একের পর এক নাটক
ওদিকে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের শীর্ষপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ আচমকা একযোগে আবিষ্কার করে বসলেন, পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বিশ্বব্যাংকের সরে যাওয়ার পেছনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দায়ী। নিউইয়র্কে গতকালও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'কোনো এক ব্যক্তির কারণে পদ্মা সেতুর ঋণ নিয়ে এত কিছু হয়েছে। একটি ব্যাংকের এমডি তাকে রাখতেই হবে—এমন শর্ত আমরা মানিনি। এর প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির কথা বলে ঋণ বাতিল করেছিল।' মেগাসিরিয়ালের ফাঁকে ফাঁকে যুক্ত হয়েছিল নানা স্বাদের কমেডিও। হুট করে বলা হল, বিশ্বব্যাংক-ট্যাংক লাগবে না, নিজেদের অর্থেই হবে পদ্মা সেতু। ঘোষণা শুনে ছাত্রলীগ-যুবলীগ পদ্মা সেতুর তহবিল জোগাড়ে রীতিমতো চাঁদাবাজিতে নেমে গেল। এর জের ধরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে খুনও হয়ে গেলেন এক ছাত্র। এক ফাঁকে আবার মুঠোফোন কলে ২৫ পয়সা সারচার্জের প্রস্তাব রাখা হল। মাঝখানে ধরে আনা হলো মালয়েশিয়াকেও। বিনোদনের ষোলকলা যেন কানায় কানায় পূর্ণ।
২৫ সেপ্টেম্বর : অবশেষে ওয়াশিংটন থেকে বিশ্বব্যাংকের নতুন 'বোমা'!
ঠিক আজ ২৫ সেপ্টেম্বরই বিশ্বব্যাংক একটি বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতি না বলে একে 'বোমা' বলাই ভালো! পুরো বিবৃতিটির বঙ্গানুবাদ এইরকম -
গণমাধ্যমে পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে ভ্রান্ত ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হয়েছে। বিষয়টি পরিষ্কার করতে আমরা নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করা জরুরি মনে করছি:
বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়নের ক্ষেত্রে উর্দ্ধতন সরকারী ব্যক্তিবর্গ ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ সরকারকে একাধিকবার প্রদান করেছে। কিন্তু সরকারের কাছ থেকে যথাযথ সাড়া না পাওয়ার কারণে বিশ্বব্যাংক ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করে।
গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে সরকার নিম্নোক্ত বিষয়গুলোতে সম্মত হয় যে:
● তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সন্দেহভাজন সকল সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যক্তিবর্গকে সরকারী দায়িত্ব পালন থেকে ছুটি প্রদান;
● এই অভিযোগ তদন্তের জন্য বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত ও আইনি দল গঠন;
● আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি এক্সটারনাল প্যানেলের কাছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সকল তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকার প্রদান যাতে এই প্যানেল তদন্তের ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উনড়বয়ন সহযোগীদের পরামর্শ দিতে পারে।
এরপর সরকার পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিষয়টি আবারো বিবেচনা করার জন্য বিশ্ব ব্যাংককে অনুরোধ জানায়।
বিশ্ব ব্যাংক সার্বিকভাবে বাংলাদেশের এবং বিশেষ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। এ কারণেই, আমরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়েছি যে, প্রকল্পে নতুন করে যুক্ত হওয়ার জন্য নতুন বাস্তবায়ন ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে যা বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী দাতাদের প্রকল্পের ক্রয় কর্মকান্ড আরো নিবিঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ দেবে।
শুধুমাত্র এই সকল পদক্ষেপসমূহের সন্তোষজনক বাস্তবায়ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের এক্সটারনাল প্যানেল থেকে ইতিবাচক প্রতিবেদন পাওয়ার ভিত্তিতে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পের অর্থায়নে অগ্রসর হবে। একটি দুর্নীতিমুক্ত সেতু পাওয়ার অধিকার বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে এগোনোর জন্য আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে অবাধ ও সুষ্ঠু তদন্ত চলছে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও পর্যবেক্ষণ জোরদার করা হয়েছে।
● বিশ্বব্যাংকের মূল বিবৃতি পাবেন এই লিংকে।
২৩ সেপ্টেম্বর : সচিবের মুখ দিয়ে সরকারি আষাঢ়ে গল্প
এদিন বিকেলে শেরেবাংলা নগরের এনইসির সম্মেলনকক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ইআরডির সচিব ইকবাল মাহমুদ জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে সহ-অর্থায়নকারীদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে সরকার। আগামী দুই-এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) ও জাপান উন্নয়ন সংস্থা জাইকার প্রতিনিধিরা ওয়াশিংটন, ম্যানিলা ও টোকিও থেকে ঢাকায় আসবেন। তারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত ও প্রকল্প বাস্তবায়নের কৌশল নির্ধারণ করবেন। এ সময় ইকবাল মাহমুদ আরও যা বলেন-
● প্রকল্পে ফিরে আসতে বিশ্বব্যাংক নতুন কোন শর্ত দেয়নি, সবই পুরোনো শর্ত।
● নতুন করে ঋণচুক্তি করতে হবে কি না, এমন প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে তিনি জানান, ‘এটি চলমান প্রকল্প। বিশ্বব্যাংক অর্থ দেবে এটা নিশ্চিত, এখন প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি ঠিক করা হবে।’
● ‘বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও জাইকার দুই রকম মিশন আসছে। একটি মিশন কাজ করবে দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়নের পদ্ধতি নির্ধারণে, আর অপর মিশনটি দুর্নীতি দমন কমিশনের সঙ্গে তদন্তকাজে থাকবে। এই দুটি কাজই একসঙ্গে চলবে। এসব প্রক্রিয়ায় সরকারই চালকের ভূমিকায় থাকবে। এসব কাজ করতে কত সময় লাগবে তা এই মুহূর্তে বলা কঠিন।’
● শুধু পদ্মা সেতু প্রকল্পে ১২০ কোটি ডলার অর্থায়নের পুনঃপ্রতিশ্রুতি ছাড়াও ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের বোর্ডসভায় ৫২ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণসহায়তা প্রদানের বিষয়টিও অনুমোদিত হয়েছে।
২০ সেপ্টেম্বর : সচিবালয় থেকে ওয়াশিংটন দূতাবাস সর্বত্রই মিথ্যাচার
প্রধানমন্ত্রীর অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানের ছুটি মঞ্জুর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেশ আস্থার সঙ্গে মিথ্যাচার শুরু করে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ওয়াশিংটনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা। ইআরডি থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হচ্ছিল, পদ্মাসেতুতে ১২০ কোটি (১.২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দিতে বিশ্বব্যাংক সম্মত হচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তেই আসতে পারে বিশ্বব্যাংকের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা। ওদিকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস তার চেয়েও দু কাঠি এগিয়ে। গণমাধ্যমকে তারা নিশ্চিত করেই জানাচ্ছিল, বিশ্বব্যাংক তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এরই মধ্যে সেকথা জানিয়ে দিয়েছে ঋণ প্রদানে সম্মত অপর দুই প্রতিষ্ঠান এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও জাইকাকে।
কেন এই মিথ্যাচার?
সরকার কী কারণে এতো মিথ্যাচারের আশ্রয় নেয়? তারা কি দেশের মানুষকে এতোটাই বোকা ভাবে? বিশ্বব্যাংকের পিলেচমকানো বিবৃতির পরও এই আজ সন্ধ্যায়ও অর্থমন্ত্রী শিবের গীত গাইছেন, 'বিবৃতির প্রভাব অর্থায়নে পড়বে না।' কে না জানে, এমনিতেই বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি দারুণ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের আজকের বিবৃতির মাধ্যমে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরেক দফা ক্ষুণ্ন হলো। এই জাতির মান-অপমান বোধও মনে হয় অবশিষ্ট নেই আর! সরকারের জন্য সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ ছিল নিজেদের দুর্নীতিমুক্ত প্রমাণ করা। সেটি তো করতে পারেইনি, উল্টো দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তদের বাঁচাতে গিয়ে ক্রমাগত মানসম্মান খোয়াচ্ছে। আর কতোভাবে অপমানিত হলে এই সরকারের লজ্জা হবে, বলতে পারেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
বাগাড়ম্বরের প্রদর্শনী : একপলকে
● নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি হবে : প্রধানমন্ত্রী
● দেশীয় অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কখনো সম্ভব নয় : অর্থমন্ত্রী
● ১৬ কোটি মানুষের ৩২ কোটি হাত দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করব : সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
● মোবাইল কলে ২৫ পয়সা সারচার্জে দিয়ে পদ্মা সেতু হবে : স্পীকার
● প্রয়োজনে এক বেলা বাজার না করে পদ্মা সেতু করা হবে : সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ ভোর ৫:১২