somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পারভার্ট – ১৩

০৯ ই মে, ২০১১ রাত ৮:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আলো আঁধারী মেশা করিডোরের দুই প্রান্তে নির্বাক তিনটি প্রাণী। পার্থ আর বাদলকে দেখে প্রথমে প্রচন্ড অবাক হয়েছিল কায়সার। এখন, খুব বিচিত্র হলেও, কিঞ্চিৎ ভয়ও পাচ্ছে সে। কোনরকম হিসেব নিকেশেই এদের উপস্থিতিটাকে মেলাতে পারছে না। যদি অনন্যার কথা শুনেই এসে থাকে তার এই দুই বন্ধু, উঠতি বয়সের, স্থানীয় ছেলে, এর মধ্যে একজন আবার প্রায় ছাত্রনেতা গোছের, তার দশাসই গড়ন, এরপর আবার বড্ড নিকটবর্তী তার মেডিকেল কলেজ; সর্বোপরি আজ কায়সার একা, বাসায় কেউ নেই – সুতরাং ভয়টাকে খুব অমূলকও বলা যায় না। কারও কারও ওপর ভয়টা সবচেয়ে বেশী ভর করে পায়ে এবং গলায়, কায়সারের এখন সেই দশা।

কায়সারকে দেখে পার্থ এবং বাদলও খানিকটা হোঁচট খেয়েছে। যার খোঁজ নেয়ার উদ্দেশ্যেই মূলত এই বাসায় আসা, ঠিক এভাবে তার মুখোমুখি হওয়ায় কিছুটা ‘চোর-ধরা-পড়ে-যাওয়া’র মত অনুভব কাজ করতে থাকে ওদের মধ্যে। সহসা কথা খুঁজে পায়না কেউই।

“তোমরা এখানে কি কর?” খসখসে গলায় অনাবশ্যক জোর ঢেলে নীরবতা ভাঙে কায়সার। ভয় লাগানোর তাগিদটা ভীত মানুষের মধ্যেই সবচেয়ে বেশী।
দ্রুত চমক কাটিয়ে ওঠে পার্থ, “কায়সার ভাই, আপনি ঠিক আছেন?”
কায়সার মনে মনে দ্রুত হিসেব করার চেষ্টা করে, কি বলবে, কি বলা উচিৎ। কিন্ত, শরীর দুর্বল, আসার পথেই একবার বমি হয়েছে, মাথা ঘুরিয়ে অন্ধকার লাগাটাও আগের চেয়ে ঘন ঘন হচ্ছে। সামনে এগুতে গিয়ে অনুভব করে, পা কাঁপছে। তবু গলার জোরটা চাঙা রেখে বলে, “আমি ঠিক আছি, কিন্তু তোমরা এসময়ে এখানে কেন?”
চমকের ঘোরটা বাদলও কাটিয়ে উঠেছে, “আমরা শুনসিলাম, আপনি ইনজুরড, তাই আসছি। এখন কি অবস্থা?”
“কে বলসে আমি ইনজুরড? অনন্যা? ও কোথায়?”
“ও এখন সুমীর বাসায় আছে। আপনি আগে ভিতরে আসেন।”

কায়সারের বাসায় কায়সারকেই প্রবেশের আমন্ত্রণ বহিরাগত বাদলের। দু’এক পা করে ওরা এগুচ্ছে কায়সারের দিকে।
কায়সারও পায়ের কাঁপুনি সামলে, চোয়াল চেপে, ঋজু ভঙ্গীতে এগোয়। “অন্যা মৌসুমীর বাসায়?” কথা খুঁজে না পেয়ে মাত্র শোনা কথাটাই প্রশ্ন আকারে ফিরিয়ে দেয়া।
“হ্যাঁ, সুমীর সাথেই আছে। ও-ই বলসে আপনার কথা ... ...” বাদলের কথা শেষ হয় না, দেখে, হঠাৎ তাল হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে যাচ্ছে কায়সার। এই রাতে দ্বিতীয়বারের মত একজন পড়ন্ত মানুষকে বাঁচিয়ে দিল বাদল। ছুটে এসে পার্থও তাকে সাহায্য করে। দু’জনে মিলে ধরাধরি করে অন্ধকার ড্রইংরুমের লম্বা সোফাটায় শুইয়ে দেয়। বাদল পার্থকে বলে, “তুই চটজলদি একটা ট্যাক্সি নিয়ে আয়, রয়েলে।”
“রয়েল হসপিটাল? কেন? সে তো অনেক দূর! তোদের মেডিকেল কলেজটাই তো কাছে!”
“কাছে ঠিক আছে, কিন্তু, হেড ইনজুরী কেস, আই সি ইউ সাপোর্ট লাগতে পারে, আমাদের ওখানে আই সি ইউ ফাঁকা পাবার চান্স খুবই কম, নাই বলতে গেলে।”
“ঠিক আছে” বলতে বলতে পার্থ ছুটে বেরিয়ে যায়। বাদল ব্যস্ত হয়ে পড়ে কায়সারের শুশ্রুষায়।

.

“কি হইসে?” অনন্যার আওয়াজে, চাউনীতে উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট।
“কায়সার ভাইকে রয়েলে নিয়া যাইতেসে।” ফোন কেটে মৌসুমী উত্তর দেয়। “বোধহয় কাছে কোন জায়গা থেকে নিজে গিয়ে ব্যান্ডেজ করাইসিল, ঘরে ঢুকে ওদের সাথে দেখা, এরপরই হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেসে।”

অনন্যার দু’চোখ জুড়ে ভর করে শূন্যতা। যে মানুষটাকে এক মুহুর্ত আগ পর্যন্ত প্রচন্ডভাবে ঘৃণা করছিল, এখন তারই জন্য বুকের ভেতর এমন করে মুচড়ে উঠল কেন?
“রয়েলে?” অনন্যা নিজেও ঠিক নিশ্চিত নয়, কেন প্রশ্নটা তার মুখ দিয়ে বেরুল।
“হুঁম! বোধহয় আই সি ইউ সাপোর্টের কথা চিন্তা করসে।” চিন্তান্বিত মৌসুমী ঠোঁট কামড়াতে থাকে।
“আই সি ইউ? অবস্থা কি বেশী খারাপ?” অনন্যার উদ্বেগের পারদ চড়তে থাকে ওপরে।
“সেটা তো তোরই ভাল জানার কথা!” খোঁচা মারা কথা বলা যদিও মৌসুমীর প্রায় অভ্যাসের পর্যায়ে, তবুও এইখানটায় তার নিজের কাছেই নিজের কথাটা অযথার্থ মনে হয়।


ঘাড় বাঁকা করে, মাথা নুইয়ে, অনন্যা নিজের নখ খুঁটতে থাকে। কায়সারের রক্তাক্ত, নিথর দেহটা যখন বিছানায় পড়ে ছিল, তখন তাকে দেখে অনন্যার ন্যূনতম বিকার হয়নি। বিছানা থেকে নেমে গুটিশুটি পাকিয়ে কিছুক্ষণ প্রচন্ড শরীরি যন্ত্রণায় কান্না করেছিল; তারপরই তাকে চেপে ধরেছিল অদ্ভুত এক ভয়। কায়সারের কাছে গিয়ে অন্তত এইটুকু দেখা – মানুষটা বেঁচে আছে, না মরে গেছে – সাহস জোটেনি। কোনরকমে হাত বাড়িয়ে আলনায় ঝোলানো পোশাকটা টেনে নেয়। নির্জন ঘরটায় একা একটা লাশের সাথে – অনন্যা ঐ মুহুর্তে ধরেই নিয়েছিল, মরে গেছে লোকটা – থাকাটা দুর্বিষহ মনে হচ্ছিল তার। উদ্‌ভ্রান্তিতে ঠাসা মন ও মগজে তখন একটাই তাড়না, পালাও! যেন পালিয়ে গেলেই বেঁচে যাওয়া যায়। সংক্ষুব্ধ সময়ের মাকড়সা জালের মাঝে হাঁসফাঁস করতে থাকা মানুষ যেমন এলোপাথাড়ি ছুটতে চায়, লুকোতে চায় নিজের কাছ থেকে, আড়াল হতে চায় নিজের ছায়া থেকেও, নিজের প্রতিবিম্ব দেখেও আঁৎকে ওঠে, শেষ নিঃশ্বাসটুকু বুকে আটকে ডুবতে থাকা মানুষ যেমন প্রবলভাবে হাত-পা ছুঁড়তে থাকে বাঁচতে চাওয়ার আদিমতম সহজাত প্রবৃত্তিতে, কিসের যেন তুমুল তোড়ে অনন্যাও তখন তেমনিভাবে খাবি খেয়ে যাচ্ছিল। এইসব সময়ে মানুষ হয়ে ওঠে স্রেফ একটা প্রাণী – টিকে থাকার মৌলিক তাড়না সর্বস্ব একটা অস্তিত্বমাত্র। তার কেবলই মনে হতে থাকে, কোনভাবে এই ইট-কাঠের খাঁচা থেকে ছিটকে বেরুনোটাই জরুরী।

পোশাক পরা হয়ে গেলে আরেকবার চোখ ফিরিয়েছিল কায়সারের দিকে। ‘সে কি মরে গেছে? যদি মরে না যায়? যদি এখনই আবার উঠে হুঙ্কার ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে?’ শংকাগুলো অন্য সব ভাবনার প্রবেশ দুয়ার রুদ্ধ করে অনন্যাকে মাতাল করে তুলছিল। মানুষের মধ্যে সম্ভবত ভয় এবং ঘৃণার তীব্রতা সবচেয়ে বেশী। নিয়ন্ত্রণহীন কাঁপুনি নিয়ে টলমলে পায়ে বেডরুমের দরজার দিকে এগুতেই তাল হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অনন্যা। ওঠার সময় হাতের তালু আর মেঝের মাঝে মুঠোফোনের উপস্থিতি টের পেতেই তাকে মুঠোবদ্ধ করে ফের হাঁচড়ে পাঁচড়ে দাঁড়িয়ে, আর একবারও পেছন ফিরে না তাকিয়ে, ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে পড়েছিল অনন্যা।

কলাপসিবল গেট পেরুতেই খোলা বাতাসের ঝাপ্টা। প্রতিটা নড়বড়ে পদবিক্ষেপের সাথে গুণোত্তর হারে বাড়ছিল অনন্যার ঘৃণা, ক্ষোভ আর রাগ। কি অদ্ভুত স্বার্থপর মানুষের মন! প্রতি মুহুর্তেই অনন্যার অনুভবে বড় হয়ে উঠছিল কায়সারের বিকৃতি, কায়সারের ধর্ষণ, কায়সারের কুৎসিত অবয়ব। তখন তো একবারের জন্যও চিন্তাটা হয়নি – যেটা এখন, মৌসুমীর কথা শোনার পর হচ্ছে। কোত্থেকে এসে জুটল এই অপরাধবোধ? এই উৎকন্ঠা? তাও সেই লোকটার জন্য, যে কিনা মাত্র ক’প্রহর আগেই তার পাশবিক বিকৃতি আর জান্তব বীভৎসতায় ছিন্নভিন্ন করেছিল তাকেই। কেন এখন নিজের ওপর বয়ে যাওয়া সমস্ত ঝড়কে ছাপিয়ে নিজের অনুভবে, নিজের বিচার এবং বিবেচনার আতশ কাঁচের নীচে নিজ কৃতকর্মটাই অনেক বেশী নারকীয় চেহারা নিয়ে বিকট হয়ে উঠছে?

প্রথমে মায়ের, এরপর অনিমেষের সাথে বেশ একচোট চোটপাট সেরে নিজের রুমে ঢোকে মৌসুমী। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় অনিমেষ যারপরনারই বিরক্ত। তারচেয়েও মহাবিরক্ত মৌসুমীর মা। কিন্তু মৌসুমীর যুক্তির আর প্রশ্নের মুখে তার কথা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় ছিলনা কারুরই। চোখ ডলতে ডলতে অনিমেষ বেরিয়ে যায় ট্যাক্সীর খোঁজে। অনন্যার কাছে এসে তার পিঠে দুটো মৃদু চাপড় দিয়ে মৌসুমী বলে, “চল, রয়েলে চল!”



(আগের পর্বগুলো )



(চলবে)
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারত থেকে শেখ হাসিনার প্রথম বিবৃতি, যা বললেন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৩২



জেলহত্যা দিবস উপলক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (২ নভেম্বর) বিকালে দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এটি পোস্ট করা হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখানে সেরা ইগো কার?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪






ব্লগারদের মাঝে কাদের ইগো জনিত সমস্যা আছে? ইগোককে আঘাত লাগলে কেউ কেউ আদিম রোমান শিল্ড ব্যবহার করে,নাহয় পুতিনের মত প্রটেকটেড বুলেটপ্রুফ গাড়ি ব্যবহার করে।ইগো আপনাকে কোথায় নিয়ে গিয়েছে, টের পেয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবং আপনারা যারা কবিতা শুনতে জানেন না।

লিখেছেন চারাগাছ, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮

‘August is the cruelest month’ বিশ্বখ্যাত কবি টিএস এলিয়টের কালজয়ী কাব্যগ্রন্থ ‘The Westland’-র এ অমোঘ বাণী যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এমন করে এক অনিবার্য নিয়তির মতো সত্য হয়ে উঠবে, তা বাঙালি... ...বাকিটুকু পড়ুন

=বেলা যে যায় চলে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৪:৪৯



রেকর্ডহীন জীবন, হতে পারলো না ক্যাসেট বক্স
কত গান কত গল্প অবহেলায় গেলো ক্ষয়ে,
বন্ধ করলেই চোখ, দেখতে পাই কত সহস্র সুখ নক্ষত্র
কত মোহ নিহারীকা ঘুরে বেড়ায় চোখের পাতায়।

সব কী... ...বাকিটুকু পড়ুন

মার্কিন নির্বাচনে এবার থাকছে বাংলা ব্যালট পেপার

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০২৪ বিকাল ৫:২৪


আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাংলার উজ্জ্বল উপস্থিতি। একমাত্র এশীয় ভাষা হিসাবে ব্যালট পেপারে স্থান করে নিল বাংলা।সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর খবর অনুযায়ী, নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ব্যালট পেপারে অন্য ভাষার সঙ্গে রয়েছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×