“তুই থাক কিছুক্ষণ, আমরা একটু আসতিসি” পার্থকে বলে মৌসুমী বাদলের সাথে কেবিন থেকে বেরোয়।
ওরা বেরিয়ে যাবার পর পার্থ ধপ করে বসে পড়ে অন্যপাশের একটা সোফায়। এখনও পর্যন্ত অনন্যার মৌনব্রত ভাঙেনি। কায়সারের বিছানার রেলিং ধরে টুলের ওপর মূর্তির মত বসে আছে।
নিজের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকায় অনন্যা টের পায়নি, কখন মৌসুমী আর বাদল কেবিনে ঢুকেছিল। ওরা দু’জন কায়সারের আরেকদফা চেক আপ সেরে অনন্যাকে কী যেন বলেছিল, বা প্রশ্ন করেছিল। ঘোরগ্রস্থ অনন্যা কোনকিছু না বুঝেই মাথা নাড়িয়ে গেছে।
পার্থ যখন কেবিনে ঢোকে, তখন তাকে দেখাচ্ছিল ঝড়ে বিধ্বস্ত আশ্রয়হীন মানুষের মত। সেটা যে স্রেফ পাঁচতলা সিঁড়ি ভেঙে ওঠার জন্য নয়, এটুক বাদল বেশ বুঝেছে। আজকে পার্থর অনেক আচরণই ব্যাখ্যাতীত এবং প্রশ্ন-জাগানিয়া। কিন্তু তৎক্ষণাৎ কোন কিছু না বলারই সিদ্ধান্ত নেয় বাদল।
রুম থেকে বেরিয়েই মৌসুমীর প্রশ্ন, “কী বলবি, বল?”
বাদল একবার দরজার দিকে তাকায়, তারপর মৌসুমীর দিকে ফিরে মাথা ঝুঁকিয়ে গলার স্বর প্রায় খাদে নামিয়ে বলে, “অন্যার বাসায় গিয়ে জিনিসটা আবিষ্কার করসি। অন্যা আর কায়সার ভাইয়ের প্রবলেম কোন জায়গায়, সেইটা বুঝতে পারসি। কায়সার ভাইয়ের ইউরোফিলিয়া আছে।”
“কী?” চোখমুখের তীব্র কুঞ্চন মৌসুমীর বিস্ময়ের ব্যাপকতা ফুটিয়ে তোলে। “ইউরোফিলিয়া?”
“হ্যাঁ, উনার পি সি-তে অন্যার ইউরিনেশনের ক্লিপ চলতেসিল। ওইখানে আরও অনেকের, ইনক্লুডিং হার সিস্টার, একই রকম ক্লিপ ছিল। উনি মাস্টার্বেট করার সময় মনে হয় অন্যা দেখি ফেলসিল, তারপর দু’জনের মধ্যে পসিবলি রাগারাগি হইসে, সেখান থেকে এই রেপ এন্ড ট্রমা।”
“শিট!” মৌসুমী অবাক হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ করে পুরো মাথাটা ফাঁকা মনে হচ্ছে। “ভগবান!” বলেই দু’হাতে মাথার দু’দিক চেপে ঘাড় নুইয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়ায় মৌসুমী।
“অন্যা জানে না এইটা একটা ডিজিজ, সে কায়সার ভাইকে একটা ডার্টি পারভার্ট বলেই বুঝছে, ওর কাছে ব্যাপারটা ক্লিয়ার করা দরকার।”
“তুই শিওর?” মৌসুমী এখনও ধাক্কাটা সামলাতে পারেনি।
“আর কি লাগে শিওর হইতে? স্ক্রীনে মিকচুরিশন, চেয়ারের সামনে, টেবিলের নীচে, ফ্লোরে দুইটা টিস্যু পেপারের দলা, বিয়ের চার বছর পরও ওদের বাচ্চা না হওয়া, আর আজকের রেপ – শিওর না হওয়ার কিছু নাই।”
“সাইকোসেক্সুয়াল পার্ভার্শনে কেউ স্টেরাইল হয় না বাদল, এদের বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা ঠিকই থাকে ...”
“কিন্তু তার জন্য তো পার্টনারের সাথে ইন্টারকোর্স করা লাগবে, ঐটাই যদি না হয়?”
“চার বছর ধরে ইন্টারকোর্স হয় না, এইটা কি করে সম্ভব?”
“হয়তো চার বছর না। সবাই তো বিয়ের পরপরই বাচ্চা চায় না। ওরাও হয়তো টিপিক্যালি কন্ট্রাসেপশন করসে। কিন্তু পরে হয়তো আর ইন্টারকোর্স নর্মাল বা রেগুলার হয় নাই, হয়তো একদমই হয় নাই! তার উপর পার্টনার যদি হয় অন্যার মত মুখচোরা, সে তো কখনোই এই ইনসাফিয়েন্সি বা ইনএফিয়েন্সি নিয়ে প্রশ্ন করবে না, বরং নিজের অপূর্ণতাই তার চিন্তায় হাইলাইট পাবে। এইটা নিয়ে সে নিজেই বরং কমপ্লেক্সে ভুগবে।”
“আর তারপর যখন মেল পার্টনারের এই দিকটা জানতে পারবে, তখন, ঐ চাপা কমপ্লেক্সের কারণে রি-অ্যাকশনটা ভিগোরাস হবে। এমনকি সেক্সুয়ালিটি নিয়ে টিজও করতে পারে, যেটা মেল পার্টনারের পৌরুষে আঘাত করলে, রেপ এর পথ বেছে নেয়া অসম্ভব না। এইবার বুঝছি।”
“এখন, অন্যাকে ক্যাম্নে বুঝাবি?”
কি হয় মৌসুমীর, হঠাৎ কথা আটকে যায়। শূন্য দৃষ্টি স্থির বাদলের দিকে। কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলছিল, মুখটা খোলাই, কিন্তু কোন আওয়াজ আসেনা। অবাক হয়ে বাদল খেয়াল করে, মৌসুমীর দু’চোখ নদী হয়ে গেছে। চাপা একটা কান্না বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে।
“কি হইসে, সুমী?” মৌসুমীর চোখ মুছে দেয় বিস্মিত বাদল। তার হাত মুখের ওপর চেপে ধরে মৌসুমী। এবার দৃষ্টি আনত, কান্নারা নীরব ফোঁপানো হয়ে পাথর-চেরা চোরা স্রোতের মত তিরতির করে বেরিয়ে আসছে। খুব আস্তে করে, খুব কোমল স্বরে, ভাঙা গলায় মৌসুমী বলে, “অন্যার কপালটা এমন কেন রে?”
কোথায় কার মাঝে কার জন্য কত আবেগ জমে থাকে, বোঝাটা সত্যিই দুরূহ। একই বন্ধুবৃত্তে থেকেও অনন্যার সাথে নীপুরই সখ্যতা ছিল বেশী, পাথুরে স্বভাবের মৌসুমী বরং পার্থ আর বাদলের সাথেই বেশী ঘনিষ্ঠ ছিল। মৌসুমীর আপাত কাঠিন্যের ভেতরকার কোমলতাটুকুন আগ অনেক, অনেকদিন পর বেরিয়ে পড়েছে বাদলের সামনে। কোঁচকানো ভ্রু নিয়ে বাদল নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে স্তম্ভের মত।
.
পুরো কেবিনটায় কবরের নিস্তব্ধতা। একজন অচেতন, অন্য দু’জন মানুষ চেতনা-অবচেতনার দোলাচলে মূহ্যমান। একটু তন্দ্রামতন আসতে শুরু করেছে পার্থর। সোফায় গা এলিয়ে দিয়েছে সে। ঠিক সামনেই অনন্যা বসে, একদম ঋজু মেরুদন্ড, ন্যূনতম নড়াচড়া নেই। এক হাত কায়সারের বিছানার রেলিঙে, অন্য হাত কোলের ওপর। পেছন থেকে অনন্যার মুখ দেখতে পাচ্ছেনা পার্থ, না হলে দেখত, জড়বৎ অনন্যার মুখের রেখা নরম হতে শুরু করেছে, টুপটাপ অশ্রুরা ইতস্তত বেরুচ্ছে চোখ থেকে। ঠোঁটে খেলা করছে অপার্থিব এক অভিব্যক্তি। অনন্যার সমস্ত মুখ ঠিকরে, কেমন যেন একটা অদৃশ্য আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে – জীবনের জন্য, পৃথিবীর সবকিছুর জন্য অদ্ভুত এক ভালবাসার আলো। জীবনের সব ভাল লাগা, খারাপ লাগা, সব সুন্দর, অসুন্দর, প্রিয়, অপ্রিয়, কাংখিত, অনাকাংখিত সবকিছুই যেন স্মৃতির শয্যা থেকে উঠে এসে শেষ আলিঙ্গনটুকু করে যাচ্ছে। এখন খুব মনে পড়ছে বাবাকে, মাকে, এত বছর প্রচন্ড অভিমানে যাদের থেকে বিমুখ হয়েছিল। মনে পড়ছে টুকরো টুকরো হাসি আনন্দের কথাগুলো। খুব ছোট্টবেলায় বেণী দুলিয়ে বাবার সাথে সাইকেলে চড়ে স্কুলে যাওয়া, মায়ের সাথে কচি হাতে রুটি বানাতে বসে বারবার দলা পাকিয়ে শেষে অবাধ্য ময়দাপিন্ডের ওপর অভিমান করে ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করা, আস্ত একটা কড়কড়ে দুপুর কঞ্চি হাতে আমসত্ত্ব পাহারায় কাকতাড়ুয়া হয়ে কাটিয়ে দেয়া, ভোরে উঠে একদল চাচাত-জ্যাঠাত ভাইবোনের সাথে চোখ কচলাতে কচলাতে গুটি গুটি পায়ে মসজিদে হুজুরের কাছে আরবী পড়তে যাওয়া, পঞ্চম শ্রেণীতে বৃত্তি পাওয়ার পর হঠাৎ কিছুদিনের জন্য খাতির-যত্নের মধ্যমণি হয়ে সংকোচ, অস্বস্তি আর খুশির মিশেলে ভেসে যাওয়া ... ... ... । অন্তিম মুহূর্তে শৈশব স্মৃতিগুলোই কেন প্রকট হয়ে ওঠে কে জানে! আজকে, একবার, শুধু একবার যদি দেখা করা যেত মা’র সাথে, শুধু আর একবার মায়ের বুকে মাথা গুঁজে রেখে কয়েকটা মুহূর্ত যদি পুরো পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়া যেত – এই বাসনাটা ক্রমশ তীব্রতর মোচড় দিতে থাকে অনন্যার বুকের মধ্যে।
.
“নীপুকে দেখে আসি, চল।” নিজেকে সামলে নিয়েছে মৌসুমী।
“অন্যা? ওকে কিছু বলবি না?” মাহফুজের মুখ দেখতে চায় না বলেই নীপুর কেবিনে যেতে বাদলের কিঞ্চিৎ আপত্তি।
“নাহ্! এখন কিছু বলা ঠিক হবে না। এখন এমনিতেই সে মেন্টালি ডিস্টার্বড, এখন এসব কথা বললে কি রি-অ্যাকশন হয় কে জানে! পরে বলব।”
“পরে কখন? সকাল থেকে তোমার, আমার – দুইজনেরই ডিউটি আছে। পার্থরও কেস আছে নাকি। আর দুপুরেই তো অন্যার শ্বাশুড়ি-দেবররা চলি আসবে ...”
“একটা দিন ডিউটি না করলে কি হয়? তোরা গেলে যা, আমি থাকব।”
বাদলের চোখে মুগ্ধতা। মেয়েটা বদলায় নি। ঠিক আগের মতই আছে। খামোখা সে-ই এ্যাদ্দিন ভুল বুঝে আসছিল।
(চলবে)