মাথায় মোটা ব্যান্ডেজ, নাকে অক্সিজেনের নল, বাঁ হাতে স্যালাইন নিয়ে অচেতন কায়সার, শুধু শ্বাস-প্রশ্বাসের ওঠানামা ছাড়া আর কোন নড়াচড়া নেই। তার পাশে, একটা ছোট্ট টুলে বসে আছে অনন্যা, তার শূন্য দৃষ্টি বিছিয়ে রাখা সামনের অচেতন, নিথর মানুষটার ওপর। স্নায়ুবৈকল্য যখন চরমে থাকে, তখন কোন চিন্তাই মন মগজে থিতু হয় না। অনন্যার তৃতীয় চোখটার ওপর এলোপাথাড়িভাবে আছড়ে পড়ছে স্মৃতির সেলুলয়েডের টুকরো টুকরো ছবি, আর আগামীতে হামলে পড়তে যাওয়া সম্ভাব্য বিভীষিকাগুলো।
যেদিন বাবার হঠাৎ নির্দেশে গ্রামে পৌঁছে অনন্যা আবিষ্কার করে ঐদিনই বাদ আছর তার আক্দ হবে, অবহেলায় অভ্যস্ত মেয়েটাই সেদিন বিস্ময়ে আর ব্যাথায় সমাহিত হয়েছিল – এজন্য নয় যে, বিয়ের ব্যাপারে তার মতামত জানতে চাওয়া হয়নি। এই ব্যাপারটা মোটামুটি তার সহজ অনুমানের মধ্যেই ছিল, তার পারিবারিক অবকাঠামো তাকে নিজস্ব পছন্দ-অপছন্দের বিলাসী সুবিধাটুকু দেবেনা। যেটা ছিল না, সেটা হল, তাকে বিয়ে দিতে, যেটা, তার চোখে, কোনভাবে কারও ‘ঘাড়ে চাপিয়ে’ দিতে, তাকে এভাবে বিদায় করতে পারার মধ্যে তার বাবা মায়ের এত স্বস্তি লুকিয়ে ছিল!
অনন্যা জানত সে অসুন্দর, সে জানত তাকে বিয়ের জন্য সুপুত্তুর রাজকুমারদের মধ্যে হুড়োহুড়ি বাধবে না, সে প্রত্যাশাও মনের মধ্যে কখনো জন্মাতে কিম্বা জমতে দেয়নি সে। পরিবারের পছন্দেই তাকে নির্বিচারে সম্মতি জানাতে হবে, এ-ও তার অননুমেয় ছিল না। কিন্তু বিয়েটা যেভাবে হয়, তাকে পাত্রস্থ করার জন্য তার নিজের বাবা মা এবং আত্মীয়দের মধ্যে যে অসহিষ্ণু অস্থিরতা ঐ একদিনেই তার চোখে পড়ে, সেটাই তাকে ভেতরে থেকে কুকড়ে কুকড়ে খাচ্ছিল।
ঐদিন নাকি পাত্রপক্ষের স্রেফ আংটি বদলের জন্য আসার কথা ছিল। অনন্যার মামার সফল কূটনীতি সেটা আক্দ-এ পরিণত করতে সক্ষম হয়। অনন্যা কখনোই টের পায়নি, কখন তার নিজের ছবিগুলো পারিবারিক এ্যালবাম থেকে হাত বদল হয়ে গেছে, কখন তার বিস্তারিত বায়োডাটা চলে অচেনা মানুষদের হাতে, কখন, কে তাকে পছন্দ করে গেছে, কীভাবে ষড়যন্ত্রময় গোপনীয়তায় সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। সেদিনই সে প্রথম জানতে পেরেছিল, তার অজান্তে আরও সতরজন সুপুত্র মুখ ফিরিয়ে নেয়ার পর এখানে এসে সৌ(!)ভাগ্য ধরা দিয়েছে; আর এজন্য তার বাবা নিজের এফ ডি-টা বিসর্জন দিয়েছেন অম্লান বদনে, নির্মল আনন্দের সাথে; জানতে পেরেছিল, পুরো আয়োজনটা হয়েছে মাত্র আড়াই দিনে – যেন, অনেক কষ্টে টোপ গেলানো পক্ষটি যাতে কিছুতেই হাতছাড়া না হয়, তারই প্রাণান্তকর চেষ্টা! “মেয়ে” হওয়ার সব সীমাবদ্ধতার সাথে অনায়াসেই আপোষ করে একটা জীবন পার করে দেয়া যায়, কিন্তু ‘বোঝা’ হয়ে একমুহূর্ত থাকার জ্বলুনীটাও অসহনীয়।
এমন নয় যে, অনন্যা স্বপ্ন দেখত না। এমন নয় যে, কখনো মেহেদী রাঙা আকাশ দেখে সে আঙুলের ফাঁকে শূন্যতা অনুভব করেনি। কোন একটা ভীষণ বৃষ্টিভেজা রাতে টিমটিমে হারিকেনের আলোয় জানালার পাশে বসে বৃষ্টি-ছাঁটের ছোট ছোট দ্বিধা মেশানো শংকিত চুমুর আর্দ্র স্পর্শে আপ্লুত হতে হতে কল্পিত কারও সাথে কথোপকথনে সে মেতে উঠেছে বহুবার। কিন্তু এমন একটা বিদায় তার নতুন পথ চলার শুরুটাকে কিছুতেই “স্বপ্নযাত্রা”র অবয়ব নিয়ে ধরা দিতে দেয়নি।
বারো বছর বয়সের ব্যবধানে থাকা মানুষটার হাতে যখন প্রথমবার অনন্যার হাত পড়েছিল, তখন সে ছিল বোধহীন; না কষ্ট, না আনন্দ, না ভয়, না দ্বিধা – কিছুই কাজ করছিল না। একুরিয়াম বদলালেও ছোট্ট গোল্ডফিশটার মাঝে পরিবর্তনের কোন অনুভব কাজ করে না – দুটোতেই সে একইরকম বন্দী – অনন্যাও ছিল তেমনই নির্বিকার। সে বুঝতে পেরেছিল, সে ‘গোল্ডফিশ’ও নয়, শুধুই ‘ফিশ’!
বিয়ের পর নাকি প্রথম দু’এক বছর, অথবা নিদেনপক্ষে মাসখানেক, নবদম্পতি রোমান্টিকতায় হাবুডুবু খায় – অনন্যা এমনটিই জেনে এসেছিল। অনন্যাও হাবুডুবু খাচ্ছিল, তবে রোমান্টিকতায় নয়, আদর্শ বৌ হবার বাধ্যবাধকতায়। কায়সার হোসেন ভদ্রলোকটি ষোলকলাই অভদ্র ছিলেন না, আধুনিক মনস্কতা এবং চিত্তৌদার্যের বেশ কিছু স্বাক্ষর রেখে ‘প্রগতিশীল’ হওয়ার গৌরবও অর্জন করেছিলেন পরিচিত মহলে – অনন্যার পড়াশুনার খরচ চালিয়ে নিয়ে, তার বন্ধুদের সাথে মেলামেশার কিম্বা বাসায় পার্থ বাদলদের আড্ডার অনুমতি দিয়ে নিজের মহানুভবত্বও প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অথচ যখনই তাঁর মা, অর্থাৎ অনন্যার শ্বাশুড়ী এবং দেবর ননদ অহেতুক শাসনের বেড়ী পরাতে আসেন, কখনো মৌনতা দিয়ে, কখনো পরোক্ষভাবে, কখনো ইঙ্গিতে তাতে সমর্থনই যুগিয়ে গেছেন কায়সার হোসেন।
কায়সার দায়িত্ববান পুরুষ – এই অর্থে যে, ছোট ভাই আফসারের মত বখে না যাওয়া, পিতৃহীন পুরো সংসারের হাল ধরে রাখা, বিয়ের পরও অনন্যার পড়াশুনার খরচ চালিয়ে নেয়া, নিজের চাহিদা থেকে নয় - শুধু ছোটভাইকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে যৌতুক নেয়া, ডিভোর্সি, এক সন্তানের জননী ছোট বোনের সব দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয়া – মোটামুটি দোষেগুণে মিলিয়ে, সমাজের বিজ্ঞজন কখনো তাকে নেহাৎ মন্দলোক বলতে পারবেন না। কিন্তু সমস্যাটা ছিল অন্য কোথাও, সমস্যাটা ছিল অনেক গভীরে।
এই ধরণের, হাজারটা ঝঞ্জাটের পাঁকে পড়া পরিবারগুলোর, সদস্যের মধ্যে পরষ্পরের বিরুদ্ধে অনেক মান-অভিমান-অভিযোগ জমে থাকে, কখনো ওগুলো বিচ্ছিন্নভাবে বেরিয়ে আসে, কখনো ছোট্ট কোন খুশীর উপলক্ষ্যে অনেক বেদনার, অনেক না পাওয়ার দগদগে দাগ ফিকে হয়ে যায়। এইসব কান্না-অভিমান-হাসি-সংঘাতের মধ্য দিয়েই মানুষগুলো টেনেহিঁচড়ে জীবনটাকে পার করে দেয়। অনন্যাও পারত। প্রেম-ভালবাসা-রোমান্টিকতাহীন দায়িত্ব-কর্তব্যসর্বস্ব জীবনের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া, একজন বাঙালী মেয়ের জন্য তো ডালভাত!
যে পর্যায়ে এসে জীবনটা, দাম্পত্যটা পানসে মনে হতে শুরু করে, সে পর্যায়টা ওদের জীবনে খুব দ্রুতই চলে আসে। তখন থেকেই অনন্যার প্রতীক্ষা শুরু – তৃতীয় একজনের আগমনের প্রতীক্ষা। একজন, যে এই শতছেঁড়া জীর্ণ জীবনটাকে এক লহমায় বর্ণিল করে তুলবে তার অস্ফুট কান্নায়, পিটপিটে চাউনিতে, নিশ্চিন্ত ঘুমের অগাধ নির্ভরতায়, অহেতুক হেসে ওঠার সংক্রামক আনন্দে। ধীরে ধীরে ইচ্ছেটা জেগে ওঠে কায়সারের মাঝেও, কিন্তু কেন যেন, প্রতিটা মাসের শেষে রক্তের স্রোত ঠিকই আশাভঙ্গের বার্তা নিয়ে আসতে থাকে।
যেদিন অনন্যা অনেক দ্বিধা, অনেক সংকোচ ঝেড়ে, তারপরও অনেক ভয়ে ভয়ে বলেছিল, “কোন সমস্যা হচ্ছে? ডাক্তার দেখাবা?” আগুন জ্বলে উঠেছিল কায়সারের চোখে – শ্লাঘায় লেগেছিল খুব। স্পার্ম রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে দেখিয়ে এসেছিল যেদিন, সেদিন ঘুমানোর আগে অনন্যাকে শুনিয়ে দিয়েছিল, “নোনা মাটিতে ধান হয় না”! অনন্যাকেও যেতে হয়েছে বেশ কিছু হরমোন টেস্টের মধ্য দিয়ে। সব রিপোর্ট স্বাভাবিক হওয়া সত্ত্বেও, কেন যে কিছু হচ্ছিল না, সেটা ওদের দু’জনের কারুরই বোধগম্য ছিল না। সেই আকূলতা থেকেই কিনা কে জানে, বিছানায় কায়সারকে অনন্যার ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু মনে হতে থাকে – অবশ্য সেটা খুব বেশী ভুলও ছিল না।
অনন্যার প্রতি কায়সারের আগ্রহ ফুরোতে খুব বেশীদিন সময় লাগেনি। আর ওই আগ্রহের ভাটার সাথে সাথে কায়সারের মাঝে বাড়তে থাকে তার পুরনো বদঅভ্যাসের ঘুণপোকা – যেটা বিয়ের পর পুরোপুরি তিরোহিত হবে বলেই তার বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল। কিন্তু তা আর হয়নি। কায়সারের সাবধানতা এতদিন যেটা লুকিয়ে রেখেছিল, আজ, এক অসতর্ক ফোকর গলে সেটাই বিস্ফোরিত হয়েছে ভীষণভাবে।
অচেতন কায়সার হোসেন একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
অনন্যা চট করে উঠে গিয়ে কায়সারের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গভীরভাবে দেখে। নাহ্, লোকটা বেঁচে আছে। কায়সারের বিছানার দু’পাশে রেলিং তুলে দেয়া। এবার রেলিঙে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায় অনন্যা। তার চাউনীর গভীরতা বাড়ে। এই লোকটাকে কি পশু বলা যায়? ঘৃণা করা যায়?
না তো! অনন্যা নিজের মাঝে অনেক হাতড়েও এই মুহূর্তে কায়সারের জন্য কোন ঘৃণার সন্ধান পায় না।
ভালবাসা?
নাহ্! তা-ও নেই।
সত্যিই কি নেই?
কিছুই কি নেই?
চারটা বছর একসাথে থেকে, এই মানুষটাকে ঘিরে কি কিছুই তৈরী হয় নি? হয়তো অভ্যেস, হয়তো মায়া, হয়তো অন্য কিছু – যার নাম তার জানা নেই। মানুষ কি তার সব অনুভবের নামকরণ করতে পেরেছে আজও?
এই মানুষটা কি চলে যাবে? চলে গেলে, অনন্যার কি কিছু হবে? কী হবে?
এই মানুষটা কি বেঁচে যাবে? সেরে উঠবে? সেরে উঠলে কি অনন্যার কিছু হবে? কী হবে?
এই মানুষটাকে কি অনন্যার খুব প্রয়োজন?
এই মানুষটা কি অনন্যার কাছে খুব ফেলনা?
সব প্রশ্নের উত্তরেই যদি “না” শোরগোল তুলতে থাকে, তাহলে সে কেন আজ কায়সারকে নিয়ে এত উদ্বিগ্ন? যে অপরিহার্য নয়, আবার পরিহার্যও নয়, তার জীবন-মৃত্যু নিয়ে নিজের ভেতর এই ভীষণ উৎকন্ঠা – কেন? নিজের জন্য?
অবাক হয়ে অনন্যা আবিষ্কার করে, এবার উত্তর এল, “হ্যাঁ”! অনেক অনেক নৈঃশব্দের মাঝে, ছোট্ট একরত্তি রিনরিনে ‘হ্যাঁ’!
আফসারকে চেনে অনন্যা, চেনে নিজের শ্বাশুড়ি আর ননদকে, চেনে নিজের বাবা মা-কে, আর চেনে এই সমাজকে। তাহলে, এদের থেকে বাঁচার জন্যই কি অনন্যা চাইছে কায়সার সেরে উঠুক? হিসেব মেলে না।
আবার মনে হয়, কায়সারের যেটুক ক্ষতি হল, সেটা কি তার অপরাধের চেয়ে, তার বিকৃতির চেয়ে অনেক বেশী বড় শাস্তি হয়ে গেল না? এতটা কি তার প্রাপ্য ছিল? হেসেব মেলে না।
হিসেব মেলে, খুব সহজেই মেলানো যায়।
অন্য একভাবে।
কোন জটিলতা থাকেনা তাহলে।
“আমাকেই যেতে হবে” একটা উপসংহারে পৌঁছয় অনন্যা।
(চলবে)