“খাবি কিছু?” রাতে কিছু না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ায়, এখন ক্ষিধেটা বেশ জোরালোভাবেই নিজের হাজিরা জাহির করছে মৌসুমীর পেটে। হাঁটুতে মুখ গুঁজে রেখেই মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানিয়ে দেয় অনন্যা। “মা, তুমি একটু ওর কাছে বস, আমি একটু আসতিসি।” মৌসুমী উঠতে যাচ্ছিল, তার মা বাঁধা দিয়ে বলেন, “তুই বয়, আমি খাবার নিয়ে আসি। অনি, তুই শুয়ে পড়গে, যা।” অনিমেষ যথারিতী উল্টোটা করে – মৌসুমীর রুমের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, এখন বিছানায় উঠে অনন্যার কাঁধে হাত রাখে, “কি হইসে আপু?” অনিমেষের প্রশ্নের উত্তরে অনন্যা মাথা তোলে, দেয় পান্ডুর, ম্লান একটা হাসি, বেশ কষ্ট করেই। “অনি, তুই যা, সকালে কথা বলিস। অন্যারে এখন একটু ঘুমাইতে দে।” মৌসুমী জানে, এত লোকের উপস্থিতি অনন্যার সহজ হওয়াটাই অসহজ করে দেবে। অনন্যার বিধ্বস্ত মুখটাই অনেক প্রশ্নের উত্তর অনুমান করে নেয়াটা সহজ করে দিয়েছিল। সুতরাং তক্ষুনি অগুণতি অপ্রিয় প্রশ্নের ঘাড়ে চেপে বসা থেকে আপাত রেহাই পেয়েছে অনন্যা।
অনিমেষ আর মা বেরিয়ে যাওয়ার পর মৌসুমী অনন্যার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে। হাঁটু মুড়ে, তার ওপর মাথা কাৎ করে রেখে অন্যমনস্ক অনন্যা জানালায় চোখ পাতে। তার পিঠ হাতে জড়িয়ে, কাঁধে থুতনি রেখে চুপচাপ বসে মৌসুমী; কষ্ট, ক্লান্তি আর শূন্যতাবোধ নীরবতায় সওয়ার হয়ে দুটো মানুষের মধ্যে তরঙ্গায়িত হতে থাকে।
ক্লিনিকগুলো হল বহুমুখী জোঁক, এরা রোগীদের রক্তও চোষে, নিজ কর্মীদের রক্তও শুষে নেয়। সিস্টার-ওয়র্ড বয়-ক্লীনার এমনকি সদ্য পাশ করা ডিউটি ডাক্তারদেরও নিংড়ে নেয় যথাসম্ভব। অপ্রতুল পারিশ্রমিক অবদমিত করে কর্মচারীদের কর্মোদ্যম, তার সাথে যখন যোগ হয় রোগীর আত্মীয় এবং উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লাগাতার লাগামহীন অভিযোগ এবং অশ্রাব্য গালিগালাজ, তখন “সেবা” জাতীয় শব্দগুলো এদের মধ্যে বিরক্তি ছাড়া আর কিছুরই উর্দ্রেক করেনা। শ্রেণীবিভাজিত ক্লিনিকের প্রতিটা স্তরেই অসন্তোষ, কাজের প্রতি অনীহা আর মালিকপক্ষের সীমাহীন লোভ – সব মিলিয়ে “মানবতার সেবা” নামক লেবাসটা হাস্যকরভাবে ঝুলতে থাকে এইসব নির্মম আগ্রাসী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে। সরকারী হাসপাতাল বাদ দিয়ে যাঁরা কিছু বেশী টাকা দিয়েও এসব প্রাইভেট ক্লিনিকে আসেন “Better service” এর আশায়, চকচকে টাইলস আর ঝকঝকে আলো ছাড়া আর কোন ইতর বিশেষ তাঁরা খুঁজে পাননা এখানে। মালিকপক্ষের কাছে ক্লিনিক হল “অল্প চাপে বেশী পানি দেয়া আর এফ এল টিউবওয়েল” এর মত – যত অল্প সংখ্যক কর্মচারীকে যত স্বল্প বেতন দিয়ে চালিয়ে নেয়া যায় – তারই প্রাণান্তকর চেষ্টা। যে কাজগুলো কমপক্ষে তিনজনের করণীয়, সেগুলো একার ঘাড়ে চেপে বসলে নাভিশ্বাস ছুটতে ছুটতে, এবং তারপরও বিরামহীন ধিক্কার, সমালোচনা আর প্রায়শঃই বাপ-মা তোলা গালিগালাজ শুনতে শুনতে, একজন কর্মচারীর কর্মস্পৃহাই যায় নষ্ট হয়ে। ডাক্তাররাও, বিশেষত ডিউটি ডাক্তার – হয়তো একটু উঁচু শ্রেণীর – কিন্তু, কর্মচারীই তো বটে। প্রত্যাশিত সেবার সাথে সম্পাদিত কাজের ফারাকটা তাই বাড়তেই থাকে। যেসব শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা এ্যাদ্দিন ক্লাশে কিম্বা হাসপাতালের ওয়র্ডে “Medical ethics” এর গুরুভারসমৃদ্ধ জ্ঞান বিতরণ করেছেন, তাঁদেরই হাতে ক্লিনিকে প্রতিদিন ঐ Ethics কে বিবস্ত্র হতে, ধর্ষিত হতে, নিহত হতে দেখে নতুন প্রজন্মের মূল্যবোধও ক্রমশঃ ক্ষয়িষ্ণু, এবং ধীরে ধীরে অস্তিত্বহীন হতে থাকে। ওদিকে রোগী এবং তাঁদের সঙ্গীদের কাছে স্বীয় মহত্বের মুখোশটা পোক্ত করতে যখন তখন কনসালট্যান্ট এবং ডিরেক্টরবৃন্দ চোটপাট চালান অধীনস্থদের ওপর, বাদ পড়েনা ডিউটি ডাক্তাররাও। ঐ চোটপাটে মগজ ধোলাই হয় লোকের, তারা ভাবতে শেখে, বিশ্বাস করতে শেখে, যত নষ্টের গোড়া ঐ ডিউটি ডাক্তার, ঐ নার্স, ঐ ওয়র্ড বয় – ইত্যাদি। পারষ্পরিক সম্মান যেখানে অনুপস্থিত, বাদাবাদুবাদ সেখানে ধারণ করে তার অশ্লীলতম রূপ। আর এইসব টানাপোড়নের মাধ্যমেই এইসব উঠতি ডাক্তারগুলো রোগী এবং তাঁর সাথের লোকজনকে চিনতে শেখে প্রতিপক্ষ হিসেবে, এবং শেষতক এই অপ-বিবর্তনই পৌনপুনিকভাবে বিজয়ীর হাসি হাসে।
ডিউটি শেষ করে মৌসুমী যখন উঠি উঠি করছে, তখনই দুটো অপ্রত্যাশিত সীজার! রাতের ডিউটির ডাক্তার তখনও এসে পৌঁছয়নি। রোগীদের ফাইল দেখে মেজাজটা খিঁচড়ে যায় মৌসুমীর। ওই দু’জনেরই, হয়তো একটু অপেক্ষা করলে, নর্মাল ডেলীভারীই হতে পারত। কিন্তু কিছুক্ষণ পরপর ক্লিনিকের তরফ থেকে “এক্সট্রা খাতির” দুটো সীজারের অনুমতি লাভে সক্ষম হয়। মোক্ষম লাভ! যে গাইনী কনসালট্যান্ট ম্যাডামকে অপারেশন পরবর্তী জটিলতায় দশবার ডাকলেও একবার পাওয়া যায় না, তিনিই মাত্র দশ মিনিটের নোটিশে হাজির। এসেই হাঁকডাক! অগত্যা মৌসুমীই ছুট দেয় অপারেশন থিয়েটারে। ঢুকতেই ম্যাডামের সাদর সম্ভাষণ, “রোগীর প্রি-অপারেটিভ ফলো আপ কই? ক্যাথেটার কই? জাস্ট ধরে ঢুকাই দিলেই হইল? কর কি তোমরা বসে বসে? আর কিছু না হোক, পালস - বি পি টা-তো দেখে রাখা উচিৎ ছিল। চেয়ার থেকে পাছা উঠাতে ইচ্ছে করেনা না?” এসব অপবাদ অভিযোগের জবাব দেয়া যায়না। বলা যায়না, এঁদের যে সীজার করা হবে, সেটাতো জানানোই হয় নি! রোগীদ্বয় একবার সম্মতি দেয়ার সাথে সাথেই তড়িঘড়ি করে তাঁদের ও. টি.তে নিয়ে আসা হয়েছে, পাছে আবার মত পাল্টে ফেলেন! দু’নম্বরী লাভের লোভ দেরী সয় না। ডিউটি ডাক্তারকে জানিয়ে, নিয়মানুযায়ী রোগীকে সীজারের জন্য প্রস্তুত করতে যে সময় লাগবে, তাতে হয়তো হাতের কাছে থাকা অ্যানেসথেশিওলজিস্ট (যিনি রোগীকে সম্পূর্ণ অথবা আংশিক অজ্ঞান করে থাকেন) বা গাইনোকলজিষ্টের ব্যস্ত শিডিউল হাতছাড়া হয়ে যাবে। সুতরাং প্রোটোকলের পাছায় লাথি! এসব কথা শুধু মনে মনেই গজগজ করতে থাকে মৌসুমী। মুখে “জ্বী ম্যাডাম, এখুনি দেখছি” বলে বাধ্য মেয়ের মত কাজে লেগে পড়ে। জবাব দিতে গেলেই বিপদ – এঁরাই যে আবার পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পরীক্ষায় পরীক্ষক হয়ে বসবেন! “পাশ” ব্যাপারটা অনেক বড় – জ্ঞানের চেয়ে, মানবতার চেয়ে, আত্মসম্মানের চেয়ে, মূল্যবোধের চেয়ে।
এগারোটার পর যখন বেরোয়, মৌসুমীর তখন চূড়ান্ত অচলাবস্থা। একটা কেক-ফ্রুটিকা গলায় ঢেলে ক্লিনিকের অ্যাম্বুলেন্সে বাসায় ফিরেই বিছানায় আত্মসমর্পণ। মোবাইলটা সেই যে ও. টি.তে ঢোকার সময় সাইলেন্ট করা হয়েছিল, সেটা আর পরিবর্তন হয়নি। লোকে ডাক্তারের কাঁড়ি কাঁড়ি গাড়ি বাড়ি আর টাকাটাই দেখে, কিন্তু জীবনের এই পর্যায়ের অমানুষিক ধকল কারুরই চোখের বা মনের রেটিনায় বিম্ব সৃষ্টি করেনা।
ক্লান্ত শ্রান্ত মৌসুমীর বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল পার্থর কথার খেই ধরতে। অনিমেষের ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাঙলেও পুরোপুরি জেগে ওঠা হয়নি তখনও।
“শোন, আজকে তোর দিন আর রাত, দুইটাই খারাপ। অনি বলসে তোর ক্লিনিকে নাকি ধকল গ্যাসে?” পার্থর কথার কোন সূচনা থাকেনা, পারলে উপসংহার দিয়ে শুরু করে।
“অ্যাঁম? হুম! কি?” মৌসুমী তখনও আগোছালো।
“শোন, অন্যা হঠাৎ ঘর থেকে বাইর হই গেসে, এত রাতে সে নাকি হোস্টেল যাইতে চায়। ঘটনা কি, ঠিক বুঝতেসি না। ঝামেলা দেখলে তোর ওখানে নিয়ে আসা যাবে?”
“হুঁ? হুম! হ্যাঁ, আয়!” মৌসুমী তখনও ঘুমঘোরে। “কবে আসবি?”
“আরে ধুত্তোর! তোর ঘুমের গুষ্টি কিলাই! অন্যাটা রাতের আড়াইটায় কামাল স্টোরের সামনে খাড়ায়া বাদলরে ফোন দিয়া কয় হোস্টেলে যাইব। বলি, ভেজাল দেখলে ওরে তোর বাসায় আনা যাইব?”
“কি ভেজাল?” মৌসুমীর জেগে ওঠা তখনও সুবহে সাদিক পর্যায়ে।
“কি ভেজাল আমি কি জানি? অন্যা জিন্দেগীতে কাউরে কিসু টাইমমত কইসে? ঘটনা ঘটায়া তারপর বোম ফাটায়!”
“এখন কি করসে ও?” এবার মৌসুমীকে মোটামুটি জাগ্রত বলা চলে।
“আরে মর জ্বালা! এতক্ষণ কি কইলাম? তুই উঠসস ঘুম থিকা? ... ...”
“ত্যানা প্যাঁচাইসনা পার্থ! অন্যার কি হইসে?”
“অন্যা হুট কইরা মাঝরাইতে ঘর থিকা বাইর হই গেসে, কেন, এখনও জানিনা। ও বাদলরে ফোন দিয়া কইল হোস্টেলে যাইতে চায়। এখন কামাল স্টোরের সামনে খাড়ায়া আসে। আমিও ওইখানে যাইতেসি। নীপুর ফোন বন্ধ। এখন ঘটনা কি হইসে সেইটা তো জানিনা। সেইরকম ঝামেলা দেখলে ওরে কই নিয়া যাই? তাই কইতিসিলাম ... ...”
“আচ্ছা, বুঝছি, নিয়া আয়, কোন সমস্যা নাই।” ঘুমের রেশ পুরোপুরি কেটে গেছে মৌসুমীর। ভাবনাগুলো, অনুভবগুলো ভোঁতা থেকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। বেশ খানিকটা সময় নেয় পুরো ব্যাপারটা বুঝে নেয়ার পর নিজের হতবুদ্ধি ভাবটাকে সামলে নিতে।
গড়পড়তাভাবে মায়েদের মধ্যে নেতিবাচক চিন্তাটাই বেশী কাজ করে; মাকে বুঝিয়ে বলতে বেশ বেগই পেতে হয় মৌসুমীর। মুখে পানির ঝাপ্টা দেয়ার সময় মৌসুমী আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল - মাত্র শোনা ঘটনার কার্যকারণ কি হতে পারে। স্বামী নিয়ে, শ্বশুরবাড়ির লোকজন নিয়ে অনন্যার এক আধটু রাগ-দুঃখ-ক্ষোভের হাল্কা আভাষ মাঝে মাঝে কানে আসলেও কখনো আমলে নেয়নি। এসব তো সব ঘরেই, মোটামুটি মামুলী ব্যাপার। তাহলে? স্রেফ দাম্পত্য কলহের মত ঘটনায় অনন্যা এরকম কাজ করতেই পারেনা। মেয়েটার অদ্ভুত সহ্যশক্তি। ভাবনার ভ্রূকুটি আরও তীব্র, আরও গভীর হয় নিজের মোবাইলটা হাতে নেয়ার পর। অনন্যা, পার্থ, বাদল – প্রত্যেকেরই অনেকগুলো মিসডকল। এবার আফসোস হয় বেশ, তারপরই বুকধড়াস! ভালই বিপদে পড়েছে মেয়েটা!
অপেক্ষার মুহুর্ত কাটছিল ঘড়ি দেখে, আর মিসডকলের লিস্ট দেখে। মোটামুটি সবগুলো ফোনই এসেছে মধ্যরাতে, তবে বাদলের কয়েকটা ফোন আছে, যখন সে ছিল সীজারে।
বাদল, এখনও মোবাইলে তার নম্বর সংরক্ষিত আছে “Ulka” নামে। প্রেমের কতটুকু আবেগ আর কতটুকু অভ্যেস? কেউ কি পরিমাপ করেছে কখনো?
সময় মানুষকে কিভাবে নিঃস্ব করে দেয়! অথবা মানুষই কি কিছু সময়কে একদম নিঃস্ব, বিবর্ণ করে দেয়? গ্রীষ্মের মধ্যদুপুরে একটা ন্যাড়া পাহাড়ের চূড়োয় চড়ার মত, একটা মাঘ রাত্তিরে পঁচা ডোবায় পদ্ম তোলার মত, ইস্পাত কারখানার বাত্যাচুল্লীর মত, দিনের শেষে ঘরমুখো গার্মেন্টস কর্মীর মানুষে ঠাসা বাসের ভীড় ঠেলে যেকোনভাবে উঠে পড়ার মরিয়া বাসনার মত কত তীব্র, দহন উত্তাপে রক্তিম সময়খন্ডগুলো জুড়ে দিয়েছিল দুটো মানুষের মাঝে কি অদ্ভুত এক যোগাযোগ! ব্যর্থতার গ্যারান্টি নিয়ে যে লড়তে যায়, তাকে স্রেফ বোকা হিসেবে করুণা করা যায়; কিন্তু এইসব সাফল্য-ব্যর্থতার প্যারামিটার ছেড়েছুঁড়ে যখন কারও মাঝে দেখা মেলে স্বপ্ন দেখার এবং তাকে মুঠোয় ভরার সত্যিকারের দুঃসাহসের, যখন সে ছোটে স্থির বিশ্বাসের দৃঢ়তায়, তাকে পার্থিব নিকেশে অবিবেচক ভাবতে একদিন মৌসুমীর মন সায় দেয়নি, বরং অপার্থিব কিছু তাকে আপ্লুত করেছিল – যাকে “ভালবাসা” জাতীয় একটা জাগতিক নাম কিম্বা সংজ্ঞায় বাঁধতে চাওয়াই হয়তো সবচে বড় ভুল ছিল! হয়তো আসলে বাদলের প্রচন্ডতা, তীব্রতা – এসবেই কিছু আসক্তি জন্মেছিল, কিম্বা হয়তো ভালবাসা ছিল - শুধু বাদলের লড়াইটার জন্য, আস্ত বাদলের জন্য নয়। নয়তো আজকালকার এই অদ্ভুত দোলাচলের কী অর্থ হতে পারে? ওর কাছে আসতে চাওয়াটার প্রতি প্রচন্ড অনীহা, অথচ ওকেই উপেক্ষা করে ছুঁড়ে ফেলতে গেলে নিজেরই ভেতর সর্বব্যাপী ভাঙনের ডাক – এমন কেন? যেন কোন তেপান্তরে ভরাট কোন বিকেলে ঘুড়ির নাটাই হাতে স্থাণু এক কিশোর – প্রচন্ড বাতাসে যার ঘুড়িটা মাত্র মাত্র হাত দেড়েক দূরে উচ্ছ্বাসে পতপত – তবু কিসের ঘোরে যেন, ওড়াতেও না পারা, গোটাতেও না পারার স্থবিরতায় মূর্তিবৎ!
আবার হঠাৎ চমকে আত্মচিন্তা থেকে ছিটকে বেরোয় মৌসুমী। অনন্যাকে ঘিরে হঠাৎ গনগনে হয়ে ওঠা এইসব মুহুর্তে এসব কি ভাবছে সে? অবশ্য এরকম গনগনে ক্ষণগুলোতেই প্রতিবার তাদের সম্পর্কের পরত পুরু হয়েছে একটু একটু করে। এখনও তার মনে পড়ে, সেদিন শরীফ ভাইয়ের সাথে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে – বাদল তখন নিভু নিভু প্রদীপ – কথা কাটাকাটি হাতাহাতিতে রূপ নিলে বাদলের দীর্ঘদিনের ছায়াসঙ্গীরা – আশফাক, মোহিত, তিলক, জোবায়েররা – যারা একসাথে গলা মিলিয়ে একদিন শ্লোগানে কাঁপিয়েছিল মেডিকেল কলেজ চত্বর, যারা একসাথে লড়েছিল পুলিশের লাঠিচার্জ আর টিয়ার শেলের সাথে, তারাই, হিংস্রতম বীভৎসতা নিয়ে নিয়ে বাদলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
সে রাতটায় এমন জোছনা ছিল না, কিন্তু অগুণতি নক্ষত্রের কোমল নীলাভতা রাতটাকে অন্ধকার হতে দেয়নি। অথবা হয়তো পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে দুই মানব মানবীর মধ্যকার আলোর উৎসবের ব্যাপন কিম্বা বিচ্ছুরণ হয়েছিল অদৃশ্য ধূলোয় চেপে। সর্বাঙ্গে ব্যাথা, ক্রমশঃ বাড়তে থাকা জ্বর, কিছুতেই বাঁধ না মানা মৌসুমীর চোখের চোরা জলস্রোত – এসব খানা-খন্দের ওপর দিয়েই সেদিন ছিল প্রথম মিলিত মেঘযাত্রা। অদ্ভুত! অস্বাভাবিক! এখনও নিজের কাছেই বিস্ময় জাগে – অমন সময়ে, কিভাবে সম্ভব হয়েছিল?
আজকের ছকে সাঁটা দিনগুলোতে, সস্তা ইঁদুরদৌড় সর্বস্বীতায় ভারাক্রান্ত দিনগুলিতে, পরাজিত, পরাভূত বাদল, উল্কার সবটুকু স্ফুলিং হারান নিষ্প্রাণ পাথরখন্ডের ক্ষয়াটে চেহারার বাদল যখন ভালবাসার দাবী নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়, কোত্থেকে যে এত বিতৃষ্ণা, এত অশ্রদ্ধা, এত বিমুখতা এসে হৃদয়ের সবটুকু এক নিমেষে আচ্ছন্ন করে! মাঝে মাঝে ধন্দে পড়ে যায় মৌসুমী, কে বেশী পরাজিত? বাদল, না সে নিজে – যে আপোস করে নিয়েছে সবরকম গতানুগতিকতার সাথে। এই আপোসী মনটাই কি আজ সেই ব্যর্থ স্বপ্নবাজকে উপেক্ষা করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে? প্রতিদিন নিজের সাথে যুঝতে যুঝতে, বোঝাপড়া করতে করতে, অপরাধবোধ আর বাস্তববাদীতার টানাপোড়নে ছিন্নভিন্ন হতে হতে, একটু একটু করে মৌসুমী নিজেকে ফিরিয়ে আনছিল ‘উল্কা’মুখীতা থেকে। ওপাশের কষ্টের ধুকপুকানি ঠিকই এখানে প্রলয়ঙ্করী ভাঙনের দামামা দুন্দুভি বাজাত, তবুও। এখন, এই প্রবল জোছনায় ভেসে যাওয়া নিজেদের ছোট্ট উঠোনে অপেক্ষার এলোমেলো পদচারণের সময়, হয়তো কোন সান্ত্বনা লাভের সুপ্ত আশায়, নিজেকে মৌসুমী বোঝায়, বাদলের এই অবয়বটা, এই ল্যাদ খাওয়া হ্যাংলামোয় ভরা ব্যক্তিত্বটাকেই অপছন্দ, হয়তো ঘৃণাও করে মৌসুমী – সম্পূর্ণ মানুষটাকে নয়। হয়তো নিজেরই মনের কোন লুকোনো, অন্ধকার চৌখুপীতে এখনও টিমটিম করে জ্বলছে, একটা স্বপ্নের, একটা আশার, একটা কল্পনাশ্রিত আবেগের ঝিমিয়ে পড়া প্রদীপ!
(চলবে)