[এটা আমার জন্মমাস তাই প্রাসঙ্গিক হবে ভেবে জীবনের এই কাহিনী কাব্য দেয়ার সাহসটুকু করলুম..]
কি দোষে আজীবন নতজানু প্রকৃতির কাছে
পড়ে আছি সময়ের ভেতর আরো গভীর সময়ে
কতোদিন ? আর কতোদিন এভাবে আমার
দুঃখের সাথে সহবাস আছে !
জানি, ঘূর্ণাবর্ত স্রোতে একবার পাক খেলে
শুধু নীচেই নেমে যেতে হয় -
নীচেই নেমে যেতে হয় যেমন শিকড়
কখনও তোলেনা মাথা রোদ ফসলা মাটির উপর
শুধু নীচেই নেমে যায়, যেমন
কখনও ঠেলে ঠেলে এগোনো যায় না উজান আর
একবার বানে ভেসে গেলে ফিরে আসা বড় কঠিন
একবার নুয়ে গেলে ঘাড় তোলা বড় কঠিন
একবার ঢিল ছুঁড়ে দিলে যেমন
ফেরানো যায়না তারে আর।
এ রকমই ভাগ্য আমার, জন্ম থেকেই কন্ঠলগ্ন
হয়ে আছে। সেই যেদিন থেকে আমার ঈশ্বর
ছুঁড়ে ফেলেছিলেন নীচের পৃথিবীতে একটা মানুষের ছেলে
একটা সীল ঠুকে দিয়েছিলেন কপালে
একটা লাইন লিখে দিয়েছিলেন -
দুর্ভাগ্য আছে তোর বরাতে।
সেই থেকে আমার হাতে
কি আছে না আছে দেখাইনি কখনও
কোনও গনকঠাকুর কিম্বা ‘হস্তরেখা বিশারদ’।
জানি, জলের ভেতর যেমন বাড়ে শ্যাওলা শ্বাপদ
গৃহস্থের মাচায় ডগমগে পুঁই শাক
যেমন বাড়ে ভরা চাঁদ শেষে কৃষ্ণপক্ষ রাত
তেমন আমার ভাগ্যেও হু হু করে অসুখ।
তবুও আমি তো একজন মানুষ ! দুই কান
দুই চোখ, দুই হাত, দুই পা একজন মানুষ
আপনারই মতো নিটোল একখানা হৃদয়
বুকে নিয়ে কি করেছি জানতে চান ?
আমার এক বন্ধু আছে, হোমিপ্যাথী করে
হাত গোনার কাজ অবসরে, ঠিক নির্ভূল লোকে বলে
এ লোকের কথা নাকি ফলে
পাথর-টাথর দেয়না, বলেনা কখোনও
নীলকান্ত পাথর কিম্বা গোমেধ এর আংটি
অমুক অমুক ধাতু সহকারে মধ্যমায় পড়ে নেবেন।
একদিন জমজমাট এক আড্ডায় হঠাৎ কি জানি
হাত বাড়ালুম কী এক খেয়ালে -
‘দ্যাখ তো, আমার হাতে কি বলে ?’
তারপর ?
তারপর, আপনারা শুনলে হাসবেন, কারন এরকম
শুনতে আমিও প্রস্তুত ছিলুম না।
কেইবা থাকে বলুন ? যখন আপনি জানেন
অতীত, বর্তমান আর আপনার ভবিষ্যত স্থির হয়ে আছে
আগেই একজন তার হিসাবের বিশাল খাতায়
পাই পাই টুকে রেখেছে হিসাব। ভালো কিম্বা মন্দ।
যার ভালো তার সবই ভালো কারন
এতোশতো মানুষের হিসাব রাখা কি চাট্টিখানে কাজ !
তাই খেড়ো খাতায়
যোগ বিয়োগ গুন ভাগের ঝামেলায়
না গিয়ে সরাসরি লিখে গেছেন বাৎসরিক ফলাফল
সাবেক হুকুম বহাল -
ভালোর ভালোই থাক্
মন্দের মন্দই যাক ।
কারন তারও তো সমযের অভাব,
একে তো এইসব রকমারী হিসাবের কাজ তার উপর
কে এলো কে গেল হিসাব রাখো তার।
পান থেকে চুন খসবে এমন উপায় নেই
তাহলেই -
এইসব বিপুল আয়োজন লন্ডভন্ড হবে
সুতরাং বলুন, তাকেই বা দোষ দিই কিভাবে ?
যাহোক্ যা বলছিলুম, তো সেই প্রথম হাত দেখা
কী সব হিজিবিজি নাম- শীরঃরেখা, চন্দ্রের ক্ষেত্র, ভাগ্যরেখা
এইসব ঘেটে ঘেটে অবশেষে হাসলো সে -
‘ তোর তো দেখি শণৈঃ শণৈঃ উন্নতি
বানিজ্য বসতে লক্ষীর মতি ’
আমি হাত টেনে নেয়া ছাড়া আর কি করতে পারতুম !
যদি জানতুম এরকম শুনতে হবে । আরও আছে -
আমার পিছনের দিন যা গেছে তা গেছে
সামনে বিপুল সম্ভাবনার দ্বার প্রায় খোলে খোলে
যদি যুৎসই একটা লাগাম তুলে
ছোটাতে পারি ভাগ্যের ঘোড়া ।
শনি কিছুটা তীর্যক হলেও ক্ষতি নেই, বেষ্পতি
তার বিপুল ক্ষেত্র নিয়ে পিছনেই আছে
আর একটা ‘তারকা চিহ্ন’ তাকে দিয়েছে পাকা ভিত
যেমন দূর্গের প্রাকার প্রকোষ্ঠে লম্বমান সৈনিক
জলপাই রং পোষাক আর অস্ত্র হাতে
দাঁড়ায় অমিত তেজে
সেই রকম আর কি।
‘তা কোনটা বা কী সেই লাগাম ?’
জিজ্ঞেস করতেই বললো - ‘চেষ্টা। চেষ্টা করতে হবে প্রানপন’।
আপনারাই বলুন এরপরে কি তাকে গাল না দিয়ে পারা যায় ?
তাহলে শুনুন, আমি তাকে গাল দিলুম
‘ আরে শালা বানচোত! কথায় ই তো আছে
বহু কষ্টে পাওয়া যায় কেষ্ট
এটা কি একটা নতুন কথা হলো ?
চেষ্টা ! সে তো সবার মতোই আমিও করেছি জন্মাবধি
তবুও ওসব আজেবাজে কথা কেনো বলো ?’
আমিতো সেই ভূমিষ্ঠ হবার দিন থেকেই
চেষ্টা করে যাচ্ছি বাঁচার।
প্রথমে চেচিয়ে কাঁদলুম এন্তার
হিসি হয়নি বলে আমার পাড়াতুঁতো এক খালা
বারংবার পিঠ চাপড়ে, সুড়সুড়ি দিয়ে
যতো না করালেন হিসি তারও চেয়ে বেশী
চেঁচাবার সুযোগ করে দিলেন আমায়।
মর জ্বালা; শুধু কি তাই ? একটা পা নাকি
কেমন যেন বাঁকা বাঁকা বোঝা যায় কি যায়না,
বড় হলে সেরে যাবে এমন কথাও
কারা যেন বললেন, ঠিক ঠাহর হয়না।
পা আমার সেরে গেছে অথচ ভাগ্যের পা শুধু
সেই বাঁকাচোরা ই থেকে গেছে আজতক্
কেবলই ঘুরছে বেপথু।
ল্যাংড়া না হলেও সেই গোড়া থেকেই
ল্যাং খেয়ে গেছি মনে হয় জন্মের ও আগে
মাতৃজঠরে একটা ক্ষনেকের স্খলনে
নিজের ঠাঁই এসে গিয়েছিলো যখোন,
তখোন আমাকে ঝেঁড়ে ফেলারও উপায় ছিলোনা,
কার্যতঃ ঐসব একটা রক্ষনের আবরন ছিলো ।
এড়াতে পারেননি সমাজের কঠিন চোখ
আমার ও বিধাতা পুরুষ,
নইলে কী সাধে আর এখোন ও করি
সেই সমাজের সাথে বসবাস!
মনে আছে আমার বাবা দশটা - পাঁচটা
আপিস করতেন। তার ছিলো নিরামিষ জীবন
মা হেঁসেলে ঠেলতেন দিনমান হাড়ি
হলুদ ছোঁপওয়ালা শাড়ী
গায়ে জড়িয়ে ওজুর পানি এগিয়ে দিতেন তাঁকে।
নামাজ পড়া শেষ হলেই সেই সন্ধ্যায়
সকাল কিম্বা দুপুরের বাসী একটু সালুন
আর মোটা একটি রুটি তাঁর সামনে
টিনের থালায় ধরতেন সেই নারী
যিনি দশ দশটা সন্তানের জননী এই বয়েসেই।
কতো আর বয়েস হবে ? এই ধরুন, টেনেটুনে পয়ত্রিশ ।
সেই বয়সেই তাঁর চুল গিয়েছিলো পেকে
কন্ঠার হাড় সব থেকে
বেশী চোখে বাজতো তার মলিন মুখ
জানিনা শেষ কবে ধরেছিলো হাসি।
সেইকালে, বয়েস এগারো কি দশ যখোন
পাড়ার ছেলেমেয়ে আর একগুচ্ছের ভাইবোন
সামনের বারান্দায় বিকেলের রোদ
গায়ে মেখে বউ বউ খেলতাম
আরো কতো কি, পৌষের হাট
যেমন মেলে তেমনি খেলার পাট
চলতোই চলতোই।
লেখাপড়া ? তাও করতাম যেমন খেয়াল খুশি ।
(ধুরছাই, কী হবে শুনে এর চেয়ে বেশী ,
আপনাদের সময়ের নিশ্চয়ই পড়েনি আকাল ?)
এই করে করে কেটেছে সকাল, কেটেছে বিকাল
দুরন্ত কৈশোর পিছে গেছে পড়ে
হঠাৎ একদিন অকুল পাথারে এসে দেখি মহাকাল
তার অজস্র বাহু মেলে, হাত ধরে
টেনে নিয়ে গেছে এক পড়ন্ত যৌবনে ।
হিসেবের খাতা, না যেন কী থাকে
লোকে খুলে খুলে দেখে !
আমিও তুললাম ছা-পোষা এক কেরানীর ড্রয়ার থেকে
তার হিসেবের খাতা, ধুসর মলিন পাতা এক অবেলায়,
দেখি শূন্যই আছে শুধু পড়ে, আর আছে একেবেঁকে
আঁকা কিছু মুখ, কিছু স্মৃতি আঁকা কালের মেলায় ।
এই বয়সেও তার নামটা মনে আছে
মনে থাকবা্রই কথা,
ছেলেবেলার বয়স আর একটু বেশী হ’লে তার সাথে
আমার একটা ব্যাপার ছিলো ।
মরালী গ্রীবা ছিলো তার, বেনী দুলানো চপল মন
খেলার সাথী অনেকের মতো একজন
ছিলো সে । মনে আছে, শরীরে তুলে ঢ়েউ
বাতাসে কম্পন, আমারি কানে কানে তার
কিঙ্কিনি স্বর বলতো -
“ তুই কোনদিনই পারলিনা জিততে খেলায়,
আসলে কপালেই জেতা নেই তোর ।”
আমি তখন না হাসতাম, না যেতাম রেগে
কেবল ছেড়ে দীর্ঘশ্বাস
নিজের মনেই নিজে বলতাম –
“হারি বলেই তো তোরা জিতে যাস,
হারি বলেই তো তোরা জিতে যাস
আমার যে বিধি বাম !”
তো সেই এক মেয়ে, নীলাঞ্জনা নাম ।
সে ও খসে গেল হলুদ পাতার মতোন
চৈতন্যের গোপন বৃক্ষ থেকে বহুদুর
আজন্ম নির্ভয় যাবতীয় বৈভব এর ভেতর ।
দরজার চৌকাঠে দাঁড়ানো তার শেষ কথা ছিলো এই -
“যাচ্ছি, একবার এসো মনে করে”
আমার আর মনে পড়েনি,
কী করেই বা পড়বে বলুন ?
আপনারা তো শুনলেন সব এতোক্ষন।
কী নিদারুন গেছে সেই সব দিন,
পায়ের চটি বহুবার গেছে ছিড়ে, মাথায় এলোমেলো চুল
নিয়ে পকেটে গড়ের মাঠ, জীবনের সব ভুল
জড়ো করে অফিসপাড়ায় হত্যা দিয়ে ছিলুম পড়ে ।
তাহলে আপনারাই বলুন,
সেই মেয়েকে আমি কী করে রাখতুম ধরে ?
ধরে যে আমি কিছুই রাখতে পারিনি,
শৈশবের খাতায় লেখা “জীবনের লক্ষ্য”
আর একটু বয়স হ’লে গোপন স্বপ্ন কিছু তার,
না পেরেছি রাখতে ধরে গরীবের যক্ষের ধন -
আশীর্বাদ পিতামাতার ।
আমি কিছুই ধরে রাখতে পারিনি,
অনন্ত সময়, সুবাতাস, পৌষের মেলা,
অরণ্যের দিনরাত্রি, পূর্নিমার চাঁদ, হরিদ্র সকাল,
ইছামতির ঢেউ, নীলাঞ্জনার শাড়ীর আঁচল ।
আগেই তো বলেছি,
এ রকমই ভাগ্য আমার, জন্ম থেকেই কন্ঠলগ্ন
হ’য়ে আছে ।
তবুও কূহকিনী আশা আছে -
আছে নিচ্ছিদ্র দুপুর, চৈত্রের খরতাপ,
সুতীব্র করতল উন্মুখ আছে চেয়ে
আসবে কবে সেই ময়ুরপঙ্খী নাও
অনাগত দিন বেয়ে !