somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোলেটরাল ড্যামেজ!

০৮ ই মে, ২০১২ রাত ৮:৪৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

“সুদানীজ্ঝি মারি ফালা ইতারে ...” পিচিক করে থুতু ফেলে বিরক্তি আর বিদ্রুপ মিশিয়ে কথাটা কিংবা কটাক্ষটা সসংশয়ে ছুঁড়ে দিতে দিতে বাবুল শেখ হোয়াইটে আরেকটা টান দেয়, আর তার কুঞ্চিত ভ্রু কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে হঠাৎ মায়ের চড় থাপ্পড় খেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জেগে উঠে ফের ভাঙা গলায় কাঁদতে শুরু করা শিশুটির দিকে তার করুণা আর মনোযোগের স্বাক্ষ্য বহন করতে থাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না বাবুলের, কথাটা ঠিকই চলে গেছে আরেকটি কাল গ্লাসে আটসাঁট বাঁধা গাড়ির জানালায় ব্যর্থ টোকা দিয়ে ফিরে আসা শিশুটির মায়ের কানে।
“সুদানীর ফুয়া তুই টেঁয়া দিবি না? তুই ক্যা মাতর?” [@#~* তুই টাকা দিবি? তুই কথা বলিস কেন?] বাবুলের মুখে ঝামা ঘষে দেয় রোদে পোড়া শতচ্ছিন্ন জামা পরিহিতা রুক্ষ চেহারার “মা”-টি -মিমি সুপার মার্কেট সংলগ্ন এলাকার একজন পেশাদার ভিখিরিনী। তার কোলে চড়ে আছে যে বাচ্চাটা - ছেলে না মেয়ে ঠাহর করা মুশকিল, বয়স নয় মাস থেকে দেড় বছর - যেকোনটাই হতে পারে - অবশ্য এদের বয়স বা লিঙ্গের মত বিলাসী পরিচয়ের সুযোগ নেই - অস্তিত্বটাই সব - এখনো কেঁদেই চলেছে, যদিও কন্ঠ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না আর, শুধু ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ ছাড়া। মাথাটা মায়ের কাঁধে এলিয়ে দিয়ে দুর্বল হাতে শাড়ির আঁচল টানছে - ক্ষিধের জানানটা স্পষ্ট।
আরেকটা চকচকে প্রাইভেট কার আসতেই তার জানালায় টোকা দেয়, হাত পেতে রাখে কিছুক্ষণ, কিন্তু ভেতরে বসা যাত্রী এই কাঠফাটা রোদে আরামদায়ক শীতলতার আবেশ ছেড়ে মানবতা কিম্বা দয়া-দাক্ষিণ্যের হাত প্রসারিত করার মত যথেষ্ট উৎসাহ খুঁজে পান না। “মা” এর সব রাগ গিয়ে পড়ে নিজের কোলে লেপ্টে থাকা শিশুটির ওপর। দুমদাম চড়-কিল বসাতে থাকে শিশুটির পিঠে, “সুদানীর ফুয়া হাঁদিন্ন্যারস? লাট সাবর ফুয়া লেডি থাইক্কস! এব্বেরে আসারি মারি ফেলাইতাম মনে হর!” [@#~* কাঁদতে পারিস না? লাট সাহেবের বেটা শুয়ে থাকিস শুধু! একেবারে আছাড় দিয়ে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করে!]
“ফোয়া ইবারে মারি ফালাইবু!” [ছেলেটাকে মেরে ফেলবে] রাস্তার পাশের ঝুপড়ি দোকানদার সুলামান চাচার চা-সিগ্রেটের বিল মেটাতে মেটাতে অস্ফুট মন্তব্য বাবুলের। “অই মাইয়্যা, বাইচ্চাডা মাইরা হালাবি?” সুলেমান চাচা ঘড়ঘড়ে গলায় নিরুদ্বেগ প্রশ্ন ছোঁড়ে, যাতে শিশুটির জন্য আবেগের লেশমাত্র থাকে না। শিশুটি তখন কেঁপে কেঁপে উঠছে, কান্নার শক্তি নেই আর। তাতানো রোদ আর মায়ের আদরের উষ্ণতায় ক্লান্ত। বিরক্তি নিয়ে মা বসে পড়ে রাস্তার ধারে, শাড়ির আঁচলের নীচে শিশুটির মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে ভয়ঙ্করভাবে নিজের রুক্ষ চুল চুলকাতে থাকে।
মার্কেটে দু’দিক থেকে দু’টা গাড়ি ঢুকতে গিয়ে একটা খানিক জটলা ... নতুন উদ্যমে মায়ের সন্ধানী হাত বিভিন্ন গাড়ির জানালার বন্ধ কাঁচ কিম্বা খোলা জানালা গলে ভেতরে। গলা ভেজানোর সুযোগ পেয়ে বাচ্চাটিও এবার আওয়াজ বের করছে। বাবুল দেখছে মহিলার কীর্তি, আর অপেক্ষার বিরক্তিকর প্রহর চাঁদিফাটা গরমে পার করতে করতে ডাক্তার সাহেবের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছে মনে মনে। স্যারের বাসা এদিকেই, তাঁকে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছিল। এসে স্যারকে ফোনও করেছে প্রায় আধঘন্টা হতে চলল, কিন্তু তাঁর দেখা নেই। একটা মেন্টোস চকলেট মুখে পুরেছে বাবুল, সিগ্রেটের গন্ধ ঢাকতে। চাচা তখন আরেক বুড়ো কাস্টমারের সাথে বেগম খালেদা জিয়ার “ঢাকা চলো” সমাবেশের সম্ভাব্য সাফল্য ব্যর্থতা নিয়ে আলাপে মশগুল। বাবুল ওই আলোচনায় অংশ নেয়ার উৎসাহ বোধ করতে শুরু করে। চাচা কিঞ্চিত বি এন পি পন্থী হওয়ায় আওয়ামী ঘেঁষা কাস্টমারের সাথে তাঁর আলাপ-তর্ক জমে ওঠে দ্রুতই। মাঝখান থেকে হঠাৎ ঐ মহিলা, শিশুটির মা, এসে বিনা বাক্যব্যয়ে চাচার এক গ্লাস ফিল্টার পানি ঢকঢক করে গিলতে শুরু করে। শিশুটির কান্না তখন বন্ধ, অবশ্য এইসব শিশুদের কান্না খুব দ্রুতই, খুব অল্পেই থেমে যায়। “ঐ হারামজাদী” খেঁকিয়ে ওঠে চাচা, “ফিল্টারের হানি হাস কিত্ত? এ্যম্বি হানি আসে না, জগত্তুন ল না!” [ফিল্টারের পানি খাস কেন? এখানে পানি আছে না, জগ থেকে নে না!] “খাইয়্যি ত কি অইয়্যেদে?” [খাইসি তো কী হইসে?] পাল্টা ঝাঁঝানো উত্তর মহিলার। “টেঁয়া আছে নি? অঅন এক টেঁয়া দে!”
“এত টেঁয়া টেঁয়া ন গরিস!” [এত টাকা টাকা করিস না] সুলেমান চাচাকে পাত্তাই না দিয়ে আবার মিমি সুপার মার্কেটের সামনে মাঠের দিকে এগোয় সে। বিরক্তির সাথে অশ্রাব্য আরেকটা গালি দিয়ে গ্লাসটা ধুয়ে রাখতে থাকে সুলেমান চাচা।
বাচ্চাটাকে মহিলাটা আবারও থাপড়াচ্ছে। ক্রন্দনরত শিশু ভিক্ষাদাতার করুণা আকর্ষণে বেশী কার্যকর। বাবুল মোবাইলটা হাতে নেয় - আরেকবার স্যারকে কল দেবে কিনা - দ্বিধান্বিত। ক্ষেপে গেলে অযথা ঝাড়ি খেতে হবে। মার্কেটের সামনে একটা সি এন জি থেকে এবার এক তরুণী নেমেছে - সুন্দরী না হলেও, সংক্ষিপ্ত পোশাকের কারণে আরও অনেকের মতই বাবুলের দৃষ্টি টেনে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। “কিয়ামত হাসাই আইসে” [কেয়ামত সন্নিকটে] সুলেমান চাচার মন্তব্য প্রমাণ করে, যৌবন গত হতে পারে, যৌন-অনুভব চির ভাস্বর।
ওদিকে মনোযোগ থাকায় বাবুল দেখেনি, বাচ্চার কান্নার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতায় ক্ষিপ্ত হয়ে মা কিছুক্ষণ শিশুটিকে দু’হাতে মুখের সামনে ধরে ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে অশ্রাব্য গালির ফোয়ারা ছুটিয়েছে। তাতেও বাচ্চার ক্রন্দনহীন নিঃশব্দ কাঁপুনি দেখে তাকে মাঠের ওপর ফেলে রেখে রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মা তাকে পিছু ফিরে ফিরে অভিশাপ দিতে থাকে, “মর তুই, মর!” এখন, বাচ্চাটার জন্য একটু মায়াই হয় বাবুলের। মাঠের ধুলোর ওপর, আগুন হয়ে ওঠা বালির ওপর কেমন নিথর হয়ে আছে শিশুটি। সত্যিই মরে গেল কি? না, এখনও কিছুক্ষণ পরপর হঠাৎ এক একটা ঝাঁকি দিয়ে উঠছে।
আরেকটা গাড়ি এসে ব্রেক করতে বাধ্য হয় - শিশুটির জন্য। সিকিউরিটি দৌড়ে এসে মহিলাকে লঠি দিয়ে আলতো পেটাতে পেটাতে বলে বাচ্চাটাকে সরিয়ে নিতে। “ফাইত্তাম ন, মারি ফালা ইতারে, ফিষি ফালা হাঙ্কীর ফুয়ারে ...” [পারব না, মেরে ফেল ওকে, পিষে ফেল] ততোধিক তেজ আর ঝাঁজ নিয়ে মা-এর উত্তর। গাড়ির পেছনের সীটের জানালা ফাঁক হয়, একটা নোট উঁকি দেয় - মা ছুটে যায়। গাড়ির ভেতর থেকে আঙুল নাড়ানো দেখা যায়, হয়ত বাচ্চাটা সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ থাকে। প্রায় মূর্তিবৎ বাচ্চাটা আবার মায়ের কোলে।
বাবুলের মোবাইল সরব হয়ে জানান দেয়, স্যার এসেছেন। ছুট দেয় অ্যাম্বুলেন্স স্টার্ট দিতে।

সি এস সি আর যাওয়ার পথে দেখে বাচ্চাটা কোলে নিয়ে মহিলা দৌড়ুচ্ছে, পেছন পেছন সুলেমান চাচা। “কি সুরি গইরগে হনে জানে!” [কী চুরি করেছে কে জানে!] বিড়বিড় করে বাবুল।

স্যারকে নামিয়ে দেয়ার পর ইমার্জেন্সীতে ওয়র্ড বয় কামালের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা পেটানোর সময় দেখে ঐ ভিখারিনী তার বাচ্চাসহ হাজির। পেছন পেছন সুলেমান চাচা। বাচ্চাটা নিথর।

পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলে, “বাচ্চা তো মারা গেছে, আরও আগে নিয়ে আসতেন!” “ও মা রে আঁর ফোয়া হন্ডে ...” বিলাপ শুরু করে মা। সুলেমান চাচা কিছুক্ষন বাচ্চার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকেন। অভিজাত হাসপাতালে এমন বিশ্রী ক্যাওয়াজ কোনভাবেই কাম্য নয়। সিকিউরিটি গার্ড এসে মহিলাকে টানতে টানতে বের করে আনে, সুলেমান চাচার কোলে বাচ্চার লাশ।

প্রায় এক ঘন্টা পর বাবুল বেরোয়, রাস্তার উল্টোদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের পশ্চিম গেটের সাথে লাগোয়া কাজলের ঝুপড়ি দোকানে চা খেতে। পাশে ডাস্টবিনে বাচ্চাটার লাশ পরে আছে। তার মা-কে দেখা যাচ্ছে না। হয়ত এখনো কোন না কোন গাড়ির বন্ধ জানালায় টোকা দিচ্ছে!

অফটপিকঃ সভ্যতার বিনির্মাণে এবং অগ্রযাত্রায় ছোটখাট কিছু “কোলেটরাল ড্যামেজ” থাকতেই পারে ... এতে বিচলিত হওয়ার কী আছে?
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×