কন্ট্রিবিউটর, যারা পত্রিকায় লেখালেখি করে, তাদের একটা ছোটখাট দল আছে মোটামুটি আমার বেশ অনুগত। মাসখানেক আগে তাদের মধ্যে চার-পাঁচজনকে আমি আমারব্লগে লেখালেখির অনুরোধ করি। সপ্তাহ যায়, পক্ষকাল যায়, ২০-২২ দিনের মাথায় তাদের জিজ্ঞেস করি, কেন তারা লিখছে না। হু-হ্যাঁ করে তারা এড়িয়ে যায়। আমি তাদের চেপে ধরি, কী সমস্যা বলো। সামহোয়্যারে নিয়মিত লিখছো, আমারব্লগে কেন নয়? মিনমিনে কন্ঠে একজন বলে, ওভারঅল ভালো লাগেনি। শুনে আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলি।
ঢাকার ফকিরাপুল থেকে অগণন আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকা বের হয়। তাতে লিড আইটেম থাকে, সেকেন্ড লিড থাকে, কয়েকটা রঙিন ছবিও থাকে। কিন্তু সেই পত্রিকা চলে না। একই ম্যাটার নিয়ে যুগান্তর -সমকাল বাজারে চলে, পাঠকের মনোযোগ কেড়ে নেয়। কেন? পার্থক্যটা কী? পার্থক্যটা হল পরিমিতবোধে আর জোরটা হল উপস্থাপনার।
সামহোয়্যারইনে যে পোস্ট ১০০ বার পঠিত আর ৩০টি মন্তব্য, আমারব্লগে তা ১০ বার পঠিত আর মন্তব্য হয়তো তিনটি। আর মন্তব্য দেখলে বোঝা যায়, ঠিক সপ্রাণ গতিটা এখানে গড়ে উঠেনি। সামহোয়্যারইনে যে প্রাণময় গতি, সচলায়তনে যে সিরিয়াস ভঙ্গি- কোনোটাই আমারব্লগে নেই। আমরা আমরাই মিলে অনেকটা জোর করে একটা আলোচনার ভঙ্গি তৈরি করি বটে, কিন্তু তা অনেকটা কাঠের ঘোড়া চালানোর মতোই।
কিন্তু সামহোয়্যার তিন বছরের ফসল, আমারব্লগ মাত্র তিন মাস- তুলনাটা কি ঠিক হচ্ছে? হ্যাঁ, গড়ে উঠতে সময় লাগে ঠিক। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় দেখি, পত্রিকা যেটা দাঁড়ায়, একমাসেই দাঁড়ায়। দাঁড়ায় মানে সম্ভাবনার ঝিলিক দেখিয়ে দেয়। যেটা দাঁড়ায় না, সেটা তিন মাসে তো নয়ই, তিন যুগেও দাঁড়ায় না। ফলে নো-মডারেশনের সম্ভাবনাময় স্টান্টটিও কাজে লাগেনি স্বাভাবিকভাবেই। সবমিলিয়ে, আমারব্লগ হয়েছে অনেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার মতো- যা নিয়মিত বের হয় কিন্তু সার্কুলেশন নেই। অন্যভাবে বললে এটা হয়েছে একটা বন্ধু-সমিতি।
অগ্রদূত হয়ে সামহোয়্যারইন পাঠক টানার যে সুবিধাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পায়, ক্লোজড কমিউনিটি হিসেবে সচলায়তনও লেখক না হোক- পাঠক আকর্ষণের যে একটা সুবিধা পায়, বলাবাহূল্য আমারব্লগ তার কিছুই পায় না। ঘিনঘিনে মৌলবাদীদের পদচারণা দেখে প্যাঁচালি মন টানে না ঠিক, কিন্তু ওই ব্লগের ইন্টারফেস পরিচ্ছন্ন, পরিমিতিবোধ আছে। আমারব্লগের ডানপাশে যে বড়ো অংকের আনরেজিস্টার্ড পাঠকের যে সংখ্যাটা আমরা সবসময়ই দেখি, সেটা গুগল এডসের ফসল। কিন্তু সেখান থেকে রেজিস্টার্ড ব্লগার আসছে না। এই আমরা আমরাই পাশের জায়গাটা দখল করে রাখছি। নতুন মুখ সেখানে নেই-ই বলতে গেলে, তারা আসছে না। আমি বারেবারে সতর্ক করেছি শুরু থেকেই পাঠক একবার এসে নিরাশ হলে, সে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয়বার হয়তো আসবে, কিন্তু তখনও যদি সে নিরাশ হয়, চতুর্থবার সে আসবে না এবং আর কখনোই সে আসবে না।
ব্লগারের চাহিদাটা যে খুব বেশি তা নয়, তারা চায় এক ক্লিকে পোস্ট খুলে সেখানে মন্তব্য দিয়ে আবার একটু রিফ্রেশ। কিংবা এক ক্লিকে পোস্ট লিখে মন্তব্যের পিঠে মন্তব্য লিখতে। ঝুটঝামেলা তারা চান না। ওয়ার্ডপ্রেসের হাজারো ঝক্কি তারা সামলাতে চান না। জাদুঘরের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ানো প্রভাত কি-বোর্ড, রাইট কিংবা লেফট অ্যালাইনমেন্ট, স্ট্রাইকথ্রু, ইনডেন্ট-ফিন্ডেন্টের কেরানিবিদ্যা তারা চান না।
আমারব্লগে হয় কী, কদিন পর পর ওয়ার্ডপ্রেসের হাজারো থিম থেকে একটা একটা নিয়ে হাজির হয়। ওই যে ব্লগার লিস্ট, ওটা দেখে কেউ দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় যেতে চাইবেন না- এমনই বিরক্তিকর। এরা মনে করেছে, গুগল অ্যাডসেন্স যুক্ত কর্লে মনে হয় ঝাঁকে ঝাঁকে ব্লগার আসবে। কিন্তু তা মোটেও হবে না।
ব্লগ মানুষ নয় যে বাহারি পোশাকে তার স্মার্টনেস ধরা পড়বে, ব্লগের স্মার্টনেস পুরোটাই শব্দচয়ন, পরিমিতিবোধ আর উপস্থাপনার ভঙ্গিতে। ভাষার ব্যবহার তো সূচনা থেকেই প্রধান এক দুর্বলতা, শুরুতেই যা পাঠককে একটা বিরূপ ধারণা দিয়ে ফেলে। ওয়েবমাস্টারটাইপ গ্রাম্য ধারণার কথা বাদই দিলাম।
এই এতোদিনে আমার ধারণা হয়েছে, আমারব্রগের ডেভেলপার, ওয়েবমাস্টার থেকে মডারেটর- পুরো টিমের কারোরই যোগ্যতা নেই ব্লগ চালানোর। এরা আওয়ামী মানসিকতা নিয়ে ব্লগ নির্মাণ করতে চায়। এমনই হাস্যকর সেই মানসিকতা- মেধাবী ডেভেলপারকে তারা হায়ার করবে না। তাদের দরকার আওয়ামী ডেভেলপার।
শীঘ্রই আসছে প্রথম আলো ব্লগ । ওটা আসার পর আমারব্লগ আরো কিছু পাঠক হারাবে। সবকিছুর ওপর মূল কথা হল, ওয়ার্ডপ্রেসে আর যাই হোক, বাংলাব্লগ দাঁড়াবে না। একটা বড়ো অংকের বিনিয়োগ নিয়ে আমারব্লগের অ্যামেচারিজমের কোনো মানে খুঁজে পাই না! কিন্তু এরপরেও আমার এই যে উদ্বেগ, এটার পিছনেও কারণ আছে। পেছনের অনেকেই আমার বন্ধুস্থানীয় যে!
পোস্টটি আসলে আমারব্লগেই দেওয়া। শুধু কপিটা রাখলাম সামহোয়্যারইনে।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই এপ্রিল, ২০১০ ভোর ৪:১৯