নীপুর ঠান্ডা স্বরে বিস্ফোরক উত্তরটার পর, শেষ চেষ্টায় মরিয়া হয়ে, মুখে জোর করে হাসি ফুটিয়ে, নীপুর বিছানা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, নিজের শ্বশুর শ্বাশুড়ীর সামনে নীপুর গালে আদুরে হাত বুলিয়ে, এটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েই যে, এই আচরণ এই মুরুব্বীদের চোখে আরও বেশী আপত্তিকর, মাহফুজ প্রশ্ন করে, “কিসের ভয় সোনা?”
নীপুর বাবা মায়ের মুখের রাগ-বিরক্তিমাখা অভিব্যক্তি মাহফুজের ভেতরটা রীতিমত কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
একটা গলা খাঁকরি দিয়ে নীপুর মেজ চাচা মাহফুজের কাঁধে হাত রেখে তাকে একপাশে সরিয়ে এনে বলেন, “বাবা, রাতভর তোমার ওপর অনেক ধকল গেছে, সকালে তোমাকে আবার অফিসে যেতে হবে। তুমি এখন বাসায় গিয়ে বিশ্রাম নাও। এখানে আমরা তো আছি!”
“যা ভাগ এখান থেকে” কথাটা সম্ভবত এর চেয়ে মোলায়েম করে, এর চেয়ে মার্জিতভাবে বলা অসম্ভব।
“চাচা ...” তবু কিছু বলার চেষ্টা করে মাহফুজ।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে থুতনি উঁচিয়ে তার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ান নীপুর বাবা। তাঁর চেহারায় স্পষ্ট নির্দেশ, ‘বেরোও এখান থেকে!’
“আচ্ছা ... আমি ...” ইতস্তত করতে করতে মাহফুজ বলে, “ঠিক আছে ... আমি না হয় ... অফিস থেকে ফেরার পথে আসব।”
দ্বিধা জড়ানো পায়ে ধীরে ধীরে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ে মাহফুজ।
মাহফুজ বেরিয়ে যাবার পর, নীপুর ওপর নতুন ভয় চেপে বসে। এক্ষুণি হয়তো বাবা মায়ের অভিশাপের ঝাঁপি খুলে যাবে। “বলসিলাম না! বাবা মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কেউ কোনদিন খুশী হইতে পারসে?” “বাবা মায়ের বদদোয়া লাগলে কেউ জীবনেও সুখী হইতে পারে না!” – ইত্যাকার কথাগুলো এখন বুঝি মুষলধারে বর্ষাতে শুরু করবে। সন্তানের ব্যাথার চেয়ে, কষ্টের চেয়ে, ওঁদের অভিশাপের সাফল্যটাই যেন বড়। ওঁদের এই প্রবণতা থেকে পালানোর জন্যই তো নীপুর মাহফুজে ঝাঁপ দেয়া! কিন্তু, নিস্তার কোথায়? নিজেকে বড্ড নিরাশ্রয় মনে হতে থাকে নীপুর।
.
কাঁধে একটা হাতের আলতো স্পর্শ অনুভব করে, অনন্যা তার কোলে ফেলে রাখা হাতটা দিয়ে ওই হাত মুঠো করে ধরে, নীচের ঠোঁট কামড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়। পার্থর অন্য হাত অনন্যার মাথার ওপর। নতুন একটা চিন্তা মাথায় আসার পর, পার্থ ঝিমুনী ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। লুকোচুরি অনেক হয়েছে, এবার একটা সমাধানে পৌঁছনো জরুরী।
“তোদের বাসায় গেসিলাম যখন, তখন কায়সার ভাই ছিল না। কিন্তু উনার কম্পিউটার অন ছিল।”
অনন্যা নিরুত্তর, প্রতিক্রিয়াহীন।
“প্রথমে দেখে আমারও মেজাজ খারাপ হয়া গেসল। কিন্তু বাদল পরে কইল, ঐটা নাকি একটা রোগ, জাস্ট একটা মানসিক রোগ। এক ধরণের, সাইকোলজিক্যাল পার্ভার্শন।”
অনন্যা এখনও প্রতিক্রিয়াহীন।
“এখন ধর, কায়সার ভাইয়ের যদি কোন অসুখে হাত পা পঁইচা যাইত, তুই কি উনারে ঘৃণা করতি? নাকি উনার ট্রিটমেন্টে হেল্প করতি?”
অনন্যা নিরুত্তর।
“অন্যা, বাদল কইল, এইটার নাকি ট্রিটমেন্ট আছে। ট্রিটমেন্ট করাইলে পুরাপুরি ভালও হয়া যাইতে পারে। একটা রোগের জন্য তো আর একটা মানুষরে ঘৃণা করা যায় না, তাই না?”
অনন্যার কাছ থেকে এবারও কোন জবাব না পেয়ে, পার্থ এবার ঘুরে এসে তার মুখোমুখি বসে। অনন্যার মুখের অভিব্যক্তি দেখে একটু অবাক হয়। সেখানে কোন উৎকন্ঠা নেই, ক্লান্তি নেই, ব্যাথা নেই, ঘৃণা নেই – শুধু কি যেন একটা অদ্ভুত প্রশান্তির কোমল আলো খেলা করছে। এই পরিস্থিতিতে এটা একদমই অস্বাভাবিক।
“অন্যা! এই অন্যা! কি হইসে তোর?”
এবার অনন্যা জড়তা ভাঙে। দুই চোখ মোছে। মাথা নুইয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর মাথা তুলে পার্থর দিকে তাকায়। তার চোখে অযুত ভাষার ছোটাছুটি, কিন্তু পার্থ ওদের ঠিক পাঠোদ্ধার করতে পারছে না।
“কি চিন্তা করতাসস?”
“কিছু না।” অনন্যার নির্লিপ্ততা কাটেনি।
“কায়সার ভাইয়ের ওপর কি এখনো রাগ আসে?”
“নাহ্!” এবার উত্তরের সাথে হাল্কা হাসির মিশেল, যেটা পার্থকে আরও ধন্দে ফেলে দেয়।
“শোন, উনি যেটা করসে তোর সাথে, সেটা ডেফিনিটলি রং, কিন্তু সমস্যার গোরা হইল একটা মানসিক রোগ, বুঝলি?”
“হুঁম।”
“এই রোগটা না থাকলে, এইরকম সিচুয়েশন কখনোই আসত না। তাই, আগে এইটার ট্রিটমেন্ট করা দরকার। তুই বুঝতাসস আমার কথা?”
“বুঝছি।”
“এখন তুই কী করবি ঠিক করসস?”
“জানি নাহ্!”
“প্লীজ অন্যা, পেটের ভিতর কথা চাইপা রাখিস না!”
এবার অনন্যা ফিক করে হেসে ফেলে, “কথা চাপার কী আসে? ওর যেহেতু মানসিক রোগ আছে, তাই ওর কোন দোষ নাই। যেহেতু আমার কোন রোগ নাই, সুতরাং আমিই দোষী – এইটা তো সহজ হিসাব।”
এইবার নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করে পার্থর। মেয়েটা সবসময় উল্টা বুঝে। আবার চেষ্টা শুরু করে পার্থ, “কে দোষী, কে নির্দোষী, সেইটা এখানে ইস্যু না। ইন ফ্যাক্ট, এখানে কেউই দোষী না। পুরাটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট, একটা মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং। এখন এই ভুল বুঝাবুঝিটা ক্লীয়ার হওয়া জরুরী। কায়সার ভাইয়ের রোগটা নিয়া বাদল ভাল কইতে পারব। এই রোগে মানুষ মেন্টালি এত সিক থাকে, নর্মাল কিছুতেই সে স্যাটিসফাই হয় না, ওইসব জিনিস লাগে। এইটা সে বাইছা নেয় না, এইটা একরকম অপারগতা। নেশাখোর যেমন নেশা না কইরা থাকতে পারে না, ঘুইরাফিরা তারে নেশার কাছেই ধরা দেয়া লাগে, সেইরকম। তাই বইলা মাদকাসক্তির কি ট্রিটিমেন্ট নাই? আছে। সেই ট্রিটমেন্ট কিন্তু ঘৃণা না, সেইটা হইল সাপোর্ট। ভাল সাপোর্ট পাইলে এডিক্টেড লোক নেশা ছাড়তে পার, এইটাও সেইরকম। লোকটার জাস্ট তোর সাপোর্ট দরকার। তুই না করলে কে ওরে সাপোর্ট করবে? নিজের এইসব প্রবলেম তোরে ছাড়া আর কারে বলতে পারবে? ওর ছোট ভাইবোনরে? নাকি ওর মা-রে? তুই ছাড়া ওর কোন অল্টারনেট নাই রে! তুই বুঝছস ব্যাপারটা?”
“অসুবিধা নাই, আরেকটা সুন্দরী মেয়ে বিয়া করলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ধ্যাত্তোরি! আরেকটা সুন্দরী আইলো কই ত্থেইকা? উনি কি পরকীয়া করত নি?”
“আমি না থাকলে আরেকটা বিয়া করতেই পারে। তখন সবাই ভাল থাকবে। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“তুই না থাকলে মানে? তুই কই যাবি?”
উত্তর না দিয়ে অনন্যা মৃদু হেসে রেলিঙে কাৎ করে মাথা রাখে।
“তুই কি ডিভোর্সের চিন্তা করতাসস? নাকি তোর শ্বাশুরী-দেবরদের নিয়া টেন্সড? শোন, ওরা সবাই জানে ঘরে ডাকাত পড়সিল – শুধু কায়সার ভাই আর তুই জানস আসল ঘটনা। কায়সার ভাইয়ের সেন্স ফিরলে, তোরে সাথে নিয়া বাদল কায়সার ভাইরে সব বুঝায়া কইব। তারপর দেখবি, সব ঠিক হয়া যাইব।”
অনন্যার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। “সব ঠিক হয়ে যাবে ...” বিড়বিড় করতে থাকে সে। পার্থ ধরে নেয়, অনন্যা এখনও মানসিক ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারে নি। হয়তো আরও কিছু সময় লাগবে। হাল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় পার্থ। ঠিক তখনই সরব পার্থর মুঠোফোন – তার মা।
নীপুর সাথে বেশীক্ষণ কথা বলতে পারে নি বাদল আর মৌসুমী। মাহফুজের অনুপস্থিতি বাদলকে কিছুটা স্বস্তি দিলেও, তার অভিভাবকদের উপস্থিতিতে ওরা খুব সহজ হতে পারে নি নীপুর সাথে। নীপুও কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে ছিল। এর মাঝেই বাদলকে পার্থ ফোন করে জানায়, তাকে বাসায় ফিরতে হবে। তাই টুকটাক কিছু কথাবার্তা সেরে ওরা দু’জন চলে আসে। ওপরে ওঠার সময়, দু’জনেই অবাক হচ্ছিল কেবিনের নিয়ে। কেমন যেন থমথমে – নীপুই যেন মস্ত বড় অপরাধী! মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরও তাকেই অপরাধী ঠাওরানো হচ্ছে, কি বিচিত্র!
“অন্যা আমি এখন যাই। পারলে দুপুরের দিকে একবার আসার চেষ্টা করব। টেক কেয়ার।” বলে পার্থ কেবিনের দরজার দিকে পা বাড়ায়। দরজার হাতলে হাত রেখে পেছন ফিরে দেখে, অনন্যা শক্ত করে রেলিং খামচে ধরে আছে দু’হাতে, ওতে মাথা ঠেকিয়ে, বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। পার্থ শুনতে পায় নি, অনন্যা বলছিল, “যা! তুই তো অনেক আগেই চলে গেছিস। চলে যা! সবাই চলে যা! আমার কাউকে লাগবে না, কাউকে না!”
কেবি থেকে বেরিয়ে পার্থ দেখে, বাদল আর মৌসুমী আসছে। ওদের দিকে এগোয় সে। কাছাকাছি আসলে বাদল বলে, “চলি যাচ্ছস?”
“হুঁ, বাসা থেকে আম্মা বারবার ফোন করতেসে।”
“উনারে কিছু বলস নাই?”
“না রে! আম্মা প্রেশারের রোগী। এইসব গ্যাঞ্জাইম্যা খবর দিলে খামোখা নিজেই টেনশনে পইড়া আমার কাজ বাড়াইবো। দেখি, টাইম পিটিশনের পর গ্যাপ পাইলে একবার আসব। তোরা থাকবি?”
মৌসুমীকে অবাক করে দিয়ে বাদল বলে, “হ্যাঁ, অন্যার শ্বশুরবাড়ির লোকজন না আসা পর্যন্ত আছি।” এবার মৌসুমীকে বলে, “তুমি কেবিনে যাও, আমি ওর সাথে দুইটা কথা সেরে আসতিসি।”
“তুমি থাকবা?” মৌসুমীর এই প্রশ্নের পর, পার্থ প্রথমবার ওদের দু’জনের নিজেদের মধ্যে সম্বোধন পদের পরিবর্তনটা খেয়াল করে।
“হুঁ, আছি” মৌসুমীকে বলেই বাদল পার্থর সাথে হাঁটতে শুরু করে।
এত ঝঞ্জাটের মধ্যেও অদ্ভুত এক ভাললাগা মৌসুমীকে আপ্লুত করতে থাকে। আজ আরেকবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হল। আসলেই, গনগনে মুহুর্তগুলোতেই ওদের সম্পর্কের পরতটা পুরু হয়।
(চলবে)