“তুমি কখন আসলা?” নীপু খুব বেশী অবাক হয়নি পার্থকে দেখে।
কোমর পর্যন্ত আকাশী রঙের চাদরে ঢাকা, বাঁ হাতে স্যালাইন লাগানো। পরনে গত সন্ধ্যার পোষাকটাই। ডান চোখের নীচটা ঈষৎ নীলচে হয়ে ফুলে আছে, কপালের ডানপাশে আড়াআড়িভাবে ব্যান্ডেজ। গাল দুটোয় সরু লম্বাটে কিছু কালশিরা মতন দাগ, ওপরের ঠোঁটে দু’জায়গায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে, কোন ধরণের মলম লাগানো হয়েছে সম্ভবত, ক্ষত দুটো চকচক করছে। নীচের ঠোঁটের ভেতর থেকে হলদেটে আঁশ জাতীয় কি যেন – ভালভাবে খেয়াল করলে বোঝা যায়, সেলাই। দাঁতের ফাকে ফাঁকে জমাট রক্তগুলো পরিষ্কার করা হয়নি – বীভৎস! কি অবস্থা হয়েছে নীপুর!
“তোমার এই অবস্থা কিভাবে?” পার্থ বিহ্বল।
“সিঁড়ি থেকে পড়ে গেসিলাম” কৌতুক মেশানো স্বর নীপুর।
“সিঁড়ি থেকে? বল কি?” এটা বিশ্বাস করা পার্থর পক্ষে অসম্ভব।
“হুম! সেইরকমই তো প্রচার হইসে। এইখানে ডাক্তারকে বলসে, ফোন করে ওর আর আমার আব্বু আম্মুকে বলসে। মজার ব্যাপার কি জানিস, সবাই এটা বিশ্বাসও করসে!” এবার ফিক করে হেসে ফেলে নীপু, হাসতে গিয়েই সেলাইতে টান পড়ে আবার “উহ্!” করে নাক মুখ কুঁচকে মাথা নুইয়ে ফেলে, ডান হাত চট করে উঠে আসে ঠোঁটের কাছে।
পার্থ ত্বরিতে এসে নীপুর পাশে বসে। এক হাত তার কাঁধে, অন্য হাত চিবুকে, গালে। নীপুর মুখটা, তার ব্যাথাটা, ব্যাথার উৎসটা দেখতে চায় পার্থ, চায় স্পর্শ করতে। উঠে থাকা ডান হাতে নীপু নিজ চিবুকে পার্থর রাখা হাতের কব্জি মুঠো করে ধরে। কিন্তু মাথা ওঠায় না। নীপুর ফোঁপানো স্পষ্ট বুঝতে পারছে পার্থ, তার হাতের তালু ক্রমশ আর্দ্র, তার কব্জিতে নীপুর মুঠোর চাপ ক্রমবর্ধমান, স্যালাইন দেয়া হাতটা পার্থর অন্য হাতের শার্টের বাহুমূল খামচে ধরে। “নীপু, নীপু!” বলতে বলতে পার্থ নীপুর আরও ঘনিষ্ঠ। একটু পর, পার্থর বুকের বাঁ দিকটা নীপু ক্রমশ উষ্ণ ও সিক্ত করে তুলতে থাকে নীরবে নিঃসঙ্কোচে, ব্যাথার – সবরকম ব্যাথার – শরীরের, মনের, হতাশার, ক্ষোভের, ঘৃণার, অপমানের – সব ব্যাথার উদ্গীরণে। ঐ মুহুর্তের জন্য ওরা ভুলে যায়, ঠিক পাশের রুমেই ডিউটি ডাক্তারের সাথে আলোচনায় মগ্ন বাদল, বন্ধ দরজার ঠিক অন্য পাশে, রিসিপশন কাউন্টারের সামনে মুঠোফোনে কথোপকথনরত মাহফুজ; ভুলে যায়, চীনের প্রাচীরের দুই বিপরীত প্রান্তসীমায় প্রেথিত ওরা দু’জন!
হুড়মুড়িয়ে পার্থ আর বাদল ঢুকে পড়েছিল নীপুকে রাখা হয়েছিল যে রুমটায়, সেখানে। ফাইলে রোগীর নাম ঠিকানা ইত্যাদি দেখে বাদল নিশ্চিত হয়েছিল, এ নীপুই। মিনহাজ বেশ অবাক হয়েছিল পার্থ আর বাদলের প্রতিক্রিয়ায়। পরে অবশ্য তাকে বোঝানো হয়, নীপু ওদেরই বন্ধু। বাদল উল্টো মিনহাজকে মৃদু ধমক দেয় নীপুকে না চেনার কারণে। অবশ্য ওতে মিনহাজেরও খুব একটা দোষ নেই; বাদলের হোস্টেলে পার্থর ঘন ঘন যাওয়া আসা ছিল, নীপুর কখনোই নয়। হয়তো কখনো কাকতালীয়ভাবে দু’একবার দেখা এবং পরিচয় – সেটা মনে না থাকাই স্বাভাবিক।
ওরা দু’জন ঢোকার পর, বিশেষত পার্থকে দেখে মাহফুজের মুখে বিচিত্র একটা অভিব্যক্তি দেখা দিয়েই আবার মিলিয়ে যায় – যার অর্থ বাদল না বুঝলেও, পার্থ ঠিকই আন্দাজ করতে পারে। পার্থর প্রতিক্রিয়াও ছিল অস্বাভাবিক, “কায়সার ভাইয়ের কি অবস্থা কে জানে!তুই এখানে থাক, আমি আসতিসি” বাদলকে বলেই চট করে ওখান থেকে চট করে পার্থ বেরিয়ে যায়। নীপুর সাথে, মাহফুজের সাথে কোন কথাই না বলে অমন হুট করে বেরিয়ে যাওয়াটা বাদলের কাছে বড় বেশী কিম্ভূত ঠেকে।
নীপু তখন চোখ বুঁজে আধশোয়া, তার মাথায় এক হাত রেখে অন্য হাতে মোবাইল ফোন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মাহফুজ। বাদল ধীর পায়ে ওদের কাছে আসে। অসংখ্য ভাবনার লাগামছাড়া মিথষ্ক্রিয়া তখন দু’জনের মাঝে। বাদল একবার দেখছিল নীপুকে, একবার মাহফুজকে। এই জুটিটা প্রেম করে বিয়ে করেছিল। শুধু প্রেম করে নয়, রীতিমত বাধা-বিপত্তির আল্পস পেরিয়ে এরা নিজেদের মোহনা গড়েছিল। নীপুর গোঁড়া, প্রাচীনপন্থী, রক্ষণশীল পরিবার কিছুতেই মেনে নিতে চায়নি সম্পর্কটা। বিয়ের আগে, প্রায় প্রতিদিন বাসা থেকে ফিরে বিষন্নতায় ডুবে থাকত নীপু; প্রতিদিন বাবা মায়ের সাথে, যৌথ পরিবারের আরও অনেক উপযাচক মুরুব্বীর সাথে তর্কে-ঝগড়ায় মেয়েটা ক্ষত বিক্ষত হত এই মানুষটার জন্য! এই লোকটার জন্যই নীপু নিজের বাবা মায়ের বিরুদ্ধ-জেদকে জব্দ করার অপচেষ্টা চালিয়েছিল গোটা বিশেক সেডিল ট্যাবলেট (ঘুমের বড়ি) খেয়ে! এই দিনটার জন্য!
পার্থকে দেখেই চিড়বিড় করে উঠেছিল মাহফুজের মেজাজটা। ভেরুয়াটা পালিয়ে যাওয়ায় রাগটাকে আপাতত ধামাচাপা দেয় মাহফুজ। মাঝরাত্তির থেকেই একটা পরাস্ত, অপরাধী ভাব চেপে বসেছিল তার ওপর। পানি ছিটিয়ে যখন নীপুর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছিল, তখনও অশ্রুপাত ছিল অনর্গল। নিজের অদৃষ্টকে শাপ-শাপান্ত করতে করতে শত চেষ্টাতেও নীপুর জ্ঞান ফেরাতে না পেরে, ক্রমশ একটা ভয় তার মন-মগজে কালো ডানা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছিল। আর সবকিছু ছাপিয়ে তখন নিজের সম্ভাব্য বিপদ অথবা ঝামেলার চিন্তাই মুখ্য হয়ে ওঠে তার মধ্যে। সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার চেয়ে নিখুঁত কোন গপ্পো আর তখন ফাঁদতে পারেনি, নিজের আর নীপুর বাবার সাথে মুঠোফনে কথা বলার সময়। বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরে হওয়া সত্ত্বেও শহরের সেরা প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে আসার পেছনেও সেই সম্ভাব্য সন্দেহ আর অভিযোগ থেকে দায়মুক্তির তাড়নাটাই কাজ করছিল বেশী।
বাদলের সাথে করমর্দনের জন্য মাহফুজ যখন হাত বাড়ায়, তখন বাদল প্রশ্ন করে, “এই অবস্থা কিভাবে?” সম্ভবত তার আওয়াজ শুনেই চোখ মেলেছিল নীপু, “কিরে, তুই? তোরেও কি ও খবর দিসে?” মাহফুজ হাল্কা একটা ধাক্কা খায়। ‘তোরেও’ মানে? তার মানে কি অন্যান্যদের ফোন করার সময় নীপু সচেতন ছিল? মানে হাসপাতালে এসে নীপুর জ্ঞান ফেরেনি, অনেক আগেই ফিরেছিল! এবং সে তাহলে শুনেছে মুঠোফোনে মাহফুজের সমস্ত কথোপকথন! প্রথমে পিঠে একটা বরফ গড়িয়ে উঠে আসে, ঘাড়ে একটা ঠান্ডা ঝাপ্টা, এরপর মাথার ভেতর সব এলোমেলো জট পাকিয়ে যায়।
“নাহ্! অন্যাদের বাসায় ডাকাত পড়সিল। কায়সার ভাই সিরিয়াসলি উন্ডেড। উনাকে নিয়ে আসছি।”
“বলিস কি? কি অবস্থা উনার? অন্যা ঠিক আছে?”
“অন্যা ঠিক আছে। কায়সার ভাই মাথায় আঘাত পাইসে, এখনও জ্ঞান ফেরে নাই। ওদের কথা রাখ, তোর বাসায়ও কি ডাকাত পড়সিল? মাঝরাইতে সিঁড়িতে উষ্ঠা খাইলি ক্যাম্নে?”
তাড়াতাড়ি উত্তর দিতে শুরু করে মাহফুজ, “ আর বইল না! আমার সাথে ঝগড়া করে, বলে বাপের বাড়ী চলে যাবে। রাত দেড়টার সময় ঘর থেকে বাইর হয়ে যাইতে নিসে। আমি ওকে আটকাইতে গেসি, দৌড়াইতে গিয়ে সিঁড়িতে হোঁচট খাই পড়সে।”
মৌনতা সবসময় সম্মতির লক্ষণ নয়, সেটা তখন নীপুকে দেখে বাদল বেশ বুঝতে পারে। হঠাৎ ভুঁইফোঁড় রাগে কথা হারিয়ে ফেলে বাদল। কোন সৌজন্যের ধার না ধরে গটগট করে রুম থেকে বেরিয়ে পাশের ডিউটি ডাক্তারের রুমে মিনহাজের সামনে বসে পড়ে বাদল। সজাগ নীপুর সামনে অস্বস্তিতে পড়ে যাওয়া মাহফুজ “এখানে নেটওয়র্ক সমস্যা” বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল। নীপু কিছু বলতে গিয়েও বলে না। লোকটা বেরিয়ে গেলে, স্বস্তির একটা দীর্ঘশ্বাস বেরোয় তার বুক থেকে।
নীপু আর পার্থ কতক্ষণ পরষ্পরে সমর্পিত ছিল, তার হুঁশ ছিল না ওদের দু’জনের কারুরই। হঠাৎ জরুরী বিভাগের ওপাশের রুমে অনেকগুলো কন্ঠের সম্মিলিত আওয়াজে সম্বিৎ ফেরে তাদের। নীপুর চোখ মুছে দরজার দিকে তাকাতেই পার্থ পাথর বনে যায়। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে, নীপুরও একই দশা।
দরজাটা আসলে পুরোপুরি বন্ধ ছিল না। এক হাত মতন হা করে ছিল।
দরজার ওপাশে, ওদের দু’জনের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে, দাঁড়িয়ে ছিল মাহফুজ।
(আগের পর্বগুলো )
(চলবে)