সিঁড়ির সামনে আলো আঁধারিতে রেলিঙে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে পার্থ। এটা হাসপাতালের পেছন দিকের সিঁড়ি – শুধু কর্মচারীরা, বিশেষত ক্লিনাররা ব্যবহার করে। তাই যত্ন কম, আলো অপ্রতুল, দেয়ালে, মেঝেতে থোকা থোকা কালশিটে, ফেনল-মাখা পচা, ভ্যাপসা একটা গন্ধ। অনেকগুলো বালতি, মেঝে মোছার সোয়াপ, ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, ভিম এর খালি প্যাকেট, হারপিক-ফিনিক্সের খালি বোতল স্তূপাকারে জমে আছে সিঁড়ির নীচে। পা দুটোকে বড্ড ভারী মনে হচ্ছে পার্থর। লিফটের দরজা বন্ধ হবার পর থেকে একটা ঘোরের মধ্যে আছে সে। চিন্তামগ্ন পায়ে এলোমেলো চলতে চলতে কখন এদিকে চলে এসেছে, সে হুঁশ ছিল না। সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ বড্ড ক্লান্ত অনুভব করতে শুরু করে পার্থ। কি এটা? রাতজাগা দৌড়ঝাঁপের ক্লান্তি? অপরাধবোধ? গ্লানি? হঠাৎ জেগে ওঠা বিবেকের কশাঘাত? কারও কষ্টের ভগ্নাশের গুণোত্তর হারে চেপে বসা? উদ্ভুত জটিলতার গোলকধাঁধায় হাঁসফাঁস? অথবা এর চেয়েও গভীরে, অনেক অতল গভীরের কোন স্থির কুঠুরীর হঠাৎ প্রচন্ড দুলে উঠে মড়মড় করে ভেঙে পড়া? দুটো এভারেস্ট টেনে টেনে তোলার সময়, ঐ নোংরা সিঁড়িতে, মরা আলোতে, বিবর্ণ দেয়ালের কুৎসিত অবয়বে পার্থ নিজের জীবনেরই প্রতিচ্ছবি খুঁজে পেতে থাকে। প্রতিটি মুহূর্তের অত অজস্র ভাঙনের পর, ক্ষয়াটে জীবনের এর চেয়ে ঝকঝকে আত্মপ্রকৃতি খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ভাবনারা যখন অ্যানাকোন্ডা হয়ে প্রবলভাবে চেপে বসে, থামিয়ে দিতে চায় পাঁজরের পেন্ডুলাম গতি, ঘষা কাঁচের মত রেটিনায় তখন নিজের বিম্বটিই বড্ড ঘোলাটে, বড্ড আবছা, বড্ড অচেনা লাগে।
“ডাক্তার তো বলল মোটামুটি আটচল্লিশ ঘন্টা অবজার্ভেশনে রেখে, সব ঠিক থাকলে নিয়ে যাওয়া যাবে।” মাহফুজ চেষ্টা করেই যাচ্ছে সবাইকে আশ্বস্ত করতে – খুব গুরুতর কিছুই হয়নি।
নীপুর পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন তার মা। অন্যান্যরা সোফায় বসে আলাপচারিতায় মগ্ন। নীপু আড়ষ্ট হয়ে আছে। মায়ের স্নেহস্পর্শে ঠিক সিক্ত হতে পারছে না, বিগলিত হতে পারছে না। মাথায় কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে মৌসুমীর কথা, অনন্যার কথা। অনন্যা – বন্ধুবৃত্তে নীপুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ – দুজনেই অন্তর্মুখী স্বভাবের হওয়াতে ওদের মধ্যে সখ্যতাও ছিল বেশী। সেইসব কথা, যা কখনও কাউকে বলা হয় না, বলা যায় না, নিজেদের মধ্যে ওসব কথার অর্গল খুলে যেত।
অনন্যার হঠাৎ বিয়ের পর, একটু একটু করে শুধু নীপুই জানতে পেরেছিল তার কষ্টের কথা, সমস্যা আর সংগ্রামের কথা। শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে, এমনকি স্বামী নামক লোকটিকে পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই অনন্যার ওপর চেপে বসেছিল “ভাল বৌ” হবার বাধ্যবাধকতা। অবশ্য ওদের দুজনেরই, পারিবারিক আবহ চিরকাল ঘাড়ে চেপে ধরে “মানুষ” হয়ে ওঠারও আগে “ভাল মেয়ে” হওয়ানোতে মত্ত, এমনকি কখনো কখনো উম্মত্ত ছিল। একদিকে প্রাতিষ্ঠানিক থেকে শুরু করে মিডিয়াতক – সর্বত্র ‘নারী’কে মনুষ্যপদবাচ্য করে তোলার আশাজাগানিয়া আপ্রাণ চেষ্টা, অন্যদিকে ঐতিহ্য অনুরাগী পরিবারের ততোধিক শক্তিতে পিছু টেনে ধরা; একদিকে আধুনিক হবার উদগ্র বাসনায় চিরচেনা চারপাশটার চোখের পলকে পাল্টে যাওয়া, অন্যদিকে অনুশাসনের বেড়াজালে আটকে স্বপ্নডানার বিরামহীন পালক ছাঁটা। এই দুই বিপরীত স্রোতের মাঝে তাল হারিয়ে, খেই হারিয়ে, নিজেকেই ঠিকমত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, নিজের অবস্থানটাই নিজের কাছে মরিচীকার মধ্যবিন্দু। সময়ের আবর্তনে সমাজে বিবর্তন এসেছে ঠিকই, কিন্তু অনেক নারীরই পরিবর্তন শুধু “মূর্খ” থেকে “শিক্ষিতা দাসী” হওয়া পর্যন্তই।
সবসময় অবদমিত হতে থাকা মানুষের স্বপ্নপূরণের দুঃসাহস থাকেনা, স্বপ্নগুলো স্রেফ অবসরের দুঃখবিলাসীতা। ওদের আবেগগুলো চারপাশের সাথে সংযুজিত না হয়ে, নিজস্ব একটা বদ্ধ ডোবায় ঘুরপাক খেতে থাকে। হয়তো এজন্যই, প্রথা আর অনুশাসনের কঠিন দেয়াল চিরে বাবা মায়ের সাথে ভালবাসার একটা সাবলীল যোগসূত্র কখনোই তৈরী হয়নি নীপুর। সম্পর্কটা শুধু দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের, কঠিন সব নিয়ম আর শৃঙ্খলার, আবেগের লেনদেন সেখানে অচল প্রায়। সন্তানকে বাবা মায়ের অথবা বাবা মা-কে সন্তানের, ভালবাসাটাও, সেখানে ‘উচিৎ’, অবশ্যপালনীয় কর্তব্যের অংশ বলে মনে হত নীপুর। একে মুখচোরা, তার ওপর এইসব শীলনোড়া চাপানোয়, খুব ধীরে ধীরে, বছরের পর বছর ধরে একটু একটু করে এক অনতিক্রম্য দূরত্বে সরে আসা, স্বনির্মিত নির্জনতায় সমর্পিত থাকা, আত্মবিশ্বাসহীন নীপু তবুও স্বপ্ন দেখত কোন একদিন ‘উদ্ধার’ পাওয়ার। সেই স্বপ্নটাও কখনও প্রবল হয়ে ওঠার সাহস পায়নি, পেতও না, চিরকাল মনের চোরা গলি ঘুপচিপথে ভবঘুরেপনা করেই নিঃশেষ হত, যদি অনন্যা না থাকত!
প্রতিদিন অনন্যার যুঝতে থাকা, প্রতিমুহূর্তে নিজের মূল্যহীনতা নতুন নতুন আদলে আবিষ্কারের বাধ্যতামূলক পৌনপুনিকতা ধীরে ধীরে নীপুকে অসহিষ্ণু করে তুলেছিল। অনন্যার অসহায়ত্ব কিংবা নির্বিকারত্ব তাকেই ক্রমশ এগিয়ে দিচ্ছিল একটা অদেখা অজানা স্ফুটনাঙ্কের দিকে। মাহফুজের জন্য নিজ ঘরে নীপুর লড়াই তাই যতটা না ভালবাসার, তারচেয়ে বেশী ছিল, ঐ একই পরিণামে সমর্পিত হওয়া থেকে পালিয়ে বাঁচার। এই বোধটুকু, তাড়নাটুকু, নীপুরও অজান্তে, তারই ভেতরে, অনেক গভীরে, অলক্ষে অদৃশ্যে থেকে তাকে চাবুক তাড়া করছিল। মাহফুজকে ঘিরে তার স্বপ্নগুলোও তখন ক্রমশ বাড়তে বাড়তে আকাশ ছাপিয়ে যেত, বাস্তব-অবাস্তবতার সম্ভাব্যতা কিম্বা সীমানা বিষয়ক হিসেব কখনো তার কল্পনার ত্রিসীমানাতেও আসে নি। মনের অথবা ব্যক্তিত্বের এই ভঙ্গুর কাঠামোই পরবর্তীতে তাকে কখনো “ডিভোর্স” এর মত সাহসী সিদ্ধান্ত নেবার জন্য যথেষ্ট শক্ত চৈন্তিক ভিত্তি যোগায়নি। পলায়নপর মানুষ কখনও স্বাধীন এবং সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
কিন্তু আজ আবার অনন্যা তাকে নাড়া দিয়ে গেল বুঝি! এমন নয় যে আজই প্রথম মাহফুজের হাত সচল হয়েছে, এমন নয় যে যতবার মাহফুজ যতবার নীপুতে উপগত হয়েছে, প্রতিবার নীপুর মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে – কিন্তু সেই সাড়ার থোড়াই তোয়াক্কা করেছে মাহফুজ। ইনসমনিক নীপুকে খুলে খাবলে নিয়ে মাহফুজ নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে পড়েছে, বিনিময়ের জন্য একটি শব্দও অপচয় না করে। এমনকি পার্থ না এলে, মাহফুজ যে কতটা অসম্পূর্ণ, সেটাও কখনো বোঝা হত না নীপুর। তবে এসব কিছুই নীপু আর মাহফুজের মধ্যকার দেয়ালের উৎসমূল ছিল না, এমনকি পার্থও নয়।
সেটা অন্য কিছু।
সেটা মাহফুজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা জঘন্য, নোংরা একটা কিছু, যেটা, হঠাৎ কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে দেখে ফেলার পর থেকে, মাহফুজ তার কাছে অচ্ছ্যুত, অস্পৃশ্য এক ঘিনঘিনে প্রাণী। এরপর থেকে, মাহফুজের স্পর্শমাত্র পেলেই তার গা গুলোতো। মাহফুজের শত চেষ্টাও তাকে, তার সেই সব কিছু, যা আগে নিমেষেই জানাতো আর্দ্র অভ্যর্থনা – তাদের জাগাতে পারত না, উল্টো প্রত্যাখ্যানের, অনীহার শুষ্কতা নিয়ে নীপু মড়ার মত পড়ে থেকে শুধু মনে মনে সমাপ্তির প্রতীক্ষা করত। অথচ এতসব কিছুর পরও ছেঁড়েছুঁড়ে বেরিয়ে আসার সাহসটুকু, আত্মবিশ্বাসটুকু নীপু নিজের মধ্যে জোটাতে পারেনি। মেরুদন্ডহীনতার চেয়ে ভগ্ন মেরুদন্ড অনেক বেশী বড় অভিশাপ!
“আম্মা, এ এমন কিছু না, ও একটু অবুঝ – এই আর কি! এসব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।” এতক্ষণ ধরে সবার কথাবার্তার বিন্দুবিসর্গও নীপু খেয়াল করেনি। মাহফুজের এই কথায় বোঝে, এরই মধ্যে নানান কথায় মাহফুজ মোটামুটি দেবত্ব অর্জন করে বসে আছে। নীপুর মধ্যে রাগের একটা স্ফুলিঙ্গ দেখা দিয়েই হতাশায় মিলিয়ে যায়।
“অন্যা মাথা ফাটাই ফেলসে, আর তুই মাইর খাই চ্যাপ্টা হইসস” – কে বলল? সুমী? না, নীপু – এই আওয়াজ নীপুর, তার নিজের ভেতরকার, দ্বিতীয়, কিম্বা তৃতীয়, কিম্বা কে জানে কততম, অন্য একটা সত্ত্বা।
“আটচল্লিশ ঘন্টাই কি থাকতে হবে?” মেজ চাচার ভরাট স্বরের প্রশ্ন।
বিপদমুক্তির স্বস্তির আতিশয্যে মানুষ কখনও সখনও বিরাট ভুল করে বসে, গাধামীটা করে বসে মাহফুজও। তাড়াতাড়ি বলে বসে, “আরে না চাচা, ডাক্তাররা একটু বেশীই বাড়াই বলে, অত সিরিয়াস না ... ... ...”
তামিম বলে ওঠে, “অতক্ষণ বেহুঁশ ছিল, সিরিয়াস না ক্যামনে?”
“আরে ওর তো বাসায়ই সেন্স চলে আসছিল!”
“তাহলে বললা যে হাসপাতালে আসার পর জ্ঞান ফিরসে? বাসা থেকে ফোনে বলসিলা জ্ঞান ফিরতেসে না?” নীপুর মা বেশ অবাক।
মাহফুজ এবার একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। প্রশ্নবোধক চাউনীগুলো থেকে বাঁচার জন্য তাড়াতাড়ি বলে, “নীপু আসলে চোখ বন্ধ করে রাখসিল, আমিই বুঝি নাই।” জোর করে একগাল হাসি মেশানো মাহফুজের কথাটা পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
সবগুলো দৃষ্টি এবার নীপুর দিকে, প্রশ্নের সাথে যোগ হয়েছে বিরক্তি। এবার নীপুর বাবা মুখ খোলেন, “এইটা তুমি কি করস নীপু? কাজটা তুমি একদমই ঠিক কর নাই। এতগুলো মানুষকে টেনশনে ফেলে দিসো!”
“নীপু অজ্ঞানের ভাণ করসিল?” নীপুর বাবার দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই নীপুর মায়ের ভ্রূকুটি নীপুর দিকে, “এর মানে কি নীপু? শুধু শুধু সবাইকে এত ঝামেলার মধ্যে ফেলস?”
এদের কাছে একটা মেয়েকে অপরাধী বানানো কত সহজ!
তামিম প্রশ্নটার পুনরাবৃত্তি করে, “বাসায়ই তোমার সেন্স আসলে তখন বল নাই কেন আপা? ভাণ করলা কেন?”
নীপুর উত্তর পুরো রুমে নিয়ে আসে পিনপতন নীরবতা। এতক্ষণ ধরে কথার পাহাড়ে চড়ে মাহফুজের অর্জন করা দেবত্ব এক লহমায় ধুলিস্যাৎ। জরুরী বিভাগে নীপুকে দেখার পর থেকে, সবার মনেই গুড়গুড় করা যে সংশয়-প্রশ্নটা ধামাচাপা ছিল, এই একটা কথায় তার সত্যতা প্রায় সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়।
আস্তে করে, নীপু শুধু এইটুক বলেছিল, “ভয়ে!”
(আগের পর্বগুলো )
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই জুন, ২০১১ রাত ৯:৫৬