“আমি সকাল হলেই চলে যাব।” এতক্ষণ পর, নিজ থেকে অনন্যা মুখ খোলে। মৌসুমীর পাশে শুয়ে, স্থির দৃষ্টি সিলিঙে তাক করে, খুব শান্তভাবেই কথাটা বলে।
সারা শরীরের ব্যাথা এখন অনেকটাই কমে এসেছে। এম আর-দের দেয়া একটা ব্যাথার ইঞ্জেকশন ছিল মৌসুমীর কাছে। ওটা দেয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর, ব্যাথার তীব্রতা বেশ খানিকটা কমে এসেছে। টানটান স্নায়ুগুলোও এখন থিতিয়ে পড়েছে অনেকটা। অবসন্নতা একটু একটু করে নিজেকে ছড়িয়ে দিচ্ছে অনন্যার মাঝে। শুধু নচ্ছাড় ভাবনাগুলো এখনও চড়বড় করে যাচ্ছে মাথার ভেতর। বন্ধুদের, বিশেষত মৌসুমীকে একটা উটকো ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলায় এখন অনুতাপ হচ্ছে খুব। যা কিছু ঘটেছে, তার অনুবর্তী হতে পারে অনেক অনেক কদর্যতা – অনুমান করে অনন্যার দুশ্চিন্তার পরতগুলো আরও পুরু হয়ে ওঠে।
“কই যাবি?” মৌসুমী উপুড় হয়ে বালিশে মাথা কাৎ করে অনন্যার দিকে মুখিয়ে অনন্যার কাঁধে হাত রেখে শুয়ে ছিল। ঘুম আসছিল না মৌসুমীর, কিন্তু ক্লান্তিও কাটছিল না। তক্ষুনি আলোচনায় যাওয়ার উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছিল না সে, বরং এই কথায় একটু বিরক্তই হয়।
অনন্যা মৌসুমীর প্রশ্নের উত্তর হিসেবে একটা দীর্ঘঃশ্বাস ঠেলে দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, “কালকে তোর ডিউটি আছে, সকালে?”
মৌসুমীর চেপে রাখা বিরক্তি তার কুঞ্চিত ভ্রু-তে খানিকটা বেরিয়ে পড়ে, “হুঁম! কেন?”
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর অনন্যা উল্টোদিকে পাশ ফিরে শোয়, “তোর সাথেই বাইর হব কালকে।”
“বাইর হবি মানে? কই যাবি?” কথার মাঝে বিরক্তির ঝাঁজটা এবার স্পষ্ট।
“কাজ আছে।” অনন্যার আওয়াজ নিভু নিভু ।
“কি কাজ?” প্রশ্নটা করেও কোন উত্তর না পেয়ে প্রথমে একটু উঁচু করে মৌসুমী ফের একই প্রশ্ন করে। অনন্যা এবারও নিরুত্তর। এবার অনন্যার কাঁধ টেনে তাকে চিৎ করে শুইয়ে অন্য হাতের কনুইয়ের ওপর ভর করে অনন্যার দিকে কাৎ হয়ে মৌসুমী এবার বেশ কড়াভাবেই প্রশ্ন করে, “তুই ঘটনা কি আমারে একটু বল তো! মাঝরাইতে জামাইর পিটা খাই ঘর থেকে ভাগসস, এখন আবার বলতাসস সকালে কি কাজে কই যাবি – হইসেটা কি? তুই কি সকালে তোর বাসায় ফেরৎ যাবি?”
“আমি থাকাতে কি তোর খুব বেশী ঝামেলা হইতেসে? হইলে বল, আমি যাইগা ... ...” অনন্যার কন্ঠস্বরে ঈষৎ আর্দ্রতা।
“এক থাপ্পড় দিব ধরি! বালের ঢং দেখলে মেজাজ খারাপ হয়। অইন্যা, তুই সোজা কথা বলতে জানস না?”
জবাব না দিয়ে অনন্যা মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়।
“কালকে আমার শুধু মর্ণিং ডিউটি আছে, তিনটার সময় আমি বাসায় চলে আসব। এর আগে তুই কোনখানে যাওয়ার চিন্তাও করবি না।” মৌসুমীর স্পষ্ট শাসন।
অনন্যা কাঠ হয়ে আছে, নিরুত্তর।
“আঙ্কেল আন্টি জানে কিছু?” মৌসুমী প্রসঙ্গ পাল্টায়।
মাথা নাড়িয়ে “না” জানায় অনন্যা।
“ভাল করসস। এত রাতে উনাদের জানানো ঠিক হইত না। দেখি, কালকে সকালেই উনাদের ফোন করব।”
“না, কক্ষনো না!” হঠাৎ যেন জোর পায় অনন্যার গলা।
“কেন?”
“খবর্দার তুই ওদের কিচ্ছু বলবি না। আপদ বিদায় করে ওরা শান্তিতেই আসে।”
এবার মৌসুমী চুপ।
বিয়েটা অনন্যা মেনেই নিতে পারেনি। আগাগোড়া ঐ সময়টা অনন্যা বিয়ে সংক্রান্ত, নিজের মতামত সংক্রান্ত কোন কথাই বলেনি। জেদ থেকে, ক্ষোভ থেকে, অভিমান থেকে অদ্ভুত এক নির্বিবাদের চাদর নিজের ওপর চেপে ধরে রেখেছিল সে। ঐ অভিমানজনিত প্রতিক্রিয়াহীনতাকে সবাই “বাধ্য মেয়ে, লক্ষী মেয়ে” ইত্যাদি ভেবে খুশিই হয়েছিল। শুধু গ্রাম থেকে ফেরার আগের রাতে, অনেক নিশুতি একটা রাতে, মাকে খুব ছোট্ট করে শুধু এইটুকুই বলেছিল, “আমি কি তোমাদের ওপর এতটাই বোঝা হয়ে গেসিলাম?” মা হয়তো মেয়ের মন বুঝেছিলেন। তাই সনাতনী কায়দায় যুক্তির ফল্গুধারা ছোটানোর পরিবর্তে নিরুত্তর থেকে অনন্যার অভিমানকে স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে অন্তর্মুখী মেয়েটা নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিল চীনের প্রাচীরের অন্যপাশে।
বিয়ের পর চার বছরে একবারের জন্যও বাবা মায়ের কাছে যায়নি অনন্যা। ফোনে যোগাযোগ হত, অথবা মাঝে মাঝে অনন্যার শ্বশুরবাড়িতে তার বাবা মা এলে দক্ষ হাতে নিপুণ, পাকা গিন্নীর মত নিখুঁত আপ্যায়ন করত অনন্যা। এই অতি-আতিথেয়তা যে সৃষ্ট দেয়ালকে পুরু করারই একটা প্রয়াস, সেটা তার বাবা টের না পেয়ে আনন্দিত হলেও, মা ঠিকই শেলবিদ্ধ হতেন। সময়ের সাথে সাথে মান অভিমানগুলো ধুয়ে মুছে যেতে পারত, যদি শত সহস্র চেষ্টার পরও অনন্যা কায়সারের সাথে, কায়সারের পরিবারের সাথে একাত্ম হয়ে যেতে পারত। রুচির, মননের ব্যবধান যখন যোজন যোজন, একই ছাদের নীচে থেকেও মিলেমিশে যাওয়াটা তখন দুষ্কর। সমঝোতারও তো একটা সীমা আছে!
নিজের রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ-কষ্ট-অভিমান-হতাশাগুলো নিজের মধ্যেই গোরস্থ করতে অভ্যস্ত অনন্যা তবু মাঝে মাঝে ক্ষণিকের জন্য হলেও, মনের ঝাঁপিটা কিঞ্চিৎ খুলে দিত শুধু নীপুর কাছে। সুতরাং আজ কোথাকার পানি কতদূর গিয়ে গড়ানোর পর অনন্যা নিগড় ভেঙে উদ্দেশ্যহীনতায় উৎক্ষিপ্ত হয়েছে, তা তার বন্ধুদের ধারণারও বাইরে।
“কিন্তু এখন সিচুয়েশনটা চিন্তা কর। আগে পরে ওঁরা তো ঠিকই জানবেন। পরের মুখ থেকে শোনার চেয়ে ... ...” মৌসুমী, সাময়িক স্তব্ধতার পর আবার সচেষ্ট হয়, কিন্তু কথা কেড়ে নেয় অনন্যা, “আমি বললেও সেটা পরের মুখে শোনার মতই হবে!”
“অন্যা! এত বছর আগের একটা রাগ, জেদ ধরে রাখার কোন মানে হয়? ওদের না বললে ... ...”
“কেন বলব ওদের? কি বলব? আর বললেই ওরা বিশ্বাস করবে? ওরা আবার ওদের আদরের জামাইকে ডেকে মেয়ের কথার সত্যতা ভেরিফাই করবেনা? মেয়ে মিথ্যাবাদী হইতে পারে, কিন্তু জামাই সবসময় বাই ডিফল্ট সত্যবাদী যুধিষ্ঠির!”
দম নেয়ার জন্য একটু থেমেছিল অনন্যা। এবার উঠে বসে, প্রথমে অনন্যা, তারপর মৌসুমী। অনন্যার চোখ জ্বলছে, “তুই বলসিলি না, কালকে কই যাব? থানায় যাব, সারেন্ডার করতে।”
“কি বলতাসস তুই এগুলা উল্টাপাল্টা?”
“ওর মাথা ফাটাই দি আসছি। বাইর হবার সময় বেহুঁশ পড়ি ছিল। বাঁচি আসে না মরি গেসে, জানিনা।”
“অইন্যা!”
“অনেক রক্ত বাইর হইসে। বাসায় আর কেউ নাই, ওর মা, ভাই, বোন – সবগুলা গ্রামের বাড়ী গেসে ... ...”
“অন্যা তুই কি করসস? তুই জানস তুই কি বলতেসস? ... ...”
“মনে হয় বাঁচবে না ... ...”
“অইন্যা, তোর মাথা ঠিক আছে? ... ...”
“মালেশিয়ান ফুলদানীটা দি মারসিলাম ... ...”
“তুই করসসটা কি? এখনও কি ঐভাবে পড়ি আসে?”
“মরে গেলে তো মার্ডার কেস হবে, না?”
“বাসায় আর কেউ নাই, অন্যা?”
“আমি এখানে না আসি সোজা থানায় গেলে ভাল হইত, খামাখা তোদের গ্যাঞ্জামে ফেলাই দিসি।”
“অন্যা, অন্যা, (এবার মৌসুমী দু’হাতে অনন্যার দু’গাল শক্ত করে চেপে ধরে নিজের দিকে মুখ ফেরায়) অন্যা! তুই ঠিক করি বল, আসলে কি হইসে? তুই কি করসস? ক্যান করসস? প্লীজ অন্যা!”
অনন্যার চোখের শিখা নিভে সেখানে শিশির জমে।
“ও আমাকে রেপ করসে। আমি ওকে মারি পালাই আসছি।”
(চলবে)