কয়েকটা ছন্নছাড়া কুকুর, ভয়ে কিম্বা সন্দেহে, ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। ওদের শব্দের রেশ মিলিয়ে যায় অচিরেই, রাতের বুকে তখন হাতুড়ী পেটার শব্দ করে চলে ক্ষণিকের জন্য উইসান বোল্ট হয়ে ওঠা বাদলের পা দু’টো। রাত আড়াইটায় রিক্সা না থাকাটা খুবই স্বাভাবিক; অবশ্য সেটা বড় কোন সমস্যাও না, মাত্র তিন-চার কিলো বিশালদেহী বাদল অনায়াসেই পেরুতে পারে। ঘাড়ের ওপর যখন ভুইফোঁড় প্রশ্ন আর আতঙ্ক ভর করে, ছোটা যায় তখন ধূমকেতুর বেগে।
অনন্যার ফোন দেখে দোলাচল-নিমজ্জিত বাদল একটু অবাক হয়েছিল। আর ফোন রিসিভ করে, প্রথমে তাজ্জব, তারপর হতবুদ্ধি, এরপর দে ছুট!
“ঘুমাই গেসিলি?” কাঁপছিল অনন্যার গলা।
“নাহ! ক্যান, কি হইসে? এত রাতে ... ?” তখনও বাদল ঘিরে থাকা কুয়াশার পুরু চাদর কেটে বেরুতে পারেনি।
“আমাকে একটু হোস্টেলে পৌঁছাই দিতে পারবি?” দ্বিধামিশ্রিত শব্দগুলোকে একটা কথার মাঝে বেঁধে রাখতে অনন্যার যে কি পরিমাণ লড়তে হচ্ছিল, তার খুব সামান্যই ছোঁয়া ছিল তার আওয়াজের মৃদু আর্দ্রতায়।
“মানে? এখন? কি কস তুই? কি হইসে? ... ...” আগুনের হলকা লাগলে ঘুমন্ত মানুষ যেভাবে তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে, বাদলেরও এখন সেই দশা।
“আমি মোড়ের কামাল স্টোরের সামনে আসি, তুই আসতে পারবি? না পারলে থাক, বাদ দে! আমি য্যাম্নে হোক, দেখি ... ...” বাদলের প্রশ্নের পর, ছোট্ট বিরতিটুকুতে, হয়তো আরও কিছু বলার জন্য জমিয়েছিল অনন্যা। কিন্তু হড়বড়িয়ে ঐটুকু বলার পর, কেউ বুঝি তার টুটি চেপে ধরে।
এরপরই, বাদলকে আর কোন প্রশ্নের সুযোগ না দিয়ে, ফোন কেটে যায়।
এর আগে, শুধু একবার, মিছিলের মাঝে পুলিশের লাঠির ঘা মাথায় আর বুটের ঘা পশ্চাদ্দেশে যুগপৎ পাওয়ার পর বাদলের মাথাটা এভাবে চক্কর দিয়ে উঠেছিল।
বাদলের হোস্টেল থেকে অনন্যার বাসা বড়জোর চার কিলো। মাঝে মাঝে বুয়ার অভাবে অন্যরা যখন রোজ হাশরের ট্রেলার দেখত, বাদলের তখন হত ভোজ উৎসব। প্রায়ই অনন্যার বাসায় বিনা নোটিশে আয়োজিত হত উচ্চগ্রাম-স্বরচর্চার জলসা। অবশ্য অনন্যা বেশীরভাগ সময়ই নির্বাক আয়োজক, প্রতিযোগীতাটা চালু ছিল পার্থ, বাদল আর মৌসুমীর মাঝে।
কতগুলো রাত খুব ক্ষ্যাপাটে হয়। নৈঃশব্দের শান্ত রুপোলী চাদরের নীচে জাগিয়ে দেয় অগুণতি ভিসুভিয়াস। নিঃশব্দ দহন, নিঃশব্দ ভাঙন, নিঃশব্দ প্রলয় – সব ঘটে যাওয়ার পরও নৈঃশব্দের নিশ্ছিদ্র আস্তরণের এতটুকু পলেস্তরা খসে না। দম দেয়া পুতুলের মত মানুষেরা, এবং তাদের যাপিত জীবনের খেলাঘরটি তখন তন্দ্রার ইন্দ্রজালে বিবশ। ঝাঁঝরা হতে হতে বিচিত্র ভাস্কর্য-প্রায়-এ পরিণত হওয়া মফস্বলী রাস্তাটা, পোস্টার-কফ-থুতু-পানের পিক-কাকের বিষ্ঠা-টোকাইয়ের কাঁকড় ঘষা নিয়ে সং হয়ে ওঠা নতশিরের ল্যাম্পপোস্টটা, হাড়-পাঁজর বেরিয়ে পড়া নর্দমার ওপরকার স্ল্যাবটা, রাস্তার ওপারে ল্যাম্পপোস্টের আলোর স্পর্শের বাইরে জমাট অন্ধকারে জমে ওঠা ডাস্টবিনটা, দু’পাশে সাটার নামানো অথবা ঝাঁপি ফেলে দেয়া সারি সারি ছোটবড় দোকানের টিমটিমে আলোআঁধারী মেশানো সাইনবোর্ডগুলো, এবং এদের সবাইকে নিয়ে ঘুমন্ত মফস্বলী মোড়টায় তখন অনন্যা একা জেগে। এলাকার মোটামুটি সবচেয়ে বড় জেনারেল স্টোরের সিঁড়িতে গুটিশুটি পাকিয়ে, কাৎ হয়ে, মাথাটা দোকানের সাটারে এলিয়ে দিয়ে অনন্যা ঠোঁট কামড়ে কান্নার আওয়াজটা থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে। এসিডপোড়া অনুভবে থেকে থেকে চামড়া-মাংসগুলো কুঁচকে কুঁচকে উঠছে, সমস্ত শরীরের অসহ্য ব্যাথা তখন অশ্রু সওয়ারী হয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ধোয়ার পর পানি নিংড়ানোর জন্য কাপড়ের মোচড় এখন অনন্যার পেটের ভেতর। গলা বেয়ে কান্না ছাড়াও আরও কিছু গড়িয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে – ঝাঁঝালো, অথবা তেতো।
কাঁপা, ত্রস্ত হাতে অনন্যা আবার ডায়ালড কল লিস্ট খোলে। নীপুর কাছ থেকে সেই একই একঘেঁয়ে সুকন্ঠী জবাব, “The number you have dialled, cannot be reached at the moment ... ...” বন্ধুবৃত্তে নীপুই ছিল অনন্যার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। এমন সময়ে নীপুর বন্ধ দরজায় মাথা ঠুকতে ঠুকতে একটা অযাচিত অযৌক্তিক অভিমান ব্যাথার জ্বলুনীটাকে আরও একটু উস্কে দেয়। জীবনে এরকম কিছু মুহুর্ত আসে – বিবেচনাহীনতার, আবেগ-সর্বস্বীতার, যুক্তি-যৌক্তিকতার পরম্পররাগুলো তখন হঠাৎ ফেরারী।
একাকীত্ব আর শূন্যতার অনুভব অভিমানের আতশ কাঁচ গায়ে জড়িয়ে চারপাশ থেকে চেপে ধরতে শুরু করে। সেই চাপটাই হয়তো, কামড়ে থাকা বাঁধটাকে ভেঙে চৌচির করে, বধির নাগরিক কানে উৎক্ষিপ্ত করে কান্নার নিস্ফল ধ্বনি। কান্না আটকাতে না পারার জেদেই কিনা কে জানে, ঘন ঘন ফোঁস ফোঁস শ্বাস নিতে নিতে, অনন্যার আঙুল এবার ফের মৌসুমীর পানে।
“দূরে কোথাও, বহু দূরে ... ...” বন্যার গান তৃতীয়দফা শোনার পর, হঠাৎ কান্নাটা যায় উবে।
কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই।
আবর্তিত হওয়ার নিরুপদ্রব বৃত্ত জুটে গেলে, কে আর সুখে থাকতে ভুত কিলাবে? পৃথিবীর পানে, আকাশের পানে, ম্যাড়ম্যাড়ে মফস্বলী মোড়টার পানে তখন অনন্যা হানে এক মৃত্যু-হীম চাউনি। সর্বাঙ্গের অমানুষিক যন্ত্রণা, নৈঃসঙ্গের বীভৎস দহন, গত কয়েক ঘন্টায় নিজ ঘরে ঘটে যাওয়া ঘটনার উত্তেজনার উত্তাপ কিম্বা তার পরবর্তীতে ভর করে বসা সিদ্ধান্তহীন অস্থিরতার তাড়া, প্রচন্ড স্নায়ুক্ষয়ী অবসাদ – সবকিছু ছাপিয়ে তখন অনন্যার সমস্ত চেতনা দখল করে দাঁতে দাঁত চেপে বসা অদ্ভুত এক অভিমান ক্রোধ। কাঁপতে কাঁপতে, গায়ের পায়ের মাংসপেশীগুলোর অবাধ্য দাপাদাপি সামলে একটু একটু করে অনন্যা উঠে দাঁড়ায়। একাই যাবে, তা হোস্টেলেই হোক বা যেখানেই হোক – এহেন জেদ চেপে যায়। দু’-চার পা এগুতেই, পেটের ভেতর প্রচন্ড এক মোচড়, আর সমস্ত বুক গলা জ্বালিয়ে যেন লাভা বেরিয়ে আসে ক্রমাগত। পৃথিবীর সব আলো একসাথে নিভে গিয়ে, মাটি যেন হয়ে ওঠে ঝড়ে যুঝতে থাকা সিন্দবাদী নাও। জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে, অনেকটা ফিল্মী কায়দায়, বাঁচিয়ে দেয় বাদল।
(চলবে)