“না, স্যার আজকে কথাটা ঠিক বলেন নাই।” মিসেস তানজীমার অসহিষ্ণুতা স্পষ্ট।
“আপনি কিসের কথা বলতেসেন?” খাতা কাটতে কাটতে মাথা না তুলেই জনাব মামুন প্রশ্ন করেন।
“ঐ যে, হাসান সাঈদের ব্যাপারে বললেন যে!”
“ও!” এবার খাতা থেকে চোখ তুলে মামুন সাহেব মিসেস তানজীমার দিকে তাকান। “স্যারের বলার ধরণটা হয়তো ঠিক হয় নাই, কিন্তু থিঙ্কিং তো ঠিক আছে।”
“কিসের ঠিক আছে? ‘রুমানারও দোষ আছে’- এইটা কোন কথা হইল? এইটা তো হাসানকে ডিফেন্ড করারই চেষ্টা।”
“আপা, আপনারা, মেয়েরা, খুব সহজেই অফেন্ডেড হয়ে যান। এখানে স্যার কিন্তু একবারও বলেন নাই যে, হাসান সাঈদ নির্দোষ। সে ডেফিনিটলি দোষী। উনি শুধু এটাই বলসেন যে, ঐ মহিলাটা ধোয়া তুলসী পাতা না।”
“কেন উনি এই কথা বলবেন? এইটাই তো হাসানকে ডিফেন্ড করার অপচেষ্টা।”
এবার মুখ খোলেন অপেক্ষাকৃত প্রবীণ, জনাব ফারুক ইসলাম, “দেখেন আপা, কেউই কিন্তু বলতেসে না যে, হাসান নির্দোষ। সে ব্যাটা যে আকাম করসে, ডেফিনিটলি তার শাস্তি হওয়া উচিৎ, নো ডাউট। কিন্তু সব ফোকাস ওখানে পড়ে যাওয়ায়, আমরা ভুলে যাচ্ছি, তালি একহাতে বাজেনা। যে কোন ডমেস্টিক ক্রাইমে একটা প্রভোকেটিভ ফ্যাক্টর কাজ করে। এইখানে প্রভোকেশনটা আসছে রুমানার পরকীয়া থেকে। স্যার শুধু এই প্রভোকেশনের কথাটাই বলতে চাইসেন।”
“কি বলেন ফারুক ভাই?” মিসেস তানজীমার উষ্মা ক্রমশ উর্ধ্বগামী, “কিসের প্রভোকেশন? একটা লোক জানোয়ারের মত, পশুর মত বর্বর, নোংরা একটা অপরাধ করসে, আর আপনারা প্রভোকেশন নিয়ে পড়ে আসেন?”
“শোনেন আপা, কোন কিছু জাস্টিফাই করতে হলে তার টোটাল গ্রাউন্ড দিয়ে তাকে জাস্টিফাই করতে হবে। আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি আমার একটা প্রশ্নের জবাব দেন, আপনার কি মনে হয়? হাসান লোকটা এই কাজটা কেন করসে?”
“কারণ সে একটা জানোয়ার, একটা পশু, একটা নরাধম, একটা পিশাচ।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন, সে যে একটা জানোয়ার, একটা পশু, সেটার আর কি কি স্বাক্ষর রাখসে?’
“মানে?”
“মানে সে এর আগে অন্য কাউরে এইরকমভাবে কামড়াইসে?” মারসে?”
“না, আমার জানা নাই, কিন্তু ...”
“সে এর আগে কাউরে রেপ করসে? খুন করসে?”
“সেটা আমার জানা নাই, কিন্তু ...”
“আর সে যদি বাই ডিফল্ট পিশাচ হয়, তাহলে তো এইরকম ঘটনা আগেও ঘটত। কই, সেরকম কোন ঘটনা তো শোনা যায় না!”
“কিন্তু এই ঘটনাই কি যথেষ্ট না, তার মুখোশ খুলে দেয়ার জন্য? আর, নিউজে তো পড়সিলাম, সে আগেও অনেকবার টর্চার করসে রুমানাকে।”
লেকচারারদের রুমে কিছুক্ষণ আগে ঢুকে চেয়ারে বসে সংবাদপত্রের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন নাজমুল সাহেব। ইনি মিসেস তানজীমার এক বছরের জুনিয়র। এবার তিনি বলতে শুরু করেন, “দেখেন আপা, এইগুলো হইল মিডিয়ার স্টান্টবাজি। মানুষের মধ্যে হুজুগ সৃষ্টি করে নিউজ বেচা। ইন্টারনেটের ব্লগগুলোও এই চামে ট্র্যাফিক বাড়ানোর সুযোগ পাইসে। হুজুগে বাঙালী হুজুগ পাইলে নেংটা হইয়া নাচে। কয়দিন আগে দেখেন নাই, ফালানীরে নিয়া কি ফালানিটা ফালাইল? হুজুগে না ভাইসা, নিজের বিবেক দিয়া চিন্তা করেন।”
রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়তে ইচ্ছে করছে মিসেস তানজীমার। তাঁর কথায় কিছুটা ঝাঁজও ঝরে পড়ে, “হুজুগ আর সচেতনতা এক জিনিস না। সবসময় সবকিছুতে মেয়েদের দোষ খোঁজা খুব বাজে, খুব মিন মাইন্ডের পরিচয় দেয়। ইভ টিজিং এর বিরুদ্ধে কথা বললেও মেয়েদের কাপড়টাই সেন্টার অব অ্যাটেনশন হয়ে যায়, কেন? যেটা অপরাধ, সেটার বিচার না করে এইসব, এইগুলো, এইগুলো ... ...” কথা আটকে গেছে মিসেস তানজীমার। দু’হাতে মুখ ঢেকে ফুঁসছেন তিনি। রাগে কান্না পাচ্ছে, অনেক কষ্টে সংযত আছেন।
“আরে আপা, এটাকে পার্সোনালি নেয়ার কি আছে... ...” ইত্যাদি বলে ফারুক সাহেব, নাজমুল সাহেব, মামুন সাহেব – এঁরা হাসিমুখে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন।
কোনভাবেই এই পরিস্থিতিকে ‘নির্যাতন’ বলে সংজ্ঞায়িত করা চলে না, অথচ মিসেস তানজীমা নির্যাতিত অনুভব করছেন, বিপন্ন অনুভব করছেন।
এতক্ষণ লেকচারার রুমের এক কোণায়, নিজের জায়গায় চুপচাপ বসেছিলেন মাসুদ রায়হান, সর্বকনিষ্ঠ লেকচারার, এই ইউনি থেকেই সদ্য পাশ করে বেরিয়েছেন। ঘাড়ত্যাঁড়ামি আর উল্টাপাল্টা কথাবার্তার জন্য ইতিমধ্যে দু’বার প্রিন্সিপ্যাল স্যারের ধাতানি খেয়েছেন। তাই পারতপক্ষে ক্যাচালে যান না। কিন্তু, কয়লা ধুলেও তো আর ময়লা যায় না, মুখ তাঁর ছুটলোই, “স্যার, (ফারুক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে) প্রভোকেশনের ব্যাপারটা একটু বুঝাই বলেন।”
ফারুক সাহেব বিজ্ঞের মত, একটু গলা পরিষ্কার করে, শুরু করেন, “প্রভোকেশন মানে উস্কানী দেয়া – এইটাতো জানো। মনে করো, এইখানে আমি তোমার ডাইরেক্ট টিচার। তুমি এক-দুইবছর আগে কেমন স্টুডেন্ট ছিলা, তোমার রেকর্ড কি, সব আমার জানা। এখন মনে কর, তুমি প্রেম করে বিয়া করতেস, মেয়ে পক্ষের লোকজন তোমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে। সেই সূত্রে ওরা আমার কাছ থেকে জানতে চাইল চাইল তোমার সম্পর্কে। আর আমি বলে দিলাম, ছেলেটা ভাল না, যার তার সাথে শোয়, মদ গাঁজার বদঅভ্যাস আছে, নেশার ঘোরে উল্টাপাল্টা বলে, দুইবার প্রিন্সিপাল স্যারের ওয়ার্নিং ও খাইসে – তখন তোমার কেমন লাগবে? ইচ্ছা করবে আমার বিরুদ্ধে কিছু করতে?”
“হুঁ” মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় মাসুদ। “তাহলে সাঈদকে রুমানা কিভাবে প্রভোকেট করল?”
“বুঝলা না?” ফারুক সাহেব একটু অবাক, একটু অধৈর্য্য, “একটা লোক বেকার, থাকে শ্বশুরবাড়িতে, অথচ বুয়েট পাশ – এমনিতেই ফ্রাস্টেশনের মধ্যে আছে। এর মধ্যে ওর বউ বিদেশী ছেলের সঙ্গে পরকীয়া করে, আর এখন বলতেসে পি এইচ ডি’র জন্য কানাডা চলে যাবে – এসবের পর আর মাথা ঠিক থাকে?”
“তাইলে তো স্যার আমরা খুব রিস্কের মধ্যে আছি!”
ফারুক সাহেব অবাক! “আমরা? রিস্কে? কেন?”
“মনে করেন, গড ফরবিড, যদি তানজীমা ম্যাডামের সাথে উনার হাসবেন্ডের কোন ঝামেলা হয়, আল্লা না করুক, উনাকে পিটায়ে তারপর কমপ্লেন করে যে, ম্যাডাম এখানে আমাদের সাথে গ্রুপ সেক্স করতেন – তাইলে? আপনারা তো বিয়া করসেন, আপনাদের ঘর ভাঙবে, আমার তো আর এই জীবনে বিয়াও করা হবে না!”
“ধেঃ মিয়া! এইসব কি উল্টাপান্টা কথা কও?” মাসুদের কথা উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন নাজমুল সাহেব, “কইলেই হইল নি?”
“হ্যাঁ নাজমুল ভাই, কইলেই হইয়া যায়। এই দেখেন না, এইখানে হইসে! হাসানের লোক পরকীয়ার শুধু অভিযোগ করসে, ওইটা সত্য না মিথ্যা কে জানে, আপনারা সবাই সেটারে বিনা প্রমাণে সত্য ধ্রুব সত্য মেনে নিয়ে রীতিমত প্রভোকেটিভ ফ্যাক্টর বানাই ফেলসেন! এমনও তো হইতে পারে যে পুরাটাই ভুয়া। অথবা এমনও হইতে পারে, ঐ ইরানী লোকটা আসলে স্রেফ থিসিসের কো-ওয়ার্কার, আমাদের মত সহকর্মী? অথবা জাস্ট ফ্রেন্ড? কিন্তু না, এইসব পজিটিভ কথায় রস নাই, রস আছে পরকীয়াতে। তাই সবাই ওইটাতেই লটকাই থাকবে। আচ্ছা, যদি পরকীয়াটাই সত্যি হয়, তারপরও তো এইটা এইরকম মাইরের প্রভোকেশন হয় না, এইটা বড়জোর ডিভোর্সের প্রভোকেটিভ ফ্যাক্টর হইতে পারে। ঐ বুয়েট পাশ ঘরজামাই কি ‘ডিভোর্স’ নামে কোন শব্দ শুনে নাই?”
মাসুদের সাথে অন্যদের তর্ক চলছেই। মিসেস তানজীমা কিছু বলছেন না। জানালা দিয়া বাইরে তাকিয়ে আছেন। সকাল থেকে রোদ পুড়িয়ে মারছিল, এখন আকাশজুড়ে মেঘের সম্রাজ্য। জানালা দিয়ে থেমে থেমে হলেও, আসছে ঠান্ডা বাতাসের ঝাপ্টা।