি “সিগনেস কনষ্টিলেশন” এ । নাম রেখেছি বনলতা...র মতো সুন্দর একটি নামও রাখা হয়েছে তার – “ ভেইল নেবুলা ” ।
ছবি : ভেইল নেবুলা....উড়িয়ে ওড়না লু হাওয়ায় ......
ছত্রিশটি চাঁদের আয়তন নিয়ে এক রঙিন দোপট্টার মতো হাওয়ায় উড়ছে যেন সে । আন্তঃনাক্ষত্রিক এই রকম ধুলোর মেঘমালাকেই মানুষ নাম দিয়েছে “নেবুলা” । আপনার রাতের আকাশে এরকম অসংখ্য ধুলোর মেঘমালা দেখতে পাবেন আপনি । এ সবই হলো বক্ষ ফাঁটা কোনও না কোনও তারার ক্রন্দন । কারো অপেক্ষায় থেকে থেকে একটি নক্ষত্র যখন পুড়ে পুড়ে শেষ হয়ে যায় তখন তার বুক বিদীর্ণ করে নিঃসীম আকাশে জমে ওঠে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম আর অন্য আয়নিত গ্যাসের ধুলো । এইসব ধুলোর মেঘের ছবি জাগাবে আপনার হৃদয়স্পন্দন । আকাশের এই ছবিটি দেখে আপনার নিশ্চয়ই মনে পড়বে নজরুলের এই গানখানি - ...উড়িয়ে ওড়না লু হাওয়ায় ......
আবার ছায়াপথ ছাড়িয়ে হাযার - লক্ষ আলোকবর্ষ দুরের গ্যালাক্সির ধুসর আলোকমালাকে ও নেবুলা নামে ডাকা হয় ।
আয় সবে সহচরী,
হাতে হাত ধরি ধরি
নাচিবি ঘিরি ঘিরি,
গাহিবি গান.......
ছবি : হলুদ তারাদের হাত ধরাধরি। এটাও একটি নেবুলা, নাম এনজিসি – ৩৬০৩ (NGC 3603.)
২০,০০০ আলোকবর্ষ দুর থেকে এই কমলা রঙের অত্যুজ্বল একগুচ্ছ তারার মেলা আপনার টেলিস্কোপিক চোখে ধরা দেবে ধুলোর মেঘ হয়ে । ছায়াপথের কুন্ডলীকৃত বাহুতে (spiral arm of the Milky Way ) কনস্টিলেশন “কারিনা” র বুকের মাঝে, দক্ষিন আকাশে গোধুলীর প্রথম লগ্নে খালি চোখে যে উজ্বল তারাটি আপনি দেখেন, তার নাম “ক্যানোপাস” । সন্ধ্যাকাশের দ্বিতীয় উজ্বল এই তারাটি এই নেবুলার অবস্থান চিনিয়ে দেবে আপনাকে । চিনিয়ে তো দেবেই , কারন তার নামটি যে এসেছে গ্রীক মিথোলোজীর হেলেন অব ট্রয় এর স্বামী স্পার্টার রাজা মেনেলাস এর জাহাজের নেভিগেটর ক্যানোপাস এর নামে ।
মূলে এই কারিনা কনষ্টিলেশনটি আরো বড় এক কনষ্টিলেশন “ আর্গো নেভীস” বা “ দ্য শীপ” থেকে ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটি অংশ যার ল্যাটিন নামটি হলো “কীল” (keel), মানে জাহাজের ভারসাম্য রক্ষাকারী তলদেশের অংশ বিশেষ ।
এনজিসি – ৩৬০৩ নেবুলাটি ঘিরে আছে উজ্বল গ্যাসীয় পদার্থ আর প্লাজমা । আন্তঃনাক্ষত্রিক বাতাসের ঝড় আর অতি বেগুনী রশ্মির বিকিরন মধ্যিখান থেকে এই গ্যাসীয় পদার্থ আর প্লাজমার নীলাভ ওড়নাটিকে হটিয়ে দিয়েছে বলেই কমলা রঙের অত্যুজ্বল একগুচ্ছ তারার মুখ আপনি দেখতে পাচ্ছেন । ছায়াপথে সবচেয়ে বেশী ঘনত্বের তারার জটলা এটাই আর তা পাকিয়েছে বিশাল বিশাল আকৃতির এই তারাগুলিই ।
রাতের আকাশে খালি চোখে কিছু উজ্জল তারাদের মিলিয়ে আপনি যে কল্পিত এক একটি আকৃতির কথা ভাবেন তা-ই “কনষ্টিলেশন” বা নক্ষত্রপুঞ্জ।
ছবি : সন্ধ্যাকাশের কনষ্টিলেশন “কারিনা” । উপর দিকের উজ্বল তারাটি এনজিসি – ৩৬০৩ নেবুলার ভেতরে থাকা তারা “ক্যানোপাস” ।
ছবি : কারিনায় অযুত তারার জন্ম..... রঙের আতশবাজি ।
খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে
হে বিরাট শিশু আনমনে
ভাঙিছো গড়িছো নিতি
আপন মনে .......
ছবি : জল রঙে কোন সে ধ্যানমগ্ন শিল্পীর আঁকা ছবি ! সোয়ান নেবুলার প্রান্তীয় একাংশ ।
আপনার জানলায় উঁকি দেয়া ৬০০০ আলোকবর্ষ দূরের “সোয়ান” (Swan) নেবুলা । সূর্য্যের চেয়ে যার উজ্বলতা কয়েক’শ হাযার গুন বেশী । আপনার বাড়ী সৌরজগতের ভরের চেয়ে ৮০০ গুন বেশী ভরের বাড়ী এটি আর তা ছড়িয়ে আছে ২০ আলোকবর্ষ নিয়ে । সূর্য্যের চেয়ে ২০/৩০ গুন বড় বড় ৩৫টি নক্ষত্রের আলোতে এই ধূলোর মেঘ কমলা রঙে সেজে উঠেছে । আশেপাশের আরো ৮০০টি নক্ষত্র এই মেঘমালায় ধরিয়ে দিচ্ছে ভাঙন (ইরোশন) । কালক্রমে একদিন হয়তো ভেঙে যাবে সব । তার বুকেই হয়তো গড়ে উঠবে আবার নতুন কোনও মেঘমালা ।
ছবি : স্যাজিটেরিয়াস কনষ্টিলেশনে “সোয়ান” (Swan) নেবুলা । শিল্পীর খেয়ালী তুলির আঁচড় ?
ভয়ঙ্করের দোদুল দোলায়
ফেনিয়ে ওঠা মেঘঘূর্ণি
আকাশ পানে ধায় যেন
আঁধার মহাকাল চূর্ণি ......
ছবি : আতঙ্কের রঙ ......ঈগল নেবুলা । ফেনিয়ে ওঠা মেঘঘূর্ণি ?
পরীর দেশের গল্পের মতো এক অতিকায় দানব যেন বেদীমূল থেকে ডানা ছড়িয়ে উড়ে যেতে চাইছে আকাশে , সবকিছু চূর্ণ করে ! রঙের এই ভয়ঙ্কর বাহারী দৃশ্যটি উঠে এসেছে তারাদের আঁতুরঘর (stellar nursery) ঈগল নেবুলা থেকে । ঠান্ডা গ্যাস আর ধুলোর সুউচ্চ এই স্তম্ভটি ৯.৫ আলোকবর্ষ , অন্য কথায় ৯০ ট্রিলিয়নস কিলোমিটার লম্বা ।
ছবি : মহাশূন্যে ঘাপটি মেরে থাকা ঈগল নেবুলা ।
ছবি : ইনফ্রারেড দৃশ্যে ঈগল নেবুলা ।
ঈগল নেবুলায় থাকা ঠান্ডা হাইড্রোজেনের মেঘ থেকেই জন্ম হয় এক একটি তারার । তাই এটা তারাদের একটা নার্সারী । সবে “হাটিহাটি পা পা” করা এইসব দেবশিশু তারাদের গায়ের বিচ্ছুরিত আলো এই গ্যাস আর ধুলোর জটলার গায়ে ঠিকরে পড়ে বলেই আকাশের গায়ে এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত আকৃতির দেখা মেলে আপনার ।
আতংক উদ্রেককারী এই রঙের খেলাটিও তেমনি আকাশের গায়ে ছায়া ফেলে আছে । ধুলোর মেঘ হলেও এটা হলো সদ্যপ্রসুত তারাদের বিশাল এক “ইনকিউবেটর” । ভৌতিক এই ছবিটির গা থেকে গ্যাসের যে আভা বেরুচ্ছে তা বহুদুরে থাকা তারাদের আলো আর পেছনের ধুলোমেঘের ক্যানভাসে “ সিল্যুএট” হয়ে আরো দানবীয় এক মেঘঘূর্ণি হয়ে উঠেছে যেন ।
মনে রেখ, আমিও ছিলাম
ছোট্ট জীবন আর
যতো হাসি গান
আমি তোমাকে দিলাম.....
ছবি : ঈগল নেবুলায় আতঙ্কের আর এক রঙ “পিলার অব ক্রিয়েশান” ।
ছবি : “পিলার অব ক্রিয়েশান” এর অতি সাম্প্রতিক ছবি । “পিলার অব ডেসট্রাকশান” ।
আপনার জানালা থেকে মাত্র ৬৫০০ আলোকবর্ষ দূরের আকাশের বুকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা
“সৃষ্টিস্তম্ভ” বা “পিলার অব ক্রিয়েশান” । আকাশের এই ছবিতে মুগ্ধ পৃথিবীর তাবৎ জ্যোতির্বেত্তারা । হয়তো আপনি ও । হাবল টেলিস্কোপের চোখে আন্তঃনাক্ষত্রিক ধুলো আর গ্যাসের এই অপরূপ স্তম্ভগুলো প্রথম ধরা পড়ে ১৯৯৫ সালে । ধুলো আর গ্যাসের মেঘের দেখা তো আকছার মিলছেই মহাকাশের বিশাল শূন্যতায়, তবে এই পিলার অব ক্রিয়েশানের রূপটি যে সবার দৃষ্টিকে টেনে রাখবে আর মনে করিয়ে দেবে সৃষ্টির রহস্যময়তাকে , তা অবান্তর কিছু কি ? আদতে এটাকে সৃষ্টিস্তম্ভ বলা হলেও অতি সম্প্রতি নাসা (NASA) র নতুন শক্তিশালী ক্যামেরার চোখ ইঙ্গিত দিয়েছে; এটা আসলে “সৃষ্টিস্তম্ভ” নয় । এটা হলো আসলে “ধ্বংসের স্তম্ভ” বা “pillars of destruction” । জমাট বাঁধা কালো কালো ছোপের মাঝে রঙের বিচ্ছুরন এই স্তম্ভের ধুলোমেঘের ভেতরে জন্ম নেয়া শিশু তারাদের তীব্র রেডিয়েশানের ফল আর সে মেঘ দ্রুত ভেঙেচুরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আশেপাশের বড় বড় মহারথি তারাদের গা থেকে উঠে আসা ঝড়ের দাপটে । ঘন ধূম্রপুঞ্জের চারপাশ ঘিরে থাকা ভয়াল নীলাভ রঙ আর কিছুই নয় , নবীন তারাদের তাপদাহে বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যাওয়া পদার্থের দল ।
আপনি সত্যিই ভাগ্যবান । এই “সৃষ্টিস্তম্ভ” তার যতো হাসি-গান আর রূপ-রঙ আপনাকেই দিয়ে গেছে । আজ থেকে মিলেনিয়াম বছর পরে আপনার মতো কেউ একজন আকাশের বুকে তাকিয়ে তাকে আর দেখতে পাবেননা । স্পিৎজার টেলিস্কোপের ছবি বিশ্লেষন বলছে , মিলেনিয়াম বছর আগেই একটি সুপারনোভা বিস্ফোরনে এটা হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো । যার আলো ৬৫০০ আলোকবর্ষ পথ পাড়ি দিয়ে ধরা পড়ে গেছে আপনারই চোখে আজ ।
এ কি সোনার আলোয়
ভুবন ভরিয়ে দিলে,
ওগো বন্ধু কাছে থেকো......
ছবি : হাবল টেলিস্কোপে ধরা পড়া ওরিয়ন নেবুলা ।
ছবি : ইনফ্রা-রেড দৃশ্যে ওরিয়ন নেবুলা ।
ছবি : ৮ইঞ্চি টেলিস্কোপে ৫ সেকেন্ডে এর কম সময়ে ধরা পড়া দৃশ্যে ওরিয়ন নেবুলা ।
হ্যা, আপনার খুবই কাছে থাকা সোনার আলো ছড়িয়ে এক বর্ণাঢ্য পড়শীর মুখ এটি , ওরিয়ন নেবুলার মুখ । মাত্র ১৫০০ আলোকবর্ষ দুরের তারাগর্ভা আপনার এই পড়শীটি, তারাদের জন্ম দিয়ে চলেছে অবিরত । “সূর্য্যের হাসি” মাতৃসদন এর মতো পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের এই “ তারাসদন”টিও যেন একগাল হাসি নিয়ে আপনার চোখে ধরা দিয়েছে । জন্ম দিচ্ছে হাযার হাযার তারা । রাতের আকাশে যে কালপুরুষের দেখা মেলে আপনার , সেই কালপুরুষের কোমরে (ওরিয়ন বেল্ট) ঝুলে থাকা তলোয়ারটির মাঝখানের উজ্জলতাটাই হলো ওরিয়ন নেবুলা ।
ছবি : কালপুরুষ বা ওরিয়ন কনষ্টিলেশন ।
ছবি : টেলিস্কোপের চোখে ওরিয়ন বেল্ট । আপনার ডান দিকের উপরের বর্ণিলতাটুকুই ওরিয়ন নেবুলা ।
চলবে ...........
প্রথম পর্ব ---
view this link
সূত্র : NASA / Wikipedia /
http://www.nasa.gov/vision/universe/solarsystem/stereo1_prt.htm
https://annoyzview.wordpress.com/
http://earthsky.org/
http://www.universeforfacts.com
http://www.skyimagelab.com/m16eanega.html
http://www.astromax.org/
http://www.spacetelescope.org/
http://apod.nasa.gov
http://www.constellation-guide.com
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মে, ২০১৫ রাত ৯:২০